লুনা রাহনুমা’র একগুচ্ছ কবিতা

0

অভ্যস্ততার অনুভব

আঁটোসাঁটো জামার মতো
জড়িয়ে থাকা দীর্ঘ সম্পর্ক
হাঁসফাঁস লাগে,
দম বন্ধ হয়ে আসে,
অনুভব-
অনুরাগ-
অবেলার ডুব সাঁতার…

অথচ দূরে যাও যদি,
যখন জানি আগামী বেশ ক’টি দিন
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে আমাদের-
তখন যুক্তিহীনভাবে
ভীষণ প্রয়োজন মনে হয় তোমাকে।
তোমার জবরদস্তির আলিঙ্গন
অধিকারবোধের বাড়াবাড়ির অভাব অনুভব করি ভীষণ।

আর তোমার পথের দিকে চেয়ে থেকে
ক্লান্ত চোখে হাত পা ছড়িয়ে বসে একাকী বিকেল পাহারা দেওয়া
খুব অসহ্য মনে হয়।

অবিকল কাকতাড়ুয়ার মত
দূরত্বে বসে নির্লিপ্ত চোখে
আমরা পাহারা দিচ্ছি, আমাদের
প্রেম-
মোহ-
আচ্ছন্নতা-
নাকি শুধুই অভ্যস্ততা!

সান্নিপাতিক নৈকট্য

আমাকে সব কথা বলো না তুমি অনেকদিন,
নির্বাচিত কষ্টগুলো নিজের কাছেই গচ্ছিত রাখো
দিনের পর দিন।

অনেক মাঘ এবং ফাল্গুন পেরিয়ে যায়
আমিও তোমাকে ডাকি না কাছে আর।
হৃদয়ের আগ্নেয়গিরিতে বিদ্রোহের টোকা পড়লেও
খুঁজি না তোমার সান্নিপাতিক নৈকট্য।

আমাদের ভালোবাসার ধারাপতনগুলো
নিঃশব্দ তারাপতনের মতো ঘটেছে
কখন, কবে, সবার অলক্ষ্যে!
সে কথা লেখা নেই সম্পর্কের কোনো স্তবকে।

মহাকালের শুরুতে জেনেছে মানুষ
ভালোবাসা এক গভীর দুঃখবোধের নাম:
দুঃখের অতলে সে ভাসে, আর
নিমজ্জিত হয় সুখের উত্তাপে।

কাঁকর

গতকাল রাতে খাওয়ার সময়
একটা আস্ত কাঁকর পাওয়া গিয়েছিল সাদা ভাতের সাথে।
কাঁকরটি তোমার থালায় না পড়ে
আমার বাদামি থালায় পড়তে পারতো।
কিংবা টুনি আর বাবাইয়ের থালাতেও পড়তে পারতো।
সে কাঁকরের নিজস্ব ইচ্ছে, কার থালা বেছে নেবে।

তুমি আরাম করে পটলের দোলমার সাথে
একদলা ভাত মেখে মুখে দিয়ে দাঁতে চিবুতেই
করকর শব্দে কাঁকড়টি গুঁড়ো হলো তোমার মুখের ভেতর।
পাশের চেয়ার থেকে শব্দ পেয়ে আমি ভাবলাম
পটলের সাথে বিচি রয়ে গিয়েছিল বুঝি বেখেয়ালে!

খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে বিরক্তি নিয়ে উঠে গেলে তুমি।
মুখে বললে, সারাদিন বাড়িতে বসে কী করো বুঝি না,
রান্নার আগে চালগুলো একটু বেছে নিতে পারো অন্তত!
সামান্য এইটুকুই তো কাজ তোমার এই বাড়িতে।

পাশের চেয়ারে বসে আমিও শুনলাম চুপচাপ।
তোমার মুখে পাথর ভাঙার শব্দ আর আমার বুকে
একটা কিছু চূর্ণিত হবার শব্দ।

তুমি শুনতে পাবে না এমন নিচু গলায় বললাম,
সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকো,
দিন শেষের সামান্য এই কয়েকটি ঘন্টা
নিজেকে একটু সামলে রাখতে পারো না বুঝি?
নিজের বদমেজাজ, বিশ্রী ব্যবহার, অকথ্য ভাষারা
এভাবেই দখল করে ফেলেছে তোমাকে আজকাল!

টুনি আর বাবাইয়ের সন্ত্রস্ত চোখের সামনে
অপহাসের দোলে ডুবে যায় আমার কথারা।
ডুবে যাই আমি অনাদরের গভীর নিগ্রহে।
আমাদের ভালোবাসা পুড়ে খাঁটি হয়
ইটের ভাটায় গনগনে আগুনের চুল্লিতে।
তারপর তারা কাঁকরের মতো বিদীর্ণ হয়
দৈনন্দিন কলহের আঘাতে আর দহনের অবঘাতে।

অনপনেয়

এখন বসন্তকাল,
তবুও আমার মনের বনে
শীতের বিবর্ণ পাতার মতো
আলগোছে খসে পড়ে
একটি একটি করে তোমার সু-স্মৃতিরা।

আমাদের ভালোবেসে আঁকা যৌথ ছবিটির রঙ
ফ্যাকাশে হয়ে যায়, তোমার অন্যমনষ্কতায়।

তুমি কি ভুলেছ প্রতিশ্রুতি দেয়া মানে
আজীবন তাকে ঘাড়ে করে বয়ে বেড়ানো?
যেমন করে ক্ষেতের কাজে
ক্লান্ত বলদের কাঁধে শোভা পায়
লাঙ্গলের ভারী জোয়াল!
যেমন করে আমার স্মৃতির সাথে
অদৃশ্য কালিতে লেখা হয়ে আছে
সর্বত্র তোমার নাম!

চাইলেও মুছতে পারি না আমি তোমাকে যেমন।

অপ্রকাশিত প্রতিজ্ঞা

অপরাহ্নের ম্লান আলো গায়ে জড়িয়ে
একদিন আমিও দিগন্তে মিলিয়ে যাবো নিঃশর্ত।
তবুও কিছু স্বপ্ন মুছে যায় না কিছুতেই
নিকষ রাতের চাদরটাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে
জ্বলে থাকে যেমন বাসনারা –
আমিও জ্বলতে থাকবো অনিঃশেষ।
পৃথিবীর একটি মানুষের জন্য,
গর্ভস্থ একটি ভ্রূণের কাছে রক্ত প্রবাহের মতো,
তৃষ্ণায় কাতর একটি গাভীর জিবে একফোঁটা জলবিন্দুর মতো,
রাতের পর রাত লিখতে না পারার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে
ছটফট করতে থাকা কবির কাছে
ছন্দের আগল খুলে যাওয়ার মতো করে
একদিন আমিও তোমার তোরঙ্গে সঞ্চিত
মুল্যবান কিছু বলে বিবেচিত হবো।

শৈশবের স্মৃতিতে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া একটি আনন্দ হবো।
ব্যবসায়ীর কারবারি চাবির গোছায় একটা ছোট পুতুল হবো,
শরীর যার সস্তা প্লাস্টিক, কিন্তু তোমার স্পর্শ আর সান্নিধ্য পায় নিয়মিত।
তারপর আমি দেয়ালে টানিয়ে রাখা একটি ছবি হবো,
পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি কথা বলবো তোমার চোখে চোখ রেখে,
যখন আমাদের চোখ ফিরিয়ে নেবার মতো কোন লজ্জাই আর
অবশিষ্ট রইবে না, এতটুকু।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.
Leave A Reply