ফরাসি গল্প: যে ছেলেটি আগে কখনো সমুদ্র দেখেনি

0

লেখকঃ জঁ-মারি গুস্তাভ ল্য ক্লেজিও, মূল ফরাসি থেকে ভাষান্তরঃ নূরুল আলম

ওর নাম ছিল দানিয়েল। কিন্তু নিজেকে সে সিন্দাবাদ নামে পরিচয় দিতে খুব পছন্দ করত। কারণ সে দুঃসাহসী নাবিক সিন্দাবাদের সমুদ্র অভিযানের গল্পগুলো পড়েছিল। তার সাথে সবসময় চামড়ায় বাধানো লাল রংয়ের বেশ ভারী একটা সিন্দাবাদের গল্পের বই থাকত,যে বইটাতে সে এই গল্পগুলো পড়েছিল। ক্লাসে অথবা ছাত্রাবাসে সে যেখানেই থাকুক, এই বই তার সাথে থাকবেই। এমনকি, আমাদের মনে হতো, সে এই বই ছাড়া আর কোন বইই কখনও পড়েনি। কারণ, আমরা তার কাছে অন্য কোন বই দেখিনি। সে এই বইটা নিয়ে নিজ থেকে কারও সাথে কোন কথাই বলত না। যদি কেউ কখনও সরাসরি জানতে চাইত, শুধু তখনই বলত। তখন তার উজ্জ্বল কাল চোখ দুটো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত। এবং তার ক্ষুরধার মুখে হঠাৎ যেন প্রান ফিরে আসত। কিন্তু সে ছিল এমন একটা ছেলে, যে সাধারণত বেশি কথা বলতে পছন্দ করত না। সমুদ্র কিংবা ভ্রমন নিয়ে কোন কথা-বার্তা না হলে, সে অন্যদের সাথে আলোচনায় নিজেকে জড়াত না। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষগুলোই ছিল স্থানীয়, তাদের এখানেই জন্ম। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, তাদের কথা বলার আগ্রহের বিষয়ও তাদের আশেপাশের বিষয় নিয়ে। একইভাবে এই এলাকায় যে নাবিকদের বসবাস, তারাও এখানকার স্থানীয় মানুষ। তারা যখন সমুদ্র থেকে ফিরে আসে, কথা বলতে পছন্দ করে ঘর-বাড়ি, মেয়ে মানুষ, নতুন গাড়ি কিংবা স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু দানিয়েল ছিল অন্য ধাঁচের। স্থানীয় বিষয় তাকে বিরক্ত করত। গাড়ি-বাড়ি, গান-বাজনা কিংবা সিনেমা নিয়ে তার কোন আগ্রহই ছিল না এবং স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলের লেখাপড়া নিয়েও না। সে এসব নিয়ে কিছুই বলত না, আবার এইসব নিয়ে আলোচনায় তার বিরক্তিও প্রকাশ করত না। সে শুধু উপস্থিত থাকত। চুপচাপ বসে থাকত কোন একটা টুলের উপর অথবা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত সামনের কোনো খোলা জায়গার দিকে। ছাত্র হিসেবে সে ছিল সাধারণ মানের, যতটুকু না পড়লেই না, শুধু অইটুকুই সে পড়ত। শিক্ষকরা যখন ক্লাসে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করত তখন সে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট পড়াটুকু বলেই আবার বসে যেত! এর বাইরে আর কিছুই না। তাকে দেখে মনে হত সে জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে। এমনকি যখন আমরা সমুদ্র নিয়েও কোনো কথা বলতাম, তখনও তার উৎসাহ খুব বেশিক্ষণ থাকত না। অল্প কিছুক্ষণ শুনত সে, দু-একটা প্রশ্ন করত, যখন সে বুঝতে পারত আমরা আসলে ঠিক সমুদ্র নিয়ে কথা বলছি না, আমরা আসলে কথা বলছি সমুদ্র স্নান, অগভীর জলে ডুব দিয়ে মাছ শিকার কিংবা সৈকতে বালির উপর শুয়ে রোদ পোহানোর বিষয়ে, তখনি সে চলে যেত। গিয়ে বসে থাকত কোন একটা টুল অথবা সিঁড়ির কোনো একটা ধাপে, আর শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত সামনের দিকে। সে যে সমুদ্রের কথা শুনতে চেয়েছিল, আমরা ঠিক ওটা নিয়ে কথা বলছিলাম না। তার আগ্রহ ছিল অন্য কোন সমুদ্র নিয়ে, যেটির কথা আমরা জানতাম না! তবে এটা বুঝতাম, এটা ছিল অন্য কোন সমুদ্র!

এসব ছিল তার হারিয়ে যাওয়ার কিংবা চলে যাওয়ার আগের কথা। কেউ বুঝতে পারেনি, সে একদিন চলে যাবে। আমি বুঝাতে চাচ্ছি, তার এ যাওয়া ছিল সত্যিকার অর্থেই একেবারে চলে যাওয়া। সে ফিরে আসার জন্য চলে যায়নি।
দানিয়েলদের পরিবার ছিল খুব দরিদ্র। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে তাঁর বাবার একটি ছোট খামার ছিল। ওখানে, ওর চাইতে বয়সে বড় তিন-চার জন ভাই ছিল বলে আমরা শুনেছি, অবশ্য আমরা ওদের চিনতাম না। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে গাড়িভাড়া খরচ করে, অত দূরে গিয়ে পরিবারের সাথে থাকার মত টাকা দানিয়েলের ছিল না। তাই সে প্রায়ই ছাত্রাবাসে থেকে যেত। আর তার পরনে থাকত বোর্ডিং ছাত্রদের ধুসর রঙের ইউনিফর্ম। দানিয়েলের কোন কাছের বন্ধু ছিল না। স্কুলের খুব কম ছেলেকেই সে চিনত এবং অন্যরাও তাকে তেমন একটা চিনত না। সম্ভবত এটাই তার পছন্দ ছিল, কারো সাথে ঘনিষ্ঠ না হওয়াটা। তার মুখের গঠন ছিল শক্ত –পোক্ত এবং তীক্ষ্ণ আর ছিল খুব সুন্দর দুটো কাল উদাসী চোখ।
সে কাউকেও কিছু বলেনি। তবে আমরা নিশ্চিত, সে অনেকদিন ধরেই চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সম্ভবত এটা নিয়ে তার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। তার মাথায় সব কিছুই পরিষ্কার ভাবে পরিকল্পনা করা ছিল, সে কোন রাস্তা দিয়ে যাবে, কোন কোন শহর সে অতিক্রম করবে, সব কিছুই তার ভেবে রাখা ছিল। দিনের পর দিন, প্রতি রাতে বিছানায় শুয়ে সে পরিকল্পনা করেছে। আমরা যখন রাতে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাশা আর সিগারেটে টান দিয়ে সময় কাটাতাম, সে তখন ভাবত মোহনার দিকে ছুটে চলা সেই সব নদীর কথা, সমুদ্রের উপর বয়ে যাওয়া বাতাস, গাংচিলের চিৎকার, ছোট ছোট পালতোলা নৌকা আর সামুদ্রের জলে ভেসে থাকা বয়াগুলোর উপর দিয়ে ধেয়ে যাওয়া ঝড়ের তীক্ষ্ণ সুরের কথা।

দানিয়েল যেদিন ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যায়, তখন ছিল মাঝ সেপ্টেম্বর, শীত সবে শুরু হয়েছে। ধুসর রংয়ের বিশাল ছাত্রাবাসটাতে অন্য ছাত্ররা যখন সবে ঘুম থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছে, ততক্ষণে সে চলে গেছে। আমরা সবাই চোখ খুলে দেখি তার বিছানা পরিপাটি করে গোছানো, সে নেই! সাথে সাথে সবাই বলে উঠল, “দেখ দেখ দানিয়েল চলে গেছে”।
কেউ খুব একটা আশ্চর্য হইনি, কারণ আমরা সবাই আগেই কিছুটা অনুমান করেছিলাম, এদিনটা একদিন আসবে। যদিও কেউ কারো সাথে এটা নিয়ে কথা বলেনি। কারণ, আমরা কেউ চাইনি এরকম কিছু ঘটুক। এমনকি আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে আড্ডাবাজ ছেলেরাও কেউ এটা নিয়ে কথা বলেনি। তারাও কিইবা বলতে পারত! কেউতো আসলে ঠিকমত জানতই না কি হতে যাচ্ছে?
সে চলে যাওয়ার পর, অনেকদিন ধরে স্কুল বারান্দায় কিংবা ফরাসি ভাষার ক্লাসে আমরা ফিসফিস করে এক জন আরেক জনকে বলেছি,
“তুই কি কিছু জানিস দানিয়েলের ব্যাপারে?”
“তুই কি বিশ্বাস করিস সে ফিরে আসবে ?”
“কখন আসতে পারে”?
“কালকে না অন্য কোন দিন?”
সবচেয়ে সাহসী কথাটা ছিল, “মনে হয় সে এতক্ষণে আমেরিকা চলে গেছে!”
এবং যারা ওর চলে যাওয়া নিয়ে হতাশ ছিল, তারা উত্তর দিল,
“নাহ্ ! সে আজকেই ফিরে আসবে!”

