·একটি প্রতিকৃতির কাহিনী। আমান উল্লাহ

0
Showing 1 of 1

“If there any good soul passing by this way, please contact with us ” রাত বারোটার পর একটা বড় মোমবাতির আলোর চারদিকে আমরা একটা কাঁচা টাকার বুকে আঙ্গুল ছুঁয়ে বসে আছি। স্কেচ বোর্ডের সাদা জমিনের মধ্যগগণে কাঁচা টাকার বুক ছুঁয়ে আমরা চারজন মৃত আত্মাকে ডেকে চলেছি। বোর্ডের ক্লিপে আঁটা সাদা কাগজের জমিন ঘেসে কিছু ইংরেজি অক্ষর আর সহজ কমিউনিকেশনের সংকেত স্বরূপ Yes, No লেখা। সবাই বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠের মত আওড়াচ্ছি If there any good soul …

সঞ্চালক বলে দিচ্ছেন আত্মা যদি এই পথে আসে তবে আমাদের আকুতি শুনে দয়া বা বাধ্য হয়ে কিছু একটি করে বসতে পারে। হয়ত আমাদের সাথে বাতচিত করার লোভে পূণ্যবান একটু সময় ক্ষেপন করবেন। বিপুল আশার মনে আলো জ্বেলে গোল পয়সার হৃদয়ে স্পর্শ করা মাত্র কেন্দ্রে রাখা তর্জনীর যৌথ মনযোগ কিঞ্চিৎ নড়ে উঠলো। একটা শিতল ভয় কাজ করলো কি? সঞ্চালক নিজেই আত্মার অস্তিত্বের প্রতি কত টুকু সন্দিহান এই প্রশ্নে নিজেকে চিঁড়ে ঝুর ঝুর করে ছিড়ছে। একটা সময় সে বাহকের মিডিয়াম হতে বাধ্য হলো। অর্থাৎ আত্মার অবিনশ্বরতার মন্ত্র কোন সন্দেহের কণা মাত্রও ঝেড়ে ফেলে বলা শুরু করলো, নিতান্ত বিনয় ভাষণে আত্মাকে জিজ্ঞেস করলো্ নাম, ধাম, নশ্বরতার পর্ব, অবিনশ্বর হওয়ার অপার্থিব যোগ সহ বেশ খোশগল্প চলছে।

আত্মার সংলাপ পর্ব সচল রাখার সাংকেতিক আয়াস অনেকটা আধাখেঁচড়া দেশীবিদেশী সংক্ষেপণী ভাষা বিবেচনার বুঝকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে রবীন্দ্র যুগেরও একশত বছর আগের সাহিত্য প্রেমিক এর দেখা পেলাম। তখনকার সময়ে ঈশ্বর ভক্তিরস প্রবল ছিল বিধায় তারা তাদের রচয়িতার নাম উহ্য রাখতো। স্বয়ং পরমের কত পেয়ার সে হৃদয়ে ধারণ করে তার কোনো প্রমাণ রাখার রেওয়াজ ছিল না।

খোদ ঈশ্বর তার মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে কত নজরানা দান করলেন তার সংখ্যা গুণতেও নারাজ এমন দরাজ তারা আর তাদের সৃষ্ট কৃষ্টি। আমরা মুগ্ধ হতে গিয়ে আরও জটিল অনুস্মরণ না করে বরং শত বংসর পরে রবীন্দ্রনাথকে চিনে কি-না জানতে চাইলাম।

বেখাপ্পা রস বোধে চিড় ধরায় উনি নিরবে ছটফট করছেন।আমরা তাকে ছেড়ে দিলে উনি বরং সদানন্দে তার যাপিত যাত্রার মোহে ধেয়ে যাবেন – এই নিমিত্তে তাকে যথা সম্মানপূর্বক বিদায় দিলাম।

এখানে তুলা রাশির যোগ বিশেষ হেতু আমার সঞ্চালনার আয়ূ বৃদ্ধি পেলো। আত্মা ধরে আনার লড়াই ক্রমে জম্পেশ আড্ডায় রূপ নিল। তুলার জাতকের অবস্থা কাহিল। বাটি চালানের রেস যারা দেখেছেন বুঝে নিবেন। স্বৈরাচারী এরশাদের বদৌলতে বিদ্যালয়সমূহ বন্ধ থাকায় আমাদের প্লানচেট পর্ব রীতিমত ঘুমহীন সাধনায় রাত যাপন করছে। আমারও অতিরিক্ত আত্মার প্রেমে মজলুম হতে হতে স্বাভাবিকতা গত হতে চলেছে। মানসিক স্বাস্থ্য তার অচেতনে গভীর মৌতাতে নিবিড় থাকতে পারছে না বলে প্লানচেট পর্ব থেকে সটকে পড়ার ধান্ধায় আছি। যারা মিডিয়াম হন তাদের স্বল্পায়ু যোগ, মৃতদের সাথে চলাফেরার বিরূপতা ইত্যাদির সাথে যোগ হলো উপস্থিত মানুষেরা। নিজ স্বার্থের গুমর খোলতাই করার অধম চর্চায় বেবাক ঘোর এবার বেপথু হওয়ার সুযোগ পেলো।

