খোঁজ
পটাশপুরে আমার কোনো বাড়ি নেই। আত্মীয়বন্ধু কেউ যে থাকে তাও নয়। তবু সপ্তাহে দুদিন আমি পটাশপুর যাই।
বাসস্ট্যান্ড থেকে তেমাথিনী রোড ধরে সোজা মিনিটদশেক। তারপর সত্যময়ী বালিকা বিদ্যালয় থেকে ডানদিকে ঘুরে ব্রজলালপুর। দূর থেকে দেখা যায় ক্ষুদিরাম স্মৃতি পাঠাগার। ছোট্ট একচিলতে ঘর। তিনদেওয়াল জোড়া বইয়ের আলমারি। মাঝখানে চারটে বেঞ্চিতে জনা পনেরো ছেলেমেয়ের তুমুল কলকল।’মাস্টারকাকু! আজ একটা গল্প বলবে?’ সামনের বেঞ্চের মেয়েটা টরটরি। সবসময় কিছু না কিছু বলা চাই!
‘আগে পড়া বল দেখি!’
‘আমি বলবো কাকু?’ পাশের ছেলেটা উৎসাহে হাত তোলে। বাইরে ঘন হয়ে সন্ধে নামে।
খুব যে সমাজসেবা করছি তা নয়! খানিকটা দায়ে পড়েই।মারোয়াড়ী মালিকের শখের এনজিও। কাঁথি থেকে দেড়’ঘন্টার পথ বাসে। তারপর ভ্যানে বিশমিনিট। অবৈতনিক স্কুল। আমার ভাগে দুদিন, মঙ্গল আর শনি।
বাড়ী ফিরতে এগারোটা বেজে যায়। অপর্ণা অপেক্ষা করে।
প্রশ্ন করে না। এমনিতেই কথা বলে কম। এজন্য সুনামও আছে। মা মাঝেমাঝেই শোনায়। পাঁচবছর পরেও।
‘কেমন পছন্দ করে এনেছিলাম বল! এমন শান্ত, লক্ষ্ণীমন্ত বৌ! মুরোদ ছিল তোর? নিজে তো একবার হাত পোড়ালি!’
আমি জবাব দিই না। এই বিয়েতে সায় ছিল না আমার। নেড়া বুঝদার হলে বার বার বেলতলায় যেতে চায় না। শোনেনি মা।
‘ডিভোর্স কি আর কারো হয় না? তা বলে বাকী জীবন এমন ছন্নছাড়া হয়ে থাকবি?’
‘বেশ তো আছি নির্ঝঞ্ঝাট মায়েপোয়ে! এই আধবুড়ো বয়েসে ……’ আমি মরিয়া চেষ্টা করেছিলাম।
‘আমি তো আর চিরকাল থাকবো না! তাছাড়া মেয়ের বয়সও তো কম না! মামামামী তো সময়ে বিয়েটাও দেয়নি! ভারী দু:খী। আপত্তি করিস না আর।’
আমি আপত্তি করি না। যে যার মত পড়া বলে যায়। কেবল সেকেন্ড বেঞ্চের কোণে বসা একজন, কিছুতেই মুখ খোলে না। তাকে আলাদা করে নিয়ে কোলে বসাতে হয়। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পড়া ধরতে হয়।
না করলেও চলে এসব। আসলে কেমন মায়া পড়ে গেছে! বাপ’মা নেই।
ইদানীং ক্লাসশেষে বেরোনোর সময় ছেলেটা এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। কিছু বলে না, শুধু ছুঁয়ে থাকে। আমিও কথার ছলে কয়েকমিনিট দাঁড়িয়ে যাই। আনমনে মাথায় বিলি কেটে দিই। তারপর হঠাৎ হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসি। লাস্টবাস ছাড়ে ন’টায়। ভ্যান না পেলে ছুট লাগাতে হবে।
রোজকার মত আজও অপর্ণা নি:শব্দে ভাত বেড়ে দেয়। আওয়াজ না করে জলের গ্লাস এগিয়ে দেয়। আধোঅন্ধকারে চোখের নীচের কালি বা কপালের কাছে রূপোলি রেখা ঢাকা পড়ে থাকে। পাশের ঘরে মা ঘুমে কাদা।
আমি খেয়েদেয়ে সোজা বিছানায় উঠে পড়ি। সপ্তাহে অন্তত: দুটো দিন একেবারে অন্যরকম। রাতও। মঙ্গল আর শনি!