এই কথাগুলো আমরা এতই ফিসফিস করে বলতাম, অন্য কারো পক্ষে কিছুই বোঝা সম্ভব ছিল না।
আমরা যদিও দানিয়েলের চলে যাওয়া নিয়ে অনেকটাই চুপচাপ ছিলাম, কিন্তু উপর মহলে এটা শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ অন্য শিক্ষকরা, স্কুলের প্রশাসনের কর্মকর্তারা সবাই ব্যস্ত হয়ে মিটিংয়ে পর মিটিং করে যাচ্ছিল। এবং পুলিশ কর্মকর্তারা প্রতিদিন স্কুলে এসে একজনের পর একজন ছাত্রকে জেরা করছিল। তারা পেঁয়াজের প্রত্যেকটা খোসা খুলে খুলে দেখছিল, ভিতরে কি আছে! প্রশাসনেরর কর্মকর্তারাও আমাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছিল। কিন্তু কেউ তো কিছুই জানত না। পুলিশ এবং শিক্ষকরা হতাশ হয়ে পড়েছিল। কেউ বুঝতে পারছিল না দানিয়েলের কি হয়েছে কিংবা সে কেন চলে গেল! এই শোরগোলটা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল। কয়েকটি সংবাদপত্রে দানিয়েলের ছবি ছাপিয়ে হারানো বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ছবি দেখে বুঝার উপায় ছিল না এটা দানিয়েল না অন্য কেউ! তারপর একদিন সব শান্ত হয়ে যায়! একই গল্প নিয়ে আমাদেরও ক্লান্তি এসেগেছিল। সম্ভবত, আমরা বুঝতে পারছিলাম, দানিয়েল আর ফিরে আসবে না। আর, তার বাবা মা এতই দরিদ্র ছিল যে, তাদের পক্ষেও বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না। একদিন, পুলিশ এই নিখোঁজ মামলার ফাইল বন্ধ করে দেয়। এবং তাদের সাথে গলা মিলিয়ে আমাদের স্কুলের শিক্ষকরাও বলছিল এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় দশ হাজার মানুষ কোনো চিহ্ন না রেখেই লাপাত্তা হয়ে যায়। যারা আর ফিরে আসেনি। শিক্ষক এবং পুলিশ পরিদর্শকরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বারবার আমাদের এমনভাবে এই কথা বলছিল যেন এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে একটা বিষয়! কিন্তু আমরা যারা দানিয়েলের চলে যাওয়াটা ভুলতে পারিনি, এটা আমাদের মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন বুনে দেয়। একটা গভীর, খুব গোপন একটা জাদুকরী স্বপ্ন। এই স্বপ্নটা এখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি।

দানিয়েল যখন এই জায়গাটায় এসে পৌঁছায়, তখন রাত। সে যে মালগাড়িটা চেপে এখানে আসে ওটা কয়েক দিন-রাত ধরে ধীরে ধীরে চলতে চলতে এখানে এসে থামে। দীর্ঘ এই মালগাড়িগুলো সাধারণত রাতেই চলাচল করে, এক একটা স্টেশন পার হয় খুব ধীরে ধীরে। দানিয়েল একটা ওয়াগনের শক্ত মেঝেতে পুরনো চটের ব্যাগ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। সে শুয়ে শুয়ে ওয়াগনের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছিল, ট্রেনটা আস্তে আস্তে গতি কমিয়ে একটা ডক ইয়ার্ডের কাছাকাছি এসে ঘ্যাচাং করে থেমে গেছে। সে উঠে দরজা খুলে লাফ দিয়ে পাশের রেললাইনের উপর এক মুহুর্তের জন্য দাড়াঁল,পরেই স্লিপারের উপর দিয়ে ডক ইয়ার্ডের উলটো দিক বরাবর কিছু দূর দৌড়ে রেললাইন থেকে উঠে গেল। তার সাথে একটা নীল রংয়ের ছোট ব্যাগ ছাড়া অন্য আর কিছুই ছিল না। এই নীল ব্যাগটা সবসময় তার সাথেই থাকে। যেটার ভিতর সে চামড়ায় বাধানো লাল রংয়ের সিন্দাবাদের বইটা রাখে।

এখন দানিয়েল মুক্ত একজন মানুষ। তার ভীষণ শীত করছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়াগনের ভিতর থাকতে থাকতে তার দুই পা অসাড় হয়ে গেছে। সে শহরটা থেকে বের হওয়ার জন্য দ্রুত হাঁটছিল। এদিকে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। যদিও সে জানত না সে কোথায় যাচ্ছে। সে তার নাক বরাবর হাটঁছিল, কখনও মালগুদামের দেয়ালের পাশ ধরে আবার কখনও ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোতে জ্বল জ্বল করা রাস্তার উপর দিয়ে। এখানে, এই বৃষ্টির রাতে কোন মানুষই দেখা যাচ্ছিল না, এবং শহরের দেয়ালগুলোতে কোন জায়গার নামও লেখা ছিল না! তবে দানিয়েল বুঝতে পারছিল সমুদ্র এখান থেকে বেশি দূরে না। এটা তার ডানদিকে কোথাও হবে, বড় বড় বিল্ডিংগুলোর আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। দানিয়েল হাটঁতে হাটঁতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। কিছুদূর হাঁটার পর সে শহর থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তার পিছনে শহরে জ্বলতে থাকা রাতের আলো আস্তে আস্তে দূরে সরে যায়। এখানে, শহরের বাহিরে রাত নিকষ কালো। আশেপাশে সমুদ্র কিংবা অন্য কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। দানিয়েল বৃষ্টি আর গায়ে সুই ফোঁটানো তীক্ষ্ণ বাতাস থেকে বাঁচার জন্য একটা আশ্রয় খুজছিল। সে রাস্তার পাশে একটা কাঠের ঘর খুঁজে পেয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়। এখানেই সে সকাল পর্যন্ত ঘুমায়। গত কয়েকদিন সে ঠিকমত ঘুমায়নি, তেমন কিছু খায়ওনি। কারণ, যতক্ষণ সে মালগাড়ির ওয়াগনে ছিল, সারাক্ষণ সে তাকিয়ে থাকত ওয়াগনের দরজার দিকে। তার আশংকা ছিল, যে কোন সময় কোন পুলিশের লোক এসে হাজির হতে পারে। তাই এই কাঠের ঘরটার ভিতরে এককোণে সে নিজেকে একপ্রকার লুকিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
দানিয়েলের যখন ঘুম ভাংগল, সূর্য তখন প্রায় মাঝ আকাশে। সে যখন ঘরটা থেকে বের হয়ে আসে, তখন চারদিকে চোখ ধাঁধাঁনো আলো। অল্প কয়েক পা সামনে হেঁটে সে দেখল, ঘরের পাশ দিয়ে একটা পথ সামনের কতগুলো টিলার দিকে চলে গেছে। সে এই পথটা দিয়ে হাঁটা শুরু করে। তার হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে যেতে থাকে, কারণ সে জানে ওটা টিলাগুলোর অন্যপাশে, মাত্র দু’শ গজ দূরে! সে দৌড় শুরু করে, পথটা ক্রমেই বালুর উপর উঠে যাচ্ছিল এবং বাতাসের গতিও বাড়তে শুরু করে, তার নাকে অজানা এক ঘ্রাণ এসে ধাক্কা দেয়, এক অজানা শব্দ সে শুনতে পায়। একটু পরেই সে একটা টিলার উপর উঠে পড়ে এবং হঠাৎ সে এটিকে দেখতে পায়! এটি এখানে, তার সামনেই, সর্বত্র, অগাথ, এটি পাহাড়ের ঢালের মত স্ফীত, নীল আলো জ্বল জ্বল করছে তার গভীর দেহে, এটি তার খুব কাছে! সে দেখছে, মাথায় নাচতে থাকা ফেনা নিয়ে বড় বড় ঢেউগুলো তার দিকে ধেয়ে আসছে। দানিয়েলের মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছিল না তখন, সে শুধু মনে মনে আওড়াচ্ছিল, “আহ্ সমুদ্র, সমুদ্র।” সে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার শরীর নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। তার হাতের আঙ্গুলগুলো টানটান হয়ে গেছে। সে তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না সমুদ্র তার পাশেই শুয়ে আছে! সৈকতের উপর আছড়ে পড়া ছোট ছোট ঢেউগুলোর অল্প অল্প শব্দ তার কানে ভেসে আসছিল। তখন বাতাসের গতি ছিল খুব ধীর, সূর্যের আলোয় ভাসছিল সমুদ্র। তার প্রত্যেকটা ঢেউ চিক চিক করে জ্বলছিল। সৈকতে ছাই রংয়ের মসৃণ বালুর উপর ছোট ছোট গর্তগুলোতে জমে থাকা জলের উপর আকাশের প্রতিবিম্বকে একটু পর পর জলস্রোত এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। দানিয়েল মনে মনে নিজেকে একটা মিষ্টি শব্দ বারবার শুনাচ্ছিল, সমুদ্র, সমুদ্র…তখন তার সমস্ত চিন্তাকে এই একটা শব্দই আছন্ন করে রেখেছিল। সে কথা বলতে চাচ্ছিল, এমনকি চিৎকারও করতে চাচ্ছিল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কিছুই বের হচ্ছিল না! তারপর সে তার নীল ব্যাগটা বালির উপর জোরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। সে এমন হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল যেন সে কোন ব্যস্ত হাইওয়ে পার হচ্ছিল। সে সৈকতের উপর পড়ে থাকা শুকনো আগাছা লাফ দিয়ে দিয়ে পার হতে গিয়ে বালুর উপর হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। সে এবার তার জুতা-মোজা খুলে ফেলে আরো জোরে দৌড়তে থাকে। তার নগ্ন পায়ে বিধতে থাকা আগাছার কাঁটা তাকে এক মুহুর্তের জন্যও থামাতে পারেনি।

