লুই আরাগোঁ (১৮৯৭-১৯৮২) বহুমুখী প্রতিভায় একজন উল্লেখযোগ্য ফরাসি কবি, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। কবিতা ছাড়াও, পরাবাস্তববাদী উপন্যাস এবং বাস্তববাদী উপন্যাস এবং সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। কবিতা যখন ধারাবাহিক ঐতিহ্যের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত, যুদ্ধপূর্বাবস্থয়ায় প্রবল উত্তেজনা ও অস্থিরতায় কবি তার অস্তিত্বের অনুসন্ধান করছে, সেই সময়ে ফরাসি কবিদের মধ্যে আরাগোঁ নিজস্ব স্বকীয়তায় সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে জনপ্রিয়, এবং ভিন্ন ধারায় কবিতা ও উপন্যাস লিখে বিশ্ব সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন।
লুই আরাগোঁ যাকে বাবা বলে জানতেন, তিনি লুই আন্দ্রিয়েক্স, দীর্ঘকায় গোঁপওয়ালা এই মানুষটির সাথে আরাগোঁর কোন সম্পর্ক ছিল না। শোনা যায় ভালো লেখার জন্যে একবার তাকে একটা কলম উপহার দিয়েছিলেন। আন্দ্রিয়েক্স প্রথমে একজন পৌর কর্মকর্তা ছিলেন, পরবর্তীতে একজন রাজনীতিবিদ এবং স্পেনের রাষ্ট্রদূতও হয়েছিলেন। আভিজাত্য পরিবারের সুন্দরী এক তরুণী মার্গারিট তুকাসের সাথে তার গোপন সম্পর্কে জন্ম নেয় আরাগোঁ। সে সময়ে রক্ষণশীল ক্যাথলিক সম্ভ্রান্ত পরিবারের আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্যে তার মাতামহ-মাতামহী আরাগোঁর দত্তক পিতামাতা হয়েছিলেন, নিজের গর্ভজাত মা হয়েছিলেন তার বোন এবং বাবা বনেছিলেন গডফাদার।
১৯ বছর বয়সে একজন অক্সিলিয়ারী ডাক্তার হিসাবে আর্ডেনেস ফ্রন্টে যোগ দেবার আগে মা মার্গারিট তাঁকে আসল সত্যটি জানান। যুদ্ধে সাহস এবং কর্মনিষ্ঠার জন্যে আরাগোঁকে ক্রোয়েক্স ডি গুয়েরের পুরস্কার প্রদান করা হয়।
বড় হওয়ার সাথে সাথে ফ্রান্সের বিশিষ্ট এই কবির মানস গঠনে সেই সময়ের বিশ্ব রাজনীতি ও পরিবেশের নানাবিধ প্রভাব পড়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। প্রাক-বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের সাথে ফরাসিদের রাজনৈতিক জোটের আনন্দ উন্মাদনা যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন রোমানিয়ায় গরীব কৃষকদেরকে হত্যা, অমানবিক নির্যাতন ও সামাজিক অবিচার। আবার ফিনল্যান্ডে নারী জাগরণ, পৃথিবীতে নারীর প্রথম ভোটাধিকার এবং একই সময়ে ফ্রান্সে নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক জগতের এক বিস্ময় ‘ওল্ড ম্যান অফ ল্যা শাপ্যেল” নিয়ানদারথ্যাল আদিম সম্পূর্ণ মানুষের ফসিলের সন্ধান।
আরাগোঁ’র বয়স তখন ১৭, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪) তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের মধ্যে। রাজনীতিকদের মিথ্যাচার, সাধারণ মানুষের অকারণ মৃত্য, খাদ্যাভাব পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে, ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে,অতীতের নিয়মনিষ্ঠ ক্লাসিক ধারাকে অগ্রাহ্য করে শিল্পীরা তখন খুঁজছেন নতুন জীবন-রীতি, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভিন্ন শিল্পধারা, শৈল্পিক স্বাধীনতা। এভাবেই অপরিকল্পিত স্বতঃস্ফূর্ত একটা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল যেটা anti-art, দাদাইজম (Dadaism), যার অনেকটাই পুরাতন ধ্যান-ধারণার প্রতি বিদ্রূপপূর্ণ উপহাস, হাসি ঠাট্টা মস্করা এবং অযৌক্তিকতার সাথে পৌরাণিক শিল্পের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা। ১৯১৬ মেডিক্যালের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন আরাগোঁ, দাদাআন্দোলন ও পরাবাস্তবতা আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র কবি আঁন্দ্রে ব্রেটনের সাথে তার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং দাদা আন্দোলনের সাথে আরাগোঁ একাত্ম হয়ে ওঠেন। ব্রেটন বন্ধু থিওডোর ফ্রাঙ্কেলকে এক চিঠিতে আরাগোঁর সম্পর্কে বলেন যে “সে সত্যিই একজন কবি, ওর দৃষ্টিটা খুব উঁচুতে, মেধায় তীক্ষ্ণ, অল্প বয়সী, সবকিছু আনন্দের সাথে নিতে জানে, সম্ভবত আমাদের চেয়ে কিছুটা কম ভয়ানক হবে।”