আলো নিভিয়ে অপর্ণা সরে আসে কাছে। বরফশীতল মেয়েটা কেমন বদলে যায়! শরীরজুড়ে আদরের ঝড় তোলে। তন্নতন্ন করে হাতড়ায় কিছু!
প্রথম প্রথম বুঝতাম না। আমোদ নিতাম। এখন লজ্জায় কাঁটা হয়ে থাকি! শুধু বুঝি না কী খোঁজে! হারানো শৈশব নাকি অধরা মাতৃত্ব!
বারোআনা
যেন একখানা সোনার চাদরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে! দু’চোখ বুজে পাকাধানের গন্ধ টেনে নেয় বুকভরে। আহ্!‘ভাত খাবা না?’ কমলার চীৎকারে চটক ভাঙে। আলের ধারে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ছে বউ।
‘হ হ। তুই থুয়ে ঘর যা।‘
‘মাথাখান গেছে! মাঝদুপুরে কাকতাড়ুয়ার পারা খাড়া হইয়ে ঢুলতিছে!’ কমলা বকেই যায়।
তারাপদ পা চালিয়ে উঠে আসে লজ্জা লজ্জা মুখে। বার’দুই ঘাড় ঘুরিয়ে জরীপ করে নেয়। বড় তৃপ্তি বুকে।
ভাত মানে একবাটি ফ্যানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একমুঠো জুঁইফুল আর একচিমটে লবণ। দু’মিনিটে শেষ করে মুখ মোছে তারাপদ। কমলার রোদেপোড়া মুখের দিকে তাকিয়ে ঢেঁকুর তোলে বারদুয়েক।
‘একখান কথা ক’দিহি। বুকে দুধ আছে তর আর?’
‘বেহায়া মিনসের কথা শোনলে গা জ্বলি যায়!’ কমলা দপদপ করে হাঁটা দেয় বাড়ির পথে।
ভিতরে ভিতরে অস্থির হয় তারাপদ। ছেলেছোকরাগুলো চেনা। অলপ্পেয়ে, বেকার। সারাক্ষণ পার্টিবাজি আর লেকচার!‘তোমার তো পাত্তাই নাই তারাদা! সারাদিন কার জমি আগলে আছো? কার জন্য ফসল ফলাচ্ছো শুনি?’
‘তিনপুরুষের জমি বাপ! নেহাত ঠ্যাকায় পইড়ে ……..’
‘বাঁধা রেখেছ, তাই তো? ঐ জমিও প্রধানের, ফসলও তার। বোঝো না?’ ছেলেটা তারাপদর কাঁধ ধরে ঝাঁকায়।
‘মাটির কী আর তুমার আমার হয় রে বাপ! ফসল তো সন্তানের লাহান!’ তারাপদর মুখে সেই তৃপ্তিটা ফিরে আসে, নাকে ধানের গন্ধ।
‘ধুর! তোমাদের কিচ্ছু হবে না! শোনো! লড়াইয়ে নামতে হবে। লড়াই!’ মোজাম্মেল হকের ছেলেটা গলার শিরা ফুলিয়ে বলে ওঠে।
‘মহাজনের সনে লড়াই? পঞ্চায়েতের সনে কাজিয়া? কেমনে?’ তারাপদর মাথায় ঢোকে না কিছু।
‘তোমার জেনে কাজ নাই। স্রেফ মনে রাখবা,রোজগারের সিকিভাগ পার্টির। বাকি বারোআনা তোমার। ঘর গিয়া ঘুমাও অখন।‘ ছেলেগুলো পিঠ থাবড়ে দিয়ে হাঁটা দেয়। তারাপদ বেবাক দাঁড়িয়ে থাকে আরো কিছুক্ষণ।
