মূল: জোহরা সাইয়েদ, অনুবাদ: রুখসানা কাজল
আমার যখন দশ বছর বয়স তখন সাকিনা নামে আমার সমবয়েসি একজনের সাথে ভীষণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। যে সময় সাকিনার সাথে আমা্র বন্ধুত্ব হয়েছিল সে সময় আমাদের বাসায় ছয়টি মেয়ে ছিল। কারণ তখনও আমার ছোট দুভাইয়ের জন্ম হয়নি। আর সাকিনা ছিল সাত সাতটি উঠতি তরুণ এবং বিবাহিত ভাইদের একমাত্র বোন। ওদের বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির একেবারে পাশে। কিন্তু ওর আব্বু ছিল ভয়ঙ্কর কঠিন মনের মানুষ। সাকিনার বাসার বাইরে খেলতে যাওয়ার খুব বেশি অনুমতি ছিল না। তাছাড়া সাকিনাকে বাড়ির কাজ করতে হত। তাই ওর আব্বু যখন ঘুমিয়ে থাকত ওর আম্মু চুপিচুপি ওকে আমাদের উঠানে খেলতে পাঠিয়ে দিত।
আমাদের দুবাড়ির মাঝখানে একটি শুকনো জলাভূমি ছিল। বছরে মাত্র দুবার জলাভূমিটি পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যেত । তবে সে পানিও ছিল একেবারে অগভীর, খুব সামান্য।
জলাভূমির যে অংশটি সাকিনাদের বাড়ির দেওয়ালের সাথে সংযুক্ত ছিল সেখানে একটি সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ মত ছিল। যদিও হামাগুড়ি দিয়ে চলাচলের জন্যে এটা বেশ বড়সড়ই ছিল । আমার বড় বোন এই সুড়ঙ্গটি সাকিনার জন্য আবিস্কার করেছিল। সাকিনা যখন নিশ্চিত বুঝতে পারত যে ওর আব্বুর নাক ডাকছে মানে ঘুমুচ্ছে, তখন সাথে সাথে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে এসে আমাদের সাথে খেলা করে যেত ।
আমার আব্বুকে ব্যবসার কাজে প্রায়ই ট্যুরে যেতে হত। এ সময় আমাদের কথা ভেবে আব্বুর খুব মন খারাপ হয়ে যেত। আব্বু তাই ঘরে ফেরার সময় তাঁর প্রতিটি সন্তানের জন্য ব্যাগভর্তি করে প্রচুর খেলনা নিয়ে আসতেন। এছাড়া আমাদের খেলাধুলার জন্য আব্বু বাড়ির উঠানে একটি ছোট্ট খেলাঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। চকচকে উজ্জ্বল ছোট ছোট খেলনাপাতি, রান্নাবাটির সেট, পুতুলের জন্যে সুন্দর পানীয় পাত্র এবং লাঠি হাতে ছিন্ন কাপড় পরা পুতুলসহ আরও যে সব খেলনা তিনি নিয়ে আসতেন সেগুলো দিয়ে আমরা ওই খেলাঘরটাকে ভরে ফেলতাম।
গাছের পাতা, বেরি, ঘাস, কাদামাটি দিয়ে আমরা মিথ্যে মিথ্যে খাবার দাবার রান্না করে ডিনার পার্টি করতাম। পুতুলগুলো ছিল আমাদের সন্তানের মত। আমাদের মা যেভাবে সন্তানদের কোলে করে আদর করত আমরা সেভাবে ছোট পুতুলগুলোকে কোলে করে রাখতাম। আমাদের সাতজনের স্বপ্ন জগত আমাদের মত করেই পার হয়ে যেত। একমাত্র সাকিনার আব্বুর কাশির শব্দ আমাদের স্বপ্ন জগতের দেওয়াল ভেদ করে ভেসে আসত। আর সেই শব্দ শুনলেই আমরা সতর্ক হয়ে যেতাম। বুঝতে পারতাম সাকিনার আব্বু ঘুম থেকে জেগে উঠেছে এবং এখুনি সাকিনাকে খুঁজতে শুরু করবে।