যুদ্ধ নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডের জুরিখে হিগো বাল আর এমি হেমিংস “ক্যাবারে ভোলতেয়ার” খুললেন। এখানে সব ধরণের শিল্পীদের আড্ডা শুরু হলো, কবিতায়, উপন্যাসে, সঙ্গীতে, পেইন্টিংসে, ভাস্কর্যে, সমাজ, দর্শন ও রাজনীতিতে। এদের পুরোধায় ছিলেন ওয়াসিলি ক্যান্ডিস্কি,পল ক্লী, জিয়োরজিও দ্য শিরিকো,মার্ক্স এরনস্ট সহ আরও অনেকে। বিখ্যাত পেইন্টার মার্শাল দ্যুশঁ তো চির পরিচিত লিওনাদ দ্যভাঞ্ছির মোনালিসার মুখে একটা গোঁপ এবং একটা ছোট্ট দাঁড়ি লাগিয়ে দিলেন, ত্রিস্তান জারা শব্দ ছন্দ ছাড়া কবিতার পদ্ধতী এঁকে দিলেন। এইসময়ে একই রাস্তার উপরে লেনিন তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। কিন্তু তিনি এই ক্যাবারে আসতেন কিনা সেটা জানা যায় না, কিন্তু ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে তখন কমরেড লেনিনের প্রশ্নবিদ্ধ পুস্তক What Is to Be Done? কিংবা Materialism and Empirio-criticism প্রকারন্তরে যেন দিয়াশলাইয়ের কাঠি, দাদা-আন্দোলনের বারুদে আগুণ ধরিয়েছিল এবং তার জ্বলন্ত শিখায় আলোকিত হয়ে উঠেছিল সেই সময়ের তরুণ সমাজ, বিশেষত শিল্পী, কবি, লেখক ও রাজনীতিকরা।১৯১৩তে নোবেল প্রাপ্তির পর আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফ্রান্সে যথেষ্ট পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ফরাসি নাট্যকার ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং একজন ভারতপ্রেমিক শান্তিবাদী লেখক রোমাঁ রোলাঁ সহ আরও অনেকের সাথে কবিগুরুর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কবি আঁদ্রে জিদের অনুবাদে « গীতাঞ্জলী” প্রকাশিত হলে ৬৬০০ কপি বিক্রি হয়ে যায় এবং খুবই সুনাম অর্জন করেছিলেন কবি। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের সম্মান আরও বৃদ্ধি পেলেও রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদ সেভাবে যে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটা আজোবধি বলা যাবে না। কিন্তু লক্ষণীয় যে পরাবাস্তবাদী আন্দোলনের পুরোধায় যারা ছিলেন, বিশেষ করে আঁন্দ্রে ব্রেটন রবীন্দ্রনাথের কিছু বক্তৃতার সমালোচনা করে « একজন অশুভ প্রাচ্য আত্মা’ অভিহিত করেছিলেন।
আরাগোঁ প্রথমে “Aventures de Télémaque” (1921), এবং পরে “Mouvement perpétuel” (1926) দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখে তখনই পরাবাস্তবতার কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এখানে জানিয়ে রাখা দরকার যে surréalism বা পরাবাস্তববাদ নামকরণ করেছিলেন গিয়ুম আপলুনিয়ের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে দাদা আন্দোলনের দ্বারা মূর্ত বিদ্রোহের ফলস্বরূপ পরাবাস্তববাদ একটি শৈল্পিক আন্দোলন। কবিতায়, গল্প, উপন্যাসে, চিত্রকলা, অঙ্কনে, ফটোগ্রাফি, সিনেমায়, কোলাজে, পোশাকে ইত্যবিধ শিল্পের প্রথাগত যুক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত, একরৈখিকতা থেকে বহুরৈখিকতায় যাবার প্রবণতা, স্বীকৃত এবং প্রচলিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে লড়ায়ে উচ্চতর স্বপ্ন ও কল্পনার মানসিক শক্তির বিকাশে, আত্মনিঃসৃত চিন্তার প্রকাশে যারা পরাবাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি পল এলুয়ার্ড, দ্রিউ লা রসেল, রবার্ট ডেসনো, রনে মাগ্রিত, মার্সেল দুসঁ, সাল্ভাদোর ডালি, জ্যাক প্রেভার, ফিলিপ সপো ওঁ আরাগোঁ প্রভৃতিজন। নারীমুক্তি ও নারীবাদী আন্দোলনও এই সময়ে অত্যন্ত জোরালো হয়ে ওঠে। অস্তিত্ববাদ বা এসেনশিয়ালিজম-এর লেখক, নাট্যকার ও দার্শনিক জ্যা পল সাত্রের আমৃত্যু বান্ধবী “দ্বিতীয় লিঙ্গ” -এর রচয়িতা ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, ও ঔপন্যাসিক সিমোন দ্য বোভোয়ার (লে ম্যান্ডারিন” উপন্যাসের জন্যে Goncourt