নগুগি ওয়াথিয়াঙ্গো এর গল্প ‘বৈভবের মুহূর্ত’ ।  অনুবাদ দিলশাদ চৌধুরী

0

গল্প
বৈভবের মুহূর্ত

নগুগি ওয়াথিয়াঙ্গো
অনুবাদঃ দিলশাদ চৌধুরী

তার নাম ছিলো ওয়ানজিরু। কিন্তু তার খ্রিস্টান নামটা তার কাছে বেশি পছন্দের ছিলো, বিয়েট্রেস। এই নামটা আগেরটার চেয়ে বেশি পবিত্র আর সুন্দর শোনাতো। এমন নয় যে সে দেখতে কুৎসিত, কিন্তু তাকে সুন্দরীও বলা চলেনা। তার কালো, মাংসল দেহে সুন্দর আকার ছিলো, কিন্তু মনে হত যেন দেহটি ক্রমাগত অপেক্ষা করে যাচ্ছে আত্মার সংযোগে পরিপূর্ণ হতে। সে কাজ করত বিয়ার হলগুলোয় যেখানে বিভিন্ন ভদ্রমহিলাদের সন্তানরা আসত নিজেদের অন্তঃস্থ জীবনকে বিয়ারের ক্যানে ডুবিয়ে দিতে আর তারপর মাতাল হয়ে আবোলতাবোল বকতে। কেউ ওকে খেয়াল করত বলে মনে হয়না। একমাত্র, শুধু যখন কোনো মালিক কিংবা অধৈর্য খদ্দের ওর নাম ধরে ডাকাডাকি করত, বিয়েট্রেস; তখন অন্যান্য গ্রাহকরা সংক্ষেপে মাথা তুলত, কয়েক সেকেন্ডের জন্য, যেন দেখতে যে এত সুন্দর নামটাকে কে ধারণ করে আছে, কিন্তু তেমন কাউকে না দেখে, তারা তাদের মদ্যপান জারি রাখে, সাথে অশ্লীল তামাশা, আর অন্যান্য পরিচারিকাদের সাথে হাসিঠাট্টা। ও যেন ওড়ার চেষ্টারত কোনো চোট লাগা পাখিঃ না চাইতেও পতন এখন তখন। কিন্তু তবুও ও ভেসে বেড়ায় জায়গায় জায়গায় যেন ওকে বিভিন্নভাবে পাওয়া যায় আলাস্কা, প্যারাডাইস, দ্যা মডার্ন, থোম কিংবা পুরো লিমুরুতে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য বিয়ার হলগুলোতে। অবশ্য কিছুক্ষেত্রে কারণটা হত যে কোনো ক্রুদ্ধ মালিক হয়ত হঠাৎ আবিষ্কার করত ও যথেষ্ট খদ্দের আকৃষ্ট করতে পারছেনা; তারপর ওকে তাড়িয়ে দিত কোনোরকম নোটিস কিংবা বেতন ছাড়াই। ও টলতে টলতে কাজ নিত পরবর্তী মদ্যশালায়। কিন্তু কিছু সময় ও স্রেফ ক্লান্ত হয়ে উঠতো এক জায়গায় থাকতে থাকতে, একঘেয়ে দৃশ্যের রোজকার সাক্ষী। ওর চেয়েও কুৎসিত বলা চলে এমন মেয়েদের নিয়ে দোকান বন্ধের সময়ে দাবিদারদের ঝগড়া লেগে যায়। ওদের কি এমন আছে যা আমার নেই? ও নিজেকে জিজ্ঞেস করে, হতাশ হয়ে। ও একটা মদ্যশালার রাজত্বের স্বপ্ন দেখে যেখানে ও একমাত্র না হলেও শাসকদের মধ্যে একজন থাকবে, যেখানে প্রজারা সব বিয়ারের ভেট নিয়ে আসবে, সাথে হতাশায় নিমজ্জিত হাসি আর প্রায়ই গালাগাল যাতে ঘৃণার চেয়ে বেশি প্রেম আর কাম লুকিয়ে থাকবে।
বিয়েট্রেস মূল লিমুরু শহর ছেড়ে আশেপাশের মাশরুমের মত গজিয়ে ওঠা শহরতলীগুলোতেও চেষ্টা করেছিলো। ও কাজ করেছে নগারারিগা, কামিরিথো, রাইরোনি এবং এমনকি টিয়েকুনুতেও আর প্রত্যেক জায়গায় একই কাহিনি। ওহ হ্যা, মাঝেমধ্যে ও খদ্দের পেতো; কিন্তু কেউই ওকে ততটা পাত্তা দিতোনা যতটা ও চায়, কেউই ওকে ততখানি চাইতোনা যতটা চাইলে ওকে পাওয়ার জন্য যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া যায়। ও ছিলো সবসময় কোনো অসচ্ছল খদ্দেরের শেষ ভরসা। এমনকি কোনো ছলনাও না, অন্তত ওর ক্ষেত্রে, টুস্কারের পঞ্চম বোতলের পর পুরুষ প্রশ্রয়ের যে মিষ্টি ভাণটা করে। পরের রাতে কিংবা বেতনের দিন, সেই একই খদ্দের এমন ভাব করত যেন ওকে চেনেই না; সে গিয়ে তার পয়সার ক্ষমতা এমন মেয়েদের দেখাবে যারা ঝুলিতে ইতিমধ্যেই একগাদা প্রেমিক পুরুষ নিয়ে বসে আছে।
এতে সে ক্ষুদ্ধ হতে লাগলো। অতঃপর প্রতিটি মেয়েকেই প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে এক বিরূপ ভঙ্গি আশ্রয় করে নিলো। বিশেষত, ন্যাগুথি ছিলো সেই কাঁটা যেটা তার ক্ষত থেকে মাংস তুলে আনতো। ন্যাগুথি, অহংকারী আর নির্লিপ্ত, কিন্তু পুরুষগুলো সবসময় ওর আঙিনাতেই; ন্যাগুথি, পুরুষগুলোর সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিত, আর ওকে শান্ত করার জন্য তারা নিয়ে আসত বিভিন্ন উপহার যেগুলো ও গ্রহণ করত নিজের অধিকার হিসেবে। ন্যাগুথিকে কখনো একঘেয়ে লাগত, অস্থির কিংবা ক্রমশ নিম্নগামী চরিত্রের ঝগড়ুটে আর তারপরও পুরুষগুলো গিয়ে এমনভাবে ওর সাথে চিপকে থাকে যেন এক স্বাধীন নারীর তীব্র অসহ্য বাক্য, মুখ ভেংচি আর নিরাসক্ত চোখের চাবুক ওদের প্রভূত আরাম দিচ্ছে। ন্যাগুথিও ছিলো এক যাযাবর পাখি, কখনোই এক জায়গায় স্থির হতে পারেনি, কিন্তু ওর ক্ষেত্রে কারণটা ছিলো বৈচিত্র্য আর উত্তেজনার জন্য ওর ক্ষুধাঃ জয় করার জন্য নতুন মুখ, নতুন অঞ্চল। বিয়েট্রেস এমনকি ওর ছায়াকেও অপছন্দ করত। ও ন্যাগুথির মধ্যে সেই মেয়েটাকে দেখতে পেয়েছিলো যেমনটা ও নিজে হতে চায়, একটা মেয়ে যে কিনা দুটোই, মদ্যশালার সন্ত্রাস ও যৌনতার পাপপুরীতে পুরোপুরি ডুবে গিয়েও ভেসে থাকা একটা মেয়ে। বিয়েট্রেস যেখানেই যাকনা কেন, ন্যাগুথির বিস্তীর্ণ ছায়া আগে বা পরে তাকে অনুসরণ করে চলেই আসে।