সাকিনার হাতের কব্জি থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সুন্দর সুন্দর চুড়ি এবং নূপুর দিয়ে ভরা ছিল। আমি এবং আমার বোনরা এই সুন্দর চুড়িগুলোর প্রেমে পড়ে গেছিলাম। আমাদের কখনও এরকম চুড়ি বা এমন কিছু পরতে দেওয়া হত না যা প্রচুর শব্দ করে বাজত । এমনকি আব্বুর সামনে আমরা গুনগুন করতে বা গাইতেও পারতাম না। সুতরাং, আমরা ছয়বোনই সাকিনার অসংখ্য ছন্দে বাজা শব্দময় চুড়ি দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকতাম যা পরা আমাদের জন্য নিষেধ ছিল। আমরা তখন করতাম কি, নানারকমের লতাপাতা দিয়ে সাকিনার মত হাতে চুড়ি এবং পায়ে নূপুর বানিয়ে পরতাম। বাস্তবে না হোক আমাদের স্বপ্ন কল্পনার জগতে ত আমরা সাকিনার মত চুড়ি আর নূপুর পরতে পারতাম।
একবার আমার আব্বু আম্মু দুজনকেই কি কারণে যেন কয়েকদিনের জন্য বাইরে যেতে হয়েছিল। তখন সাকিনাদের বাসায় আমাদের থাকতে হয়েছিল।
আমার দাদিমা না আসা পর্যন্ত সাকিনার মা আমাকে এবং আমার বোনদের দেখাশুনার জন্য রাজি হয়েছিলেন। এটা ছিল মাত্র দুই দিনের জন্য। প্রথম রাতে ঘুমানোর সময় সাকিনা তার চুড়ি এবং নূপুরগুলো খুলে রেখেছিল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, অই গয়নাগুলো পরার লোভ আমি কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না। লজ্জা লজ্জা কুন্ঠায় আমি ঘুমন্ত সাকিনার মাথার কাছে গিয়ে খুব আস্তে ফিসফিস করে বলেছিলাম, “সাকিনা এ সাকিনা, আমি কি তোর গয়নাগুলো একবার পরতে পারি ? শোন না, মাত্র কিছুক্ষণের জন্য পরব প্লিজ। এই তুই শুনছিস ত সাকিনা !” যদিও আমার ডাকাডাকিতে সাকিনা কোন সাড়া দেয়নি। তার অবশ্য কারণ আছে। আমি এমনভাবে ওকে ডাকছিলাম যাতে ও সম্পূর্ণ সজাগ না হয়ে ওঠে। মনে মনে ভয় ছিল যদি ও গয়নাগুলো পরতে আমাকে না বলে দেয় !
আমার বিবেক সত্য- এমন ভাব দেখিয়েছি আমি। সাকিনার অনুমতি নিতে ওকে ত জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছি। ও ঘুমিয়ে থাকলে আমার কি ! তাই এভাবে ওর গয়নাগুলো পরার জন্য আমার কোন অপরাধই হবে না !
ঘরের এক কোণে বসে আমি সাকিনার সমস্ত চুড়ি এবং নূপুরগুলো পরেছিলাম। আমার হাত ও পায়ে খুব সুন্দরভাবে সেগুলো ফিট করে গেছিল। কি যে ভাল লাগছিল ! যদিও ওগুলো খুব ভারী ছিল। কিন্তু আমার ভীষণ ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। যতবার আমি হাত পা নাড়াচাড়া করছিলাম গয়নাগুলো ততবার তীব্র ঝাঝালো ভাবে চিং চিং করে বেজে উঠছিল।
চিং ! চিং ! চিং! আমার ঘুমন্ত বোনদের পাশ দিয়ে আমি হাঁটছিলাম আর আমার হাত পা থেকে গয়নাগুলো বেজে উঠছিল। চিং ! চিং ! চিং !
