পোড়ামাংসের কয়লা অথবা অবরুদ্ধ বৃষ্টি । জান্নাতুল ফেরদৌস

0

প্রতিদিন রাত আসে হাড় কাঁপানো আতঙ্কে। ভোর হলেই তো শুনতে হবে নতুন কোন মৃত্যুর পোড়ামাংসের ক্রন্দন। চোখের সামনে শতশত প্রাণ বিনা কারণে অকাতরে রক্ত কয়লা করছে। রাতের কুকুর পৌষের শীতে উত্তর আকাশে চেয়ে অঝোরে কাঁদছে। কে জানে, দেশমাতার কোলে আর কোনো বন্দুকের নল ছোঁড়া গুলি এসে বিঁধবে অবলীলায়। হয়তো সে শঙ্কায় কাঁদছে পোয়াতি কুকুরটি।

রেলস্টেশনে গাদাগাদি করে শোয়া লোকজন। কেউ ভোর থেকে বসে বসে পা ফুলিয়ে এবার শুয়ে পড়েছে। কেউবা টানা দুদিন ধরে ট্রেনের অপেহ্মায়—আশার জলন্ত প্রদীপে পূজো করে বন্দর থেকে এবার গঞ্জে যাবে। মায়ের মুখে ভোরের শিশির ঝরাবে।

মতিগঞ্জের কামারখালি গ্রামের কামাররা দা, বটি, ছুরি, খুন্তি পাশে রেখে জ্বলজ্বলে চোখে ঘরের চিন্তায় বিভোর। তাদের আদরের সন্তানটির মুখে রাতের খাবার উঠেছে কি না সে শঙ্কায়। স্ত্রীর সহজ সরল মুখের ছবি ছেঁড়া গামছায় ঘামের কণায় আয়নার মত জ্বলজ্বলে দেখায়। আজ কি হবে ফেরা? অথবা কাল, পরশু অথবা কোনদিন না, অথবা পরবর্তী কোনো প্রজন্মে। আমি দেখি ভোর, তীব্র আলোকিত এক যৌবনা সূর্যের ভাঁজে এক ঝাঁক সাদা বক উড়ে যাচ্ছে আমার চেনা বিলটার তীর ঘেঁষে। সকাল থেকে রাত, মাস থেকে বছর, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এভাবে কেউ অপেক্ষার দ্বার খুলে তালপাখা নিয়ে বসে আছে। হয়তো এবার খুলবে দুয়ার অবরুদ্ধতার চোয়াল ভেঙে।

ভাই, আমারে বাঁচান।

প্লাটফর্মের ওপাশে করুণ আর্তনাদ আগুন জ্বলা এক দেহমনে। ফাগুনের কৃষ্ণচূড়ার পোড়াগন্ধ, ওদিকে শিমুল বলে ফুটবে না আর কোনোদিন। আর্তনাদের শব্দে ক্লান্ত কুমার চোখ খুলে তাকায়, পরক্ষণেই মাথা নুয়ে পড়ে। আমারে বাঁচান পেটে ইট গুইজা শুইয়া আছি, ভাবখানা এমন। 

গায়ের সরলা বালিকাবধূ জল ঢালে তুলসি তলে। আকাশ কোণে পতপত শব্দে ওড়ে মন মাতানো ঘুড়ি, অদৃশ্য ঘুড়ি, কল্পলোকের ঘুড়ি, স্মৃতির ঘুড়ি, সোনালি শৈশবের ঘুড়ি, রঙিন ঘুড়ি…। মাগো তুই কবে আসবি—এই যাতনায় গুমরে মরি শিথান কোণে একগাদা ছবি রেখে। আমি আসব, রাজপথে নেমে হেঁটে হেঁটে। হাতে থাকবে জন্ম মৃত্যুর চিহ্ন; যার রঙ সোনালি, সাদা, কালো অথবা ধূসর। মানব সৃষ্টির গন্ধ চারিদিকে। মোটা পাথরের চকচকে অস্ত্রের ঝলকানিতে নবশিশুর চিৎকার। এ কোন অশান্ত বন্যায় ভেসে যায় আমার মানচিত্র, আমাদের স্বাধীনতা।

