হাইকু: নৈশব্দের কবিতা

0
Showing 1 of 1

রফিক জিবরান

জাপানি শিল্পসাহিত্যে নৈশব্দের উপস্থিতি অনুভব করা যায়। কবিতা, চিত্রকর্ম, থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র, সবখানেই। জাপানিদের জীবনাচারণ থেকেও এটা অনুভব করা যায়। যেমন, হয়তো অনেক জাপানিদের সাথে আমরাও একমত হতে পারি যে- চেরিফুলের সৌন্দর্য উপভোগ বা দেখার চেয়ে প্রধানত অনুভবের। এই উপলব্ধির শেকড় হয়তো তীর্থঙ্কর মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ বা ফকির লালনের বিনয় ও সরলতার ’সহজমানুষ’ এর- যাত্রাপথে নিহিত। জেন শব্দের শেকড়ও যেমন ধ্যান শব্দে প্রোত্থিত। কবিতাও যেমন এক ধ্যানস্থ মূহূর্তের সৃষ্টি।

মনে প্রশ্ন জাগে কবিতা (বা গান) কী ধ্যানের মাধ্যম? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি জাপানের হাইকু কবিতার গুরুদের নিকট থেকে। তাঁরা প্রায় সকলেই একই সাথে ছিলেন জেন ধারার সাধক ও পথিক। মাৎসুও বাশোদের জীবনকাহিনী পড়লেই তা বুঝতে পারা যায়। আবার, প্রাচীনকাল থেকে কবিতাই হলো সেই মাধ্যম যা সবচেয়ে কম শব্দে সবচেয়ে গভীর ও মর্মসঞ্চারী দুনিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপন করে। যেমন, হতে পারে- একটা ঝরাপাতার সাথে কোনো প্রেমিকের হৃদয়ের আকুলতা ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা।

হাইকুও যেমন, (সম্ভবত সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত) এক নিরব উপলব্ধির প্রতিধ্বনি। এ ধরণের কবিতা পাঠের পর মনে হবে অনেক কিছুইতো বলা হলো না, অনেক কিছুই রয়ে গেলো অনুভবের অপেক্ষায়। আমরা অপেক্ষা করি। অপেক্ষা কেবল দয়িতার জন্য নয়, অপেক্ষা নির্বাণের জন্যও, যা পাওয়া যেতে পারে কোলাহলপূর্ণ শব্দে নয়, নিরবতায়। হাইকু সেই অর্থে শব্দ দিয়ে সাজানো তিনটি লাইন মাত্র নয়, শব্দ বা কোলাহল থেকে অনেক দূরে নৈশব্দের অনুরণন। কেননা, শব্দ এখানে মুখ্য নয়, উচ্চারিত ধ্বনিব্যঞ্জনা পেরিয়ে এমন একটা বোধের দুনিয়া- সরল এবং সুন্দর, নির্জন এবং পরস্পর সংযুক্ত। এখানে, হাইকু রচনা করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বোধের সেই চূড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা। সারাজীবন ধরে একটি হাইকু লেখাও তাই মহত্তম অর্জন হিসেবে গণ্য হতে পারে।

হা্ইকু রচনা এখন মূল জেন উৎস থেকে অনেকটা সরে এসেছে। হয়ে উঠেছে, অনেকটা অণুকবিতা চর্চার মাধ্যম, যেখানে উপলব্ধির সারাৎসারে লেখকের যাত্রাপথের কোনো এক মূহূর্তের ঝিলিক থাকলেই সার্থক হিসেবে গণ্য হয়। কেননা, হাইকু রচনার জাপানি রীতি, অর্থাৎ ৫-৭-৫ মোরাস, ইংরেজীতে অনেকটা পরিবর্তত হয়ে অনূবাদিত হয়েছে সিলেবল হিসেবে, এবং আরও পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় আমরা একে কখনো মাত্রা, কখনো তাল বা অক্ষর গণনার মধ্যে বন্দী করতে চেয়েছি। কিরো এবং কিরেজি অর্থাৎ একটা ভাবের সাথে আরও একটা ভাবের সংযোগে (কিরো) ঋতুবাচক কোনো একটা শব্দের (কিরেজি) উপস্থিতি মিলে একটা হাইকু। ধরা যাক, বাশোর সেই বিখ্যাত হাইকুটি-

The old pond-
A frog jumps in,
Sound of Water.