শেষরাতে চেনাশব্দে ঘুম ভেঙে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে তারাপদ। এ শব্দ জন্মজন্মান্তরের চেনা! এ যে বিয়োবার আওয়াজ, নাড়ি ছেঁড়ার শব্দ! ধড়মড়িয়ে উঠে দরজার পাশে রাখা শাবলখানা নিয়েই বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি ক্ষেতবরাবর কালো কালো ছায়ামূর্তি!‘হই শালা শুয়ারের পো! কাটি ফালাবো সবকটারে! ভাগ ইখান থিকি! ভাগ!’ শাবলখানা উঁচিয়ে ধরে অন্ধকারে প্রেতাত্মার মত ছুটে যায় তারাপদ।
‘এই দালালের বাচ্চা! চুপ কর বাঞ্চোৎ! বাড়ি যা এক্ষুণি!’ পাশ থেকে হিসহিসিয়ে গর্জন করে ওঠে কেউ।
হুঁশ ফেরে না তারাপদর। এলোপাথাড়ি শাবল ঘোরাতে ঘোরাতে জমির মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায় সে। সোনার চাদরখানা ততক্ষণে গায়েব হয়ে গেছে প্রায়! চারদিকে ‘ম ‘ম করছে ধানের গন্ধ। মায়ের দুধের গন্ধ! ঘোর লেগে যায় তার! চোখ বুজে সবটুকু টেনে নিতে চায় বুকে।
ঘাড়ের কাছে তীব্র আঘাতটুকু টের পেতে পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সামনে। দুধের গন্ধে মিশে যায় নোনা রক্তের অচেনা গন্ধ! ধাঁধা লেগে যায় চেতনায়। ততক্ষণে ভাগের বারোআনাটুকুও লুঠ হয়ে গেছে তার।
আলোছায়া
আমি বরাবর চালচুলোহীন। নাহ্, ‘ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে’ টাইপ নয়। বলার মত একখানা ঠিকানা আছে। সেখানে মা আছে, বাপ আছে। ফাউ বলতে একটা ইঁচোড়েপক্ক ভাই আছে। তবে সব থেকেও যেন টানটুকু ছিল না কোনোকালেই। একচিলতে জমির উপর দেশলাইবাক্স বাড়িটায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো। তিনজোড়া চোখ যেন আমাকে দিনরাত গিলে খেতো।
– ‘কয়েকটা টিউশানি করলেও তো পারিস! খালি বসে থাকার চেয়ে ভালো।‘ আমার কেরানী বাপ প্রায় প্রতিদিন বলত কথাগুলো। এক বাক্যবন্ধ, একই শব্দ পরপর বসানো। আমি চোখ বুজে লিপ দিতে পারি এখনো।
ওরা চেয়েছিল আমিও খাতা লিখি, বাপের মত। আমার গা গুলোতো। ঐ রাইস মিল, ভুতোরিয়ার লাল ছোপ দাঁত, পানমশলার গন্ধ, ন্যাতানো নোটের বান্ডিল – বমি পেত আমার!
– ‘লিখি তো! কবিতা লিখি যে!’ মুচকি হেসে বলতাম।
– ‘টানাটানির সংসারে দুটো পয়সা আসে, তাই বললাম। নইলে ঐ কবিতা তো কেউ পড়েও দেখে না!’ আমার তামাটে হয়ে যাওয়া মা দীর্ঘশ্বাস ফেলতো।
– ‘আমি নিজের জন্য লিখি। কাউকে পড়াবার জন্য নয়! বাদ দাও।‘
ঠিক ঐ সময়গুলোতেই আমার কবিতা পেতো। হুড়মুড় করে ঘিরে ধরতো শব্দেরা। মাথার ভিতর লাইনের পর লাইন বসে যেত বাধ্য সন্তানের মত! মা হাল ছাড়তো না।
– ‘আমি নাহয় বাদ দিলাম! নিজেকে জিজ্ঞেস কর এতগুলো বছর কী করলি!’
