ইসমত চুগতাই এর গল্প ‘বিষ’ । মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী

0

ইসমত চুগতাই এর গল্প
বিষ

মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী

[ইসমত চুগতাই (১৯১৫-১৯৯১) ভারতীয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, চিত্রনাট্যকার। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ উর্দু কথাকারদের একজন। নারীজীবন, প্রেম, যৌনতা, শ্রেণী-সংঘর্ষ তাঁর গল্পের বিষয়। কথাশিল্পে নিজের সময়কে তুলে ধরতে সিদ্ধহস্ত। যুক্ত ছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে, বিশ্বাস ছিল তাঁর বাস্তববাদে। ‘বিষ’ পল্পটি অনুবাদ করা হয়েছে মূল উর্দু থেকে।]

কী আশ্চর্য মৃত্যু! যারা গত সন্ধ্যায় মিসেস নোমানের সাথে চা পান করেছেন, সভায় তাঁর বক্তৃতা শুনেছেন তাঁরা তো তাঁর মৃত্যুর কথা বিশ্বাসই করতে পারেন না। অনিদ্রার কষ্ট ছিল তার অনেক বছর থেকেই, আর ঘুমের বড়ি তিনি আজ থেকে খাচ্ছেন না যে ভুল-ভ্রান্তির কোন প্রশ্ন আসবে।
প্রতিদিনের মতো রাত বারোটার দিকে ফেরেন। মিস্টার নোমান দশটার দিকে ঘুমিয়ে পড়তে অভ্যস্ত। তার ঘরের দরজা দস্তুরমতো বন্ধ ছিল। আয়া রাতের খাবারের কথা বলে, কিন্তু মিসেস নোমান মানা করে দেন। দুধের কথা জিজ্ঞাসা করে। বলেন, ‘নিয়ে এসো।’ কিন্তু দুধে তিনি হাতও লাগান নি। রাত জাগার পর সাধারণত তাঁর বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস। মিস্টার নোমান অফিসে চলে গেছেন। এগারোটা বাজার পরও যখন মিসেস নোমান চায়ের জন্য ডাকছেন না তখন আয়ার একটু চিন্তা হয়। তাঁকে জাগানোর জন্য পায়ে হাত দেবার সাথে সাথে এমন চিৎকার করে ওঠে যেন সে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে। ডাক্তার বলেন, মৃত্যু হয়েছে রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে। অধিক সংখ্যক ঘুমের বড়ি খাবার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।
মিসেস নোমানের মৃত্যুতে পুরো শহরে হইচই পড়ে গেছে। তার বন্ধু-বান্ধব এবং জানাশোনা লোকের সংখ্যা অনেক। তাছাড়া সোশ্যাল ওয়ার্কের কারণে শ্রমিক এলাকায় তিনি যাওয়া-আসা করতেন। তিনি নার-শিক্ষার জবরদস্ত সমর্থক ছিলেন, ছিলেন নারী-অধিকারের পতাকাবাহক! তাঁর আকস্মিক এবং অসময় মৃত্যুতে কত স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক মাস ধরে শোকসভা চলতে থাকে।
আল্লাহ মিসেস নোমানকে কী দেননি। লক্ষপতি পিতার একমাত্র কন্যা, সুন্দরী, শিক্ষিতা। কলেজ থেকে বি.এ. পাস করে বের হবার সাথে সাথে প্রেমিকের কিউ পড়ে যায়। মিসেস নোমান শৈশব থেকেই দারুণ মেধাবী। টেনিসের চৌকস খেলোয়াড়, প্রথম শ্রেণীর ঘোড়সওয়ার, সাঁতারে জিতেছেন অনেক পদক। এমন সেতার বাজান যে মনে হয়, ওস্তাদ বিলায়েত হোসেন বাজাচ্ছেন। অত্যন্ত মিষ্টভাষিনী। যে সভায় তিনি যান সকলকে প্রভাবিত করে ফেলেন। যার সাথে একবার দেখা হয় তার মন মুঠোয় পুরে ফেলেন।
