প্রবন্ধ: সবার উৎসব। মনিরা রহমান মিঠি

0

প্রবন্ধ

সবার উৎসব

মনিরা রহমান মিঠি

পৃথিবীটা পাকিয়ে পাকিয়ে নিজের বয়স ক্রমে বাড়িয়েই চলেছে। এই যে পাক দিচ্ছে আর চক্রাকারে ঘুরছে, সেও গুনে ফেললো মানুষ দিন রাত্রির হিসেবে। বয়সের হিসেবে সংখ্যার পর দশখানা শূন্য গেলো পড়ে। সে হিসেব রাখছে কিনা পৃথিবীর অভিভাবক সূর্য, তা মানুষ জানে না, কারণ কিনা পৃথিবীর জন্মের হিসেবে মানুষের এধরায় পরিক্রমণ কয়েক পল মাত্র। তবুও সেই কয়েকপলের কারিগর কতোভাবেই না তার পৃথিবীটাকে দেখছে তার নেই সীমা কোনো।
অল্পখানিক নিজের পাশটি দেখে একজন দিলো এক রায় তো অন্যখানে আরেক রায়। সকাল কি সন্ধ্যা, শীত কি গ্রীষ্ম একই তারিখে এই একরত্তি পৃথিবীতে কতই না পালার সমাবেশ। একরত্তি অর্থ সেই ছোট্ট রাজকুমারের গ্রহের মতো ততটা ছোটো নয়। সূর্যের দেখাশোনায় এই পৃথিবীর প্রতিবেশীই বলি বা ভাইবোনই বলি অন্য গ্রহের কারো চেয়ে ছোটো, তবুও বিচিত্র তার রূপ, আমরা দেখি বলেই।

মানুষই তো দেখে, মানুষই নিজের মতো বোঝে, আবার অন্যের মতোও বোঝে। আবহাওয়া প্রকৃতি- তার সাথে নানান ধরনের সংগ্রাম একেকজন মানুষ স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দেয়। শত শতকোটি মানুষের শত শতকোটি বোধ, অনুভূতি- তার প্রকাশও অনন্য। দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি এইসব মিলে আমাদের নিরন্তন বিভাজন। দিন রাত্রির পালাবদলে কতো বাঁধনেই না বাঁধি নিজেদের। দিন, ক্ষণকে দেই শতেক রকম মহিমা। তিনশো পঁয়ষট্টি বা ছেষট্টি যাই বলি তার নানান পারমুটেশন – কম্বিনেশন। মাস বা হপ্তার হিসেবে গেলে কোনোটি পবিত্রতা পায়, কোনো দিন, দিন হিসেবে ভীতিকর বা প্রীতিকর।

খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য গ্রহণ শেষে আমরা সকলেই একটু আনন্দ চাই। আদিম সমাজে প্রাত্যহিক নৃত্য হয়তো ছিলো। কিংবা শিকারে যেয়ে দলের কাউকে হারিয়ে ফেলতে যেনো না হয়, সেকারণে নাচ। নিজেদের ফুল পাতা কি পাখির পালক কিংবা কড়ি বা পাথরের টুকরোয় কবে সাজাতে শিখলো মানুষ সে খবর ইতিহাসবিদ রাখুক। আমরা নাহয় শুধু চোখ বুজে সেই কোনো আদিম জনপদে ফিরে ফিরে যাই। পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় মানুষের বুকের ভেতর জমে থাকা প্রীতি বা ভীতি। তারার অবস্থান দেখে গতিপথ খুঁজে পাওয়া, দিনের হিসেব রাখা। কোন তারাটা কোথায় এলে বানডাকে নদীতে। ফলের মওসুম। পাখি বা পশু শিকারের দারুণ সময়। সবই প্রকৃতি বলে দেয়। প্রকৃতি বদলে যায়। অনুভব অনূভুতি বদলে যায়। মানুষের প্রখরতা বাড়ে। গুণে গুণে দিনক্ষণের হিসেব রাখে। কতদূর থেকে এলো মানুষ! যাবে কতোদূর? এই যে সুদূর সব হিসেব নিকেশ করে মানুষ আজ টিকে আছে নীল-সবুজ গ্রহ জুড়ে তার দিন-কাল নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভাবনার শিকড় অন্ধকারে যেমন বিস্তৃত হয়। তেমনি ডাল-পালা শাখা-প্রশাখা পল্লবিত হয়। বেঁকে চলা মানুষ থেকে পিঠ সোজা করে চলা মানুষ। লুপ্ত নগরী থেকে মেট্রো নগর। সাইফাই শহর। গ্রহান্তরের জনযাত্রা ভাসাই মনমেঘ।