পুরস্কৃত) নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা, নারীর দেহ নারীর, নারীর সেক্সসের স্বাধীনতা চান, বিয়ে প্রথার বিরুদ্ধচারণ করেন। প্রিয় বন্ধু জ্যাঁ পল সাত্রের সাথে অভিনেত্রী অল্গা কসাকিউইজকে নিয়ে তারা তিনজনই একসাথে জীবন যাপন শুরু করেন। সমাজের বিধি নিষেধ, প্রচলিত ধ্যান-ধারনা থেকে বেরিয়ে এসে, চুল ছোট করে কাটা, জুপ ছোট করে পরা, পোশাক-আশাকে বিশেষ স্টাইল, জুতো, মাথার টুপি, পুরুষের মতো ধূমপান ইত্যাদি প্রচলনের সাথে সাথে মাদাম চ্যানেল-এর পারফিউম চ্যনেল৫ নারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্ণ বৈষম্যের স্বীকার হয়ে আমেরিকা থেকে চলে আসা সেই সময়ে বিখ্যাত ফলি বার্যেরের নাচিয়ে এবং পরবর্তীতে জাজ গায়িকা কৃষ্ণাঙ্গী আমেরিকান, উনিশ বছরের জোসেফিন বেকার প্রায় নগ্ন অন্তর্বাসহীন, কলার বেল্ট পরে পায়ের বিশেষ ছন্দে নাচ দেখিয়ে নানান তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে দিনে দিনে প্যারিবাসীর মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। অনেকই বিরুদ্ধাচরণ করলেও, এলসা ট্রিওলে, আরাগোঁ জোসেফিনের নাচকে প্রশংসা করে তার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন ।
আরাগোঁ চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়ে সার্বক্ষণিক লেখালিখি এবং রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এলুয়ার্ডের সাথে তিনি নাৎসিবাদের বিরোধিতা করেন। পরাবাস্তবাদের অনুসরণে, আরাগোঁ লিখলেন «Feu de joie» « Le Mouvement perpétuel » চিরস্থায়ী আন্দোলন যেখানে আধুনিকতা, প্রযুক্তির প্রভাব ও রাজনৈতিক সচেতনতা প্রতিফলিত হয়েছে।
১৯২৬-১৯২৮, আরাগোঁ প্রেমে উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশ কবি নান্সি কুনার্ডকে নিয়ে। ব্রিটেনে এক জাহাজ ব্যবসায়ী সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্মেও নান্সি বর্ণবৈষম্য এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। দাদাইস্ট ও সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। যৌনচারে বেপরোয়া, বিদুষী সুন্দরী এবং কবি এই রমণীর সাথে সেই সময়ে বড় বড় সব কবি-লেখক-চিত্রশিল্পী সহ অনেকেই প্রেমে পড়েছেন, এবং তাঁদের কাব্য, উপন্যাস এবং চিত্রকর্মকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর প্রেমিকাদের মধ্যে ত্রিস্তান জারা, আলডাউস উক্সলে, এজরা পাউন্ড, ভ্যান্দাম লুইস, হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস এবং ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও সংবিধান রচয়িতা ভি.কে কৃষ্ণ মেনন-এর নাম জানা যায়। কিন্তু শেষে নান্স্যির সাথে আরাগোঁর প্রেমের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নান্সিকে নিয়ে ভেনিসে বেড়াতে গিয়ে নান্সি এক জাজ পিয়ানিস্ট হেনরি ক্রাওডারের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়লে আরাগোঁ নান্সিকে ছেড়ে হোটেলে চলে যান এবং আত্মহত্যা করার চেষ্টা নেন।
১৯২৮ সালে প্যারিসের মোম্পারনাসে আমেরিকান ব্রাসেরি রেস্তরাঁ “লা কুপল”-এ রাশিয়ান বংশোদ্ভুত লেখক এলসা ত্রিওলের সাথে আরাগোঁর পরিচয় হয় এবং তখন থেকেই তার সঙ্গিনী এবং তার সমস্ত কাজের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। ইহুদী পরিবারের উকিল বাবা এবং পিয়ানিস্ট মা’র সন্তান এলসা এবং লিলি বড় হয়ে উঠেছিলেন রুশ, জার্মান ও ফরাসি সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে। দুবোনেরই প্রেমিক কবি, নাট্যকার,অভিনেতা মায়াকোভস্কি ছাড়াও অনেক বিখ্যাত রুশ কবি ও লেখকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন সেই ছোট বেলা থেকেই। এদের মধ্যে কবি ও ঔপন্যাসিক বরিস পেস্তারনাক, ম্যাক্সিম গোর্কিও ছিলেন। এলসা আর্কিটেক্ট ছিলেন। মস্কোতে একজন ফরাসী আর্কিটেক্ট অফিসার আন্দ্রে ত্রিওলের সাথে তার পরিচয় হয় এবং পরবর্তীতে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পরে এলসা স্বামীর সাথে প্যারিসে আসেন। কিন্তু কয়েক বছর পরেই মতানৈক্যের কারণে তারা পারস্পারিক সমঝোতায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। এই সময়ে প্যারিসে কবি সাথী অভাবে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ জীবন যাপন যখন করছিলেন। এলসার এক বান্ধবীর মাধ্যমে আরাগোঁর সাথে তার পরিচয় হয়।