বালুর দীর্ঘ সমতল ভূমির পর সমুদ্র সূর্যের আলোকে জ্বলছিল। এটির রং আর চেহারা পাল্টাচ্ছিল বারবার, অনেক দূর পর্যন্ত নীল, তারপর ধূসর, আবার সবুজ। ঢেউগুলো মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে নেচে নেচে দৌড়াচ্ছিল। দানিয়েল তখনও বুঝতে পারেনি সমুদ্র তার কাছে থেকে কতটা দূরে। সে ক্রমাগত দৌড়েই যাচ্ছিল, তার হৃদপিন্ড সমস্ত শক্তি দিয়ে বুকের ভিতর ধুক ধুক করছিল তখন। তারপর সে অনুভব করতে শুরু করে পায়ের নিচে বালি এখন কাঁকড়ের মত শক্ত আর ভারি হয়ে গেছে। তার নগ্ন পা ভিজে শীতল হয়ে পড়ছিল। সে সমুদ্রের যত কাছে যাচ্ছিল, ঢেউয়ের শব্দ বাস্পীয় ইঞ্জিনের হুইসেলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছিল। প্রথমে এটি ছিল খুব নরম আর ধীর লয়ের, তারপর লোহার পুলের উপর ট্রেন উঠার মত বিকট আর বিরক্তিকর, পরেই আবার নদীর জল গড়িয়ে যাওয়ার মত। কিন্তু দানিয়েল ভয় পাচ্ছিল না। আশেপাশে কোন দিকে না তাকিয়ে, ঠান্ডা বাতাসের মধ্য দিয়ে সে যতটা সম্ভব দ্রুত সোজা সামনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল। সে যখন জলের ফেনা থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে ছিল, তখন সে নিশ্বাসে লোনা জলের গভীর ঘ্রাণ পেয়ে থামল। তলপেটের কাছে পুরানো একটা ব্যথার জন্য লোনা জলের তীব্র গন্ধে তার নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। সে ভেজা বালির উপর বসে যায়। বসে বসে দেখছিল, সমুদ্র তার সামনে প্রায় মাঝ আকাশ পর্যন্ত উঠে গেছে। সে এই মুহুর্তটির কথা কতদিন ধরে যে ভেবে আসছিল! কত দিন সে এই মুহুর্তটি কল্পনা করেছে! অবশেষে তার সামনে সত্যিকারের সমুদ্র। ক্যামেরায় তোলা কোন সমুদ্রের ছবি না, কিংবা সিনেমা দৃশ্যের কোন সমুদ্রও না, তার সামনে যতদূর দেখা যায় শুধুই সত্যিকারের সমুদ্র! এটি ফুঁসছে, বড় বড় ঢেউগুলো একবার উপরে উঠছে আবার ভেঙ্গে পরছে, সূর্যের উজ্বল আলোর নিচে ফেনার মেঘ থেকে জলকনা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মত চারদিকে ছিটকে পরছে। এবং অনেক দূর দিগন্তে, আকাশের গায়ে এটি রামধনুর মত বাঁকা হয়ে আছে! দেখে মনে হচ্ছে একটা বাঁকা প্রাচীর। সে এতদিন, এই মুহুর্তটাকে এতটাই প্রানপনে চেয়েছিল যে, এখন সত্যিকারের সমুদ্রের সামনে এসে তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। তার দেহে আর কোন শক্তি নেই, তার মনে হচ্ছিল সে বুঝি মারা যাচ্ছে! সে ভাবছিল এটা তার সমুদ্র, একান্তই তার। সে কখনও এটিকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারবে না।

দানিয়েল অনেকক্ষণ বালির উপর শুয়েছিল। এতটাই সময় পার হয়ে যায় যে, সমুদ্রের জল সৈকতের বালির উপর উঠতে শুরু করে। ঠান্ডা জল তার নগ্ন পা স্পর্শ করে। তখন ছিল জোয়ারের সময়। দানিয়েল একঝটকায় তার পা দুটো টেনে নেয়, তার ভয় হচ্ছিল, স্রোতের ধ্বাক্কায় তার পায়ের মাংস না আবার খুলে পড়ে! আর ওই সময়টায় সৈকত থেকে অনেকটা দূরে, কতগুলো কালো পাথরের চাইয়ের উপর ঢেউগুলো বজ্রপাতের মত শব্দ করে ভেঙ্গে পরছিল। কিন্ত সমুদ্র তখনও শান্তই ছিল। তবে, জলের গতি বাড়ছিল, আর সৈকতের কিনারায় বালুর উপর হালকা জলে বুদবুদ ভেসে উঠছিল। জল তখনও হামাগুড়ি দিয়ে আসছিল। দানিয়েলের গোড়ালি হালকা ফেনায় ঢেকে যায়। ঠান্ডা জল তার পায়ের আঙ্গুল আর গোড়ালিতে সুঁই ফুটিয়ে অসাড় করে দিচ্ছিল। জোয়ারের সাথে সাথে বাতাসের গতিও বাড়ছিল, পুরো দিগন্ত জুড়ে বাতাস বইছিল তখন। আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে। কিন্ত সমুদ্রের জলে ভেসে থাকা ফেনার মত এই রকম মেঘ দানিয়েল আগে দেখেনি। লোনা বাতাসে সৈকতের বালু শস্যদানার মত উড়ে বেড়াচ্ছিল। দানিয়েল ভয় পাচ্ছিল না। সে ফেনার মধ্যে আস্তে আস্তে পা ফেলে সৈকতের উপরের দিকে ফিরে আসছিল। সে অনুভব করছিল ঢেউয়ের প্রত্যেকটা তরঙ্গের সাথে সাথে তার পায়ের আঙ্গুলের নিচে একবার বালু সরে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। অন্যদিকে, দূরে দিগন্তের কাছে সমুদ্র আরও ফুলে-ফেফে উঠছিল। মনে হচ্ছিল যেন, সমুদ্র জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীর দিকে তার শ্বাস ছুড়ে দিচ্ছে। দানিয়েল তৃষ্ণার্ত ছিল, সে এক আঁজলা ফেনা মেশানো জল নিয়ে চুমুক দেয়। লোনাজলে তার মুখ আর গলায় জ্বলুনি ধরে যায় কিন্তু সে ক্রমাগত লোনাজল পান করতেই থাকে, কারণ সে সমুদ্রের স্বাদ নিতে চাচ্ছিল। সে কতদিন সমুদ্রের এই জলের কথা ভেবে ভেবে দিন পার করেছে ! এখন তার সামনে সীমাহীন অগাধ সাগরজল। সে ভাবছিল সারা জীবন ধরে পান করলেও এই জল শেষ হবে না, এবং এর জন্য কাউকে কোন মূল্যও পরিশোধ করতে হবে না।

সমুদ্রে তখন জোয়ারের সময় চলছিল। উপকূলের দিকে তেড়ে আসা উত্তাল ঢেউগুলো কতগুলো কাঠের গুড়িকে এমন ভাবে চিন্নভিন্ন করে দেয় যে, জল নেমে যাওয়ার পর এগুলোকে বড় বড় হাড়ের মত দেখাচ্ছিল। একটু পর আরেকটা ঢেউ এসে আবার গুড়িগুলোকে মাথায় তুলে নেয় এবং পরেই এদের গায়ে কালো শেওলা মিশিয়ে দিয়ে উপকূলের কাছে আছড়ে ফেলে দেয়। দানিয়েল জলের পাশ ধরে হাঁটছিল আর গভীরভাবে সবকিছু দেখছিল! যেন সে বুঝতে চাইছিল, এ সময়টায় সমুদ্র তাকে আর কি কি রূপ দেখায়। সে সৈকতে পড়ে থাকা শেওলা আর ঝিনুকের খোসা খুড়িয়ে হাতে নেয়। সে ভেজা বালির উপর হাঁটলে হাঁটতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। সূর্য তখন মাঝ আকাশে ঘোলাটে হয়ে ঝুলছিল আর সমুদ্র তখনও তার মেজাজ দেখানো বন্ধ করেনি। দানিয়েল হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গিয়ে দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছিল আর দেখছিল, উঁচু উঁচু ঢেউগুলো কি ভাবে প্রবাল প্রাচীরের গায়ে ভেঙ্গে পরছে, আবার পরক্ষণেই প্রাচীরের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসছে। দানিয়েল গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে শ্বাস নিচ্ছিল আর অনুভব করছিল নিশ্বাসের সাথে সাথে সমুদ্র আর পুরো দিগন্ত তার মাথা, পেট আর ফুসফুসের ভিতর ঠুকে গেছে। তখন নিজেকে তার মনে হচ্ছিল, সে একটা বিরাট দৈত্য হয়ে গেছে।