যে সময় মুসলিম লীগ শক্তিশালী হতে শুরু করে, তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে নিজের জোরদার বক্তৃতায় লীগের পক্ষে কথা বলতে থাকেন। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি মানুষের প্রশংসা অর্জন করেন। একসময় পর্দা-প্রথার বিরুদ্ধে মেয়েরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল মিসেস নোমান ছিলেন তার অগ্রণী। তিনি সেই স্বল্পসংখ্যক নারীর একজন যাঁরা পর্দার অভিশাপকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে কর্মভূমিতে নেমে এসেছেন।
যে এলাকায় ডেপুটি নোমান বদলি হয়ে যান তার ভাগ্য খুলে যায়। যাবার সাথে সাথে মিসেস নোমান ক্লাব এবং বিভিন্ন কমিটির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন। সাধারণ মানুষের পরলোক সংশোধনের অপরিসীম আগ্রহ তাঁর। তিনি সত্যিকার অর্থেই মিস্টার নোমানের দক্ষিণ হস্ত। মেহমানদারীতে এমন পটু যে বড় বড় পার্টির ব্যবস্থা করা তাঁর বাম হাতের খেলা। মিস্টার নোমান চাপা স্বভাবের মানুষ। তাঁর জীবন-সঙ্গিনী এমন শ্রেষ্ঠ যোগ্যতাসম্পন্ন না হলে তিনি এত উন্নতি করতে পারতেন না, সোসাইটিতে তাঁর এই পজিশন হত না যাকে মানুষ দেখে ঈর্ষার চোখে। উচ্চ পদও তিনি পেয়েছেন মিসেস নোমানের কল্যাণে অথবা তার পিতার প্রভাবের বদৌলতে। নইলে মিস্টার নোমান তাঁর বাল্যকালের বাগদত্তা আয়েশা বেগমকে ত্যাগ করতেন না।
আয়েশা বেগম মিস্টার নোমানের বিয়ের পর আজীবন কুমারী থাকার কসম খেয়েছিলেন। তিনি একটি স্কুলের শিক্ষিকা। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তিনি স্কুল প্রাঙ্গণকেই নিজের ঘর বানিয়ে নেন, সেখানে তিনি এক নিরস অর্ধমৃত জীবন যাপন করেন।
হৃদয়ের ব্যাপারে মিসেস নোমান বড় কপাল নিয়ে এসেছেন। বন্ধুমহলে তাঁর প্রেমিকের একটা বড় সংখ্যা ছিল। একসময় মিসেস নোমান সৌন্দর্যের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতেন। কলেজে পড়বার সময় একাধিক তরুণ তাঁর প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। তাঁর সময়কার প্রগতিশীল কবি তাঁর সৌন্দর্যে প্রভাবিত হয়ে সাহিত্য রচনায় উচ্চ সাফল্য অর্জন করেছেন। কত গল্প-লেখক তাঁর ব্যক্তিত্বের ছায়ায় প্রাণ দান করেছে। তাঁর নামে অজস্র বেনামী প্রেমপত্র আসত। সেগুলো সঙ্কলিত ও প্রকাশিত হয় জনপ্রিয় হয়েছে। যদিও কিছু ঈর্ষাকাতরের বক্তব্য হল, এগুলো মিসেস নোমান নিজেই লিখেছেন। যদি এই অমূলক অভিযোগ মেনেও নেয়া যায়, তবুও এই পত্রগুলি সাহিত্যিক সম্পদের মর্যাদা পাবার যোগ্য এবং এগুলো প্রমাণ করে যে ভাষা ও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে মিসেস নোমান উচ্চমানের সাহিত্যিকও।
নানা ধরনের সামাজিক কর্মের মধ্যে তিনি নারী-শিক্ষার ওপর জোর দেয়া ছাড়াও স্বল্প সন্তান জন্ম দেবার পক্ষে প্রচারণা চালান। তাঁর ধারণা, ডজন ডজন সন্তান আমাদের দেশের দারিদ্র্যের জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। এরা দারিদ্র্যের উৎপাদন এবং এদের কারণেই দারিদ্র্য চরমে পৌঁছে। কেবলমাত্র গ্রাম্য অশিক্ষিত নারীই এমন কষ্ট করে সন্তান জন্ম দেয়। তাই সন্তান অশিক্ষা এবং গ্রাম্যতার জীবন্ত প্রমাণ। সভ্য নারীর এরকম যেন-তেন ভাবে সন্তান হয় না।
