গৃহযুদ্ধকালে রচিত শ্রীলঙ্কার ৬ তামিল নারীর কবিতা। ভাষান্তর: মাজহার জীবন

0

ধূসর পূব/বিজয়লক্ষী সেগারুপান

ভোরে
পূব আকাশে রক্তিম আভা
বাসা ছাড়ে পাখির ঝাঁক
এমনি করে পাহাড়ে পাহাড়ে
পূবের ভোর আছড়ে পড়ে।

ফুল ফুটেছে
মেয়েদের হাতে ফুলের ঝাঁপি
অথচ মায়েদের হাত ফুলশুন্য।

প্রতিটি ঘরে
গাঁয়ের যুবকদের
ঝুলিয়ে রাখা ফোটোতে
পুষ্পাঞ্জলি আর
ধূপকাঠির ধোঁয়ায়
দেব-দেবীর প্রতিকৃতি
আধারে
ঢেকে যায়।

এভাবেই পূবের ভোর
আমাদের গ্রামের
পাহাড়ে পাহাড়ে
আছড়ে পড়ে।

তামিল থেকে ইংরেজি: শ্রীগণেশন

নারীকে বাঁচতে দাও/মিন্নলি

সেই সময়ে নারী — স্বাধীন ছিল
তারপর নারীকে — দাস বানানো হলো
এখন নারী — মুক্তির জন্য যুদ্ধরত

সমর্পন দুর্বলতা নয়
বরং শক্তি
অতিরিক্ত সমর্পন
ভক্তিতে রূপ নেয়

রক্তকে বিষ করতে
বাধ্য কোরো না
নারীকে বাঁচতে দাও
কারণ —
নারী হলো
শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুর গোড়া

আশা/যোধা আকবর

জানি না কখন ফিরে আসবে তুমি
আশায় থাকি একদিন ফিরবে
দরোজা তাই খুলে রাখি আমি

কিন্তু তুমি তো আসো না, আসে শকুন

যখন তোমাকে ধরে নিয়ে গেল
তখন আমি মৃতপ্রায়
যা কিছু আছে বাকি
তাও হরণ করে এইসব শকুন
আজও আমি তোমার ফেরার প্রতীক্ষায়
যতক্ষণ আছে শ্বাস দেহে আমার

তামিল থেকে ইংরেজি: থাভা সাজিথারন।

ভোরের টিকেট/হিলদারুবিনি

নারী
যখনই তোমাকে দেখি
আমার মনে প্রশ্ন জ্বলে উঠে!

সমাজটা এমন কেন?
তোমার ইচ্ছে আর প্রেরণা
কবর দেয়া হয়েছে।
সাধারণ জিনিষপাতির মতো
তুমি চার দেয়ালে বন্দী।
তোমার জ্ঞান অভিশপ্ত;
দাবার বড়ে যেন তুমি
থালাবাসন মাজাখসা করো,
হেঁসেলের ধোঁয়ার জ্বলেপুড়ে যাও
স্বামীকে বিদায় দিয়ে
শ্বশুরবাড়ির লোকের ফায়ফরমাস খাটো
এই তো নিত্যদিনের কাজ তোমার।

আজ, আগামীকাল
তারপরের দিন
আমাদের দূরের ভোর
বিরতিহীন হামাগুড়ি দিয়ে আসছে।

তামিল থেকে ইংরেজি: শ্রীগণেশন

বোঝা/থামবিলুভিল জেগা

আমি একাকী একটা ষাড়
টেনে চলছি সংসার-গাড়ি।
রান্না, ধোঁয়ামোছা
কিংবা সেলাইয়ের সময়
কতশত কবিতার আগুন
জ্বলে আমার ভেতর;
আমি তাদের সাথে নিয়ে চলি
কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না।

একদিকে,
কাগজ-কলম
আমাকে ডাকে;
অন্য দিকে
আমার পোলাপান
চিৎকার করে কাঁদে
” আমার খিদে পেয়েছে, মা”
আমার নিজের ক্ষুধা মরে যায়।

