নাছরিন অপি’র মুক্তগদ্য ’হাত’

0

ভুল তো তুমি সেই দিনই করেছিলে যেদিন গাঁয়ের পথে জুতো মচমচিয়ে হাঁটতে গিয়ে বীজতলার কৃষাণকে ‘চাষা’ আর কাস্তে দিয়ে ক্ষেত নিড়ানো মজুরকে ‘ক্ষ্যাত’ বলে গালি দিয়েছিলে।
তোমার ভুলেই ক্ষেতমজুরের ছেলে কানাডার এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিতে মেশিনে আপেল তুলতে গেলো,নিজেকে কেতাদুরস্ত প্রমাণ করতে। চাষার ছেলেমেয়েরা কূপিবাতির আলোয় রাত জেগে ঘুমে ঢুলে ঢুলে বিসিএস গাইডগুলো ঠোঁটস্হ করেছে,ঠেলেছে সচিবালয়।
ক্ষেত ফসলের ন্যায্য দাম দিতে যদি কোনোকালে শিখতে,তবে মহা দুর্যোগে তোমার গুদামে ১৭লাখ টন নয়,সতেরো মাসের খাবার মজুদ থাকতো।

মাটিবান্ধব তৈজস তোমার ভঙ্গুর লাগলো,
পালপাড়ায় ১০টাকা খরচ করতে তোমার গায়ে বিঁধলো। তুমি নিয়ে এলে ৫টাকার প্লাস্টিক, মেলামাইন।
তখোন তুমি জানতে না প্লাস্টিকব্যাগে ভরে একদিন বিলাত থেকে আসবে ক্যান্সার,চৈনিক বাসনে চড়ে আসবে করোনা।
কুমোরের চাকায় লাথি মারবার সময় তোমার তো মনেও হয়নি কখনো মুখের উপর একে একে বন্ধ হয়ে যেতে পারে সমস্ত দেশের দ্বার।
মাটি-তামা-কাঁসা নিয়ে তোমার হীনমন্যতার দিন ফুরোয়নি আজও?

তোমার ভুলেই আজ জেলের ছেলের গায়ে আঁশটে গন্ধ নেই, পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে ছেলেটা ব্যস্ত থাকে ক্যালকুলেটর,পি সি তে,মাল্টিন্যাশনালের ক্যাশ ইন ফ্লো,আউট ফ্লো এর হিসেব কষতে।কোনোদিন ভেবেছিলে বৈশ্বিক অর্থনীতির সকল ফ্লো আচমকা কোনো এক ফ্লু’তে স্থবির হয়ে যেতে পারে?সেখানে তুমি কোন্ ছার্ !?

গমের আটার রুটি,গনগনে মাটির চুলোয় তাওয়া বসিয়ে লালচে মোটা রুটি ঝলসে খেতে তোমার আর ইচ্ছে হয়নি।ব্রয়লারের কুচিতে তাই বেকিং, টেস্টিং সল্ট আর ময়দায় ঈস্ট মেখে তোমার ফোলানো ফাঁপানো মেকী সভ্যতাকে তুমিইতো ঠেলে দিয়েছিলে মাইক্রো ওভেনে,ঠেলছো এখনো উত্তপ্ত আঁধারে।

বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ,গরুর গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ কী ভীষণ গাঁইয়া লাগতো তোমার। তুমি নিয়ে এলে ভট্ ভটি,মোটর, ইঞ্জিন।তোমার বাতাস আজ পৃথিবীতে সবচে দূষিত।
গাড়োয়ানের যে ছেলেটা আম্রিকায় ট্যাক্সি হাঁকায়,বৈঠা ফেলে যে মাঝি মরুর দেশে বুর্জ দুবাই গড়ে, তাদের শরীরের নোনাজলে তোমার রেমিট্যান্স এর লকলকে জিভ নোনতা লাগে না?

তোমার সোনালী আঁশ সোনা দেয়নি বলে পাটকলগুলো বন্ধ করে পাটশ্রমিকদের গলাধাক্কা দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিলে।সেই কোন্ উপকথার যুগ থেকে তাঁতীকে ‘জোলা’ বলে গাল দিতে শেখালে সন্তানকে,আজ তোমার সেলাই কলে লক্ষ লক্ষ শহুরে ‘জোলা’ বিলিতি ফরমায়েশের কাপড় কাটে,বোতাম লাগায়; তোমার কাপড় বোনা ফেলে।সেলাই মালিকদের ফড়িয়াবাজীকে তুমি কখনোই টেক্কা দিতে পারোনি, একালেও পারলে না।

মুচিকে চামার ভাবতে ভাবতে বলতে বলতে খেয়ালই করোনি তোমার চামড়া কারখানায় যারা মজুর খাটে তাদের ফুসফুস জরাগ্রস্ত।কালো।
পাশের নদীটা ক্রোমিয়াম গিলে গিলে ঘন কালো হতে হতে পানি নয়,অন্য কোনো তরল ধারণ করে মাতামহীকে ভুলে গেছে।

শহরের এঁদোগলিতে মেথরপট্টী,খিস্তি খেউড় কম তো করোনি ওদের।কখনো সন্তানের সামনে পড়ে গেলে দূর থেকে দু’টাকা ছুঁড়ে দিয়ে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছো।অথচ তোমরা প্রত্যেকে নিজেই যদি সত্যিকারের মেথর হতে পারতে,হয়তো, আজ জীবাণু যুদ্ধে হেরে যেতে হতো না।

গাঁয়ের শেষ মাথায় ফেলে রেখেছো যে ডোমদের,সমাজে ‘অচ্ছুৎ’ বলে,তাদের শতবছরের দীর্ঘশ্বাস বুঝিবা ইথারে মিশে ছিলো,তাই আজ তোমাদের লাশ পরিজনেরাও ছুঁয়ে দেখে না,চাইলেও ছুঁতে পারে না।সমাজের দায় নেই তোমাকে সৎকার করবারও।
সামাজিক মানুষেরা আজ নিজ স্বার্থে গৃহবদ্ধ জীব।

কামারের রক্তবর্ণ লোহাকে,হাতুড়ি-হাঁপরকে তাচ্ছিল্য করেছিলে বলে তোমার জীবন আজ হাতুড়ির নীচে।অন্যের ছাঁচে অন্যের হাতে তোমার আকার আজ পাল্টে যাচ্ছে,কেবলই পাল্টাচ্ছে; ওতে আর তোমার কোনো হাত নেই।

যুগ যুগ ধরে সহস্র বছর ধরে মানুষের হাতকে, হাতের শক্তিকে তুমি অস্বীকার করেছো,অবজ্ঞা করে গেছো শুধু। তাই আজ তোমার হাতেই, তোমার হাত ই তোমার মরণবীজ।
ভুল হাতে ভুল হাতিয়ার গড়েছো এতোকাল মানুষ।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.