আমার মনে আছে, দশ সন্তানের জননী আমার আম্মা মিসেস নোমানকে ভয় পেতেন। তাঁর অশিক্ষার জীবন্ত প্রমাণ অর্থাৎ আমরা মোটাতাজা দশ সন্তান মিসেস নোমানকে পাশ কাটিয়ে চলতাম। আমাদের ময়লা হাঁটু এবং ফোঁড়ায় ভরা পা দেখে তিনি কেঁপে উঠতেন। আমাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে তাঁর মাথায় ব্যথা উঠে যেত, আমাদের খাইখাই স্বভাব দেখে দস্তরখানার ওপর বমি আসত তাঁর। কিন্তু তাঁর অভ্যাস ছিল বিনা খবরে চলে আসবার। আম্মার মনে হত, লজ্জায় ডুবে মরেন। আমরা আহমকের মত চারিদিক থেকে ঘিরে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কোনো কোনো পোড়ামুখী বলত, মিসেস নোমান বন্ধা।
তিনি চলে যাবার পর আম্মা কিছুদিন আমাদের ওপর পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতেন। আমাদের শিকনি পড়া নাকে চিমটা দিয়ে ছ্যাকা দেয়ার হুমকি দেয়া হত। দোজখের আজাবের মতো আমাদের পায়ে জুতো গলিয়ে দেয়া হত। মারপিট করতে করতে আম্মা ক্লান্ত হয়ে যেতেন। শেষ পর্যন্ত আম্মার আনাড়ী স্বভাব আমাদের পক্ষেই যেত, আর আমরা পুনরায় স্বাধীন হরিণের মত লাফাতে শুরু করতাম।
মিসেস নোমান লক্ষবার আমাদের নাজিল হওয়া বন্ধ করার উপায় বলেন, কিন্তু আমাদের আব্বা কি জানি কেমন মানুষ ছিলেন। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া এ বিষয়ে সফলতা আসবে কেমন করে? তিনি পারলে আমাদের জোড়ায় জোড়ায় নিয়ে আসতেন। তিনিই আমাদের জংলীদের মতো এই স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন।
বড়লোকের শত্রুও থাকে অনেক। মিসেস নোমানের এই সর্বজনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষাকাতর অনেক লোক নানারকম কথা বলত। মুখের ওপর বলার সাহস ছিল না কারোর।
‘শুনেছেন আপনি, কেমন ছোটলোক সব!’ তিনি হেসে নিজেই বলেন, ‘নোমান সাহেবকে তো আপনি চেনেন, তিনি এমন নীচ হতে পারেন?’
‘না আপা, লোকে কত কথা বলে যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই।’ আম্মা মিসেস নোমানের মর্জি মতো বলেন, ‘আপা, উনি তো আপনার জন্য পাগল। আর হবেন না কেন? এমন কী ভাল গুণ আছে যা আপনার মধ্যে নেই? যেমন যোগ্য তেমনি শিক্ষিত। আপনার মত সকল স্ত্রী হলে, খোদার কসম, আমাদের দেশ এত পেছনে পড়ে থাকত না।’ আম্মা প্রচারিত পাঠ পুনরোচ্চারণ করেন।
‘না আপা, আমি তো একটা বুদ্ধু, কী যোগ্যতা আছে আমার?’ তিনি অত্যন্ত বিনম্র স্বরে বলেন।
‘আপনি বিনয় করছেন, নইলে আপা, আপনি আসাতে শহরের অবস্থা বদলে গেছে। কেমন অশিক্ষা ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে।’ আম্মা সেই নতুন নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করেন যা সম্প্রতি স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, ‘তিনি আসবার আগে নারী-শিক্ষা অসম্ভব খারাপ অবস্থায় ছিল।’ আম্মা মাখন লাগাতে থাকেন যাতে মিসেস নোমানের মনোযোগ এদিকে থাকে এবং মুরগির পেছনে দৌড়াতে থাকা বজ্জাত বাচ্চাদের তিনি না দেখেন, যাদের তিনি ইশারায় দূর হয়ে যেতে বলছিলেন। মিসেস নোমান আমাদের দেখে ফেললে সমস্ত সংশোধন ত্যাগ করে তিনি আমাদের সংশোধনের জন্য কোমর বেঁধে লেগে যেতেন এবং আমাদের নাকের ওপর নির্যাতন নেমে আসত।