ও লিমুরু থেকে পালিয়ে এসেছিলো চিরি বিভাগের ইলমোরগে যাবার জন্য। ইলমোরগ এককালে বেশ একটা ভৌতিক গ্রাম ছিলো, কিন্তু এটি যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে সেই কিংবদন্তী মহিলার কারণে, ন্যাঙ’এনডো, যাকে সমস্ত পপগানের দল তাদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে। সেই ছিলো কারণ যার জন্য তরুণ মুত্থু আর মুচুন জি’ওয়া নেচে নেচে গেয়েছিলোঃ
ইলমোরগের জন্য যখন নাইরোবি ছাড়লাম
জানতে পারিনি কখনো,
আমি ধারণ করব এই বিস্ময় সন্তান আমার
ন্যাঙ’এনডো।

ফলস্বরূপ, ইলমোরগ সবসময়ই ছিলো একটা আশা জাগানিয়া শহর যেখানে তৃষ্ণার্ত আর নিপীড়িতরা পাবে বিশ্রাম আর তাজা পানির খোঁজ। কিন্তু আবার, ন্যাগুথি ওর পিছনে পিছনে চলেই এলো।
ও দেখলো যে কিংবদন্তী কিংবা নাচ গান সত্ত্বেও লিমুরু থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। ও বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করলো। কাপড়? কিন্তু এমনকি এখানেও সে নিজের জন্য ঝলমলে কাপড় কেনার মত যথেষ্ট আয় করতে পারলোনা। একমাসে পঁচাত্তর শিলিং, তাও ঘরভাড়া ছাড়াই, এটা কি পোশো নাকি, মানে বেকার প্রেমিক? ততদিনে আম্বি ইলমোরগে পৌঁছেছে, আর বিয়েট্রেস ভাবলো এই এক সমাধান হতে পারে। সে কি লিমুরুতে তার চেয়েও কালো মেয়েদের ওই ত্বক সাদা করা ক্রিমগুলো মেখে রাতারাতি কালো কাউয়া থেকে সাদা রাজহংসে পরিণত হতে দেখেনি? আর পুরুষেরা তাদের জন্য যেন হা করে থাকে, বুক ফোলানো গর্বের সাথে তাদের নবজন্ম হওয়া প্রেমিকাদের সম্পর্কে বলে। পুরুষ অদ্ভুত প্রাণী, এসবের ব্যাখ্যা খুঁজতে খুঁজতে বিয়েট্রেস ভাবে। তারা আম্বি, বুটন, ফায়ারস্নো, মুনস্নো, পরচুলা, টান চুল এগুলোর ব্যাপারে সমানে বিষোদগার করত; অথচ তারা ওই আম্বি মেখে সাদা করা ত্বক আর ইউরোপীয় বা ভারতীয় চুলের অনুকরণে করা পরচুলা মাথায় দেয়া মেয়েগুলোর পেছনেই ছুটতো। বিয়েট্রেস কখনো চেষ্টা করেনি নিজের এই কালো সত্তাটাকে ঘৃনা করার মূল কারণ খুঁজে বের করতে, সে সাধারণভাবেই এই স্ববিরোধীতাকে মেনে নিয়েছে আর যেন কিছুটা প্রতিহিংসা নিয়েই নিজেকে আম্বির কাছে সমর্পণ করেছে। তার এই লজ্জাজনক কালো রঙ তাকেই ঘষে সাদা করতে হবে। কিন্তু এমনকি খুব বেশি আম্বি কেনার সামর্থ্যও তার ছিলোনা ; সে ওটাকে শুধু তার মুখ আর হাতেই লাগাতে পারত, যার কারণে তার পা আর ঘাড় কালোই রয়ে যেত। এছাড়াও তার মুখমণ্ডলের কিছু জায়গাও ছিলো যেখানে তার হাত ঠিকঠাক পৌঁছাত না — কানের পেছনে কিংবা চোখের পাপড়ির ওপর, আর এটা ছিলো তার আম্বিমাখা ব্যক্তিত্বের পক্ষে এক সার্বক্ষণিক লজ্জা আর যন্ত্রনার উৎস।
এই আম্বি মাখার সময়কালটা তার বিশেষভাবে মনে থাকবে তার পরবর্তী বৈভবের মুহূর্ত আসার আগ পর্যন্ত তার গভীর অপমানের স্মৃতির অন্যতম হিসেবে। সে কাজ করছিলো ইলমোরগের স্টারলাইট মদ্য ও অতিথিশালায়। ন্যাগুথি তার বালা পরা হাত আর বিরাট দুল পরা কান নিয়ে কাউন্টারের পেছন থেকে পরিবেশন করত। এখানকার মালিক ছিলো এক ভদ্র খ্রীস্টান লোক যে কিনা প্রতিদিন গির্জায় যেত আর সমাজসেবামূলক কাজের টাকা পরিশোধ করত। ভুড়িওয়ালা। ধূসর চোখ। নরম ব্যবহার। একজন সম্মানিত সংসারী ব্যক্তি, ইলমোরগে সুপরিচিত। যথেষ্ট পরিশ্রমীও, সে ততক্ষণ অব্দি মদ্যশালা থেকে যায়না যতক্ষণ না ওটা বন্ধ করার সময় আসে, অথবা বলা যায় যতক্ষণ না ন্যাগুথি চলে যায়। সে অন্য কারো দিকে ফিরেও তাকাতো না, ওর চারিপাশেই চক্কর খেত, আর কিজানি কেন ওকে পোশাকের উপহার কিনে দিত, তাও এমনকি একটা ভদ্রগোছের ধন্যবাদ পর্যন্ত পেত না। কেবল এক প্রত্যাশা ছাড়া, এক আগামীর প্রত্যাশা। অন্য মেয়েদের সে মাসে আশি শিলিং করে দিতো। ন্যাগুথির একটা নিজের কামরা ছিলো। ও তখনই