বের্না ফ্রিয়ো’র দুটি অণুগল্প । মূল ফরাসি থেকে অনুবাদঃ নূরুল আলম

0

০১
একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে (Un acccident, peut être)

ব্রেস্ট থেকে দ্রুতগামী ট্রেনটির গন্তব্য প্যারিস। মঙ্গলবার সকাল, দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগে… ঠিক ছয় মিনিট বাইশ সেকেন্ড…. নিশ্চিত ভাবে কেউ কিছু সন্দেহ করছেনা, প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শ্রেনীর কেউনা। মোট দুইশ একষট্টিজন যাত্রী (আদৌ কেউ কী ছিল!) একশ একুশ জন মারা যাবে। বত্রিশ জন আহত হবে, এর মধ্যে উনিশ জনের অবস্থা হবে গুরুতর। তাদের কেউ কিছুই জানে না।
গাড়ি নম্বর ১, মাদাম দোলাভো একটি শব্দজটের ঘর পূরণের চেষ্টা করছেন। তিনি কখনই “অস্ট্রিয়ার মিষ্টি”এই শব্দ জটটির সমাধান খুঁজে পাবেন না। লুক বঁতঁ তার ল্যাপটপে একটি পশ্চিমা ফিল্ম দেখছেন। তিনি কখনই এর শেষ দৃশ্য দেখতে পারবেন না (অবশ্য তিনি এই ফিল্মটা বিশ বছর আগে একবার দেখেছিলেন, কিন্তু ভুলে গেছেন)। অখেলি ভেলের তার ছোট ছেলের জন্য একটি সুয়েটার বুনছেন, যে কখনও এটি পরতে পারবেনা।
গাড়ি নম্বর ২, সেলিম বেনাস তার স্কেচ খাতায় পেনসিল দিয়ে একটি সান্ধ্য পোশাকের নকশা আঁকছেন। লিস দ্রোভাল তার হাঁটুর উপর একটা গানের শীট ছড়িয়ে রেখে কারমেলিতের সংলাপ অপেরায় ব্লসের ভূমিকা স্মরণ করার চেষ্টা করছেন। ক্যাথেরিন দেলগাদো নিচু স্বরে তার দুই নাতি, নাতনি, কারমেন ও জেনকে রুয়াল দালের গল্প পড়ে শুনাচ্ছেন।
এবং অন্য আরও কয়েকটি জায়গায়, বাস এবং কার সহ আটটি গাড়িতে দুইশ একষট্টিজন যাত্রী নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছে। তাদের কোন ধারণাই নেই, কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি দুর্ঘটনা ঘটবে!
একটা সেতুতে প্রবেশ করা মাত্র রেলপাতের উপর একটি ভারি পাথরের কারণে ট্রেন লাইচ্যুত হয়। ট্রেনের ইঞ্জিন সেতুর একটা পিলারে ধাক্কা মারে। পেছনের বগিগুলো নিমিশেই সামনের বগিগুলোর উপর উঠে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়!! যাত্রীদের দেহ ছিন্নভিন্ন, টুকরো টুকরো। মৃত্যুঃ একশ একুশ।
দুর্ঘটনাটি হয়ত ঘটবে না কিংবা নিশ্চিত ভাবে ঘটতেও পারে। তবে, এটা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর ! দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আর বাকি। কিছুই নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেও এটা ঘটতে পারে।
বন্ধ করুন সময় গণনাঃ আঠারো, সতেরো, ষোল, পনেরো…
দুর্ঘটনাটি হতে পারে, আবার হয়ত না।

আপেল গাছ (Le pommier)