তামিল থেকে ইংরেজি: শ্রীগণেশন

কোদাল/জয়ন্তী থালায়াসিঙ্গম

বাস্তুচ্যুত নতুন জীবন
সংসারের নানা টুকিটাকির সাথে
বয়ে আনা কোদালও।

যুদ্ধ আমাদের বারবার
হানা দিলেও
গর্বিত আমি
আশা ছাড়িনি কখনই।
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ হিসেবে
আমরা নতুন জায়গায়
শুরু করি চাষবাস।

কিন্তু,
একটা খবর আমাদের আশাহত করে
সেটা হলো:
একনলা রকেটের বদলে
বহুনলা রকেট মোতায়েন করা হয়েছে

তাই এখন
অন্তত নিশ্চিত হয়েছে
আরো নতুন মৃত্যু
আর মৃতব্যক্তিকে
ফেলে না যাওয়ার প্রত্যয়ে
সৎকারের সহজ উপায়
কোদাল হাতে
আমরা ছুটি
সৎকারের উদ্দেশ্যে

তামিল থেকে ইংরেজি: শ্রীগণেশন

চাওয়া/ইলানগয়েশ্বরী

আমার সন্তানকে আমি জড়িয়ে ধরতে আর চুমু খেতে চাই;
আমার মায়ের কাছ থেকে আমি খেতে চাই;
আমার বন্ধুদের সাথে আমি ঘুরে বেড়াতে চাই;
আমি সুন্দর কাপড়চোপড় পরতে চাই;
প্রচুর পানি পানের মতো আমি নিজেকে অনুভব করতে চাই;
খোলায় জায়গায় আমি বসে গলা ছেড়ে গান করতে চাই।

লেখাপড়া শেষে আমি একটা
চাকরি পাবার আশা করি;
আমার একটা চাকরি দরকার;
আমি কাজ করতে ভালবাসি।

আমি আমার ভাইদের সাথে একসাথে ঘুমোতে চাই;
আমি আমার বড় বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে চাই;
আমি নদীতে সাঁতার কাটতে চাই;
আমার ভেতর অনেক অনেক চাওয়া।

এমনকি তারা আমার কাছে
একটা শব্দও উচ্চারণ করে না;
গর্জনরত সিংহের মতো
তারা আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে;
আমার পোশাক ছিঁড়ে ফেলে,
আমার হাড় ভেঙ্গে ফেলে,
আমাকে নগ্ন করে,
আমার স্বপ্নকে আহত করে,
প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে।

এখন,
আমি একা,
এখানে, আমার কবরস্থানে;
তারপরও এখনও আমার ভেতর
আমার চাওয়াগুলো রয়ে গেছে।

তামিল থেকে ইংরেজি: শ্রীগণেশন

বিজয়লক্ষী সেগারুপান: ছোটগল্পকার ও কবি। থাকেন বাট্টিকোলাতে। নাট্যচিত্র রচনা করে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। গল্পগ্রন্থ: Vaanam Enn Mela Ponathu
মিন্নলি (ভেরোনিকা মিন্নলি নান্থকুমার ) ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। শিশুকাল থেকে তিনি কবিতা লেখেন।
যোধা আকবর: বাস্তুচ্যুত কবি। নানা ধরনের সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত।
হিলদারুবিনি: বাস করেন বাট্টিকোলাতে। গায়িকা ও অভিনেত্রী। সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত
থামবিলুভিল জেগা (জগতেশ্বরী): পেশা শিক্ষকতা। রেডিও ও সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। প্রকাশিত কবিতার বই Vidiyavillai, পেয়েছেন Kavikogilam সম্মাননা।
জয়ন্তী থালায়াসিঙ্গম : জন্ম জাফনায়। বাস করছেন ফ্রান্সে। লেখালেখি করেন ১৯৭৭ সাল থেকে। শ্রীলঙ্কায় সূর্য নামের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
ইলানগয়েশ্বরী: জন্ম বাট্টিকোলায়। ২০০০ সাল থেকে লেখালেখি করেন।
কবিতাগুলো Let the poems speak নামে এক অনুষ্ঠানে ২০০৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর পঠিত হয় বাট্টিকোলায় যার আয়োজক ছিল সংস্থা সূর্য নারী উন্নয়ন কেন্দ্র। এখানে শুধু নারী কবিদের কবিতা (কবি নিজে অথবা তার পক্ষে) পাঠ করা হয়।

মাজহার জীবন: অনুবাদক, কবি ও সম্পাদক, উঠান

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.