‘আল্লাহর কসম, কখনো কখনো তো আপনার ভাইয়ের ভালোবাসায় অস্থির হয়ে যাই। এটা কোনো কথা হল, যেদিন ডিটনারে আমি না থাকি, ও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।’ আম্মা জানতেন, এ নেহায়েতই গপ্পো। কিন্তু তিনি স্বপ্নেও মিসেস নোমানের বিরোধিতা করতে পারতেন না। নিজের পরকাল মাটিতে মেশানোর কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কিন্তু কি জানি কেমন করে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, ‘অন্যকোথাও খেয়ে আসেন হয়তো।’ বলে তো ফেললেন, তারপর ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বলেন, ‘লোকে বলে আপা…’
‘লোকে তো সাদা কাপড়ে কাদা ছিটাতে মজা পায়। তারা তো সেই নীচ বুদ্ধির লোক যারা আমাদের জাতিকে এতটা অশিক্ষা আর মন্দ বুদ্ধির হতাশায় ডুবিয়ে রেখেছে। দুনিয়া জানে, মিস্টার নোমান কী রকম চরিত্রের লোক। স্ত্রীর কাছে কেউ মনের কথা লুকিয়ে রাখতে পারে? খোদা নাখাস্তা যদি এমন কিছু ব্যাপার থাকত, আমার কাছে লুকিয়ে রাখতে পারত না।’ তিনি আম্মার দিকে তাকান, ‘আপা, আপনি তো সরল মানুষ।’ তাঁর বলার উদ্দেশ্য ছিল, আপনি তো নির্বোধ, নিতান্ত অশিক্ষিত। ‘কিন্তু নোমান সাহেব আমার কাছে কোনো কথা লুকাতে পারেন না।’
‘হ্যাঁ আপা, আপনার কাছে কীভাবে কেউ কথা লুকাতে পারবে।’ আম্মা স্বীকার করেন।
‘আর লোকে যদি বলেই তবে সেটা কার জন্য? আয়েশা বেগমের জন্য। দেখেছেন আপনি আয়েশা বেগমকে?’
‘হ্যাঁ, শুকনো খটখটে… তওবা তওবা!’
‘না আপা, মানুষের বাচ্চা। কান ধরে বলছি, খোদা বড় কথা না বলাক। আমি নিজে, না রূপে না চেহারায়, ভিড় থেকে বাইরে আয়… কিন্তু… তওবা… তার চেহারায় তো কেবল…’
‘মুহররমের মাতম লেগে থাকে।’
‘দুর্ভাগ্য ঠিকরে বের হয়।’
‘পুরুষের প্রেম না পেলে মেয়েদের চেহারা থেকে লানত ঝরতে থাকে।’
‘হায়-হায় ভাই, এই সারা জীবনের কুমারীত্বও চেহারাকে বিকৃত করে দেয়।’
অনেকক্ষণ পর্যন্ত আম্মা এবং মিসেস নোমান বসে বসে চিকিৎসাশাস্ত্র এবং সামাজিক নিয়মের বরাত দিয়ে আয়েশা বেগমের চেহারার আদি দুর্দশার বিশ্লেষণ করতে থাকেন। তওবা তওবা করতে থাকেন এবং মিসেস নোমানের মধুর বচন উৎকর্ষে পৌঁছতে থাকে।
‘যাকগে এখন তো বেচারী অসহায়। এমনিতেও সে কখনো তো আপনার ধারে-কাছে ছিল না। হলে ছোটবেলার বাগদত্তাকে ছেড়ে আপনার সাথে কেন ঘর বাঁধবে? লোকে বলে, ডেপুটি কালেক্টরীর লোভে নোমান সাহেব তাকে ত্যাগ করেছেন।’ আম্মা মাঝে মাঝে সরলভাবে এমন বাজে কথা বলে ফেলেন।
‘এসব বাজে কথা আপা।’ মিসেস নোমান উত্তেজিত হয়ে যান, ‘নোমান সাহেব, এতগুলো মানুষকে পালতেন কী করে। তার আত্মীয়রা একথা ছড়িয়েছে। আপনি একবার ভাবুন, আধা ডজন ভাই বোনের ভার যে সে কথা? আয়েশা বেগম বংশের মেয়ে। বংশের লোকেরা সব সময় তার পক্ষে কথা বলেছে। কিন্তু সত্য কথা হল আপা, কোনো মেয়ের মধ্যে নিজস্ব ক্ষমতা না থাকলে কেউ তার অধিকার রক্ষা করতে পারে না। তার মধ্যে এতটুকু আকর্ষণ থাকলে নোমান সাহেব তাকে ত্যাগ করবেন কেন?’