দানিয়েল অনেক দূরে মাঝ সমুদ্রের কালো জলের দিকে তাকিয়ে দেখছিল, ওখানটায় কোন জমিন কিংবা জলের উপর ফেনা নেই, শুধু কালো জল আর মুক্ত আকাশ। সে দূরের ঐ সমুদ্রকে উদ্দ্যেশ্য করে খুব নীচু স্বরে বলে উঠে, “আস, এখানে চলে আস, তুমি সুন্দর, তুমি এসে পুরো পৃথিবী ভরিয়ে দাও, ভাসিয়ে দাও সব নগর, তুমি উঠে যাও সব উঁচু উঁচু পাহাড়ে, উঠে আসো তোমার সব ঢেউগুলো নিয়ে।” তারপর সে ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সৈকতের উঁচু অংশ বরাবর হাঁটতে শুরু করে দেয়। সে হাঁটতে হাঁটতে দেখছিল কি ভাবে ফুলে উঠা জলের ধারা উপরে উঠে আসে, আর কিভাবে হাতের আংগুলের মত বালির উপর ছড়িয়ে পড়ে। কতগুলো ধুসর রংয়ের কাঁকড়া তার সামনে দৌড়াদৌড়ি করছিল। ক্ষুদ্র পোকামাকড়ের মত দেখতে তাদের ছোট ছোট নখগুলো উঁচু হয়ে আছে। কিছুই তার দৃষ্টি এড়াচ্ছিল না! সাদা ফেনা ভরা জল সৈকতের উপর কতগুলো রহস্যময় ছোট ছোট গর্ত আর কতগুলো গোপন সুড়ঙ্গ ভরাট করে দিচ্ছিল। প্রত্যেকটা তরঙ্গের সাথে সাথে ঢেউগুলো একটু একটু উঁচু হয়ে সৈকতকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। দানিয়েল ধুসর রংয়ের কাঁকড়াগুলোর মত জলের পাশে নেচে নেচে দৌড়াচ্ছিল, মাঝে মাঝে সে হাত বাড়িয়ে জলের স্পর্শ নিতেই, জল তার হাতে ঠান্ডা হুল ফোঁটাচ্ছিল। তারপর সে জলে নেমে পা দিয়ে জোরে জোরে বালুর মধ্যে পরিখা খনন করতে শুরু করে দেয়, যাতে জল আরো দ্রুত আসতে পারে! সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সুর করে গান গাওয়া শুরু করে দেয়, “আস, আরো উপরে, উঁচু উঁচু ঢেউগুলো তোমরা উঠে আস, আরো উপরে উঠে আস!” জল তার কোমরের বেল্ট পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়েছিল, তবুও তখন তার শীত লাগছিল না, সে ভয়ও পাচ্ছিল না। তার গায়ের কাপড় জলে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে ছিল, মাথার ভেজা চুল শেওলার মত চোখের উপর ঝুলছিল। সমুদ্র তার চারপাশে সিদ্ধ করা জলের মত টগবগ করছিল। জলস্রোত তাকে ধ্বাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, সে পায়ের আংগুল দিয়ে বালু আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ভীষণ জলস্রোত তাকে ঠেলে সৈকতের আরো উপরে নিয়ে যেতে থাকে। জলের নিচের মরা শেওলাগুলো তার পায়ে চাবুকের মত আঘাত করছিল, তার গোড়ালি পেঁচিয়ে যাচ্ছিল। দানিয়েল শেওলাগুলোকে জলের নিচ থেকে হেসকা টান দিয়ে তুলে নিয়ে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেয়। সে সময়টায় সূর্য কিংবা আকাশ কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, দূরের তটরেখা আর গাছগুলোর অবয়বকেও সে আর দেখতে পাচ্ছিল না। এখানে তখন সমুদ্র ছাড়া জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না, এবং দানিয়েল ছিল পুরোপুরি মুক্ত!

হঠাৎ জল আরো দ্রুত বাড়তে শুরু করে এবং উপকূলের বাঁধ ছাপিয়ে যায়। ঢেউগুলো স্বাধীন ভাবে আসতে থাকে, এগুলোকে বাধা দেয়ার মত আর কিছুই ছিল না। এই টেউগুলো ছিল অনেক উচু আর লম্বা, তাদের মাথার উপর ধোয়া উড়ছিল এবং মাঝখানে পেটের কাছে ঘন নীল জলে ফেনার একটা রেখা সাথে নিয়ে সৈকতের দিকে একটু কোণাকোণি ভাবে ধেয়ে আসছিল। টেউগুলো এত দ্রুত এসে পরেছিল যে, দানিয়েল নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময়টুকুও পায়নি, সে পিছন ঘুরে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু ঢেউগুলো তার কাঁধে ধ্বাক্কা দিয়ে তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। সাথে সাথে দানিয়েল নিশ্বাস বন্ধ করে তার আংগুলগুলো দিয়ে বালু আঁকড়ে ধরে রাখে। প্রচন্ড গর্জন করে একটার পর একটা ঢেউ তার উপর আছড়ে পরতে থাকে। লোনাজল তার চোখ, কান, নাক আর মুখের ভিতর ঘুর্ণির মত পাক খেতে থাকে। দানিয়েল হামাগুড়ি দিয়ে খুব চেষ্টা করে উপরের দিকে উঠে যেতে কিন্তু সে খুব একটা নড়তে পারছিল না, সে হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষণ তার পেটের উপর ভর দিয়ে শুয়ে থাকে। এরমধ্যে আরো বড় বড় ঢেউ বিশাল গুহার মত হা করে ধেয়ে আসতে শুরু করে।
দানিয়েল কিছুক্ষণ পর হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা উপরের দিকে চলে আসতে পারে এবং সে উঠে দাড়াঁতেও সক্ষম হয়। সে যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে উপকূলের বাঁধ পার হয়ে একটা টিলার উপর উঠে যায়। এবং দিনের বাকি অংশ সে আর সমুদ্রের কাছাকাছি যায়নি। কিন্তু তার সারা শরীর তখনও কাঁপছিল, তার দেহের সমস্ত ত্বক আর শরীরের ভিতর লোনাজল যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তার চোখের ভিতরে ঢেউ আচঁড়ের চিহ্ন রেখে গেছে।

উপকূলের পাশের একটা টিলার যে অন্ধকার গুহায় দানিয়েল প্রথমদিন আশ্রয় নিয়েছিল এবং যেখান থেকে সে প্রথমবার সমুদের দিকে তাকিয়েছিল, সে ওখানেই বসবাস শুরু করে দেয়। এখান থেকে সারাদিন অন্য কোন দিকে চোখ না সরিয়ে চুপচাপ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। তার এই গুহাটি খাঁজ কাটা কালো পাথর, নুড়ি আর ধুসর বালিতে ভরা।
পরদিন ভোরে, দানিয়েল যখন ঘুম থেকে উঠে গুহাটা থেকে বের হয়ে আসে, সূর্য তখনও আলো ছড়াতে শুরু করেনি, চারদিক ফ্যাকাশে আর ধুসর, দিগন্তে যেখানে আকাশ সমুদ্রের সাথে মিশে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন ওখানটায় সুতার মত একটা রেখা এঁকে রেখেছে। বৃষ্টির জমে থাকা জল পান করার জন্য দানিয়েল একটা কালো পাথরের গা বেয়ে উপরে উঠে আসে। সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো কতগুলো বড় বড় পাখিও ওখানটায় জলপান করতে এসেছিল তখন, তারা দানিয়েলের মাথার উপর উড়ে উড়ে তিক্ষ্ণ সুরে কিচির-মিচির করছিল। সে ঠোঁট দিয়ে শীস বাজিয়ে তাদের স্বাগত জানায়।