– ‘গাছ লাগিয়েছি! ঐ যে!’ পাশের পুকুরপাড়ে ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা কাঠচাঁপা গাছটা দেখিয়ে হেসে বলে উঠতাম আমি।
কলকাতা না গেলে, এই পাড়াগাঁয়ে বসে কিচ্ছু হবে না। কথাটা বুঝতে চারবছর লেগেছিল। জোড়ামন্দিরের মোড় অবধি এসেছিল বাপ-মা, আমাকে ছাড়তে। রতনদার ভ্যানরিক্সায় বসে কাপড়ের ব্যাগটায় হেলান দিয়ে সামনে তাকাতে দেখলাম বুল্টিও এসেছে টা টা করতে!
একসময় আমরা বর-বউ ছিলাম। সেইসব রান্নাবাটির দিনগুলোতে, আমার ঠাকুমা যখন দুজনের সম্বন্ধ করে দিয়ে টুক করে মরে গেল! আমরাও অনেকদিন অবধি নিশ্চিত জানতাম বড় হলে সত্যিকারের বর বউ হবো। মা-বাবারা যেমন!
তারপর দুম করে এ পাড়ায় সন্তুদারা এল। একদিন শুনলাম সাইকেলের রডে বসিয়ে রোজ বিকেলে বুল্টিকে নাকি ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যায় সন্তুদা! সে প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। সাইকেলে চেপে এখনও মাঝে মাঝে বাজারের দিকে যায় ওরা। হয়ত ফুচকাও খায়। হোমিও ফার্মেসী থেকে ওষুধ নিয়ে ফেরে। বুল্টির শ্বেতীটা ছড়াচ্ছে ক্রমশঃ।
তুমুল বর্ষা হয়েছে এবছর। বর্ধমানে বানভাসি ছিল দুসপ্তাহ। আমার বেলেঘাটার মেসবাড়িতেও হাঁটুজল ছিল দিনচারেক। দেখতে দেখতে কেটে গেল একবছর! খাতাই লিখি এখন আমি, দীনদয়াল উচ্চবিদ্যালয়ে।
– ‘সেই যে গেলি, একবারও তো এমুখো হলি না! এত বড় বান গেল একটা!’ পরশু ফোনে মায়ের গলা শুনে ইচ্ছেটা জন্ম নিল! ট্রেনে আসার সময়ে মন্দ লাগছিল না। বেকার ছেলে সাকার হয়ে বাড়ি ফিরছি, পুরনো ফিল্মে যেমন হত!
বাড়ি ঢোকার মুখে মনটা আরো ভালো হয়ে গেল। কাঠচাঁপা গাছটায় থোকা থোকা ফুল হয়ে আছে। বাড়িঘরের হাল খারাপ কিছু দেখলাম না। শুধু তুলসীমঞ্চটা পড়ে গেছে।
– ‘সন্তুটা পালিয়েছে, জানিস?’ খেয়েদেয়ে সিগারেট ধরাবো বলে বেরোচ্ছিলাম। পেছন থেকে মায়ের ছুঁড়ে দেওয়া কথাটায় থমকালাম। বাকি কথাগুলো হাওয়ায় ভেসে রইল বুল্টিদের বাড়ি অবধি।
– ‘আরে! তুমি কখন এলে?’ ভেজা কাপড় উঠোনে দড়িতে মেলছিল। সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছে।
– ‘কেমন আছিস?’
– ‘ভালোই তো!’ সাদাকালো মুখটায় এবার আলোছায়া।
– ‘এত দেরী করিস কেন?’
– ‘কই আর দেরী! ভিতরে এসো।’
– ‘আমার সঙ্গে যাবি?’
– ‘কোথায়?’
– ‘আমাদের স্কুলটায় অনেক ছেলেমেয়ে। মিনতিদি পেরে ওঠে না একা।‘
– ‘সেখানে আমি কী করবো অতীনদা?’
– ‘রান্নাবাটি খেলবি! সেই ছোটবেলার মত?’
– ‘ধ্যাত!’ ঈষৎ ফুলে ওঠা পেটটা চেপে ধরে হেসে ফেলল বুল্টি।
দেবাশিস সেনগুপ্ত: গল্পকার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।