চিং চিং। চিং ! খুশীতে আমি ইচ্ছে করেই হাঁটাহাঁটি করি। হাত দোলাই। আর গয়নাগুলো নানা শব্দে বেজে বেজে উঠে।
হঠাৎ আমার মনে হল এই শব্দগুলোর খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং গূঢ় গভীর অর্থ রয়েছে। আমি পিছনের দরজার কোণে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং সামনে পেছনে আমার হাত দোলালাম। সামান্য কিছুক্ষণের জন্যে একটুখানি আমার পা ঠেকিয়ে রাখলাম। অমনি শুনতে পেলাম হাত পায়ের গয়নাগুলো একসাথে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা রকমের শব্দ করে বেজে উঠল। মনে হল আমার শরীরে পরা ঠান্ডা গয়নাগুলো সাথে সাথে গরম হয়ে উঠল।
“চিং! চিং ! চিং!” এরকম বাজনা বাজানো মজার খেলার মধ্যে বুঝতে পারলাম প্রচুর পানি খেয়েছিলাম বলে আমার এখন ওয়াশরুমে যেতে হবে। এমনিতে রাত্তির বেলা একা ওয়াশরুমে যেতে আমি ভয়ঙ্কর রকমের ভীতু ছিলাম। এদিকে আবার লজ্জায় কাউকে ডাকতেও পারছিলাম না। কারণ অনুমতি না নিয়ে সাকিনার গয়না পরেছি বলে বুঝতে পারছিলাম ছোট করে হলেও আমি অপরাধ করে ফেলেছি।
অবশেষে আমি আমার সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে ভয়ে ভয়ে পিছনের দরজা দিয়ে একা একা বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
চিং ! চিং ! চিং ! অশরীরী জ্বীনদের ভয়ে আমি চুড়ি এবং নূপুরে অনেক বেশি বেশি করে শব্দ করতে শুরু করেছিলাম। আমার ধারণা ছিল জ্বিনরা উঠানের খোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বা গাছের ডালে ডালে ঝুলে দোল খাচ্ছে।
চিং ! চিং! চিং ! ভয় তাড়াতে এই শব্দের বাজনাগুলো আমাকে সাহস দিচ্ছিল এবং সেই খুশিতে ভুলেই গেছিলাম যে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আমি একা ওয়াশরুম খুঁজে বেড়াচ্ছি।
চিং ! চিং ! চিং ! অবশেষে আমিও চলাফেরায় সাকিনার মত শব্দতরঙ্গের আনন্দ পেতে শুরু করেছিলাম।
চিং ! চিং ! চিং ! আচ্ছা সাকিনা কেন এই সুন্দর বাজনাগুলোর শব্দ চেপে রাখতে চেষ্টা করত যখন সে শুনতে পেত যে ওর আব্বু জেগে উঠেছে ? তাছাড়া প্রায়ই মানে মাঝে মাঝেই কেন সে তাদের পাশের দেওয়ালের গায়ে হওয়া ছোট্ট একটি গর্তে এগুলোকে ফেলে দিত?
চিং ! চিং ! চিং ! তবে কি সাকিনা চাইত না আমরা এগুলোর সাথে খেলা করি ?
চিং ! চিং ! চিং ! আচ্ছা নাকি ও ভেবেছিল আমরা ওগুলো ভেঙ্গে ফেলতে পারি ?
চিং ! চিং ! চিং ! রাতের অই নীরবতা ভেঙ্গে হঠাত তিনটি গুলির শব্দ বাতাসে ভেসে এসেছিল। অই সময় আমার মনে হয়েছিল যেন বেহেশত ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়ে ঝুলে পড়েছে ! ভয় আর আতঙ্কে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গিয়ে সেখানেই আমি নিজেকে ভিজিয়ে ফেলেছিলাম।
ওদিকে সাকিনার আব্বু ছাদের উপর থেকে পস্তু ভাষায় চীৎকার করে বলছিল, সাকিনা তুমি একা কোথায় যাচ্ছ ? এক্ষুনি বাসায় ভেতর চলে এসো। তুমি কেন তোমার আম্মুকে তোমার সাথে আসতে বল নি? কেন ?
গোলাগুলির শব্দ শুনে পুরো বাড়ি জেগে উঠেছিল। এমন বিব্রতকর অবস্থায় আমাকে দেখে আমার সব বোন, সাকিনা, সাকিনার মা এবং অবশ্যই, তার আব্বু আমার অন্যায় কান্ডকারখানা জেনে যাবে যে ! শেষ পর্যন্ত আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে ফার্সি কথ্য ভাষা দারিতে বলতে পেরেছিলাম, “চাচা, আমি শিরিন গুল। আমি কাউকে জাগাতে চাইনি। আমার খুব জরুরি অবস্থা ছিল তাই বাইরে এসেছিলাম।”