সকালে ভাটার সময় সমুদ্রের বিশালতাটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। সৈকতে কতগুলো রহস্যময় কালো গর্তে জল জমে আছে। পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে জলীয়বাস্প স্থির হয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় শেওলার পাহাড়। সৈকতে যাওয়ার পথটা পিচ্চিল হয়ে আছে। টিলাগুলোর পাথুরে গা বেয়ে ঝর্ণার জল সৈকতে গিয়ে পরছে। দানিয়েল পাথরের উপর থেকে নেমে এসে বিশাল সৈকতের দিকে যেতে থাকে। তার মনে হচ্ছিল, সে সমুদ্রের একেবারে মাঝখানে এসে পড়েছে, এটা যেন একটা নতুন দেশ, কয়েক ঘন্টা আগেও যার অস্তিত্ব ছিল না! দানিয়েল দ্রুত আরো সামনে এগিয়ে কালো প্রবাল প্রাচীরগুলোর কাছাকাছি পোঁছে যায়। প্রবাল প্রাচীরে ভেঙ্গে পড়া ছোট ছোট ঢেউগুলোর মৃদু শব্দ আর গভীর সমুদ্রের ফিসফিসানি তার কানে ভেসে আসছিল। এখানে সূর্য বেশি সময় আলো দেয় না। সমুদ্র দ্রুতই তার ছায়ার নিচে সব ঢেকে ফেলে, সূর্য জলকে উষ্ণ করার সুযোগ না পেয়ে, শুধুই নিজেকে জলে প্রতিফলিত করে মাত্র। এই সময়টাতে সমুদ্র তার অনেক গোপনীয়তা উম্মুক্ত করে দেয়, কিন্তু আপনাকে এসব থেকে দ্রুতই শিখতে হবে, কারণ নিমিষেই সে আবার সব ঢেকে দিবে। দানিয়েল সমুদ্র পাড়ের বনের ভিতর দিয়ে পাথরের চাইগুলোর উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছিল। জলাশয় আর অন্ধকার উপত্যকাগুলো থেকে একটা তীব্র গন্ধ ভেসে আসছিল, এই অপরিচিত গন্ধটা মানুষকে মাতাল করে দিতে পারে!

সমুদের আশেপাশের জলাশয়গুলোতে দানিয়েল মাছ, চিংড়ি আর শামুক খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সে জলের তলে শৈবালের ঝাড়ের ভিতর হাত ঢুকিয়ে অপেক্ষায় থাকে, কখন কাঁকড়া আর চিংড়ি তার আংগুলে সুরসুরি দিবে আর সে খপ করে তাদের ধরে ফেলবে। স্বচ্ছ জলে সামুদ্রিক উদ্ভিদগুলো তাদের বেগুনি, ধূসর, রক্ত-লাল পাপড়িগুলো একবার খুলছিল আবার বন্ধ করছিল। জলের তলের পাথরগুলোতে বসবাস ছিল সাদা আর নীল রংয়ের ঝিনুকদের, আর নানা আকার আর রংয়ের শামুকের দলের। কখনও কখনও জলাশয়ের স্বচ্ছ জলের নিচে মা ঝিনুকের মুক্তোগুলোর উপর সূর্যের আলো ঝিলিক দিয়ে আবার ফিরে আসছিল। ধারালো ছুরির ফলার মত একটা পুরোনো ঝিনুকের খোল হঠাৎ সামুদ্রিক উদ্ভিদগুলোর পাপড়িগুলোতে ঝড় তুলে দেয়। দানিয়েল অনেকটা সময় ধরে জলের নিচের এই পৃথিবীটাকে দেখছিল, তার মনে হচ্ছিল সেও এই জলাশয়টার নিচে কোন একটা পাথরের খাঁজে বাস করা কেউ এবং সে সূর্যের আলো ঝলমলে দিনের পর রাতের সমুদ্রের জন্য অপেক্ষা করছে। খুব খিদে পেয়েছিল দানিয়েলের, খাবারের খোঁজে সে জলাশয়ের অগভির জলে নেমে পড়ে। জলের তলে পাথরগুলোর গায়ে কয়েকটা শামুক সেটে ছিল। দানিয়েল খুব ধীর সতর্ক পায়ে সেদিকে যেতে থাকে, সে চাইছিল তার পায়ের বড় বড় আংগুলগুলো দিয়ে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে শামুকগুলোকে পাথর থেকে আলগা করে ধরে ফেলবে। কিন্তু দ্রুতই শামুকগুলো হয়ত তার পায়ের শব্দ কিংবা তার নিশ্বাসের হিস হিস শব্দ শুনে ফেলে পাথরের আড়ালে চলে যায়, আর ক্রমাগত ঠোকর দিতে থাকে পাথরের গায়ে।

দানিয়েল তার খাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমান চিংড়ি আর শামুক শিকার করে জলাশয়ের পাড়ের পাথরগুলোর খাঁজে জমা করে রাখে। পরে সে এগুলোকে শুকনো সামুদ্রিক শৈবাল পুড়িয়ে একটা টিনের কৌটায় রান্না করবে। মাছ ধরা শেষ করে সে অনেকটা সমতল ভূমি পার হয়ে দূরে যেখানে সমুদ্র গর্জন করছে ঐ দিকে চলে যায়। কারণ ঐখানেই তার অক্টোপাস বন্ধুটা থাকে। প্রথম যেদিন সে এখানে এসেছিল, সে দিনেই তার সাথে দানিয়েলের পরিচয় হয়। এমনকি, গাংচিল আর সামুদ্রিক শৈবালদের সাথে পরিচয়ের আগেই তার সাথে অক্টোপাসটার পরিচয় হয়েছিল! সে যখন সমুদ্রের কাছে এসে পৌঁছায়, তখনও টেউগুলো শান্ত ভাবেই সৈকতে ভেঙ্গে পড়ছিল আর দিগন্ত দেখা যাচ্ছিল পরিষ্কারভাবে। সমুদ্র তখনও ফুলে ফেফে উঠা শুরু করেনি, কালো ভংয়কর টেউগুলোকে সমুদ্র তার পেটের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত এই জায়গাটাই পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় গোপন স্থান, যেখানে দিনের আলো মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখা দিয়ে আবার চলে যায়।
দানিয়েল খুব সতর্ক ভাবে কতগুলো পিচ্ছিল পাথরের উপর পায়ের আংগুল চেপে আবার কখনও নিচু হয়ে পাথরের গায়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল,যেন সে পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্র বরাবর নামছে! সে সামনে একটা জলাশয় দেখতে পেল, যেখানে সৈকতের দীর্ঘ প্রান্ত এসে মিশে গেছে। সে স্থির হয়ে তাকিয়ে দেখছিল সামানের দিকে, তার মাথাটা তখন প্রায় মাটির কাছে নেমে এসেছে। তখনি সে সামনের জলাশেয়টার এক পাড়ে ভাসমান অক্টোপাসটার শুঁড়গুলোকে দেখতে পায়। দানিয়েল অক্টোপাসটাকে একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে, তার মনে হচ্ছিল গর্ত থেকে যেন একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী ভেসে উঠছে ! আর উঠতে উঠতেই অক্টোপাসটার শুঁড়গুলো শেওলার উপর আলতোভাবে পিছলে যাচ্ছিল। দানিয়েল অনেক্ষণ চেপে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে দেখছিল, অক্টোপাসের শুঁড়গুলো জলাশয়ের পাড়ের শেওলার উপর নড়াচড়া শুরু করেছে। পর মুহুর্তেই, অক্টোপাসটা তার নলের মত দীর্ঘ দেহটা নিয়ে সতর্কাতার সাথে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে।তার শুঁড়গুলো সামনে দুলতে থাকে। সূর্যের আধো আলোতে অক্টোপাসটার লম্বাটে ভ্রুয়ের নিচে হলুদ চোখ জোড়া ধাতব খন্ডের মত জ্বল জ্বল করছিল। অক্টোপাসটি তার ফিকে লাল রংয়ের শুঁড়গুলো থেকে মাথাটা ধীরে ধীরে বের করে এদিক ওদিকে নাড়াচড়া শুরু করে, দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন কিছু একটা খুঁজছে। তারপরেই সে জলাশয়ের উপর দানিয়েলের ঝুঁকে থাকা মাথার ছায়া দেখতে পেল। নিমিষে সে এক ঝটকায় পিছনে চলে যায় এবং তার শুঁড়গুলোতে মোচড় দিয়ে অদ্ভুত রকমের ধূসর নীল মেঘের মত কিছু একটা ছাড়ে। দানিয়েল জলাশয়ের স্বচ্ছ জলের দিকে মাথাটা আরও ঝুঁকিয়ে আস্তে আস্তে অক্টোপাসটাকে ডাকতে থাকে। জলাশয়ের যে পাড়ে অক্টোপাসটার বসবাস সেখানে একটা পাথরের উপর বসে দানিয়েল তার পা দুটোকে জলে ডুবিয়ে কোন সাড়াশব্দ না করে অপেক্ষা করতে থাকে। অল্প কিছুক্ষণ পর, সে জলের নিচে তার পায়ের ত্বকে আর গোড়ালিতে অক্টোপাসটার শুঁড়ের আলতো স্পর্শ অনুভব করে। অক্টোপাসটা শুঁড় দিয়ে তার পায়ের পাতায়, আবার কখনও আঙ্গুলের মধ্যে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। আর তাতে দানিয়েল নিজে নিজে হাসতে শুরু করে।