ঘুম থেকে উঠতো যখন ওর তহবিলের ভার নিতে মন চাইতো। কিন্তু বিয়েট্রেস আর অন্য মেয়েদের পাঁচটায় উঠতে হত, অতিথিশালার লোকেদের জন্য চা বানাতে হত, মদ্যশালা আর বাসনকোসন পরিস্কার করতে হত। তারপর তারা মদ্যশালায় বদলি কাজ করত দুপুর দু’টো অব্দি, তারপরে ছোট একটা বিরতি নিয়ে পাঁচটা থেকে আবার শুরু, তখন আবার তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে খদ্দেরদের জন্য ফেনাওয়ালা বিয়ার আর সুন্দর হাসি নিয়ে, রাত বারোটা কিংবা তারও বেশি সময় অব্দি যতক্ষণ না খদ্দেরদের টাস্কার আর পিলসনারের চাহিদা মেটে। যেটা মাঝেমধ্যেই বিয়েট্রেসকে বিরক্ত করত সেটা হলো মেয়েদের স্টারলাইটেই রাত কাটাতে মালিকের আরোপিত নিয়ম, অবশ্য ওর ক্ষেত্রে এটা হলে না হলে কিছুতেই ওর কোনো সমস্যা ছিলোনা। নইলে ওরা কাজে আসতে দেরী করবে, মালিক বলে। কিন্তু সে মূলত চাইতো মেয়েদের শরীর ব্যবহার করে রাতে অতিথিশালায় থাকার জন্য আরও খদ্দের টানতে। ন্যাগুথির নেতৃত্বে, বেশিরভাগ মেয়েরাই এই নিয়ম ভাঙতো আর দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে ভেতর বাহির করতো। তারা তাদের স্থায়ী বা এক রাতের প্রেমিকদের সাথে দেখা করতে চাইতো এমন এক জায়গায় যেখানে তারা স্বাধীন আর যেখানে তাদের শুধুমাত্র মদ্যশালার মেয়ে হিসেবে দেখা হয়না। বিয়েট্রেস সবসময় ভেতরেই ঘুমাতো। তার প্রায় দুষ্প্রাপ্য এক রাতের পোষকেরা খুব বেশি খরচ করতে চাইত না। এক রাত এমন এসেছিলো যখন মালিক ন্যাগুথির কাছে পাত্তা না পেয়ে তার কাছে এসেছিলো। সে শুরু করলো তার কাজের ভুল ধরা দিয়ে ; তারপর তাকে গালি দিতে লাগলো, তারপর হঠাৎই তার প্রশংসা করতে লাগলো, অবশ্য যদিও এক বিরক্তিকর অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে। সে তাকে টেনে ধরলো, যেন কুস্তি করতে লাগলো, ভুড়িওয়ালা পেট, ধূসর চুল, আর বাকিসব। বিয়েট্রেসের লোকটার সম্পর্কে ধারণায় আচমকাই পরিবর্তন এলো। এই কিছু সময় আগেই ন্যাগুথির সরিয়ে দেয়া জিনিসকে কিছুতেই সে কাছে টেনে নেবেনা, নিতে পারবেনা। হে ঈশ্বর! সে ভেতরে ভেতরে বিলাপ করলো, ন্যাগুথির এমন কি আছে যা আমার নেই! লোকটি এবার নিজেকে তার সামনে অপমানিত করলো। সে মিনতি করলো, তাকে উপহারের প্রতিশ্রুতি দিলো। কিন্তু সে নিজেকে সমর্পন করলোনা। সেই রাতে সে নিজেই নিয়ম ভাঙলো। সে একটা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালালো; আরেকটা মদ্যশালায় গিয়ে বিছানা পাতলো আর ফিরে এলো সেই সকাল ছয়টায়। মালিক সবার সামনে তাকে ডাকলো আর তাকে চাকরি থেকে বার করে দিলো। কিন্তু বিয়েট্রেস বরং নিজের কর্মকাণ্ডে অবাকই হলো।
একমাস সে কোনো চাকরি ছাড়াই কাটালো। সে অন্যান্য মেয়েদের খামখেয়ালি দয়ার ওপর নির্ভর করে একেকদিন একেকজনের কামরায় দিন কাটাতে লাগলো। ইলমোরগ ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে আবার নতুন করে সব শুরু করবার মত মনের অবস্থা তার ছিলোনা। ক্ষতে জ্বালা ধরে গিয়েছিলো। সে জায়গা বদলাতে বদলাতে ক্লান্ত। সে আম্বি ব্যবহার করাও বন্ধ করে দিলো। টাকা নেই। সে নিজেকে আয়নায় দেখলো। তাকে কেমন বয়স্ক লাগছে, টেনেটুনে এক বছর হয়ত হয়েছে তার ঈশ্বরের কৃপাবঞ্চিত জীবনের। তখন সে কেন অমন খুঁতখুঁতে ছিলো, সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু যেভাবেই হোক, তার একটা ভয় ছিলো উপযাচক হয়ে প্রেমিক আকর্ষণ অথবা সরাসরি নিজের শরীর দেখিয়ে টাকা উপায়ের ব্যাপারে। সে চাইত কেবল একটা ভদ্রগোছের কাজ আর এক বা একাধিক পুরুষ যারা তার সত্যিকারের পরোয়া করবে। হয়ত তার আসল প্রয়োজন ছিলো একজন পুরুষ, একটা ঘর আর একটা শিশু, তার পাশে, তার বিছানায়। হয়ত এই প্রত্যাশাই ছিলো সেই ভয় যা মদ্যশালার নারীদের থেকে অন্যকিছু চাওয়া পুরুষদের তাড়িয়ে দিত। সে রাতের গভীরে কাঁদত আর বাড়ির কথা মনে করত। এসব সময়ে তার মায়ের বাড়ি নায়েরি তার কাছে ঈশ্বরের সৃষ্ট সবচেয়ে সুন্দর জায়গা বলে মনে হত। সে তার গ্রাম্য বাবা মায়ের জীবন অমিত সুখ সঙ্গতির রোমাঞ্চকর কল্পনায় ভরিয়ে দিতে চাইতো। তার মনে প্রবল ইচ্ছা জাগত বাড়ি ফিরে গিয়ে তাদের দেখে আসতে। কিন্তু সে খালি হাতে কিভাবে ফিরে যেতে পারে? যাই হোকনা