জোনাই একটানা সারাদিন কাজ করে ঘাড়ে ঝিঁঝিঁ ধরে গিয়েছে সুলতার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে পার হয়ে রাত্রি আটটার ঘণ্টাও শুনেছে বেশ খানিকক্ষণ আগেই। রবিবার সকালেই একটা প্রেজেন্টেশন আছে। সারাদিন পার হয়ে গেলো এ ছবি, ওই নকশা লেখার প্রুফিং এ।কম্পিউটারে সেসব রেডি করতে চোখেও ধাঁধা লেগে গেলো। আশ্বিন মাসের রাত প্রায় নয়টা, বেশ রাত। পিয়ন বেলাল অপেক্ষা করছিলো অফিস বন্ধ করার জন্য । সে সুলতাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে বাসায় ফিরবে, সেই দিয়াবাড়ি। সুলতা যাবে দশ নম্বর সেক্টর। অফিস থেকে বের হতেই দেখলো একটা রিক্সা ওদের পার হয়ে সামনে যাচ্ছে। কি অবাক! ঢাকার রিক্সার পেছনে রিক্সাছবি আঁকা! গ্রামের দীঘি। তাতে লাল শাপলা। উপরে আকাশ। একটা পায়রা উড়ছে! রিক্সায় একটা হারিকেনও বাঁধা। আজকাল রিক্সায় হারিকেন বাঁধা দেখেছে বলে মনে পড়ে না। সব রিক্সাই আলোহীন। অন্যদের দায় তাকে দেখে চলার! বেলাল রিক্সা ডাকে। সাদা লুঙ্গি সাদা ফতুয়া পরা রিক্সা চালক। চেহারায় বাউল ছাপ। যেনবা মাত্রই হাতের একতারা নামিয়ে রেখেছে। জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাবেন আম্মা?’ সুলতা বলতে চায়,’ আমার ছেলেবেলায়’, এমন একটা কথা ফেসবুকে বন্ধুর ওয়ালে দেখেছে আজই। নিজেকে সামলে বলে, দশ নম্বর সেক্টর, ছয় নম্বর রোড। ভাড়া ঠিক করে উঠে বসে রিক্সায়। বসেও আরাম। অতোটা খাড়া নয় তো! চালক বলে,’ আম্মা শক্ত করে ধরে বসেন, তাড়াতাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেই।’ বেলাল কিছুদূর রিক্সার সাথে এসে অন্য পথ ধরে। রিক্সা যে পথে আগায় সেখান দিয়ে রাস্তা একটু কম, কিন্তু ঘিঞ্জি, দুর্গন্ধ। সুলতা ওই রাস্তায় রিক্সা নিতে নিষেধ করতে না করতে, ঝুপ করে অন্ধকার নামে। বিদ্যুৎ গেলো। আশেপাশে বাড়ি থেকে শিশুরা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে। আজকাল এমন হয় নাকি! আইপিএস, জেনারেটর এসবের বদৌলতে ঘুটঘুটে আঁধার তো হয় না। কিন্তু তা তো নয়।বারান্দা বারান্দায় কথা হয়,’টিলো এক্সপ্রেস’ সব উল্টা পালটা। বাতি জ্বলে ওঠে না। সবাই বুঝি অন্ধকার উদযাপন করছে! মৃদু ঠান্ডা বাতাসে মেহেদি ফুলের ঘ্রাণ। রাস্তা পেরুতে পেরুতে একে একে হাসনাহেনা, কামিনী, শিউলি আর ছাতিমের ঘ্রাণ ঘিরে ধরে ওকে। শৈশবেই কি ফিরছে নাকি! সেই ওদের ছোট্ট শহরে গলিপথ! বিদ্যুৎ গেলেই পাড়ায় মা-চাচিদের বারান্দা আড্ডা। বাড়ির আঙিনায় সুগন্ধি ফুলের বৃক্ষদের নিজেদের মধ্যে ফিসফিস কথা, তাদের ডালে ডালে জোনাকির আলোকসজ্জা! গলি জুড়ে সকলের লুকোচুরি খেলা! রাস্তায় শিশুদের দৌড় টের পাওয়া যায়। কোনো কোনো জানালায় টিমটিমে কেরোসিন ল্যাম্প, হারিকেন এর আলো চোখে পড়ে ধীরে ধীরে। হঠাৎ মোশন বদলে গিয়েছে। রিক্সা অনেক সময় নিয়ে পার হচ্ছে পথ। এখনেও অন্ধকারে ফুটতে থাকে হাজারও জোনাকি। শিশুদের কোলাহল থেমে গেলে ঝিঁঝিঁপোকার খোলা গলায় বাজতে থাকে তানপুরার একই সুর। আজ বাড়ি পৌঁছানোর তাড়া নেই আর। দূর থেকে আসা সাইরেনের শব্দও স্তব্ধ হয়েছে। শীত শীত বাতাসে গায়ে আঁচলটা টেনে নেয় সে। বাড়ির গেইটে নিজেকে আবিস্কার করে সুলতা। ঘড়িতে তখনও নয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি! শাড়ির ভাঁজে আটকে আছে একাকী এক জোনাই!
মনিরা মিঠি: আবৃত্তিশিল্পী, গল্পকার