প্রেমিকা এলসাকে নিয়ে আরাগোঁর অসংখ্য কবিতা ফরাসী ছাড়াও বিশ্বসাহিত্যে গুরুত্ব পেয়েছে।
প্রায় দশ বছর পরে বিয়ে করলেও এলসা প্রথম স্বামীর নাম তার নামের সাথে আমৃত্যু জড়িয়ে রেখেছিলেন।
“আমি ভবিষ্যতের কিছুই জানি না, আমি ভালবাসতে ভালবাসি এবং আমি ভালবাসতে বাসতেই মরে যাব।“। আরাগোঁ লেখেন।
রোববার হোক বা সোমবার
সকাল-সন্ধ্যা-দুপুর অথবা মধ্যরাত
নরকে বা স্বর্গে
ভালোবাসায় প্রেমে আলিঙ্গনে
আমি তোমাকে গতকাল বলেছিলাম
আমরা একসাথে ঘুমাবো
গতকাল কিংবা আগামীকাল
শুধু তুমিই আমার চেনা পথ
তোমার হাতে রেখেছি আমার হৃদয়
তোমার সাথে আত্মার আত্মীয়তা
জীবনের যেটুকু আছে সময়
আমরা একসাথে ঘুমাবো
আমার ভালোবাসা যা ছিল থাকবে চিরকাল
আমাদের উপর বিছানো চাদর আকাশ
আমার বাহুর নিবিড় বন্ধনে তুমি
অন্তরে কাঁপন ভালবাসি তোমায়
তুমি যতক্ষণ চাও যতো সময়
আমরা একসাথে ঘুমাবো
আরাগোঁ ১৯২৭ থেকে ফ্রান্সের কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, এবং তখন থেকেই আমৃত্যু তিনি ফ্রান্সের কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রিকার « l’Humanité » সাংবাদিক এবং পরে « Ce Soir » পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে একাধারে তিনি লিখেছেন, ডাক্তার হিসেবে জনগণের সেবা দিয়েছেন, সম্পাদকীয় লেখায় কম্যুনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা জনগণকে ওয়াকিবহাল করেছেন, আলিয়েন্স দেশের প্রতি যুদ্ধ বিরতির পক্ষে “Vive la Paix » শান্তি প্রচারণা করেছেন, রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং কবিতার মাধ্যমে জনগণকে একত্রিত হবার আহবান জানিয়েছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে, শান্তির চিহ্ন সাদা কবুতরের কাহিনীটি এখানে বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবার পরে ফ্রান্স কম্যুনিস্ট পার্টি আয়োজিত বিশ্ব শান্তি দিবসে আরাগোঁ একটা সাদা কবুতরের জন্যে বন্ধু পিকাসোর কাছে যান। পিকাসোর খাতায় অনেকগুলো কবুতর আঁকা ছিল, সেটা থেকেই আরাগোঁ একটা ছবি বেছে নেন এবং তখন থেকেই বিশ্বশান্তি সম্মেলনে শ্বেত কবুতর শান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে।
১৯৩১ এর পর থেকে পরাবাস্তববাদ থেকে সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদের দিকে আরাগোঁ আগ্রহী হয়ে উঠেন। স্তালিনের একনায়কতন্ত্রকে আরাগোঁ মেনে নিতে পারেননি এবং তিনি ইউএসএসআর-এর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। একই মত ও আদর্শের ধারক রোমাঁ রোলাঁর সাথে আরাগোঁ
সামাজিক সচেতনতা, গণমানুষের অধিকার এবং বিশ্ব সংস্কৃতির উন্নয়নে কবি শিল্পী লেখক বুদ্ধিজীবীদের একত্রিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। জীবনের সর্বত্রই বেপরোয়া, নির্ভীক ও মানবতাবাদী, নারীবাদী এবং নাস্তিক এই লেখকের সহচর ও জীবনীকার পিয়ের ডেক্স-এর লেখায় জানা যায় যে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য থাকাকালীন অনেক দায়িত্বে আরাগোঁর সুনাম থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে সমঝোতা করায় তাঁর বদনামও কমও ছিল না।
“তারা আমাদের আত্মার মাহাত্ম্যের জন্য হাসবে
তারা আমাদের বিদ্রোহকে ভালবাসার জন্য হাসবে”
১৯৩২ সালে আন্দ্রে ব্রেটনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। প্রতিরোধ কার্যকলাপের সমান্তরালে, তিনি আরও ধ্রুপদী শৈলীতে ফিরে এসে উপন্যাস লেখার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং সামাজের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে সমালোচনা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা নিয়ে লিখতে থাকেন।