কেন, ওই জায়গাটা এখন তার স্মৃতিতে এক দূরবর্তী দিগন্ত ছাড়া আর কিছু নয়৷ তার জীবন ছিলো এখানে, এই সাথীহারা অপরিচিত ভীড়ের মাঝে। ঈশ্বরের কৃপা থেকে পতিত, চরমভাবে। সে ওই প্রজন্মের অংশ ছিলো যারা কখনোই ঠিক মাটি, শষ্য, বাতাস কিংবা চাঁদের হয়ে উঠতে পারেনি। তার মনে পড়ে তার গ্রামের সেই মেয়েটির কথা, যার কিনা একটা বেশ চাকচিক্যের জীবন ছিলো, একের পর এক ধনী পুরুষ লিমুরুতে তাকে রক্ষিতা করে রাখত, যে কিনা পরে আত্মহত্যা করেছিলো। এই প্রজন্ম মৃত্যুর রহস্যময় জগতের ব্যাপারে দ্বিধাহীন, একইভাবে জীবনের মায়ার ব্যাপারেও অনুভূতিশুন্য ; যেমন কয়জন অবিবাহিত মা আছে যারা জীবনের সেই চাকচিক্য হারানোর বদলে বাচ্চা ল্যাট্রিনে ছুড়ে দেয়াকে বেছে নেবে? মেয়েটার মৃত্যু হাস্যরসে পরিণত হয়েছিলো। মেয়েটার মোক্ষলাভ হয়েছে – কোনো কষ্ট ছাড়াই, সবাই বললো। তারপর, প্রায় এক সপ্তাহের জন্য, বিয়েট্রেসও একই কাজ করার কথা ভাবলো। কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করতে পারলোনা।
তার ভালোবাসা প্রয়োজন ছিলো, জীবনের প্রতিও লোভ ছিলো।
ইলমোরগে একটা নতুন মদ্যশালা খোলা হলো। ট্রিটপ মদ্যশালা, সরাইখানা ও রেস্তোরাঁ। ট্রিটপ নামের কারণ বিয়েট্রেস বুঝলোনা, কারণ পুরোটাই ছিলো ইটকাঠের ভবনঃ নিচতলায় চায়ের দোকান, আর একদম ওপরে মদের দোকান। আর মাঝখানে সব ঘর ছিলো পাঁচ মিনিট থেকে একদিন অব্দি থাকার জন্য সরাইখানা। মালিক ছিলো একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী যে কিনা এখনও রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলো। লোকটি ছিলো বিরাট ধনী, কেনিয়ার প্রত্যেকটি বড় শহরে তার ব্যবসা প্রসারিত ছিলো। সারা দেশ থেকে বড় বড় হোমরাচোমরারা তার কাছে আসতো, বেশিরভাগ সময়ই রাজনীতির কথা হত আর তাদের কাজের কথা। তারা তর্ক করত, ঝগড়া করত, মাঝেমধ্যে হাতাহাতিও লেগে যেত। কিছু প্রসঙ্গেই তারা একমত হত, যেমন লুও সম্প্রদায় কেনিয়ার সব সমস্যার মূল; বুদ্ধিজীবী আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সুবিধার স্বর্ণশিখরে বাস করে; উন্নয়নে কিয়াম্বুর অংশ সিংহভাগের চেয়েও বেশি; নায়েরি আর মুরুঙ্গা থেকে আসা লোকেরা নাইরোবির সব বড় ব্যবসা দখল করে নিলো আর ওরা চিরি জেলার দিকেও এগিয়ে আসছে; আর আফ্রিকান মজুর, বিশেষত কৃষকগুলো, হিংসায় মরে যাচ্ছে ‘তাদের’ দেখে কারণ তারা প্রভূত উন্নতি করেছে। অথবা তারা নিজেদের প্রশংসা প্রতিপ্রশংসায় ব্যস্ত থাকত। মাঝেমধ্যে তো মদ্যপ অবস্থায় প্রশংসার বানে ভেসে মদ্যশালার সবাইকে দুটো করে বিয়ার দান করত, ইলমোরগের গরীব লোকেরাও সেই আশায় ট্রিটপের ফটকের সামনে এসে বসে থাকতো।
এখানে বিয়েট্রেস চাকরি পেলো একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আর ঘর গোছানোর লোক হিসেবে। কিছুদিন তার বেশ ভালোই বোধ হলো। এখানে সে সেসব লোকেদের ঘর গোছাতো যাদের এতদিন সে শুধু নামই শুনেছে। কিন্তু শীঘ্রই তার কপাল ঘুচে গেলো। অন্যান্য মদ্যশালা থেকে মেয়েরা ট্রিটপে চলে এলো, যাদের সে লিমুরুতে দেখেছে, ইলমোরগে দেখেছে। আর বেশিরভাগই বিভিন্ন ধনী লোকেদের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেললো। আর ন্যাগুথিকেও দেখা গেলো, কাউন্টারের পেছনে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ধনী গরীব সবার নজর কেড়ে নিয়ে বসে আছে। এদের উপস্থিতিতে বিয়েট্রেসের মত পরিচ্ছন্নতাকর্মী আরও অদৃশ্য হয়ে উঠলো। ভাগ্য জয় করা মেয়েগুলো তাকে পাত্তাই দিলোনা৷
সে স্বপ্নমাখা চোখে জীবন নিয়ে যুদ্ধ করছিলো। সে স্বপ্ন দেখত প্রেমিকের যারা স্রেফ দুজনের জন্য তৈরি মার্সেডিজ গাড়িতে চড়ে আসবে। সে নিজেকে কল্পনা করে এমন এক প্রেমিকের হাত ধরে সে যাচ্ছে, নাইরোবি আর মোম্বাসার রাস্তা ধরে, উঁচু জুতোয় টপটপ শব্দ তুলে, জোরে কিন্তু ছোট পদক্ষেপে৷ সে আর কখনোই তখন ছেড়া পোশাক সেলাই করবেনা৷ সে হবে বিভিন্ন রকমের পরচুলার গর্বিত মালকিন। তাহলেই না, সমস্ত দুনিয়া এই এক বিয়েট্রেসের নামে জয়ধ্বনি দেবে। তখন সে আর সামান্য পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকবেনা, পাঁচ মিনিটের রাসলীলার জন্য বিছানা তৈরি করবেনা। তখন সে হবে সেই বিয়েট্রেস, ওয়াংগু মাকেরির উত্তরসূরী যে কিনা চাঁদের আলোয় নগ্ন শরীর দেখিয়ে তার প্রেমিকদের কামে অচেতন করে ফেলত, ন্যাঙ’এনডোর মেয়ে যে কিনা আধুনিক ইলমোরগের রূপকার, যার কথা এখনও কিংবদন্তি যে সে তার বেশ কিছু প্রেমিকদের কাম তাড়নায় নপুংসকে পরিনত করেছিলো।