“শুভদিন ওয়াট”, দানিয়েল অক্টোপাসটাকে সম্ভাসন করে। এটা যে তারই নাম, এটা অবশ্য অক্টোপাসটা জানতই না! দানিয়েল তাকে খুব নিচু স্বরে ডাকছিল, যাতে না আবার অক্টোপাসটা ভয় পেয়ে যায়! তার কাছে সে জানতে চায়, সমুদ্রের তলদেশে কি কি ঘটে? আর যখন বড় বড় ঢেউগুলো তার উপর দিয়ে যায়, তখন সে কি দেখে? কিন্তু অক্টোপাসটা তার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না! সে শুধু তার পায়ের তলায়, তার গোড়ালিতে আলতো সুড়সুড়ি দিয়ে যেতে থাকে। অক্টোপাসটাকে দানিয়েলের খুব পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু আর বেশিক্ষণ তার কাছে থাকা সম্ভব ছিল না, কারণ সমুদ্র দ্রুতই ফুলে উঠতে শুরু করে। আজ সে ভালোই মাছ শিকার করতে পেরেছে, তাই ওখান থেকে সে অক্টোপাসটার দিকে কয়েকটা চিংড়ি আর কাঁকড়া ছুড়ে দেয়। অক্টোপাসটা তার ধুসর রংয়ের একটা শুড় চাবুকের মত নিক্ষেপ করে নিমিষেই তার দেয়া উপহার ধরে ফেলে এবং জলের নিচে নিয়ে যায়! দানিয়েল এর আগে অক্টোপাসটাকে খেতে দেখেনি। কারণ, এটি প্রায় সবসময় তার শুড়গুলোকে উপরে ভাসিয়ে রেখে অন্ধকার জলের নিচে ঘাপটি মেরে থাকত। হয়ত সে দানিয়েলের মতই, অনেক দিন জলাশয়ের নিচে ঘুরে ঘুরে তার নিজের সত্যিকারের ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে! যেখানে স্বচ্ছ জলের নিচ থেকে পরিস্কার আকাশ দেখা যায়!
একদিন, ভাটার সময় সমুদ্র যখন অনেক দূরে, তখন যেন পুরো পৃথিবী আলোয় ভাসছিল। দানিয়েল শেওলার কার্পেট বিছানো কতগুলো পাথরের উপর দিয়ে হাঁটছিল। সূর্য তখন পাথর আর জলের উপর তীব্র উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। বাতাস বইছিল না, এমনকি কারও শ্বাস ছাড়ার মত বাতাসও না! সমুদ্রের সামনে বিস্তীর্ণ জমিনের উপর নীল আকাশটাকে অনেক বড় দেখাচ্ছিল। আর তখন কেমন একটা অদ্ভুত আলো জ্বল জ্বল করছিল আকাশে। দানিয়েল তার মাথা আর কাঁধের উপর প্রচন্ড তাপ অনুভব করে, সে তার চোখ বন্ধ করে ফেলে যাতে তীব্র তাপে সে অন্ধ না হয়ে যায়। সেখানে অন্য আর কিছুই ছিল না, কিছুই না!! শুধু সূর্য, আকাশ আর সাদা লবন সমুদ্রের সামনে বিস্তীর্ণ জমিনের পাথরগুলোর উপর নাচানাচি করছিল। সমুদ্র তখন অনেক দূরে সরে গেছে, দিগন্তে শুধু একটা নীল রেখা দেখা যাচ্ছিল। দানিয়েল পাথরের উপর দিয়ে সমুদ্রের দিকে যাত্রা শুরু করে। সে অনুভব করছিল, সে একদম আনকোরা নতুন একটা ভূমির উপর দিয়ে যাচ্ছে, এর আগে এখানে কারও পা পড়েনি। এখানকার সবকিছুই অপরিচিত। জায়গাটা এমনই নেশা ধরিয়ে দেয়ার মত যে, এখান থেকে কেউ নিজেকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। দানিয়েল হঠাৎ দেখে, সে শক্ত জমিন পার হয়ে একটা কর্দমাক্ত জায়গায় এসে পড়েছে। এখাকার নির্জনতা দানিয়েলকে মুগ্ধ করে। চারদিকে সামুদ্রের জলের আঘাতে জরাজির্ণ পাথরগুলোর নীরবতা, আর জমিনের ফাঁটল আর গর্তগুলো কেমন একটা অস্থিরতা ছড়াচ্ছিল। প্রথমে সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে, তারপর দৌড় শুরু করে দেয়। প্রথম যেদিন সে সমুদ্রের কাছে এসেছিল ঠিক ওইদিনের মত তার হ্দপিন্ড প্রচন্ড জোরে ধুকধুক করতে থাকে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তারপরও সে পিচ্ছিল শেওলা আর ব্লেডের মত ধারালো অসমান পাথরের উপর দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে দৌড়াতে থাকে! তার চারদিকে ছোট ছোট জলাশয়ের জল আর পাথরগুলো সূর্যের তীব্র আলোয় চকচক করছিল। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে মৃত প্রবালগুলো তাপে চৌচির হয়ে গেছে। শেওলাগুলো থেকে বাস্পের সাথে একটা তীব্র গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। দানিয়েল কোন কিছু না বুঝেই সমুদ্রের দিকে দৌড়ে যেতে থাকে, সে ঢেউয়ের মতি গতি বোঝার জন্য একবারও থামেনি। সমুদ্র তখনও দিগন্তের কাছাকাছি প্রায় অদৃশ্য হয়ে ছিল, তার সব জল যেন কোন একটা গর্ত দিয়ে পৃথিবীর পেটে চলে গেছে! দানিয়েল ভয় পাচ্ছিল না, কিন্তু সে নিজের মধ্যেও ছিল না তখন! তবে সে সমুদ্রকে আগের মত ডাকাডাকি করছিল না, নিজে নিজে কোন কথাও বলছিল না। চারদিকেই সূর্য উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। জলের গর্তগুলো তীব্র রোদকে আয়নার মত প্রতিবিম্বিত করে পাথরগুলোর উপর ফেলে রোদের তাপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তাই দানিয়েলকে তপ্ত পাথরগুলোর উপর এলোমেলো ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াতে হচ্ছিল। তখন সূর্যের আলো ভোরের সৈকত কিংবা সবুজ টিলাগুলোর মত কোমল আর শান্ত ছিলো না। এটা ঘুর্ণির মত আকাশ আর পাথরের উপর অবিরাম চক্কর দিচ্ছিল! রোদের তীব্রতা দানিয়েলকে অস্থির করে দেয়, প্রায় কিছুই না দেখে সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। চারদিকে শুধুই লবন আর লবন! গত কয়েকদিন ধরে কালো পাথরগুলোতে, ছোট নুড়িগুলোর উপর, শামুক-ঝিনুকের খোলে এবং টিলাগুলোর পায়ের কাছে সাগরলতার ছোট ছোট পাতার উপর এই লবন জমেছে। দানিয়েলের পরনের কাপড়ে, তার পুরো শরীরের চামড়ায়, চোখের পাতায়, ভ্রুতে, ঠোঁটে আর তার চুলেও লবন জমে শক্ত হয়ে গেছে। আর এই লবন তার সারা শরীরে জ্বলুনি ধরিয়ে দিয়েছে। এমনকি লবন তার গলার ভিতর, পেটের ভিতর এবং হাড়ের মজ্জাতেও ঢুকে গেছে। কাচের গুড়ার মত লবনের কণা তার দুই চোখের দুর্বল মনিতে আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছিল। সূর্যের তীব্র আলো পড়ে লবন থেকে অসংখ্য রশ্মি দানিয়েলের দেহের উপর আর তার আশেপাশে ছড়িয়ে পরছিল। এই সবকিছু দানিয়েলকে মাতাল করে দেয়, তার দেহে বিদ্যুৎ বইয়ে দেয়। সে স্থির থাকতে না পেরে ক্রমাগত দৌঁড়াতে থাকে। একটা পাথর থেকে আর একটা পাথরের উপর ঝাঁপিয়ে পরছিল সে। দানিয়েল আলোর এতো শুভ্রতা আগে কখনও দেখেনি। এমনকি আকাশ আর জলাশয়গুলো পর্যন্ত তীব্র সাদা হয়ে ছিল ! তার চোখ জ্বলে যাচ্ছিল। সে চোখ বন্ধ করে থেমে যায়,তার দুই পা কাঁপছিল তখন। সে সমুদ্রের লোনাজলে ভরা একটা জলাশয়ের পাশে একটা পাথরের উপর বসে পড়ে। পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আগুনের মৃদু, শুকনো, কর্কশ, হিস হিস শব্দ তার কানে মৌমাছির তীক্ষণ গুণগুণের মত ভেসে আসছিল। তার খুব জলতেষ্টা পেয়েছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল কোনও জলই কখনও তাকে তৃপ্ত করতে পারবে না। রোদের তাপে তার মুখ, হাত আর কাঁধ পুড়ে যাচ্ছিল। যেন হাজার হাজার কাঁটা তার দেহে হুল ফোঁটাচ্ছিল। তার বন্ধ চোখ থেকে নোনতা অশ্রু পুড়ে যাওয়া গালে দাগ কেটে কেটে গড়িয়ে পড়ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখ খুলে আধো দৃষ্টিতে সামনের সাদা পাথুরে সমভুমির দিকে তাকায়, মরুভুমির মত বিস্তীর্ণ অঞ্চলটায় জলাশয়গুলোকে আলোতে ঝলমল করতে দেখে সে। কোথাও সমুদ্র পাড়ের কোন প্রানী দেখা যাচ্ছে না, সব শামুক, ঝিনুক আর কাঁকড়ার দলগুলো গর্তে লুকিয়ে গেছে! দানিয়েল তার চোখকে রোদ আর লবনের তীব্রতা থেকে বাঁচানোর জন্য শার্ট খুলে মাথার উপর ঝুলিয়ে দেয়। সে অনেকটা সময়ের জন্য তার মাথাকে দুই হাঁটুর মাঝখানে গুজে দিয়ে স্থির হয়ে থাকে। আর ঠিক তখন, সমুদ্রের নিচে একটা জ্বলন্ত তাণ্ডব নাচ একবার বাড়ছিল আবার কমছিল। তারপরেই ঝড়টা শুরু হয়। প্রথমে দুর্বল, যেন গুমট আবহাওয়ায় ঝড়টার চলতে অসুবিধা হচ্ছিল! এরপরেই বাতাসের বেগ বাড়তেই থাকে আর দিগন্ত থেকে ঠান্ডা বাতাস আসতে শুরু করে। সমুদ্র পাড়ের শান্ত জলাশয়গুলোর রং পালটাতে থাকে। আকাশে মেঘ জমে তীব্র আলো ফিকে হয়ে যায়। দানিয়েল তার কাছাকাছি সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছিল। বিশাল বিশাল ঢেউ সৈকতের পাথরগুলোর উপর তাদের পেট দিয়ে আঘাত করছিল। ফোঁটা ফোঁটা জলে দানিয়েলের কাপড় ভিজতে থাকে, তার তন্দ্রাভাব কেটে যায়। সমুদ্র এরমধ্যেই তার কাছাকাছি পৌছে গেছিল। এটা খুব দ্রুতই আসছিল,নিমিশেই পাথরগুলোকে চারদিকে ঘিরে ফেলে। তখন পাথরগুলোকে ছোট ছোট দ্বীপের মত দেখাচ্ছিল। এটি সৈকতের সব ফাটল আর গর্তগুলোকে ডুবিয়ে দেয়। সমুদ্র বন্যার পানিতে ফুসতে থাকা খরস্রোতা নদীর মত তীব্র হুংকার দিয়ে আসতে থাকে। বাতাসে গর্জন করে একটার পর একটা বড় বড় পাথরকে যখন সে গিলে নিচ্ছিল, পৃথিবী কেঁপে উঠছিল। দানিয়েল লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে পাড়ের দিকে দৌড়াতে থাকে। এখন তার তন্দ্রাভাব কেটে গেছে, আলো আর লবন ভীতিও চলে গেছে। সে তার শরীরে প্রচন্ড ক্রোধ অনুভব করে, সে বুঝতে পারে একটা প্রচন্ড শক্তি এসে ভর করেছে তার দেহে। সে চাইলে এখন পাথরগুলোকে পিষে গুড়ো করে দিতে পারে, কিংবা গোড়লির এক আঘাতে ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে সৈকতে! সে উপকূলের উঁচু বাধের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে তার পিছনে সমুদ্রের উত্তাল গর্জন শুনতে পাচ্ছিল। আর সে হঠাৎ হঠাৎ সমুদ্রকে ডাকছিল, “আস, আস, হেই হেই”! “সমুদ্র তুমি দ্রুত উঠে আস”। যেন সেই সমুদ্রকে আদেশ দিচ্ছে, তার পিছে পিছে আসার জন্য! দানিয়েলকে দ্রুত দৌড়াতে হচ্ছিল। কারণ সমুদ্রের সামনে যা কিছু পড়ছিল পাথর, শেওলা, সবকিছুই সে গিলে নিতে চাইছিল। মাঝে মাঝে সমুদ্র ধুসর ফেনার ঝাপটা দিয়ে দানিয়েলের পথ আটকে দিচ্ছে। তখন সে লাফ দিয়ে কোন একটা পাথরের উপর উঠে পড়ছিল, আবার যখন সমুদ্র তার সব জল নিয়ে পিছিয়ে যায়, তখন সে নতুন ভাবে দৌড় শুরু করে। দানিয়েলকে এর মধ্যে বেশ কয়েকটা ঘোলা জলের জলাশয়ও সাঁতার দিয়ে পার হতে হয়েছিল। তবে সে তখনও ক্লান্ত হয়ে পড়েনি। অন্যদিকে তার খুব আনন্দ হচ্ছিল, যেন সূর্য, বাতাস আর সমুদ্র মিলে তাকে লবনের মত গলিয়ে দিয়ে মুক্ত আর স্বাধীন করে দিয়েছে! সমুদ্র তখন তার সব সৌন্দর্য মেলে ধরেছে। বিশাল ঢেউগুলো নাচের তালে তালে একবার উঁচুতে উঠছে, আবার নিচে ভেঙ্গে পরছে। আর ঢেউয়ের মাথার উপর সাদা ফেনা বন্দুকের গুলির মত ছিটলে উপরে উঠে মেঘের মত কিছুক্ষণ ভেসে আবার বাতাসের ধাক্কায় পিছলে নিচে পড়ছে। জলের একটা স্রোত মিলিয়ে যাওয়ার পর আবার আর একটা নতুন স্রোত আরো বেশি জল আর গতি নিয়ে ফিরে আসছে। অনেক দূরে পাহাড়গুলোর কাছে সৈকতের উপর সাদা রাস্তাটা চিকচিক করছিল। তখন দানিয়েলের মনে পড়ছিল সিন্দাবাদের জাহাজ ভেঙ্গে যাওয়ার গল্পটা, যেবার সমুদ্রের ঢেউ সিন্দাবাদের ভাঙ্গা জাহাজকে রাজা মিহরেজের দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিল। তখন চারদিকে ঠিক এরকমই হয়েছিল। দানিয়েল পাথরের উপর দিয়ে যতদূর সম্ভব দ্রুত দৌড়াচ্ছিল। কোনরকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই ঠিক পাথরগুলোর উপর সে নগ্ন পা ফেলে এগুচ্ছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন সে এই সমুদ্রের তলদেশের এই উম্মুক্ত জমিতে, এইরকম জাহাজ ভাঙ্গা ঝড়ের মধ্যেই সারা জীবন বসবাস করে আসছে। সে ঢেউয়ের গর্জন শুনতে শুনতে সমুদ্রের মত একই গতিতে এগুচ্ছিল, দম না ছেড়ে, একবারও না থেমে। লম্বা লম্বা ঢেউগুলো যেন পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে আসছিল, তারা মাথার উপর সাদা ফেনা নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে মসৃণ পাথরগুলো পার হয়ে যাচ্ছিল। দিগন্তের কাছাকাছি সূর্য স্থীর হয়ে জ্বলছিল তখন। এই সূর্যই ঢেউগুলোকে শক্তি যোগায়, তার আলোই পৃথিবীর বিরুদ্ধে ঢেউগুলোকে ঠেলে দেয়। এটি এমন একটা নাচ, যা কখনও শেষ হয় না। ভাটার সময় চলে লবণের নাচ,আর জোয়ারের জল যখন তীরের দিকে ছুটে চলে, তখন শুরু হয় ঢেউ আর বাতাসের নাচন!