Les Cloches de Bâle (১৯৩৪), Les Beaux Quartiers (১৯৩৬), Les Voyageurs de l’Impériale (১৯৪২) লেখেন। ১৯৩৯ সালে তিনি এলসা ত্রিওলকে বিয়ে করেন।
আরাগোঁর সাথে এলসা নামটি পরবর্তীতে এমনই অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে যে ফরাসি সাহিত্যে এঁরা প্রতীকী দম্পতি হয়ে উঠেছিলেন। প্রেমিকা বা স্ত্রীকে নিয়ে এতো রোমান্টিক কবিতা বিশ্ব সাহিত্যের আর কোন কবি লিখে যেতে পারেননি। পরপস্পরের ধ্যান ধারণা এবং ভাবানুভুতিতে তারা একে অপরের সম্পূরক এবং প্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন। আরাগোঁ বলেই দিলেন,
“আমি ভবিষ্যতে কিছুই জানি না, তবে আমি ভালবাসতে ভালবাসি এবং ভালবাসতে বাসতে আমি মারা যাব”।
“গানের চেয়ে ভালোবাসা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এটা বললেও যথেষ্ট নয়, এক কথায়, ভালোবাসা ছাড়া বাকি আর সবকিছুই কেবল ঝরা পাতা”।
১৯৪২ তে তিনি “ক্যান্টিক এলসা” এবং “এলসার চোখ” কাব্যগ্রন্থ দুটি প্রকাশ করেন।
এলসার চোখ
তোমার চোখ এতোই গভীর যে আমি পান করতে নিচু হয়ে যাই
দেখেছি অসংখ্য সূর্য সেখানে সমবেত আলোক বিচ্ছুরণে
সকল হতাশা ঝাঁপিয়ে পড়তে মরণে
তোমার চোখ এতোই গভীর আমার স্মৃতি নিয়ত হারায়।
পাখির ছায়ায় উন্মাদ উতল সাগর
তোমার চোখ বদলে যায় হটাৎ মৃদু আবহাওয়ায়
গ্রীষ্ম মেঘ কেটে দেবদূতের অনাবৃত পোশাক বানায়
আকাশ কখনো হয় না নীল সবুজ গমের উপর
বাতাস বৃথাই তাড়ায় স্পর্শকাতর স্বর্গের নীল
তোমার চোখ তীক্ষ্ণ আরো যখন অশ্রুতে ঝিকমিক
তোমার চোখ বৃষ্টির পর আকাশকে ঈর্ষান্বিত করে অধিক
ভেঙে গেলে কাঁচ কখনই হয় না এতো নীল
সাত দুঃখের জননী হে ভেজা আলো
রঙের প্রিজম বিদ্ধ করেছে সাত তলোয়ার
কান্নার মাঝখানে যে দিনটি মর্মস্পর্শী আরও
নীল আইরিস শোকে ছিদ্র বেদনার্ত কালো
দুর্ভাগ্য তোমার চোখজোড়া ওরা বিদ্ধ করে
রাজারা অলৌকিক কাজে পুনঃউৎপাদনে তৎপর
হৃদস্পন্দন নিয়ে তিনজন দেখল অতঃপর
মেরির কোট ঝুলছে তারে
সব গানের জন্য এবং সব কবিতার
শব্দের জন্য মে মাসে একটি মুখই অনুপম
লক্ষ নক্ষত্রের জন্য একটি মহাকাশ খুব কম
রহস্য উন্মোচনে মিথুন রাশিদের, তোমার চোখ দরকার
শিশুদের ছবি ছড়িয়েছে সুন্দর দিগ্বিদিক
অগোছালো প্রকাশ তাদের করেছে বিস্তার
যখন চোখ বড় করে দেখো, জানি না তুমি মিথ্যা বলছো কিনা
মনে হয় বুনো ফুল ফুটেছে বর্ষণে চারিদিক
ওরা কি ল্যাভেন্ডারের মধ্যে বজ্রপাত লুকিয়ে রেখেছে কোথাও
প্রেমের হিংসায় কামড়ে আগের মতোই পোকামাকড়
আমি সিনেমার তারকাদের জালে ধরা পড়ে আছি
আগস্টের মাঝামাঝি সমুদ্রে ডুবে যাওয়া নাবিকের মতো
আমি পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম নিয়েছি
নিষিদ্ধ আগুনে আমার আঙ্গুল পুড়েছে
শতবার হারানো স্বর্গ আমি খুঁজে পেয়েছি
তোমার চোখ আমার পেরু, আমার গোলকুন্ডা, আমার ইন্ডিজ
সেটা ঘটেছিল এক সুন্দর সন্ধ্যায় মহাবিশ্ব ভেঙে চুরমার
দুষ্কৃতকারীরা আগুণ ধরিয়ে দিয়েছিল জাহাজের প্রাচীর
আমি জ্বলজ্বলে আগুণ দেখেছি সমুদ্রের উপর
সে চোখ এলসার সে চোখ এলসার সে চোখ এলসার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৩৯ সালে আহত সেনাদের সেবা দেবার জন্যে সামরিক চিকিৎসা বিদ্যায় ফিরে আসেন লুই আরাগোঁ। দেশ মুক্তির লড়াইয়ে জনমত গঠনের কাজে এলসা ত্রিওলকে নিয়ে তিনি দক্ষিণ অঞ্চলে « জাতীয় লেখক কমিটি” প্রতিষ্ঠা করেন। ২৭ জুন, ১৯৪১ জার্মান বর্ডার থেকে আরাগোঁ ও এলসাকে বন্ধী করে টুর শহরের জেলে রাখে জার্মান সেনা, কিন্তু এলসার চাতুর্যপূর্ণ সাজানো গল্পে ১৫ই জুলাইতে ছেড়ে দিলে তাঁরা নিস শহরে গিয়ে কিছুদিন বসবাস করেন। এই সময়ে তিনি “Le Musée Grévin”, (1943), “La Rose et le Réséda” (1944) এর মতো উল্লেখযোগ্য কবিতা লেখেন। “গোলাপ এবং রেসেদা” কবিতায় (গোলাপ অর্থে কম্যুনিস্ট এবং ক্যাথলিক বা কাপিট্যালিস্টে বিশ্বাসী রেসেদা হলো সাদা বন্য ফুল ) দেশের সবাইকে সমবেত হবার আহবান জানান।