তারপর একদিন সে তাকে দেখলো, তার স্বপ্নের প্রেমিকের একদম বিপরীত। সে এক শনিবারে এলো একটা বিরাট পাঁচটনি ট্রাক চালিয়ে। সে খুব সাবধানে দামী গাড়িগুলোর পাশে ওটাকে থামালো, একটা ট্রাক হিসেবে না, যেন ওটাও কোনো বেশ দামী কোম্পানির গাড়ি। তার গায়ে ছিলো একটা ধূসর স্যুট আর তার উপরে একটা মিলিটারি খাকি ওভারকোট। সে ওভারকোটটা খুলে সামনের সিটে রাখলো, বেরিয়ে ট্রাকের দরজা বন্ধ করলো আর ট্রাকটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলো যে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন আছে কিনা। ট্রিটপে ঢোকার শেষ মূহুর্তেও সে ঘুরে একবার দেখে নিলো যে তার ট্রাক জায়গামতো ঠিক আছে কিনা। সে এক কোণায় বসে কেনিয়ার দেশী মদ অর্ডার দিয়ে পরিচিত মুখ খুঁজতে লাগলো। সে এক বেশ নামডাকওয়ালা লোককে চিনতে পারলো আর চট করে তার জন্য এক বোটল ভ্যাট ৬৯ মদের অর্ডার দিলো। লোকটি মাথা নাড়িয়ে একটা আস্কারামূলক হাসির মাধ্যমে মদটা গ্রহণ করলো, কিন্তু তার সাথে কথা এগোতে গিয়ে ট্রাকওয়ালা বিশেষ পাত্তা পেলোনা। সে বিব্রত হলো, একটু দমে গেলো, কিন্তু শুধু একটু ক্ষণের জন্যই। সে আবার চেষ্টা করলো, কিন্তু বদলে তাচ্ছিল্যই পেলো। হাসিতামাশার ক্ষেত্রে তো সে আরও বাজেভাবে ব্যর্থ হলো। সে একাই জোরে জোরে হাসতে লাগলো আর বাকি সবাই চুপ করে গেলো। সেই সন্ধ্যায় কিছু পরে সে উঠলো, কিছু কড়কড়ে একশ শিলিংয়ের নোট গুনে কাউন্টারে ন্যাগুথির কাছে রাখতে দিলো। লোকেরা ফিসফিস শুরু করলো, কেউ ব্যঙ্গের হাসি হাসলো, কিন্তু সত্যি বলতে তারা প্রভাবিত হয়েছিলো। কিন্তু এই ব্যাপারটা তাকে সাথে সাথেই আলোচনায় নিয়ে আসেনি। সে ঝিমুতে ঝিমুতে ভাড়া নেয়া ৭ নং ঘরের দিকে চললো। বিয়েট্রেস তার জন্য চাবি নিয়ে এলো, সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখলো, তারপর সব উৎসাহ হারিয়ে ফেললো।
তারপর থেকে সে প্রতি শনিবারেই আসতে শুরু করলো। সে আসত, কোণায় বসত, আর ৭ নং ঘরটা ভাড়া নিত। বিয়েট্রেস নিজের অজান্তেই তার আসার জন্য অপেক্ষা করত আর ঘরটা গুছিয়ে রাখতো। প্রায়ই বড়লোকদের কাছে বাজেভাবে অপমানিত হবার পর সে বিয়েট্রেসের সাথে কথা বলত অথবা বলা চলে বিয়েট্রেসকে সামনে রেখে নিজের সাথেই কথা বলত। তার জীবনটা ছিলো সংগ্রামের। শিক্ষার ব্যাপারে উচ্চাশা থাকা সত্ত্বেও সে কোনোদিন স্কুলে যেতে পারেনি, সুযোগই পায়নি। তার বাবা রিফট ভ্যালিতে ইউরোপীয় দখলদারদের হয়ে জমি দখলের কাজ করত। ঔপনিবেশিক দিনগুলোতে সেটা অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। ব্যাপার এই ছিলো যে যারা ওই কাজ করে তাদের আর তাদের সন্তানদের জীবন ধ্বংস হয়ে যায় ওই সাদা কুত্তা আর ওদের সন্তানদের জন্য খাটতে খাটতে। সে বিদ্রোহ করেছিলো, সংশোধনাগারে গিয়েছিলো, সেখান থেকে ফিরে এসেছিলো একেবারে অন্যরকম হয়ে। হওয়ার মধ্যে হলো এই যে বড় চাকরি করার মত কোনো শিক্ষাই সে লাভ করতে পারলোনা। সে কয়লার কাজ থেকে শুরু করলো, তারপর কসাইয়ের কাজ, তারপর পদে পদে কাজ করতে করতে এখন সে রিফট ভ্যালি থেকে চিরি জেলা হয়ে নাইরোবিতে সবজি আর আলু নিয়ে যাওয়ার একজন বড় পরিবহন মালিক। সে তার সাফল্যে বেশ গর্বিত ছিলো। সে সেসব পুরনো দিনের কথা বলত, পড়াশোনা করতে পারলে কি হত তা বলত, তার সন্তানদের শিক্ষার জন্য ভালো বন্দোবস্ত করার কথাও বলত। তারপর সন্তর্পণে তার টাকাগুলোকে গুণে বালিশের তলায় রাখত, তারপর বিয়েট্রেসকে বিদায় করে দিত। কখনো কখনো তাকে একটা বিয়ার কিনে দিত, কিন্তু পয়সালোভী হিসেবে চেনা মেয়েদের সে বেশ সন্দেহের চোখেই দেখে। অবশ্য তার কারণ তার এখনো বিয়ে হয়নি।