কবিগুরু তার প্লানচেটে যাদের সঙ্গ নিতেন আর কতবিধ প্রক্রিয়ায় পরলোক ও ইহলোকের মধ্যরেখা (পুলসিরাত) দৃষ্টিগোচর হত তার বাস্তবতার চর্চা হয়ত শেষ হয়ে গেছিলো, কিংবা ঈশ্বরের সাথে তার প্রেমার্থিদের ক্রম বর্ধমান দুরত্বের রাশ টানতে টানতে পরমের প্রেমিকেরা বাস্তবে প্লানচেটের মত উদাসীন আত্মাদের আশাহীন গন্তব্যে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না।

এই স্থাবর-অস্থাবর অস্তিত্বের জের ধরে সম্পদ তছরুপের হীন ষড়যন্ত্রে মশগুল এক গ্রুপের বদৌলতে শেষ পর্যন্ত প্লানচেট পর্ব তার অসারত্ব প্রমাণের পথ খুঁজে পেলো। আমাদের আড্ডার এক গুরুভাই তখন বেসরকারি এনজিওতে চাকরী করেন। তাদের চাকরি স্থলে ঘটে যাওয়া একটা মার্ডার কেসের জট খোলার নিমিত্তে তারা রাত বারটার আসরে এসে জুটলেন। আমার সঞ্চালনে গুরুভাইদের তিনজন তখন হত্যার সরেজমিন বিশ্লেষণে লেগে গেলেন। তাদের সন্দেহকে উপাত্ত করে ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের হোতা আবিষ্কারে পুরো আসরে পিনপতন নিস্তব্ধতা।শেষ প্রহরে সবার দৃষ্টি কোন প্রতারক গ্রুপের সুরতহাল হাল নাগাত করতে করতে ফজরের আযান শোনা গেল। সবাই আড্ডা ভেঙ্গে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আমিও সঞ্চালনার অহেতুক তুলা রাশির বেদম ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে আসলাম। আত্মার উপস্থিতি-অনুপস্থিতির চাইতে আত্মার ঘাস মারিয়ে অপ তৎপরতার উদ্ভাসে গুলিয়ে যাওয়া সূক্ষ সাংঘর্সিক বাস্তবতাকে রাজত্ব করতে থাকা কলুষিত মানুষগুলোর প্রতি ঘৃণা জন্ম নিল। আর তখন থেকে ভুলে গেলাম আমি তুলা রাশির জাতক।

আসলে মৃত মানুষ তার বেদনা কঠিন যন্ত্রণাকে অসহায়ের চোখে দেখতে চায় বলেই মৃত্যু মুহূর্তে তার চোখ বিস্ফারিত দেখায়। তখন মৃতের স্বজনেরা চোখের পাতা বন্ধ করে দেয়।মানুষের ঘুম চোখে মণি নড়াচড়া করে। তার চিন্তা ঘুমায় না সে সাধন ভজন করে। চিন্তা শূন্য হতে চায়। জগত দুঃখ ময়। আনন্দ তার স্বর্গীয় অনুভব। দেহ ভাণ্ড ত্যাগের মায়া কাটিয়ে উঠতে উঠতে দেহকে ছেড়ে যেতে হয়।

এখানে পবিত্র আত্মারা চির দিনকার ভালমানুষের দল, যাদের মৃত্যু নেই। মৃতের পৃথিবীতে বারবার ফিরে আসা আত্মার জাগরী দৃষ্টিকে নির্মলীত রাখার ভেতর চেতনা উজ্জীবিত থাকে। চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখার ভেতর সভ্যতা জেগে থাকে।


লেখকের নিজের আাঁকা চিত্রকর্ম ‘ক্রোধ’, বোর্ড পেপারে আঁকা, মিশ্রমাধ্যম।

আমান উল্লাহ: সহযোগী অধ্যাপক, শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিব টেকনোলজি, ঢাকা।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Showing 1 of 1
Share.

Comments are closed.