স্বপ্ন সেজেছে উত্তাল আকাঙ্ক্ষায়। তুমি রোজ ফুল তুলে ভুল করে এসে খোঁপায় গুঁজে দিতে। শুধুই কি ভুল? নাকি কোনো অদৃশ্য টানে আমার খোঁপার গন্ধ তোমায় বিভোর করে দিত। কর্ণফুলি, তুমি কি রাত জেগে কোন কবিতার মত করে সুর তোল কাশবনে, বাতাসে অথবা বালিকণায়? প্রতিদিন অশান্ত হুংকারে ছিঁড়ছে রাখালের গরুর দড়ি, ঝুড়িভর্তি মাছের প্রেমে অসহায় শঙ্কা দোলে। মতিগঞ্জের কুমারদেরও হাঁড়ি ভাঙে গ্রেনেডের মত কোন দাবানলে।

চোখের কোণে সূদুরের স্মৃতিভেজা অশ্রু বলে, কেন তুমি আনলে টেনে আমার স্বাধীনতা। অবরুদ্ধতার গ্লানী মুছতে গিয়ে আঁধার চোখে তুমি বিশ্বমাতার কোলে অশ্রু ঝরাও, তবু দুদণ্ড আলো খুঁজে ফেরে না তোমায়। দুপায়ে বেঁধে রেখেছো আমারই পূর্বপুরুষের তৈরি অন্ধ কারাগার। আজ সে উঠনে শুকনো গাছে অবাক তাকিয়ে তুমি খুঁজে ফের মুক্ত আকাশ।

ফুলছড়ি ঘাটে নৌকা ভিড়েছে। গবিন্দীর চরের খেটে খাওয়া দিন মজুর কিষানি, বৃদ্ধা, জেলে হুড়মুড় করে পা ফেলে চকচকে বালির কোলে। কাঁখে মুড়ির পোটলা নিয়ে কুঁজো ঘাড় সোজা করে আতঙ্কে তাকায় সম্মুখে। এপার এলো, আরো দু’পার ডিঙিয়ে তবেই মেয়ের বাড়ি। এক পারাপার কাটিয়ে তোলে না জন আতঙ্ক।

বাবা, ও বাবা এনা শুনবেন?

ঘুমঘুম চোখে জনৈক তাকায় বৃদ্ধার মুখোপানে।

বাবা, ওমরা নাকি গরিব মানুষ ধরি ধরি মারি ফেলবেন নাগচে? বড় আস্তাত মোটরে চড়া নাগবে। মুই তো তাও সাহস পাও, তোমার চাচা যে যাবারি চায় না। কও তো বাবা মুই একন কি করম।

জনৈক মৃদু হাসে। আকাশের ভাঁজে দু’চোখ বুলায়। দুপাশের ঝাঁপটা বাতাস চেপে ধরে দু’কান। জেলে শিশুর কান্না। ফুলছড়ি ঘাটে আরো একটি নৌকা ভিড়ে।

ক্ষেতের সমস্ত ফসল-শাক-সবজি পচে গেছে ক্ষেতেই। মস্ত ঝাঁকায় শুয়ে ভ্যানের চাকায় গড়িয়ে যেতে পারেনি গঞ্জের মহাজনের ট্রাকে। জনৈক, আইলের পাড়ে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদে। সে কান্নার ধ্বনি পৌছায় না অট্টালিকা ডিঙিয়ে আরাম কেদারায় শায়িতের কানে। তবে মঙ্গার বীণ বাজে সকাল থেকে নিশিরাত। বাজারের ব্যাগে দুর্ভিক্ষ, পরনের ছেঁড়া কাপড়ে দুর্ভিক্ষ, রাত পোহালেই শোনা যায় দুর্ভিক্ষের নীল হুংকার।

বুবুর কাছে বায়না ধরে সাত বছরের মায়া।

দেনা বুবু ও বাড়ির কলমির মত পায়েল কিনে।

কত দাম?

কত আর হবে, দুশ টাকা।

দুশ, সেতো অনেক। দু’বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে মাসে পাই তিনশ টাকা। এখানে ওখানে চেয়ে তোকে খাওয়াই। আমাদের এমন শখ মানায় না বোন। মুখ ঘুরে মায়ার মায়াবি চোখে মায়ার ছায়া পড়ে। সে ছায়ার আগুনে পোড়ে বুবুর প্রাণ।

বর্ষা আসবে কবে? তুফানির প্রশ্ন মাকে ঘিরে। বর্ষা এলে বুঝি সব নিভে শান্ত হবে। জ্বলবে না, জ্বালাবে না, ঝরবে না কোনো কচিপাতার প্রাণ। তবে আসুক বর্ষা চারিদিকে ভেজা মেঘের ভেলায় চরে।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.