একরাতে সে বিয়েট্রেসের সাথেই ঘুমালো। সকালে উঠে সে তাকে একটা চকচকে বিশ শিলিংয়ের নোট ধরিয়ে দিলো। বিয়েট্রেস একটু ইতস্তত করে টাকাটা নিলো। বেশ কিছুদিন লোকটা এমনই করলো। বিয়েট্রেসের টাকা নিয়ে সমস্যা ছিলোনা, টাকাটা তার কাজেই লাগত। কিন্তু লোকটা এমনভাবে ওর শরীরের জন্য টাকা দিত যেন কোনো আলুর বস্তার দাম দিচ্ছে। সে তার অহমিকায় বিরক্ত হত, বিরক্ত হত তার একঘেয়ে প্রলাপে। কিন্তু তবু, কিছু একটা যেন ছিলো, একটু আগুন, একটা বীজ, একটা ফুল, গহীনে, জায়গা করে নিচ্ছিলো। সে তার মধ্যে তার মতই এক অসহায় ত্রস্ত হরিণকে খুঁজে পেয়েছিলো যার আশায় পথ চেয়ে বসে থাকা যায়। সে আশা করত এমন একজনের যে তাকে বুঝবে।
আর তারপর সে ওই কাজটা একদিন করলো, কথার মাঝখানে চুপ করিয়ে দিলো। সে জানেনা সে কেন এটা করেছে। হয়ত বাইরের বৃষ্টিটাই কারণ ছিলো। সে লোকটাকে শোনাতে চাইলো, তাকে শুনতেই হলো। সে কারাতিনা থেকে নায়েরিতে এসেছে। ব্রিটিশ সৈনিকেরা তার দুটো ভাইকে গুলি করে মেরেছে। আরেকজন মারা গেছে আটক অবস্থায়। তার বাবা মা গরীব, সেই হয়ে পড়লো একমাত্র সম্বল। তারা তাদের যৎসামান্য জমি চাষ করে তার পড়াশোনার খরচ যোগাতো। প্রাইমারির প্রথম ছয় বছর সে খুব পরিশ্রম করলো, তারপরের বছর হঠাৎ কি হলো, হয়ত সেই পরিশ্রম কম করেছিলো, তার ফলাফল একটু খারাপ হলো। তারচেয়েও খারাপ ফলাফল নিয়ে ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন হাইস্কুলে লোকজন ধরাধরি করে পড়তে চলে গেলো। তার কোনো পরিচিতও ছিলোনা, হারাম্বি স্কুলে দেয়ার মত তার বাবা মায়ের টাকাও ছিলোনা। সে বাড়িতেই রইলো, বাবা মাকে সাহায্য করতে লাগলো। কিন্তু এই ছয় বছরের লক্ষ্য থেকে তার জীবন হঠাৎই যেন এক ভিন্ন খাতে চলে গিয়েছিলো। সে প্রায়ই কারাতিনা থেকে নায়েরি যেত কাজের খোঁজে। কিন্তু সব জায়গায় একই প্রশ্ন, কি জানো তুমি? টাইপরাইট? শর্টহ্যান্ড? সে হতাশ হয়ে পড়লো। এভাবেই একবার নায়েরিতে, সে একটা দোকানে বসে ফান্টা খাচ্ছিলো, চোখে পানি, তার দেখা হলো কালো স্যুট আর সানগ্লাস পরা এক ছেলের সাথে। সে তাকে দেখে এগিয়ে এলো, নাইরোবি থেকে এসেছিলো সে। চাকরি দরকার? সে তো সহজ, বড় শহরে কাজের কোনো অভাব নেই৷ সে সাহায্য করতে পারবে। গাড়ি? তার গাড়ি ছিলো বৈকি, একটা ঘিরঙা পগেট। সে তাকে টেরেস বারে নিয়ে গেলো। ভ্রমনটা বেশ ভালোই ছিলো। তারা বিয়ার খেলো আর নাইরোবি নিয়ে কথা বললো। জানালা দিয়ে সে নিয়ন আলোর শহর দেখলো আর ভাবলো এখানে আশা আছে। ওইরাতে সে নিজেকে ওই লোকটার কাছে সঁপে দিলো, এক নতুন সকালের আশায়। বেশ একটা গভীর ঘুম হয়েছিলো তার। সকালে উঠে সে আর লোকটিকে দেখতে পেলোনা, কখনোই না। এভাবেই সে একজন মদের দোকানের মেয়ে হিসেবে নিজের জীবন শুরু করেছিলো আর তারপর এই দেড় বছরে সে একবারও বাবা মায়ের কাছে যায়নি। বিয়েট্রেস কাঁদতে শুরু করলো। তার ক্ষতগুলো তাজা ছিলো। এই জীবন তার ভালো লাগেনা, কিন্তু সে আটকে পড়েছে। সে হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। তারপর হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলো। তার কান্না হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। লোকটা বহু আগেই নিজেকে কম্বলে ঢেকে নিয়েছে। তার জোরে জোরে নাকডাকা শুনতে ভুল হবার মত নয়।
এক অদ্ভুত শুন্যতা তাকে ঘিরে ধরলো। হা ঈশ্বর! এই কি সে প্রতি শনিবারে যার দুঃখের গল্প আমি শুনে বেড়াই? এই কি সে যাকে আমি আমার সমব্যথী ভেবেছি? অবশ্য সে তার সেবা টাকা দিয়ে কিনেছে, তার বিলাপ ওই লোকটির ঘুমপাড়ানি গান হয়েছে। হঠাৎই কিছু একটা তার মধ্যে জ্বলে উঠলো। এই দেড় বছরের সমস্ত রাগ, অপমান, তিক্ততা এই লোকটির উপর কেন্দ্রীভূত হলো।
তারপর সে যা করলো তা করতে বেশ পাকা হাতের দরকার হয়।
বিয়েট্রেস লোকটার চোখ স্পর্শ করলো, গভীর ঘুমন্ত চোখ। তারপর সে তার মাথাটা তুলে ধরলো, তারপর পড়ে যেতে দিলো। তার চোখগুলোতে এখন পাষাণ তীব্রতা। মাথার নিচ থেকে বালিশ সরিয়ে সে তার টাকা বের করে আনলো। গোলাপি নোটগুলো গুনে সে তার কাঁচুলির ফাঁকে লুকিয়ে রাখলো।
সে ৭ নং ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বাইরে তখনো বৃষ্টি হচ্ছিলো। তার নিজের সরু ঘরটায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলোনা। মাটিকাদা বৃষ্টি পেরিয়ে সে চলছিলো ন্যাগুথির ঘরের দিকে। সে দরজায় ধাক্কা দিলো, প্রথমে চুপচাপ, তারপর ন্যাগুথির ঘুমজড়ানো কণ্ঠ শোনা গেলো।
– কে?