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর একাংশ মার্শাল ফিলিপ পেতাঁ ভিসি শহরে নিজ সরকার গঠন করে সর্বময় ক্ষমতায় ইতালি-জার্মানির পক্ষ নিয়ে প্রতিরোধকারীদের হত্যা ও অত্যাচার শুরু করলে, শত্রুবাহিনীকে প্রতিহত করতে দেশবাসীকে একত্রিত হয়ে লড়ায় করার আহবান জানান ফরাসি জাতীয় মুক্তি কমিটির প্রধান জেনারেল দ্য গোল। সর্বত্র খাদ্যভাব, গাছের পাতা, কুকুর বিড়ালের মাংস পর্যন্ত খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ফরাসী বাহিনী প্লেন থেকে গ্রামে গ্রামে খাবার ফেলে দিতে থাকে, সেই সাথে বন্দুক এবং আরাগোঁর দুটি কবিতা। তার একটি কবিতা ‘গোলাপ এবং রেসেদা’।
গোলাপ এবং রেসেদা
(কবিতাটি উৎসর্গ করেন কম্যুনিস্ট পার্টির ৪জন কমরেডকে যাদেরকে গুলিবিদ্ধ করে মারা হয়েছিল। এরা ছিলেন গ্যাব্রিয়েল প্যেরি, এস্তিয়েন দর্ভ, গি মকে এবং জিল্বারট দ্রু)।
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
দুজনই সুন্দরকে ভালবাসতো
বন্দী সৈন্যদের মই বেয়ে উঠেছিল
আর নিচে দেখছিল
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
নাম যাই হোক না কেন
পদধূলিতে উভয়ের স্পষ্টতা ছিল
যে একজন গির্জা থেকে এসেছেন
আর একজন ধর্ম থেকে পালিয়েছেন
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
দুজনেই বিশ্বস্ত ছিলেন
হৃদয়ের ঠোঁট থেকে বাহু পর্যন্ত
দুজনেই বলেছিল তারা দীর্ঘজীবী হবে
দুজনেই বলেছিল তারা বেঁচে থাকবে
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
যখন গম শিলাবৃষ্টির নিচে থাকে
পাগল যে চালাকি করে
পাগল যে তার পাগলামির কথা ভাবে
যে কোন লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
দুর্গের উপর থেকে সেন্ট্রি গুলি করে দুজনকে
একজন দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধতায়
অন্যজন পড়ে মারা যায়
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
তারা কারাগারে ছিলেন
ঘন বরফে জমে থাকা
বিষাদী তৃণশয্যা থেকে দূরে
যার একটি ইঁদুর পছন্দ করে
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
বিদ্রোহী বিদ্রোহীই
তাদের আর্তনাদ এক একটি মৃত্যুঘণ্টা
বেদনার ঘন কুয়াশায় যখন ভোর আসে
জীবন থেকে মৃত্যুতে দেয় পাড়ি
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
একজনের নামের পুনরাবৃত্তি
করে ওরা প্রতারণা করেনি কেউই
তাদের দুজনেরই ধমনীতে রক্ত
একইভাবে লাল এবং চকচকে
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
যে মাটিকে তারা ভালোবাসেন
তাতে ডুবে থাকে মিশে থাকে প্রতিদিন
সেখানে নতুন মৌসুমে নতুন ফসল
অপরূপ বাহারে পাকা আঙ্গুর
যিনি স্বর্গে বিশ্বাস করেছিলেন
এবং যিনি সেটা বিশ্বাস করেননি
একজনের ডানা আছে, আরেকজন দৌড়াবে
ব্রিটানি কিংবা জুরা থেকে
রাস্পবেরি কিংবা মিরাবেল কুড়াবে
বাঁশি বলো কিংবা ভায়োলিন
বনের ফড়িং আবারো গাইবে
ওদের ভালোবাসায় জ্বলবে আগুণ
ফিঙে বুলবুলি একসাথে আবার
গোলাপ মিগনেটের ডালে গাইবে
জার্মানিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছড়ানোর কারণে আরাগোঁ এবং তাঁর ইহুদী স্ত্রীকে বন্ধী করার উদ্যোগ নিলে, স্ত্রী এলসাকে নিয়ে তিনি ১৯৪৩-এ সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ফ্রান্সে ভ্যালেন্সের কাছে একটা গ্রাম সাঁ দোনায় সাধারণ একটা পরিবারের সাথে ১৯৪৪ পর্যন্ত লুকিয়ে থাকেন। নিরপত্তার জন্যে উভয়ের জন্যে আইডেন্টিটি কার্ড তৈরি করে নেন। এটা বেশ কৌতূহলের বিষয় যে এই সময়ে তিনি তাঁর অপরিচিত বাবার নামে নিজের ছবি দিয়ে আইডেন্টিটি কার্ড তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এমন প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে ওঁরা কখনই বিরত থাকেননি। এলসাকে নিয়ে এখান থেকেই তিনি একটা সংবাদপত্র “লা ড্রম অন আর্মস” প্রকাশ করেন। অনেক কষ্ট করে কাগজ, কালি সংগ্রহ করতে পারলেও মুদ্রণের সুযোগ না-থাকায় সারাদিন রাতে এলসার হাতে লেখা পত্রিকা নিয়ে এক গ্রামবাসীর গাড়ি করে রাতের অন্ধকারে গ্রামে গ্রামে দিয়ে আসতেন। প্রতিদিনকার ঘটনা, সেনা এবং দেশবাসীকে কি করতে হবে, ইত্যবিধ নির্দেশ দিয়ে ৪টি সংখ্যা ওঁরা প্রকাশ করেছিলেন।