“অহ শিরিন গুল ?” সাকিনার আব্বু বিভ্রান্ত হয়ে বলেছিল, “ওহো, আমি খুবই দুঃখিত। তুমি সাকিনার মত শব্দ করছিলে। রাগে আমি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম কারণ সাকিনাকে অন্ধকারে একা ঘর থেকে বের হওয়ার পার্মিশন দেওয়া হয়নি। তোমারও উচিত ছিল তোমার কোন এক বোনকে জাগিয়ে তোমার সাথে নেওয়া। “
আমার এমন বিভ্রান্ত ভয়ার্ত চেহারা প্রথমে সাকিনা এবং ওর মার চোখে ধরা পড়েছিল। ওরা হাসতে শুরু করেছিল। প্রথম দিকে হতবাক হয়ে যাওয়া আমার বোনেরাও ওদের হাসিতে যোগ দিয়ে মজা পাচ্ছিল। একমাত্র আমার বড় বোন আমাকে নিয়ে কিছুটা বিব্রত হয়েছিল। তবে আমি খুব সাবধান ছিলাম। ওদের যত খুশি হাসির সাথে কিছুতেই যেন আমাকে নিয়ে আরও মজা করতে না পারে সেজন্যে স্কার্ট দিয়ে মাটির ভেজা অংশটি লুকিয়ে রেখেছিলাম।
লজ্জা পেয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে সেখানেই বসে থাকলেও আঙুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে মেরে সবকিছু দেখছিলাম।
অবশ্য সেই রাতে আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম সাকিনা কেন তার চুড়ির আওয়াজ চেপে রাখত বা লুকিয়ে সেগুলোকে কেন গর্তে ফেলে দিত তার গোপন রহস্য। আসলে চুড়ি আর নূপুরের শব্দ শুনে ওর আব্বু জানতে পেরে যেত সাকিনা কোথায় আছে বা কোথায় গেছে। তবে সাকিনার চুড়িগুলোর শব্দ ছিল অন্য রকমের, স্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র। যা কিনা সাকিনার আম্মু্র পরা চুড়ির বাজনা থেকে ছিল একদম আলাদা।
সাকিনাদের বাসা থেকে দাদিমা যখন আমাদের নিতে আসেন তখন তাকে পুরো গল্পটি জানানো হয়েছিল। হাসতে হাসতে এমনিতে কড়া হৃদয়ের আমার দাদিমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। লজ্জায় আমি সাকিনার জামাকাপড়ের আলমিরার পেছনে লুকিয়ে ছিলাম। দাদিমা সেখান থেকে আমাকে বের করে আনে। আমার ভাগ্য অনেক ভাল যে সাকিনার গয়না না বলে পরেছিলাম বলে ও কিছু মনে করেনি। বরং ক্ষমা করে দিয়ে বলেছিল, ওকে বললেই ওগুলো ও আমার হাতে এবং পায়ে পরিয়ে দিত। সাকিনা ছিল আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু । এ ঘটনা আমাদের বন্ধুত্বকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল।
তবে বাসায় এসে দাদিমা আমাকে খানিকটা বকাঝকা করেছিলেন। পরে কেনাকাটার জন্য মুদি দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নিয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি যা করেছ তার জন্যে তোমার শাস্তি হল মুদি দোকান থেকে কেনা সমস্ত সদাইপাতি তোমাকে বাড়িতে বয়ে আনতে হবে। কিন্তু যখন আমরা বাজারে গিয়েছিলাম, তখন দাদিমা সবজি দোকানের কাছে না গিয়ে সরাসরি সেই ছোট্ট লোকটির কাছে নিয়ে গেছিলেন যিনি চুড়ি এবং পায়ের নূপুর বিক্রি করত। চুড়ির শব্দ শুনে আমি ত আনন্দে মোহিত হয়ে গেছিলাম। লোভীর মত দুহাত ভরে চুড়ি পরার জন্য আমি বেছে নিয়েছিলাম উজ্জ্বল গোলাপি চুড়ি। খুশিতে আনন্দে কৃজ্ঞতায় আমি দাদিমার হাতে চুমু খেয়েছিলাম।
দাদিমা নিজের কাজে খুব খুশি ছিলেন। আমার সব বোনের জন্য এক সেট করে চুড়ি বেছে নিয়ে আমরা যখন বাসায় ফিরে সেগুলো বোনদের উপহার দিচ্ছিলাম, তখন আমি এবং আমার বোনেরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছিলাম। আনন্দ খুশি হাসিতে আমরা আমাদের উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিলাম না। চুড়ি ঝাঁকিয়ে রিনঝিন রিনঝিন শব্দ করে বাসার প্রতিটি রুম ভরে ফেলেছিলাম। দাদিমার উপহার পাওয়া চুড়িগুলো আমাদের দেওয়ালের উপর দিয়ে সাকিনাদের পাশে ঝুলিয়ে দেখিয়ে ঝাঁকিয়ে সাকিনাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিলাম।