– আমি, একটু খোলো।
– কে?
– বিয়েট্রেস
– এত রাতে?
– খোলো, দয়া করে।

আলো জ্বলে উঠলো। দরজা খুলে গেলো। ন্যাগুথির গায়ে একটা স্বচ্ছ রাতপোশাক, গলায় উদ্বেগ।
– কিছু হয়েছে বিয়েট্রেস?
– আমি কি কিছুক্ষণ বসতে পারি? আমি ক্লান্ত, আর তোমার সাথে কথাও বলতে চাচ্ছিলাম।
– কিন্তু কি হয়েছে?
– আমি শুধু একটা প্রশ্ন করতে চাই ন্যাগুথি!

তারা দুজনেই তখনো দাঁড়িয়েই ছিলো, এই পর্যায়ে দুজনেই বিছানায় বসলো।
– তুমি বাড়ি কেন ছেড়েছিলে ন্যাগুথি?
কিছু নিস্তব্ধ মুহুর্ত কাটলো। বিয়েট্রেস উত্তরের অপেক্ষায় বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর যখন ন্যাগুথির গলা শোনা গেলো সেটা বেশ অস্থির শোনাচ্ছিলো।
– এটা বেশ লম্বা কাহিনি, বিয়েট্রেস। আমার বাবা মা বেশ ধনী ছিলো। তারা বেশ ধার্মিকও ছিলো। আমরা বেশ শৃঙ্খলার মধ্যেই জীবনযাপন করতাম।নাস্তিকদের সাথে হাটবেনা, মূর্তি পূজারিদের সাথে মিশবেনা, এই সেই। কখন কিভাবে কি খেতে হবে, এমনকি তার জন্যও নিয়মকানুন ছিলো। ধার্মিক মেয়েদের মত হাটতে হবে, ছেলেদের সাথে যেন কখনোই আমাকে দেখা না যায়। নিয়ম আর নিয়ম। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার বদলে আমি আর আমার মতই আরেকটা মেয়ে ইস্টলেঘ থেকে পালিয়ে আসি। সেই থেকে এই পর্যন্ত, চার বছর হয়ে গেলো আমি বাড়ি যাইনি। এইত!”

তারপর আবার স্তব্ধতা, তারপর তারা একজন আরেকজনের দিকে পরিচিত ভঙ্গিতে তাকালো।
– আরেকটা প্রশ্ন ন্যাগুথি, আমার সবসময় মনে হত তুমি আমায় ঘৃণা করো, আমাকে এড়িয়ে চলো।
– না না বিয়েট্রেস। ঘৃণা নয়। আসলে কোনোকিছুই আমাকে আর আগের মত টানেনা, এমনকি পুরুষমানুষও নয়। সবকিছু খুব একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। হ্যা, আমি চাই, আমার ওই ক্ষণিকের উত্তেজনাটুকু দরকার, ওই মিথ্যে মন রাখার জন্য বলা মিষ্টি কথাগুলো দরকার। কিন্তু তুমি, তুমি এসবের অনেক উপরে, তোমার ভিতরে তুমি এমন কিছু ধারণ করে আছ, যা আমি পারিনা।
বিয়েট্রেসের কষ্ট হলো চোখের পানি ধরে রাখতে।
পরেরদিন খুব ভোরে সে নাইরোবিগামী একটা বাসে উঠে বসলো। সে বাজারের মধ্যের পথ দিয়ে হেটে গেলো দোকান দেখতে দেখতে। তারপর সরকারি রাস্তায়, কেনইয়াট্টা এভিনিউতে। হোসেন সোলেমানি সড়কের এক দোকান থেকে সে বেশ কয়েক জোড়া মোজা কিনলো আর একজোড়া পরেও নিলো। তারপর একটা নতুন জামা কিনে সে সেটাও পরে নিলো। তারপর কাছেই একটা বাটার দোকানে গিয়ে একজোড়া উঁচু হিল জুতা কিনে পরে নিয়ে তার পুরনো জুতা ফেলে দিলো। তারপর সে কিনলো নতুন কানের দুল। একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে তার নতুন রূপ দেখে নিলো। হঠাৎই তার একটা ক্ষুধাবোধ হচ্ছিলো, যেন আজকের দিনটার জন্য সে তার পুরোটা জীবন ক্ষুধার্ত ছিলো। মোতি মহলে ঢুকতে সে একটু ইতস্তত করলো, তারপর হেটে এগিয়ে গিয়ে ঢুকলো ফ্রান্সেই তে। তার চোখে এখন সেই চমক ছিলো যেটা পুরুষদের তার দিকে আকৃষ্ট করছিলো। সে শিহরিত হলো। একটা কোণার দিকের টেবিলে বসে সে ভারতীয় তরকারির হুকুম দিলো। একটা লোক নিজের টেবিল ছেড়ে তার সাথে যোগ দিলো। সে তার দিকে তাকিয়ে দেখলো, জ্বলজ্বলে চোখ, কালো স্যুট পরা সেই লোকটার চোখে ভেসে উঠেছে কামনা। লোকটি তাকে একটা মদ কিনে দিলো, তার সাথে ভাব জমাতে চাইলো, কিন্তু সে চুপচাপ খেয়েই গেলো। লোকটি টেবিলের নিচ দিয়ে হাত এগিয়ে তার হাঁটু ছুঁয়ে দিলো, সে কিছুই বললো না। তারপর আরেকটু এগিয়ে লোকটি তার জঙ্ঘায় হাত রাখলো, তখন সে হঠাৎ তার আধখাওয়া খাবার এবং একদম না ছোঁয়া মদ ফেলে রেখে উঠে চলে যেতে লাগলো। তার বেশ ভালো লাগছিলো। লোকটি তার পেছন পেছন