আমার বৈশাখ: কাচের চুড়ি রঙিন ফিতা । মনিরা মিঠি

0

দৃষ্টি বিভ্রমে অবিরত কিছু বুদবুদ চোখের চারিপাশে ঘুরতে থাকে। তার ভেতর থাকে আলাদা আলাদা স্ন্যাপ। বড্ড রঙিন সেসব। দেখতে দেখতে সে যায় দূরে। আসে নতুন ছবি। স্মৃতি হাতড়াতে হয় না। আপনিই আসে। পুরো কোনো গল্প তৈরি হয় না বটে। তবে কিছু হারানো শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ফিরে পাই। ফিরে আসে কিছু রঙের এলোমেলো উঁকিঝুঁকি।

আশির দশকে রাজশাহীর সাহেববাজার তখন এমন বিভাজিত, বিক্ষিপ্ত নয়। কাপড়পট্টি ছাড়িয়ে যেখান থেকে মুদি দোকানের শুরু, কিছু রঙের দোকানদার বসতো সেখানে। মাটির ছোটো ছোটো সরায় তাদের রঙের পসরা। সে দেখতে যে কি আনন্দ! শুধু শুধু রঙ কিনে, পানিতে গুলিয়ে কখনও নিজেরা ছিটাই। কাপড়পট্টির শুরুর দিকে দুটো গুমটি দোকানে পাওয়া যেতো চুল বাঁধার রঙিন ফিতা। রঙিন ফিতায় চুলে বিনুনী গাঁথায় কী যে ভালো লাগা ছিল! সেই যে রঙ ভালোবাসা, সেখান থেকেই বুঝি জীবনের নানা ক্ষণে নানা রঙে রাঙিয়েছি নিজেকে। বোঝা না বোঝার আগেই উৎসব চেয়েছি, যা হবে রঙের।

চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই বড্ড বালু ওড়া শুরু হতো শহরময়। বিশেষ করে নদী থেকে যাদের বাড়ি আধা মাইলের মধ্যে। দরোজা জানালা যতই ভেজানো থাকুক, ঠিক ঘরের সর্বত্র হতো বালুর ঠাঁই। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা আর চড়ক পুজো হতো সেসময়ই। তার পরপরই বৈশাখি মেলা। শহরের মধ্যিখানে হতো না বলে আমাদের শৈশবে সে মেলায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বেদেনীরা সেসময় ঝাঁকা ভরে রেশমী কাচের চুড়ি নিয়ে শহরের অলিতে গলিতে যেমন ঘুরতো, তেমনি কোনো কলেজের সামনে বসতো পসরা সাজিয়ে। সেই থেকে কাচের চুড়ি মানেই রিনিঝিনি সুখ। কিনে জমা করায় অপার আনন্দ। শহুরে মেলা স্কুল, কলেজের মাঠে হতো এক আধ দিনের জন্য। সে দেখে খুব মন ভরতো না। আমার স্কুলে একবার হলো মিনাবাজার। বেশ রঙ ছড়িয়েই গেল।

তখন বৈশাখি ঝড়কে ভয় পেতাম না বলেই তাকে নিজের যতটা আপন মনে হতো, বাড়ির আর সকলের কাছে সে আলাদা সমাদর পাওয়া শুরু করেনি। বাড়িতে তেমন কোনো বৈশাখি আয়োজন তাই ছিল না। ঠান্ডা খাবার, শরবত, টক, তেতো খেতে হবে যেহেতু দিনগুলো শুষ্ক, রুক্ষ। মায়ের হাতের খেজুরের গুড়ের পায়েস হলো সেসময় আহ্লাদের খাবার। অদ্দিন অবধি ঘরে গুড় রাখাটা সেসময় কঠিন ছিল। লোকে সময়ের জিনিস সময়েই খেতো কিনা! বৈশাখের শুরুর দিন পান্তা খাওয়ার প্রচলন আমাদের বাড়িতে ছিল না। ইলিশ তো নয়ই। এসময়ে ভালো ইলিশ পাওয়াই যেতো না। দই, চিড়া, কলা বেশ পছন্দ করেই খাওয়া হতো। তরমুজ আর বাংগি খাওয়ারও ধুম ছিল। দুপুরে কচি পটল দিয়ে পাতলা ঝোলের মাছ দিয়ে ভাত। সাথে আমের টক। সেই তো গরমে শান্তি দিত। বিকেলে মুড়ি কি কাউনের চালের মোওয়া, নারকেলের নাড়ু, খই, সে আলাদা কোনো খাবার নয়, কৌটোয় থাকতো, খাওয়ার সাথে ক্ষুধার তেমন কোনো সম্পর্কও ছিল না। এমনধারা সব খাবার এখন সবাই শখ করে খেলেও আমাদের শৈশবে এগুলো প্রাত্যহিক খাবারের মধ্যেই পড়তো। কদমা, লই, বাতাসা, খাজা, চিনির ছাঁচ, কটকটি এগুলোও মজা করে খাওয়া হতো। এতো গেলো খাবার দাবার। অনুষ্ঠানাদিরও ছিল অল্প আয়োজন।