আমার বসার ঘরে একটি আপেল গাছে আছে এবং এটি বেশ সুস্থ সবল। গাছটি গত দুই বছর ধরে এখানে আছে। একটা কথা বলে নেই, যেই দিন আমার স্বামী রোলাঁ হারিয়ে যায় সেই দিনেই গাছটিকে আমি প্রথম দেখতে পাই। আমার মনে আছে, ওই দিন আমার চাচাতো ভাই জঁ পল সবেমাত্র মেঝের টালি সরিয়ে কংক্রিটের স্ল্যাব ভেঙে ফেলেছিল। নতুন টাইলস বসানোর আগে কংক্রিটের ঢালাই আবার নতুন করে করতে চেয়েছিল সে। এটা আমারই পরিকল্পনা ছিল, কারণ আমি আগের গাঢ় বাদামী টাইলস দেখেতে দেখতে ক্লান্ত বোধ করছিলাম।
তারপর থেকে আপেল গাছটা বেড়ে চলেছে এবং আমার বসার ঘরটা তখন থেকে জ্বলজ্বল করছে। তিন দিকে উঁচু কাঁচের জানালা থাকার কারনে ঘরটা শীতকালের বাগানের মত দেখতে হয়েছে। গাছটি ঘরের মধ্যে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং এটি বেড়েই চলেছে। আমিও আপেল গাছটির সাথে দারুনভাবে যুক্ত হয়ে গেছি। ভাবুন তো, রোলাঁ চলে যাবার পর থেকে এটি আমাকে কতটা সঙ্গ দিচ্ছে !
একবছরের মধ্যে আপেল গাছটি প্রায় এক মিটারের মত দীর্ঘ হয়ে উঠে। জঁ পল তো বিশ্বাসই করতে পারেনি এটা এতটা বেড়ে উঠবে,
-“মনে হচ্ছে নিচে ভাল জৈব সার পেয়ে এটা এতটা বেড়ে উঠেছে”
-“হতে পারে” আমি উত্তরে বললাম পলকে।
পল গাছটার চারপাশ ইটের দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়। দেয়াল খুব একটা উঁচু না, মাত্র বিশ সেন্টিমিটার। এতে বসার ঘরটিকে আরও সুন্দর লাগছে।
আমি আরাম কেদারাটাকে গাছটার কাছে নিয়ে এসে রাখি। দেয়ালের উপর ভেষজ চায়ের কাপটা রেখে চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে আমরা দু’জন কথা বলতে শুরু করি, আমি আর আপেল গাছটা। এখন প্রতিদিন আমাদের এই চলে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাতে হাসির কিছু নেই ; আমি তার সাথে কথা বলি এবং সে আমার কথা শোনে! সে একদম রোলাঁর মত না। আগে আমি যখনি কথা শুরু করতাম তখনি দেখতাম রোলাঁ ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আমি যখন তাকে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দিতাম সবসময় সে বলত, -“কি হয়েছে? কি হয়েছে? ও আচ্ছা, তুমি আমার সাথে কথা বলছিলে!” এবং আবার সে ঘুমিয়ে পড়ত।
কিন্তু রোলাঁ অদৃশ্য হয়ে গেছে। একদম রাতারাতি উবে গেছে!
অদ্ভুত, তাই না?
পুলিশ তদন্ত করতে এসেছিল, পুরো বাড়ির উপর নিচ তল্লাশি করে তারা। তিন বার এসেছিল। পরে আর আসেনি।
আমার বৃদ্ধ পরিচারিকা জেন, প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে,
-“তোমার একা একা লাগে না?”
-“না, আমার আপেল গাছ আছে না? আমি ওর বেড়ে ওঠা দেখি প্রতিদিন। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। একদিন গাছটায় আপেল ধরবে।“
-“সবই ভাগ্য”, বলে জেন।
-“হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছ জেন, সবই ভাগ্য। তবে ভাগ্যকে মাঝে মাঝে সাহায্য করতে হয়! আর বেশি করে গাছ লাগাতে হয়”। উত্তরে বললাম জেনকে।

(লেখক পরিচিতিঃ ফরাসি লেখক, অনুবাদক, শিশু সাহিত্যিক ও শিক্ষক বের্না ফ্রিয়ো(Bernard Friot) ১৯৫১ সালে উত্তর ফ্রান্সের সাঁ পিয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্রান্সের বেশ কিছু শহরে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত থাকার পর বর্তমানে তিনি বর্দোতে বসবাস করছেন। তিনি এখন পর্যন্ত তরুন ও শিশু-কিশোরদের জন্য পঞ্চাশটির উপর বই লিখেছেন এবং জার্মান ও ইতালি ভাষা থেকে ফরাসি ভাষায় তাদের জন্য বেশ কিছু অনুবাদ করেছেন। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লেখালেখির পাশাপাশি অণুগল্প এবং কবিতাও লিখছেন।)

নূরুল আলমঃ গণমাধ্যমকর্মী, অনুবাদক ও লেখক।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.