‘আল্লাহর দেয়া চেহারা বেচারীর।’ আম্মা বলেন।
‘আল্লাহ চেহারা দিয়েছেন, সাথে সাথে বুদ্ধিও তো দিয়েছেন। যত্ন-আত্তি, কাপড় চোপড়েরও তো ব্যাপার আছে। ঠিকমতো সাজগোজ করলে সাধারণ চেহারাও সুন্দর দেখায়। কথাবার্তা বলারও তো কোনো ঢঙ নেই তার। কি অসম্ভব বোরিং আয়েশা বিবি। সত্যি করে বলুন, তার কথার মধ্যে কোনো রকমের প্রাণ আছে? কোনো আকর্ষণ আছে?’
‘না আপা, আমারতো প্রাণ অস্থির হয়ে যায় তার সামনে। যেন চুপ থাকবার রোজা রেখেছে।’
‘ইউরোপ-আমেরিকায় তো রীতিমতো এধরনের স্কুল আছে যেখানে পুরুষের জন্য নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে শেখানো হয় মেয়েদের। এই জন্যই তো আমরা সমস্ত দুনিয়ার পেছনে।’ মিসেস নোমানের বক্তৃতা শুরু হয়ে যায়।
একদিন মিসেস নোমান নারীর আত্মসম্মান এবং অধিকার সম্পর্কে আম্মার কানে এমন মন্ত্র দিয়ে যান যে সেদিন আম্মা আব্বাকে বলেন, ‘তুমি ইংরেজ মহিলাদের সাথে এমন হেসে হেসে কথা বলো কেন?’
‘চলো তুমিও আমার সাথে। তুমিও তাদের স্বামীদের সাথে হেসে হেসে কথা বোলো।’ আব্বা মৃদু হেসে জবাব দেন।
‘হায় হায়… তওবা!’ আম্মা মাথায় হাত দিয়ে বসেন। সেদিন থেকে আর কখনো স্ত্রীর অধিকার ফলানোর সাহস তাঁর হয়নি।
মিসেস নোমান কখনো নিজেও নোমান সাহেবকে ক্ষ্যাপান, ‘তুমি বেচারীর জীবন বরবাদ করে দিয়েছ।’ কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দেন।
‘বেচারী নিশ্চয়ই আমাকে উঠতে-বসতে শাপ-শাপান্ত করে।’ নোমান সাহেবের চেহারায় লজ্জার আভাস দেখা যায়।
‘সত্যি করে বলো তো, আয়েশা বেগমকে কি তুমি ছোটবেলা থেকেই অপছন্দ করতে?’
‘অনেকটা এরকমই।’ নোমান সাহেব আবার এড়াতে চান।
‘তাহলে কি পরিবারের লোকজন জোর করেই পাকা কথা করিয়েছিল?’
‘অসহায়তা মানুষকে দিয়ে সবকিছুই করিয়ে নেয়।’ তিনি শীতল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিসেস নোমানের চুলের গোছা নিয়ে খেলতে থাকেন।
‘পুরুষ কত ধোকাবাজ!’ তাঁর মন মিস্টার নোমানের প্রেমে নেচে ওঠে। মিস্টার নোমান সঙ্কোচে সিগার-কেস নিতে নিতে অন্যদিকে ঘুরে যান।
মিসেস নোমানের হৃদয় এক বহতা নদী যার মধ্যে সমস্ত দুনিয়ার বেদনা। আয়েশা বেগমের জন্য তো তার অসীম করুণা। বেচারী! ডেপুটি কালেক্টরের সাথে বিয়ে হলে কেমন ঠাটবাটে থাকত‌। ডিনার, পার্টি এ্যাট-হোম। কিন্তু বেচারী ছাই কন্ট্রোল করতে পারত না, বাচ্চা দিয়ে ঘর ভরে দিত। মিসেস নোমান অন্তত এই অসুখ থেকে তো ঘরকে পবিত্র রেখেছেন।
‘হিন্দুস্তানে এত বাচ্চা আছে যে, যে নারী সন্তান জন্ম না দেয় সে দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় সেবা করে।’ মিসেস নোমান বলতেন।
কিন্তু এসব ভাববার সময় তিনি ভুলে যান যে যদি আয়েশা বেগমের বিয়ে নোমান সাহেবের সাথে হত তবুও আজ পর্যন্ত সে স্কুলে মাস্টারি করত। স্কুল পরিদর্শন উপলক্ষে কখনো কখনো আয়েশা বেগমের সাথে তাঁর দেখা