ভাসতে ভাসতে নিজের ছোট্ট গণ্ডিতে ঠাঁই নিলে দেখি সেখানেও শতেক বোধের রঙিন বা ধূসর পসরা নিয়ে মানব মেলা। কোটি মানুষের কোটি ভাবনা। সংস্কৃতির নানান রাসয়নিক বিক্রিয়ায় আরো কতই না নতুন সংস্কৃতি। কোথাও একটি বিষয় যুক্ত হলো তো কোথাও থেকে ঝরে গেলো দুটি। পারস্পরিক বিনিময়ে আমাদের এই ভূখণ্ড জুড়ে শত ভাবের সন্নিবেশ। এতো মহামানবের সাগরতীর! অবয়ব, ভাষা, দর্শন এর সাথে বহুপুরুষের বয়েচলা জিন প্রবাহ তো রয়েছেই। তাদের রয়েছে নানান সংস্কৃতি। কারো সাথে কারো সামনাসামনি তেমন কোনো মিল নেই, হয়তো গভীর করে ভাবলে প্রতিটির মিল রয়েছে। রয়েছে অদৃশ্য সুতোর বন্ধন। আবার বাইরে বাইরে আমাদের ছোটো ছোটো ডিটেইলে অনেক সাংঘর্ষিক ক্রিয়াও রয়েছে। আমাদের অনেককিছুই মিথিক্যাল। সেটা যৌক্তিক নিক্তিতে পরিমাপ করা যায় বটে, আমরা বেশিরভাগই রেশমগুটির ভেতর গুটিয়ে থাকি, তাই সে পরিমাপে যাই না।

কিন্তু আনন্দকে তো উপেক্ষা করতে পারি না। আমরা আনন্দে অবগাহন করতে চাই। উৎসবে মিলতে চাই পরস্পরে। একটি পায়ে চলা পথে একা হাঁটতেও আনন্দ, রাত্তির জুড়ে জলের উপর নৌকার পাটাতনে দুলতেও আনন্দ, তারায় তারায় চোখ ভাসিয়ে পরিভ্রমণ সেও তো কম আনন্দ দেয় না!

কিন্তু যখন ভাগ করে নিতে চাই আনন্দকে তখন চাই উৎসব। চারপাশ ঘিরে। দেশ জুড়ে। আরো ভালো হয় যদি মানব মানচিত্র জুড়ে হয় উৎসব। উৎসব জুড়ে মিথ। যার যে মিথে ভরসা নেই, সে সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন আরো বিপুল সংখ্যক মানুষ। মানুষের এই মতান্তর বিভেদ বাড়িয়ে একেক জনকে দ্বিপের মতো সংযোগহীন করে। তবু শেষ পর্যন্ত মানুষই একে অপরের কাছটি ঘেঁষে বসে। সেই উৎসব উদযাপন সবার যেখানে সবাই আনন্দের সমান ভাগীদার।

তেমন দিনও একেক অঞ্চলের জনজীবনে আসে। ঘুরতে গিয়ে পৃথিবী প্রতিদিনই একেকটি বছরের আবর্তন শেষ করছে। একেক দেশে সেদিনটিই নতুন বছর। নতুন বছরে সকল বর্ণের ধর্মের মানুষের জন্য আকাঙ্ক্ষার দিন। মিথ নেই, তারকা রাজি আছে। তার অবস্থান একেক ভূখণ্ডে একেক সময়ে নানান ভাবে বছর পরিমাপ করা হয়। আর শুরুর দিনটি সকলেই উদযাপন করে। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে দিন হয়তো আলাদা। আনন্দের ধরনে মিলও আছে। সবুজ এই দেশে ফসল কেন্দ্রিক দিনপঞ্জি। আকবরের রাজ দরবার থেকে উত্থাপিত হলেও তার বহু আগে থেকেই এই মুলুকে ছিলো বছর গণনা। সেটাই কিছুটা, হিজরি সনের সাথে মিশিয়ে বাংলা সাল হলো। লোকের মনে ফূর্তি ছিলো ফসল নিয়ে। ফলে খাতাও হালনাগাদ হলো। বাদশারও বরাতের পালে লাগলো হাওয়া। গুটি গুটি পায়ে বাংলা সন কয়েকশো বছর এগিয়ে আমাদের বারান্দায় বেশ আয়েশ করে বসেছে।

,পহেলা বৈশাখ মধ্যবিত্ত বাঙালী থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারেও সদর্পে বিচরণ করছে।
উৎসব উদযাপনে আমরা, ভালো ভালো খাই, নতুন কাপড়ের বায়না ধরি। দল বেঁধে ঘুরে বেড়াই। পোশাকের পার্থক্য খুব একটা থাকেনা। এদেশের খাল-নালা দিয়ে উৎসবের জল সকল মানুষকে সিক্ত করে বইতে শুরু করেছে গ্রাম থেকে গ্রামে।
এই উৎসব ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভাজিত করবার অপচেষ্টাও রয়েছে। সহজিয়া বাউলের মানুষের উচ্চতার প্রশ্নে পহেলা বৈশাখ নিজের আলোতেই তবু উজ্জ্বলতা ছরাবে যারা অন্ধ তাদের জন্যও।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.
Leave A Reply