ইশতিয়াক ফয়সল এর গল্প: ‘বড়দের ঘুমপাড়ানি রূপকথা’

0

[Girl: Mom, is that guy in the space rocket….? Is that Jesus?
Mother: No, baby.
Watchmen (2009); 1hrs 59min 59sec ]
প্রস্তাবনাঃ
… “অতঃপর তাহারা সুখে ও শান্তিতে বাস করিতে লাগিল”।
এখানে একটি রূপকথার শেষ হয়েছে । এরপরের ঘটনাগুলি ক্যামন?
মানে এইযে পারিবারিক সহিংসতা, তালাক টালাক, পরকীয়া, দাম্পত্য খুন খারাবী, নানান পরিসংখ্যান, দ্যাখা করবার নামে গণধর্ষণ, মানবাধিকারের বাঁদর নাচ… খবোর মাধ্যমে আমরা য্যামোনটা দেখি টেখি আরকি।
যেকোনো রূপকথার একটা অদেখা জগত থাকবার কথা। কল্পনায় আমাদের দেখা সেই রাজ্যটা যেমন অকল্পনীয় ঝলমলে সুন্দর, তেমনি এর অদেখা জগতটা ঠিক ততটাই অন্ধকার এবং বিষণ্ণ।
সেই গল্পের শুরু হয় বাবুছানারা যখন গল্পের প্রথমাংশ শুনে বিভোর স্বপ্নের রাজ্যে ডানা ম্যালে। কোন কোন দুঃখী মানবী তখন গোপন অবসরে ম্যালেরিয়াগ্রস্থ রোগীর মতো শিউরে ওঠেন।
পাঠকদের বলে রাখি নিচের ঘটনাটা প্রায় এক যুগ আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভরতিচ্ছু এক এলেবেলে ছেলের কাছে শোনা।
তাতে তৎকালীন সময়ের চলমান সামাজিক সমস্যা বা তার কারণ ও প্রতিকারের কোন রুপক আমি খুঁজে পাই নি।

রাজকুমারী গোলবদন ও রাজকুমার গোলজারঃ
…………………………………. রাজকুমারী গোলবদন মলিন বদনে উপরোল্লিখিত গোপন অবসরের মতোন একটা সময়ে বসে আছেন তখন। মাঝে মাঝে পাওয়া এই সময়টা তিনি ভূতে পাওয়া রোগীর মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন।
ছোটো রাজকুমারের বিয়ের আয়োজন চলছে। সারা প্রাসাদ উৎসব মুখর। দাসী-বাঁদিদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বারান্দায় এসে বসেছেন। বয়েস হয়েছে, শরীরে জমেছে মেদ।