আমি এটার বাংলা করেছি, আক্ষরিক নয়, ভাবের দিকে তাকিয়ে, রূপান্তরে ৫-৭-৫ মাত্রা মেনে চলতে পারিনি-

পরিত্যক্ত পুকুরটিতে-
লাফ দিলো একটা ব্যাঙ,
জলের শব্দ।

এখানে ‘পরিত্যক্ত পুকুরটি’ বলতে বাশো এমন কোনো নির্দিষ্ট পুকুরের কথা বলেছেন কী-না আমরা জানি না। হতে পারে, পুকুরটি কোনো এক জাপানি ঐহিত্যের অংশ। হতে পারে বাশো নিজেকেই ভেবেছেন পরিত্যক্ত পুকুর হিসেবে। হতে পারে আরও অনেক কিছু। এখানে কল্পনার সুযোগ অবারিত। তো, ধরা যাক, পুরাতন বা পরিত্যক্ত পুকুরটি নির্জন কোনো স্থানে অবস্থিত। কোনো পথিকও হয়তো ভুল করেও সেখানে যায় না, স্তব্ধ এবং চাঞ্চল্যহীন। এমন একটি পুকুরে হঠাৎই একটি গতির সৃষ্টি হলো, একটি চাঞ্চল্য বা একটা পাগলামি- একটা ব্যাঙ লাফ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যক্ত পুকুরটিতে সৃষ্টি হলো একটা গতি, একটা উন্মাদনা এবং একটা অন্য রকম নৈশব্দ- পুকুরটি হয়তো বহুকাল অপেক্ষা করে আছে যার জন্য। ধ্যানীর অপেক্ষা যেমন হয়।

এখানে পাশাপাশি তিনটি ইমেজ- পুরাতন পুকুর, একটি ব্যাঙ এবং জলের শব্দ। এখানে পুকুর এবং একটি ব্যাঙ এর মাঝখানে বসে থাকা হাইফেনটিকে বলা যেতে পারে একটা দেয়াল এবং সেতু যা তৃতীয় ইমেজের নিয়ে যাচ্ছে। আবার, ’পরিত্যক্ত পুকুর’ হাইকুটিতে ব্যবহৃত একটি ব্যাঙ, যা এখানে ঋতুবাচক শব্দ, যা জাপানে সম্ভবত বসন্তকালকে চিহ্নিত করছে।

হাইকু এখন কবিতার বৈশ্বিক মাধ্যম। বাংলা ভাষাতেও যথেষ্ট হাইকু লেখা হচ্ছে। অবশ্য, আগের কাঠামো পুরোপুরি অক্ষুন্ন থাকছে না। কিছু ক্ষেত্রে অণুকবিতা মাত্র, কোনো গভীরদৃষ্টি পাঠকের কাছে কখনোবা কবিতাও হয়ে উঠেনি। বিবেচনা পাঠকের।

আমাদের গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হাইকু কবিতার কিছু নমুনা রেখে গেছেন, যদিও তিনি ৫-৭-৫ মাত্রা এবং তিন লাইনের বিন্যাস মেনে চলেননি: তাঁর দুটি হাইকু কবিতা:

(১)
স্বপ্ন আমার জোনাকি
দীপ্ত প্রাণের মণিকা
শুপ্ত আঁধার নিশিথে
উড়ছে আলোর কণিকা।

(২)
প্রজাপতি সেতো বরষ না গণে,
নিমেষ গণিয়া বাঁচে,
সময় তাহার যথেষ্ট তাই আছে।

হাইকু অভিজ্ঞানযাত্রা চলতে থাকুক। শেষ করছি আমার লেখা একটি হাইকু চেষ্টার দৃষ্টান্ত দিয়ে ।

আকাশস্তনে—
ফুটেছে হলুদাভ,
বিনাশী ফুল।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Showing 1 of 1
Share.

Comments are closed.