কবিতায়, উপন্যাসে এবং অনুবাদ সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে ১৯৪৪ সালে এলসা ত্রিওলেকে « Goncourt » পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। তিনিই প্রথম মহিলা এই পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
কবিতা, উপন্যাস ছাড়াও ফরাসি-রুশ সাহিত্যে দুদিক দিয়েই অনুবাদ সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি আরাগোঁ, মায়াকোভস্কি, দস্তভয়োস্কি, শেকভ, গোর্কি অনুবাদ করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছাড়া আরও একজন কালো আমেরিকান, ফলি বার্যেরের বিশেষ নাচিয়ে এবং জাজ গায়িকা, জার্মানের কবল থেকে ফ্রান্সের মুক্তির জন্যে লড়ে গিয়েছেন এবং আমৃত্যু মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন, তিনি হলেন জোসেফিন বেকার। অত্যন্ত প্রিয় এবং সর্বত্রই জনপ্রিয় এই মানুষটিকে নিয়ে দুকথা এখানে বলতেই হয়।
« আমার দুইটা প্রেম, এক আমার দেশ (আমেরিকা), আরেক প্যারিস” জোসেফিনের বিখ্যাত উক্তি। মুক্তি সংগ্রামে বিপক্ষদলের ভিতরে গোয়েন্দাগিরিসহ নানাবিধ অবদানের জন্যে জোসেফিনকে ফ্রান্স মিলিটারি থেকে একাধিক পুরস্কার শুধু নয়, স্বয়ং শার্ল দ্য গোল, তাঁকে সোনার পদক দিয়ে সম্মানিত করেছেন, যদিও সেই পদক অকশনে চড়া মূল্যে বিক্রি করে দিয়ে পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্স মুক্তিসংগ্রামের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৭৫ এর ১২ই এপ্রিল, জোসেফিন মঞ্চে গান গাইতে গাইতে মাথায় রক্তক্ষরণের কারণে পড়ে যান এবং কয়েক ঘণ্টা পরে হাসপাতালে মারা যান। ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঘোষণায় “স্বাধীনতা ও মুক্তির” প্রতীক হিসেবে তাঁর দেহ ৩০নভেম্বর ২০২১ রাষ্ট্রীয় সম্মানে রাষ্ট্রীয় সমাধিস্থান পান্থেয়োতে আনা হয়। জেসেফিনই প্রথম কালো মহিলা যিনি পান্থেয়োতে অমরত্ব পেলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাগোঁ তার সাহিত্যকর্ম এবং ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে তার সক্রিয়তার মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরি করে নেন। তিনি কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা সংস্থা ফরাসি পাবলিশার্স ইএফআর-এর প্রেসিডেন্ট রইলেন এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাস্তবতা নিয়ে এবং সমাজে সাম্যবাদের অপরিহার্য প্রয়োজনের পক্ষে কথা বলতে শুরু করলেন। কিন্তু কবিতা নয়, সহজ গদ্যে, তাঁর নিজস্ব রচনাশৈলী দিয়ে মানুষের কাছে তাঁর বক্তব্য এবং ব্যাখ্যা পৌঁছে দিতে চাইলেন। এই সময়ে তাঁর কয়েকটি উপন্যাস অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য: অরেলিয়েন (১৯৪৪), লে কমিউনিস্টস-৬টি ভ্যলুম (১৯৪৯-১৯৫১), লা সিমেন সেন্ত (১৯৫৮)।
বিভিন্ন সময়ে লেখায় কিংবা আলোচনায় আরাগোঁর কিছু কিছু উক্তি আজোবধি মানুষের মুখে মুখে। তার কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
“কোন কোন দিন মানুষের নোংরামি মুছে ফেলার জন্যে একটা রাবার গামের স্বপ্ন দেখি।”
“সূর্য সর্বদা তার উপাসকদের চোখেই আঘাত করছে।“
“কাজের মাধ্যমেই মানুষ রূপান্তরিত হয়।”
“আমি পুরুষের রাজত্বের শত্রু যা এখনও শেষ হয়নি। আমার কাছে নারী মানুষের ভবিষ্যৎ, এই অর্থে যে মার্কস বলেছিলেন যে মানুষ মানুষের ভবিষ্যৎ।”
“জয়লাভ যদি করতে চান, সামনে শূন্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন এবং শিখুন।“
“আমি এমন পরিস্থিতিতে বাস করি যা আমাকে দেওয়া হয়। আমি কি আমার নাকের আকৃতি, আমার মুষ্টির শক্তি বেছে নিয়েছি? আমি যা লিখি তা আপনি যখন পড়বেন, তখন মনে রাখবেন জীবন নিজই একটি ভাষা, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি লেখা। তাদের ব্যাকরণগুলো বিনিময়যোগ্য নয়, এগুলো অনিয়মিত ক্রিয়া” ।