সাক্ষাৎ হয়। বোঝাই যায়, আয়েশা বেগম তাকে ঈর্ষা করে। যদিও এতে না তাঁর কোনো দোষ আছে না নোমান সাহেবের। ঝলমলে এক চাঁদ ছেড়ে কেমন করে এক শুকনো মৃতপ্রায় অম্ল স্বাদের টুকরো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে কেউ।
লোকে বলে, সভায় সভাপতিত্ব করবার পর তিনি স্কুলের পেছনে আয়েশা বেগমের কোয়ার্টারের দিকে চলে যান।
‘চা খাওয়াবেন না?’ যথারীতি সুশীল ভঙ্গিতে তিনি বলেন। আয়েশা বেগম সকলকে বসিয়ে নিজে চা বানিয়ে নিয়ে আসেন। মিসেস নোমান তাকে হামেশাই খোঁচান, সেদিনও বলেন, ‘আপা, আমি আপনার হবু স্বামীকে ছিনিয়ে নিয়েছি, কিন্তু এতে আমার কী দোষ ছিল?’ আয়েশা বিবি লজ্জিত হয়ে মৃদু হাসেন।
‘না বেগম, আপনার দোষ হবে কেন?’
‘নিশ্চয়ই আমার ওপর খুব রাগ হয় আপনার?’ মিসেস নোমান আবারও হাসেন। আয়েশা বেগমের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, সহনশীলতার সাথে বলে, ‘রাগের কী আছে বেগম? সব ভাগ্যের খেলা।’
‘ভাগ্য! হুঁহ্! সেই অশিক্ষিতের মত কথা। এই কথাতেই তো আমাদের দেশের নির্বোধ মেয়েরা নিজেদের জীবনকে দোজখ বানিয়ে রেখেছে। পুরুষ নারীকে বিফল করে কাঁদিয়ে চলে যায় আর নারী মুখে তালা লাগিয়ে বসে থাকে।’ মিসেস নোমান বক্তৃতাবাজী শুরু করে দেন। সেদিন সৈয়দা আয়েশা বেগমের মেজাজ কোনো কারণে একটু খারাপ ছিল। কি জানি কেন মিসেস নোমানের তামাশায় একটু ক্ষুব্ধ হন। মাথা থেকে পা অবধি থর থর করে কাঁপতে থাকে তাঁর। কাটা কাটা বাক্যে বলেন, ‘ছিনিয়ে নেবার কথা বলেছেন বেশ ভাল। বেগম, মানুষ কি মাটির খেলনা যে তাকে কেউ ছিনিয়ে নেবে? শরীর ছিনিয়ে নেয়া যেতে পারে, কিন্তু মন ছিনিয়ে নেয়া যায়না।’
‘আরে বাহ! আপনি তো মনে হচ্ছে অনেক বড় দার্শনিক আয়েশা বেগম! এই শূন্যগর্ভ প্রেম…’
‘প্রেম কখনো শূন্যগর্ভ হয়না বেগম! প্রেম জীবনের সবচেয়ে বড় সওদা।’ রাগে আয়েশা বেগমের হাত-পা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। বলেন, ‘আপনি অত্যন্ত নির্বোধ বেগম!’
মিসেস নোমান এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। ‘মিসেস নোমান নির্বোধ! কি চমৎকার কথা!’
‘ইরফান… আরে বাবা ইরফান!’ আয়েশা বিবি পর্দার ফাক দিয়ে উঁকি দিয়ে ডাকেন। রেকেট হাতে ষোল-সতের বছরের একটি ছেলে এসে দাঁড়ায়।
‘এদিকে এসো বাবা! খালাকে সালাম দাও।’
মিসেস নোমানের হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়। তার সামনে বিশ বছর আগের নোমান সাহেব দাঁড়িয়ে এবং আয়েশা বেগম তার ঘন চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার মরহুমা বোনের স্মৃতি। সালাম দাও বাবা।’
লোকে কানাঘুষা করে, আয়েশা বেগম মিসেস নোমানকে বিষ খাইয়ে দিয়েছেন।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.