হিন্দোলে গান শিখতে যাবার সুবাদে বৈশাখি অনুষ্ঠানে কোরাস গান গাইবার দলে ঠাঁই হলো, তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। অনুষ্ঠান হবে পদ্মা রঙ্গমঞ্চে। সে তো চিনিনে। তখনকার দিনে বাবা মা তো আর সাথে যেতো না। খুঁজে পেলাম না অনুষ্ঠানস্থল। পহেলা বৈশাখের প্রথম যে অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি, সেখানে আর অংশ নেওয়া হলো না। সেই মনখারাপ বেশ দীর্ঘদিন ছিল। পরে আর গানটা শেখা হয়ে উঠলো না। তা বলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন বন্ধ হয়নি। কখনও স্কুল থেকে কখনও নিজেরা বৈশাখের অনুষ্ঠান করেছি। নব্বইয়ের দশকে এসে যেটা বেশ বিস্তৃতি পেলো। সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনই তখন এক প্ল্যাটফরমে অনুষ্ঠান আয়োজন শুরু করেছে। আবার নিজেদের আলাদা আলাদা আয়োজন তো ছিলই। ১৩৯৮ সাল আমরা রাজশাহী আবৃত্তি পরিষদ শহর প্রদক্ষিণ করে ঘুরে ঘুরে নানা জায়গায় বৈশাখি অনুষ্ঠান করেছিলাম। এখন সেই জায়গাগুলোই বদলে গিয়েছে।

১৪০০ সাল উদযাপন করা হয়েছে মহাসমারোহে। বিশাল শোভাযাত্রা নিয়ে সে সময় শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে আমাদের ভ্রমণ ছিল এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। পুরোটা পথ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর নৃত্য পরিবেশন যে ছাপটা ফেলেছে, সেই হয়ে উঠেছে আমার আনন্দের সারথী। এই আয়োজনটির উদ্যোক্তা ছিল শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র।

পরবর্তীতে বর্ষবরণ মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। পহেলা বৈশাখ ঘিরে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই। চৈত্র সংক্রান্তি এবং বৈশাখের দুদিনের অনুষ্ঠান ঘিরে চলেছে ব্যাপক প্রস্তুতি। সেসময় এই অনুষ্ঠান ঘিরে প্রচুর মানুষের উদ্দীপনাও ছিল স্মরণযোগ্য, যা এই সময়ে এসে আমরা হারিয়ে ফেলছি। গত প্রায় বছর দশেক ধরে সেসময়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ক্ষয়ে যেতে দেখছি। দেখছি চর্চার জায়গাটি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। মানুষের অংশগ্রহণ কমছে। অল্পকিছু মানুষ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গাঁও-গ্রামে বরং পহেলা বৈশাখ পালন হচ্ছে বেশি আন্তরিকতার সাথে।

বর্তমান কালের তরুণদের পালস ধরতে পারা কঠিন। এই বিশ্বায়নের সময়ে এসে তারা পৃথিবীর সকল কিছুর সাথে দ্রুত পরিচিত হচ্ছে এবং তাদের মন-মনন বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আমার মন বলে আমরাও সেই বয়সে ছিলাম, বিশ্বের সাথে পরিচিত হতে হতে আমরা যে বাইরের কিছু নিইনি তা নয়। নিয়ছি। তার সাথে মিশিয়েছি আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য। আজকালের তরুণেরাও গ্রহণ বর্জনের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। আমার সেই কাচের চুড়ি এখনও আছে। ফিতা পরিবর্তিত হয়েছে বটে কিন্তু এখন রঙিন ফিতায় চুল বাঁধতে বেশ লাগে। বৈশাখ এলেই হাতে ওঠে রঙিন চুড়ি। রিনিঝিনি সে বেজে চলে বছরব্যাপী।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.