স্বাধীনতা: বাবার আঙুল ধরে হাঁটি
মায়ের ভাতঘুম দুপুরগুলো দুই ভাইবোনের জন্য ছিলো টো টো ছুট। পাদ্মানদীর পাড় তখন লাল ইট – স্টিল তার দিয়ে বাঁধানো। মাঝে মাঝে নদীর ভেতর ছোটো ছোটো বাঁধ আড়াআড়ি ঢুকে গেছে। তাতে আকন্দ, ভাঁটফুল এর ঝোঁপ। জল শুকিয়ে গেলে ফটফটে সাদা বালুর চড়। চৈত্র মাসের সে বালু লু হাওয়ার সাথে বইতে থাকলে বাড়ির পথে দে ছুট। সেন্ডেল পথে ফেলে আসার ভয় নিয়ে চুপি চুপি গৃহ প্রবেশ। আর মায়ের সামনে পড়ে গেলে বাড়তি পাওনা গোটাকতক চড় থাপ্পড়। সে অবশ্য গায়ে লাগাচ্ছে কে!
এই যে জন্ম স্বাধীন- এর বীজ শৈশব থেকে ঢুকে গেলো হৃদয় মাটিতে, তার যত্ন নিতে হয়নি। ডালপালা গজিয়েছে। সবুজ পাতা উঁকি দিয়েছে ডালে ডালে। বাবার আস্কারার জলে গাছ আরো বেড়ে উঠেছে আকাশকে সীমা ভেবে। ইচ্ছের সলতেয় ছোট্ট আগুন জ্বালিয়েওছে বাবা। যা খুশি পড়েছি। যা খুশি খেলেছি। কিছু একটা হয়ে উঠতে হবে এমন কোনো বিধিবিধান ছিলো না। গাছ যেমন স্বাধীন ততটাই, পিদিমের আলো যতটা স্বাধীন ততটা।
মিঠে শৈশবে, বাবার চওড়া বুকে ঘুমিয়ে যাওয়া নিশ্চিত নিরাপত্তায়, সেটাই বুঝি ছিলো দেশ। সেই দেশে পরিচিত ধুকপুক, নিঃশ্বাসের স্পর্শ বুঝিয়ে দিতো বাঁচা। পিঠে হাল্কা চাপড়, বুঝিয়ে দিতো -সে হলো ভরসা। হাঁটতে শিখে, বাবার আঙুল ধরে যেখানে গিয়েছি সেটাই ছিলো স্বপ্নের দোকান।
শরনার্থী হয়ে পাশের দেশ থেকে যুদ্ধের সময় বেঁচে ফিরতে পারবে রোগে ভোগা মেয়ে, তেমন আশা ছিলো না মা-বাবার। সে যে বেঁচে গেলো, এতেই খুশি হয়ে মেয়েটিকে যেনো প্রকৃতির হাতেই ছেড়ে দিলো তারা। রোগে ভুগে এইযে নিজের মতো বেড়ে ওঠা, এই হলো মেয়েটির স্বাধীনতা। সে গাছে গাছে ঝুলতে থাকে। ছাদ থেকে ছাদে টপকে টপকে যায়। পরেও ছাদ থেকে, সাইকেল থেকে। বন্যার জলে হাঁসের পেছনে সাঁতার কেটে, কাটিয়ে দেয় সারাদিন। আঁজলা ভরে পান করে নদীর জল। গপ্পের বই মায়ের চোখ এড়িয়ে বাবার হাত থেকে ঠিক পেয়ে যায়। ডাংগুলি খেলে বাবার সাথে।বাবার হাতের বানানো গুল্লি ছিটকে যায় বহু দূর। ঠিক যেমন তার ছুটে চলা। কিন্তু সে কখনই জানলো না অন্যকে নিজের অধিকারে আনতে হয় কি প্রকারে। অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ তার কাছে মানুষের দীনতা।
বেড়ে ওঠার কালেও একই রকম থেকে যাওয়া। ঘুড়ি লাটাই ছেড়ে, গান, ছবি, নাটক, আবৃত্তি – মশগুল সবেতেই। নেই কোনো বাঁধা। শুধু
কোনো একদিন মা বলেছিলো উদ্বেগে- তোমাকে দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা, যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছো তুমি। এই বাক্যে স্তম্ভিত মেয়েটি, মাকে বললো, তোমার দয়ার স্বাধীনতা চাইনা। নাও ফিরিয়ে। গৃহবন্দী থাকলো দিনের পর দিন। বাবা কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই – মেয়ে জানিয়ে দিলো তাকেও, চাইনা স্বধীনতা। বাবার ব্যাখ্যা হলো তার আজীবনের অভিজ্ঞতা – দেশের স্বাধীনত অর্জন করতে হয় যদি থাকে অন্য কারো অধীনে। মানুষ জন্ম স্বাধীন। সেটাকে নিজেই প্রতিমুহূর্তে উদযাপন করতে হয়, অন্যের কোনো কিছুতে টোকা না দিয়েই। অন্যের সামন্য বিরক্তি ঘটলেই তুমি হবে স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী।
সেই থেকে বাবা হলো স্বাধীনতা।