এলো। সে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলো। কিছুটা পথ লোকটি তার পাশে পাশে চললো, সে নিজের মনে হাসলো কিন্তু ফিরেও তাকালো না। লোকটি মনোবলই হারিয়ে ফেললো, এক হতাশ দৃষ্টি নিয়ে কাচের ওপার থেকে দেখলো তার চলে যাওয়া। ইলমোরগ যাবার বাসে লোকেরা তাকে দেখে জায়গা ছেড়ে দিতে লাগলো, সে এসব উপভোগ করলো অধিকারের মত করে। ট্রিটপে পৌঁছে সে সোজা কাউন্টারে চলে গেলো। বড় বড় মানুষের স্বাভাবিক ভিড়টা তখন সেখানেই ছিলো, তার আগমনে তারা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো। তাদের কামাতুর চোখ তার দিকেই নিবদ্ধ রইলো। এমনকি ন্যাগুথিও তার উদাস ভাবটা বজায় রাখতে পারলোনা। ম্যানেজার তার কাছে দৌড়ে এলো, কথা জমানোর চেষ্টা করলো। সে কাজ কেন ছেড়ে দিলো? সে কোথায় ছিলো? সে কি এখনও কাজ করতে আগ্রহী কিনা, সে চাইলে ন্যাগুথিকে কাউন্টারের কাজেও সাহায্য করতে পারে? এক পরিবেশক তাকে একটা চিরকুট এনে দিলো। বেশ পরিচিত বড় মানুষদের একজন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের টেবিলে গিয়ে বসতে। এমন আরও কিছু চিরকুট এলো, রাতে কি তার অবসর হবে? একটা নাইরোবি যাওয়ার প্রস্তাবও এলো। সে কাউন্টার ছেড়ে নড়লোনা, কিন্তু সে তাদের দেয়া মদগুলো গ্রহণ করলো, অধিকার হিসেবে। সে এক নতুন শক্তি অনুভব করলো, এক নতুন আত্মবিশ্বাসও
সে একটা শিলিং বের করে গানের বাক্সের গর্তে ফেললো আর বাক্সটা ধুম করে বেজে উঠলো রবিনসন মোয়াংগির হুনউ ওয়া মাসাম্বানি গানে। তারপর সে একটা কামারু আর ডিকে গান বাজালো। লোকগুলো তার সাথে নাচতে চাইছিলো। সে তাদের উপেক্ষা করছিলো, কিন্তু একইসাথে তাদের তোষামোদ উপভোগও করছিলো। সে আরেকটা ডিকে গানের তালে পাছা দোলাতে লাগলো। তার শরীর ছিলো স্বাধীন। সে বাতাসে মিশে থাকা উত্তেজনা আর দ্বিধা শুষে নিতে লাগলো।
তারপর হঠাৎই ছয়টার দিকে ট্রাকওয়ালা লোকটা হন্তদন্ত হয়ে বারে এসে ঢুকলো। তার গায়ে ছিলো তার মিলিটারি ওভারকোট। তার পেছনে ছিলো পুলিশের লোক। সে চারিদিকে তাকালো। বারের সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু বিয়েট্রেস পাছা দোলানোতেই মগ্ন ছিলো। প্রথমে সে গানের বাক্সের পাশে বৈভবের কিছু মুহুর্ত উদযাপনে নাচতে থাকা বিয়েট্রেসকে চিনতেই পারেনি। তারপর সে যেন জয়ের আনন্দে চিৎকার করে উঠলো, “এইত সেই! চোর চোর!”
লোকজন সব নিজেদের আসনে এলিয়ে পড়লো। পুলিশ গিয়ে তাকে হাতকড়া লাগিয়ে দিলো। সে বাঁধা দিলোনা। কেবল দরজা অব্দি গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে সে একদলা থুতু ফেললো। তারপর পুলিশের সঙ্গে চলে গেলো।
বারের মধ্যকার স্তব্ধতা হাসির শব্দে খানখান হয়ে গেলো যখন কেউ একজন এটাকে কৌতুক করে মারকাটহীন মিষ্টি ডাকাতি বললো। তারা তার সম্পর্কে আলোচনা করলো। কেউ বললো তাকে মার দেয়া উচিত ছিলো। আর বাকিরা সার্বিকভাবে ‘এসব বারের মেয়েরা’ নিয়ে বললো। কিছু লোক আবার মাথা নেড়ে নেড়ে অপরাধের হার বেড়ে যাওয়া নিয়ে শংকা প্রকাশ করলো। ফাঁসির আইনটা সবধরনের চুরি ডাকাতির ক্ষেত্রেই দেয়া উচিত, নয় কি? আর সবার অজান্তেই ট্রাকের মালিক যেন নায়ক বনে গেলো। তারা তাকে ঘিরে ধরলো আর পুরো ঘটনা শুনতে চাইলো। কেউ আবার তাকে মদও কিনে দিলো। তারচেয়েও বড় ব্যাপার, তারা শুনছিলো, মন দিয়ে শুনছিলো, মাঝেমধ্যে তাদের মনোযোগী স্তব্ধতা হাসিতে ফেটে পড়ছিলো। আর সেই লোকটি, প্রথমবার যাকে এভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, রসিয়ে রসিয়ে গল্পটা বলে যেতে লাগলো।
কেবল কাউন্টারের পেছনে ন্যাগুথি কাঁদলো।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.