পরাবাস্তববাদ থেকে কমিউনিজম, স্টালিনবাদ থেকে রোস্ট্যান্ডের ভাবধারায় এবং কখনও কখনও
দেরোলেদের জাতীয়তাবাদের বিরোধিতার মাধ্যমে, আরাগোঁ চমকপ্রদ একটা বিদ্রোহের নমুনা রেখে গেছেন যা বৈচিত্র্যময়, পরস্পরবিরোধী এবং দৃশ্যত ধ্রুবক।
কবিতা এবং উপন্যাসে শব্দশৈলী, বাক্যকৌশলে অভিনবত্ব, সাহিত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিহ্নিত, আধুনিক ধ্রুপদী ধারার কবি আরাগোঁকে আজ বিংশ শতাব্দীর একজন প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই শতাব্দীর প্রধান গায়কয়েরা তার কবিতা নিয়ে গান করেছেন, যেমন লেও ফেরে, জঁ ফেরা বা জর্জ ব্রাসাঁ প্রভৃতিজন।
প্যারিস থেকে অনতিদূরে মুলাঁ দ্য ভিলনভ’এর ছয় হেক্টর বিস্তৃত বাগান ঘেরা বাড়ির এক কোণে এলসা ত্রিওলের মরদেহ শায়িত আছে। আজোবধি ঘরের মধ্যে দেয়াল ঘড়িটির কাঁটা ১৬ই জুন ১৯৭০ তে থেমে আছে। এখানে জঁ সিবাস্তিয়া বাকের « লা সারাবান্দ” সুরধ্বনির মূর্ছনায় তাঁর লেখা এফিটাফের শব্দগুলো হলুদ ঝরা পাতার সাথে ইতিহাস-বন্দিত।
“অবশেষে আমরা যখন পাশাপাশি শুয়ে থাকব, ভবিষ্যতকে আরও ভাল বা খারাপের জন্য আমাদের বইগুলো আমাদেরকে একত্রিত করবে যা আমাদের স্বপ্ন এবং আমাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল। ক্রস চিহ্ন নিয়ে সাদা পাতায় কালো অক্ষরের বইগুলো আমাদের সামনে আসবে, এবং আমাদের একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার বিরোধিতা করবে।” এলসা ত্রিওলে।
১৯৫৩-১৯৭২ সময়কালে সোভিয়েত-এর পক্ষে ভিন্নমতাবলম্বীদের সমর্থনের লক্ষে এবং কম্যুনিস্ট পার্টির আর্থিক সহযোগিতার জন্যে তিনি « ফ্রান্সের চিঠি” (les lettres française) পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তিনি ইউএসএসআর-এর দমন ও একনায়কতন্ত্র বিষয়ে তাঁর অনৈক্যতা থাকলেও ফ্রান্স কম্যুনিস্ট পার্টির কাছে সরাসরি তিনি দ্বিমত পোষণ করতে পারেননি।
« তাঁকে ছাড়া আমি কিছুই হতে পারতাম না » জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এলসার প্রতি আরাগোঁর গভীর প্রেম থাকলেও জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি সমকামী হয়ে ওঠেন। অবশ্য তার এই প্রবণতা তার প্রথম জীবনেও ছিল বলে অনেকে মনে করেন। তার জীবনীকার পিয়ের ডেক্সের লেখায় জানা যায় যে কম্যুনিস্ট পার্টি অফিসে শুধু একজনই গোলাপি টাক্সোডো স্যুট পরে আসতেন, এবং তিনি ছিলেন আরাগোঁ।
১৯৬৩তে রক অ্যান্ড রোল গায়ক তরুণ জনি হলিডে, যিনি পরবর্তীতে বিখ্যাত পপ গায়ক ও অভিনেতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আরাগোঁ বলেন যে, “তরুণদের পছন্দকে আমি নিশ্চয় অস্বীকার করিনা, আমার মতো বৃদ্ধও তার গানকে পছন্দ করে, তবে গানের ভিতরে কবিতার শক্তিই প্রবল। শেষপর্যন্ত কবিতারই জয়।“
“যুবকরাই সমাজের ভবিষ্যৎ” ১৯৬৮ সালে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামনে এসে আরাগোঁ বলেন “বয়স্কদের সামনে এসে তোমাদেরকেই বলতে হবে যে তোমরা যা ভাবছো সেটাই সঠিক, সেটা যদি না-বলতে পারো, তোমরাই তোমাদের শত্রু হয়ে উঠবে।”
ফরাসি সাহিত্যে স্যাতোব্রিওঁ কিংবা ভিক্টর হুগোর উত্তরাধিকারী কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গিউম অ্যাপোলিনায়ার, চার্লস পেগি, পল ক্লদেল, পল ভ্যালেরি ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে আরাগোঁ এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা জনপ্রিয় কবি হিসেবে তাঁর নাম সগর্বে খোদাই করে গিয়েছেন।
প্রাজ্ঞ সমাজে একথা কারুর অবিদিত নয় যে ১৯৫৮ থেকে প্রায় প্রতিবছরেই নোবেল পুরস্কার প্রস্তাবনায় তাঁর নাম থাকলেও একজন কম্যুনিস্ট কবিকে নোবেল কতৃপক্ষ পুরস্কৃত করতে চায়নি।
লুই আরাগোঁ চল্লিশ বছর আগে, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৮২, ৮৫ বছর বয়সে মারা যান।
আমীরুল আরহাম: চলচ্চিত্র নির্মাতা, কবি ও প্রাবন্ধিক