আমরা এতবেশি চুড়ির শব্দ করছিলাম যে সাকিনা নিজের চুড়ির আওয়াজ চেপে আমাদের সাথে বেরিয়ে এসেছিল। ওর আব্বুর তীক্ষ্ণ সতর্ক কান ওকে সনাক্ত করতে পারে নি। আমাদের উঠান জুড়ে চুড়ির শব্দতরঙ্গ ব্যাপক বাজনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছিল তাতে সাকিনার আব্বু উপলব্ধি করতে পারে যে, সাকিনা ঘরের কাজকর্মের পরিবর্তে আমাদের সাথে খেলছে।
আমি এবং আমার বোনেরা জানতাম যে আব্বু আম্মু ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের এই আনন্দ উৎসব শেষ হবে না । কিন্তু হঠাৎ বাঁধ ভাঙ্গা বন্য আনন্দ উৎসবের মধ্যেই আব্বুআম্মু উপস্থিত হয়ে অবাক করে দিয়েছিল। আমাদের অবস্থা দেখে আব্বু ত প্রথমে রেগে আগুন হয়ে গেছিলেন। রেগেমেগে তিনি তার গানবাজনা মগ্ন আলুথালু পাগল পাঁচটি মেয়েকে চড় মারতে হাত তুলেছিলেন এবং চুড়ি ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে আব্বুর রাগের সামনে ভয় আতঙ্কে কাঁপছিলাম। কিন্তু দাদিমা দ্রুত তার বেতের লাঠি দিয়ে আব্বুর হাতটাকে আটকে দেয় বলে বেঁচে গিয়েছিলাম। এরপর পরিবেশ শান্ত হলে সাকিনাদের বাসায় কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে আস্তে আস্তে দাদিমা তাদের জানায়। শুধু সাকিনার আব্বুর ভয়ে আমি যে পেশাব করে নিজেকে ভিজিয়ে ফেলেছিলাম সেই লজ্জার কথা তিনি চেপে যান। সব শুনে আব্বুর রাগ বাতাসের মত উড়ে যায় আর আব্বু আম্মু দুজনেই হেসে ফেলেন।
অবশেষে আব্বু আমাদের চুড়ি পরার সখ মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি চুড়ির রিণিকঝিনিক শব্দ নিয়ে তিনি কখনও আপত্তি করেন নাই। তবে আমরা সবাই জানতাম দাদিমা আমাদের সোনার চুড়ি কিনে দেন নাই, দিয়েছিলেন কাঁচের চুড়ি। এগুলো ভেঙ্গে গেলে তিনি কখনও আমাদের জন্যে আর চুড়ি কিনে দিবেন না।
এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। সাকিনা আর আমি সেরা বন্ধু হয়ে গেছি। আমার বিয়ের আগের রাতে, হাতে মেহেদি লাগানোর সময় সাকিনা অন্যান্য মহিলাদের কাছে আমার চুড়ি পরার গল্পটি বলছিল। অবশ্য আমাকে ক্ষ্যাপানোর জন্যে সাকিনা একটু বেশি বেশি রঙচঙ মেখে বলছিল বলে আমি লজ্জায় ঘোমটার ভেতর মুখ ঢেকে হাসলেও অন্যদের মত খুব মজা পাচ্ছিলাম। আমার স্বামিও গল্পটি শুনে লুফে নিয়েছিল। খুব সম্ভবত তার ছোট বোন তাকে গল্পটি জানিয়েছিল।
আমাদের হানিমুনের দ্বিতীয় রাতে স্বামি আমাকে দু সেট সোনার চুড়ি এবং দক্ষ হস্তশিল্পীর নিপুন হাতে করা একজোড়া নূপুর উপহার দিয়ে চমকে দিয়েছিল। আমি তার উপহার পেয়ে শিউরে উঠেছিলাম। যদিও সে বলেছিল, আমাকে খুশি করার জন্যেই সে এগুলো এনেছে। আমার দু হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত সে চুড়ি দিয়ে ভরে দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারি, সে আসলে এ উপহারগুলো এনেছিল সাকিনার আব্বুর মানসিকতার থেকে শিক্ষা নিয়ে তার মতের সাথে একমত হয়ে।
________________________________________
লেখক পরিচিতিঃ
এই গল্পটি আগে রায়হান ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রথমবার আফগান কমিউনিকেটরের নভেম্বর-ডিসেম্বর 1998 সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আফগান কমিউনিকেটর পুনরায় প্রকাশনার অনুমতি প্রদান করে।
জোহরা সাইয়েদ ব্রুকলিন ভিত্তিক আফগান আমেরিকান কবি। তার কবিতা এবং প্রবন্ধ অসংখ্য পত্রপত্রিকা এবং জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।