জল যখন সমুদ্রতীরের কিনারায় পৌঁছে যায়, তখন দানিয়েল তার গুহাটায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। সে গুহার নুড়ি পাথরগুলোর উপর বসে পড়ে। সে আপাতত এখান থেকেই সমুদ্র আর আকাশ দেখবে। কিন্তু ততক্ষণে ঢেউ উপকূলের বাঁধ পার হয়ে গুহা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, সে বাধ্য হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে গুহার আরও ভিতরে ঢুকে পড়ে। সমুদ্র তখনও তার ঝাপটা মারছিল, তার সাদা ফেনার আঘাতে গুহার নুড়িগুলো ফুটন্ত জলের মত কাঁপছিল। উপকূলের পাথরের বাঁধ আর একের পর এক শৈবালের বাধা ডিংগিয়ে ঢেউগুলো আরও সামনের দিকে এগুতে থাকে। দানিয়েলের আশ্রয় নেয়া গুহাটার মুখে গত কয়েক মাস ধরে স্তুপ হতে থাকা লবণ মিশানো গাছের ডালগুলোকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে জল গুহার ভিতরে ঢুকে পড়ে। দানিয়েল গুহার একদম শেষ প্রান্তে দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে ছিল। তার আর পিছু হটার উপায় নেই। সে পিছন ফিরে একবার দেখল, যদি সমুদ্র এবার থামে! সে কোন কথা না বলে, তার দেহের সব শক্তি দিয়ে ধেয়ে আসা জলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে হাত দিয়ে ঝাপটা মেরে ঢেউগুলোকে পেছন দিকে ছুড়ে মারে কিন্তু পরেই আর একটা বড় ঢেউ এসে তার প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেয়। বেশ কয়েকবার ঢেউ গুহাটাকে পুরো ভাসিয়ে টিলার উপর দিয়ে চলে যায়। দানিয়েল তখন গুহার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে, যতক্ষণ না জল আবার নেমে যায়।
হঠাৎ সমুদ্র তার উত্থান থামিয়ে দেয়। তার ভয়ানক গর্জন থেমে যায়। এখন ঢেউগুলোর গতি ফেনার মত হালকা ওজনের । দানিয়েল বুঝতে পারে এটা শেষ হয়ে গেছে। সে গুহার মুখের কাছে নুড়ি পাথরগুলোর উপর শুয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদিও ঠান্ডা আর ক্লান্তিতে তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু এত সুখ তার জীবনে সে আর পায়নি। পরম শান্তিতে সে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে। এবং একসময় সূর্যের আলো কমতে কমতে নিভে যাওয়া কুপি বাতির মতো ম্লান হয়ে যায়।

এবং তারপর….. তার কি হয়েছিল? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, সমুদ্রের ধারে ঐ গুহার ভিতর সে কি করেছে? হয়ত সে কোন একটা কার্গো জাহাজে চড়ে আমেরিকা, অথবা চীন অবদি চলে গেছে। হয়ত সে এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে ঘুরছে, কিংবা এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে! এই রকম স্বপ্নগুলো কখনও শেষ হয়ে যাওয়া উচিত না। এখানে, আমরা যারা সমুদ্র থেকে অনেক দূরে থাকি, তাদের কাছে সবকিছুই একই সাথে অসম্ভব আর সহজ ছিল। আমরা শুধু জানতাম যে, অদ্ভুত কিছু একটা ঘটেছে। আবার দানিয়েলকে নিয়ে আমাদের এইসব কল্পনা আমাদের নিজেদের কাছেই আশ্চর্য লাগত, কারণ এখানকার যারা গুরুত্বপুর্ণ মানুষ, যারা সব বিষয়ে অনেক জানেন, তাদের কথার সাথে আমাদের কল্পনাকে অযৌক্তিক মনে হত। শুরুতে আমাদের শিক্ষক, প্রশাসক আর পুলিশের কর্তারা মরিয়া হয়ে দানিয়েল সিন্দাবাদ সম্পর্কে আমাদের কাছে অজস্র প্রশ্ন করেছে। কিন্তু একটা নিদির্ষ্ট সময়ের পর তারা এমন আচরণ করতে শুরু করে যে, যেন দানিয়েল নামে কারও কখনও অস্থিত্বই ছিল না! তারা তাকে নিয়ে কোন কথা বলত না। তার সব ব্যক্তিগত জিনিষ-পত্র, এমন কি স্কুলে জমা দেয়া তার পুরনো অ্যাসাইনমেন্ট পেপারগুলোও তারা তার মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। স্কুলে তার স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না আর। এমনকি লোকেরা তাকে নিয়ে স্মৃতিচারনও করতে চাইত না। তারা বরং আগের মত তাদের নিজেদের স্ত্রীদের নিয়ে, তাদের ঘর-বাড়ি, নতুন গাড়ি অথবা স্থানীয় নির্বাচন, এসব নিয়ে কথা বলতে ভালবাসত। যেন কিছুই ঘটেনি! হয়ত এটা তাদের কোন ভান ছিল না। কয়েক মাস ধরে দানিয়েলকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনা চিন্তার পর তারা তাকে সত্যিই ভুলে গেছে। আর দানিয়েল যদি এখন ফিরেও আসে, সম্ভবত কেউ তাকে চিনতেই পারবে না! স্কুলের দরজায় সবাই তাকে জিজ্ঞেস করবে, “কে তুমি?” “কি চাও এখানে?”

কিন্তু আমরা দানিয়েলের বিষয়টা ভুলে যাইনি! স্কুলের আঙ্গিনায়, ক্লাসে, ছাত্রাবাসে আমরা ওকে মনে রাখতাম। এমনকি যে ছাত্রদের সাথে ওর পরিচয় ছিল না, তারাও ভুলে যায়নি। আমরা বরাবরের মত স্কুলের সাধারণ বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলতাম। এই যেমন, গণিতের সমস্যা কিংবা আমাদের করা ল্যাটিন ভাষার অনুবাদগুলো নিয়ে। তবে, এর মধ্যেও সবসময় আমরা তাকে নিয়েও কথা বলতাম, যেন সে আসলেই, অনেকটা সিন্দাবাদের মতোই বিশ্ব জুড়ে পথ তৈরি করে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে আমরা অন্য কোন বিষয়ে গল্প করতে করতে হঠাৎ চুপ হয়ে যেতাম, আর তখন কেউ একজন বরাবরের মত একই প্রশ্ন করত, “আচ্ছা, তোর কি মনে হয়? সে এখন কি ঐ জায়গাটায় আছে?” যদিও আমরা কেউ জানতাম না, জায়গাটা ঠিক কোথায়? তবে আমরা কল্পনায় দেখতাম জায়গাটা; অপার সমুদ্র, দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, মেঘের দল, সমুদ্র পাড়ে পাথরের গায়ে বুনো ফুল ফুটে আছে, উচু উচু ঢেউ, আর সাদা রংয়ের বড় বড় গাংচিল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে যখন গাছের ডাল দুলতে থাকে, আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞ নাবিকের মতো উদবিগ্ন হয়ে বলতাম, “এখন মনে হয় ওখানে ঝড় উঠবে”! আর যখন শীতের সূর্য নীল আকাশকে আলোকিত করে দিত, তখন আমরা বলে উঠতাম, “আজ তার সৌভাগ্যের দিন”! তবে আমরা এর চেয়ে বেশি কিছু বলতাম না। কারণ, আমরা দানিয়েলকে না জানিয়েই তার সাথে একটা চুক্তি করেছিলাম। এটা ছিল গোপনীয়তা আর নীরবতার চুক্তি। তার সাথে কাটানো দিনগুলোতে আমরা তাকে যেমনটা দেখতাম। অথবা, সম্ভবত আমরা তার মতই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। কিংবা একদম সহজভাবে বলতে গেলে, আমাদের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল সেইদিন, যেদিন সকালে আমরা চোখ খুলে আধো আলোতে দানিয়েলের খালি বিছানাটা দেখেছিলাম, যেটা সে সারা জীবনের জন্য ঘুছিয়ে গেছে, যেখানে সে আর কোনো দিন ঘুমাবে না।

(লেখক পরিচিতিঃ নোবেল বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক জঁ-মারি গুস্তাভ ল্য ক্লেজিও( Jean-Marie Gustave Le Clézio) ১৯৪০ সালের ১৩ এপ্রিল ফ্রান্সের নিচ শহরে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা ব্রিটিশ আর মা ফরাসি। তার বাবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একইজন চিকিৎসক ছিলেন। ল্য ক্লেজিও বেড়ে উঠেছেন ফ্রান্স এবং মারিশাসে। শৈশবের কিছু সময় তিনি নাইজেরিয়াতেও কাটিয়েছেন। তিনি জীবনের বিভিন্ন সময়ে বৃটেন, মেক্সিকো, পানামা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড সহ পৃথীবির নানা প্রান্তে বসবাস করেছেন। ল্য ক্লেজিওর তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিকে তুলে ধরার পাশাপাশি বারবার পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ল্য ক্লেজিও বিশেষ করে মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার আদিবাসী জনগণের জীবন পর্যবেক্ষণ করার জন্য জন্য ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন এবং তার জীবনের এইসব অভিজ্ঞতা তার লেখালেখিতে উঠে এসেছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস “Le Procès-Verbal ” প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে, তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রথম সাড়া ফেলেন ১৯৮০ সালে প্রকাশিত “Désert ” উপন্যাস দিয়ে। উপন্যাস ছাড়াও তিনি ছোট গল্প, ভ্রমন বিষয়ক বই, প্রবন্ধ এবং ছোটদের জন্য লেখালেখি করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৮ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি আরও অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ‘যে ছেলেটি আগে কখনো সমুদ্র দেখেনি’ (Celui qui n’avait jamais vu la mer) এই গল্পটি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত তার লেখা গল্পের বই Mondo et autres histoires -এ প্রকাশিত হয়েছে।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.