প্রায় বছর পচিশেক আগের কথা-
রাজকুমার গোলজার যখন তাঁকে মহিপুট গ্রহের দ্যাওরাজ মনা পাগলার রাজদরবার থেকে উদ্ধার করে পৃথিবীতে এনেছিলেন সেদিন ঠিক এমনই এক উৎসবে মেতে উঠেছিল এই প্রাসাদ।
কিন্তু সেই অদ্ভুত গ্রহ, ছায়া ছায়া জগত, উদ্ভট জাদু আর…… আর সেই স্পর্শ !!!!
সেই পাপড়িবিহীন চোখ, হলদে সবুজ সুচাল দাঁত, খসখসে চামড়ার স্পর্শ, ক্রমাগত লালা ঝরতে থাকা সেই অসুস্থ, পুঁতিগন্ধময় ঠোঁট……… দ্যাও রাজ্যের সেই বীভৎস রাজকুমার চৈতা পাগলা
…. গোলবদন সইতে পারেন না। তাঁর অবশ অবশ লাগে। প্রচণ্ড এক ঘোর এসে গ্রাস করে তাঁকে ব্যাখাতিত এক অনুভুতিতে। এই অনুভুতির জন্ম মহিপুট নামের একটি অন্ধকার গ্রহে। আমাদের পৃথিবী থেকে সহস্রকোটি আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহ।
মহাযুদ্ধঃ
একসময় একই পৃথিবীতে দ্যাও এবং মানুষ এই দুই প্রজাতি বাস করত। দ্যাওদের বাস ছিল পৃথিবীর দুর্গম অঞ্চলে। পাতালপুরীতে অথবা বাতাসের আড়ালে – মানুষের চোখের আড়ালে।
বেশ চলছিলো সব …
একটা সময় মানুষ এবং দৈত্যদের মাঝে এক ব্যাপক বিধ্বংসী যুদ্ধ লেগে যায়, বিশ্বযুদ্ধ বলাই ভালো, পৃথিবী কাদের একক দখলে থাকবে এই নিয়ে। যুদ্ধের সঠিক কারন ঐতিহাসিকরা আজও অবশ্য বের করতে পারেননি। তেজী এবং বীর্যবান রাজা ও রাজকুমারেরা সেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। দুই পক্ষেই অসংখ্য হতাহত হয়। ধর্ষিত হয় অসংখ্য মানুষ, মানবী, প্রেত, প্রেতিনী ও শাঁখচূর্ণী। এই ঘটনার পর পৃথিবী হয়ে পড়ে বসবাসের অযোগ্য। কারন ততদিনে মানুষ আর দ্যাও- দানবের সম্মিলনে না-মানব-না-দ্যাও তৃতীয় এক প্রজাতির উদ্ভব হয়ে গেছে। এরা বুদ্ধিতে গবাদি পশুর মতোন অসহায়, উচ্চতায় দানবীয়, সহনশীলতায় ইস্পাতের চাইতে নমনীয়।
কিন্ত মানুষের বুদ্ধি অপরিসীম। এই সংকটকালীন সময়ে মহীয়সী জ্যোতির্বিদ তারাবাঈ বের করেন বাসযোগ্য আরেক পৃথিবীর খোঁজ। মহান আলকেমিক মখদুম বিন মুলখ তাঁর নির্দেশনায় ব্যাপক গবেষণার পর এক আন্তঃনাক্ষত্রিক যান তৈরি করেন।
সন্ধ্যার মতোন এক মেঘলা সকালে বাজের মতোন তীব্র আলো ছড়িয়ে সেই যানে চেপে তারা উড়ে যান নতুন বাসস্থানের দিকে। যাবার আগে পুরনো পৃথিবীর চারপাশে তাঁরা দিয়ে যান এক নিরাপত্তা বলয় যাতে কোনদিন এই দানবরা পৃথিবী, যাকে একটু পরেই আমরা মহিপুট নামে চিনবো , ‌ ছেড়ে বাইরে বের হতে না পারে।
মহীয়সী তারাবাঈ ও মহান মুলখ জানতেন যে নতুন পৃথিবীতে তাঁরা জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন পথ প্রসারিত করতে পারবেন। তাই তাঁরা তাদের আবিষ্কৃত একটি ছোটো যন্ত্রে সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করে নিয়ে যান কারণ বিশাল পুঁথিঘর ঐ যানে এঁটে যাবার মতো জায়গা ছিল না। আর তারা ভাল করেই জানতেন এই গোঁড়া দানবের দল কোনদিন জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হবে না।
পরিত্যাক্ত পৃথিবীতে তাই পড়ে থাকল কেবল কিছু তৃতীয় প্রজাতি, গুটিকয় খানদানি দানব, মানুষের ফেলে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ, আর সেই মহান পুঁথিঘর ।
নতুন পৃথিবীতে মানুষ কি কোন যুদ্ধের মাধ্যমে বা রাজনৈতিক কুটকৌশলে তার আদিবাসিদের হঠিয়ে দিয়ে মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো তাও অবশ্য ঐতিহাসিকেরা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।

মহিপুটের দিননামাঃ
সেখানে সময় স্থির। চির বিকেলের এক নগরী, স্বচ্ছ হলুদ আলো খেলা করে প্রাচীন ও পরিত্যাক্ত গ্রহের অলিতে গলিতে, বিষণ্ণ দালান কোঠায়। বিষণ্ণ নগরের রাজপথে তৃতীয় প্রজাতির শিশুরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়।
তাদের চোখে শূন্য দৃষ্টি, মলিন অর্ধনগ্ন দেহ। তারা অসম্ভব মৌনতা আর নিরবিকারত্ত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এখানে বিষণ্ণ গাছের পাতায় জং ধরা নিবিড় বন, ধুলয় ধুসর, মাকড়সার জাল দিয়ে ঘেরা। সেই জালে ঘন কুয়াশা আটকা পড়ে রোদের সাথে আঁতাত করে অন্তহীন ছায়া ছায়া ঠাণ্ডা বিকেল জিইয়ে রাখে সবসময় য্যানো সন্ধ্যে নামলো বলে এই ।
এখানে রাজা মনা পাগলার প্রাসাদ ঢেউহীন, গতিহীন এক স্থির মহাসাগরের উপর ভাসমান। প্রাসাদটির অর্ধেক নতুন, অর্ধেক ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। প্রাসাদের ঠিক নিচেই সাগরের জলের উপর দণ্ডায়মান শূন্য চেয়ারে মনা পাগলার কাছারি। চারিদিকে এক পরাবাস্তব শূন্যতা আর অশ্রাব্য মৌনতা।

এখানে শব্দ, কোলাহল আর বিনোদন বলতে হঠাৎ কোন কোন একদিন নগর সরণিতে এক সাপুড়িয়ার অদ্ভুত খেলা ।
অধিকাংশ দানবেরা জানেই না কখন তিনি আসবেন। তাই খুব অল্প কারো সৌভাগ্য হয় সেই আজব খেলা দ্যাখার। সাপুড়িয়ার হাড়ের বাঁশির অদ্ভুত টানাটানা আওয়াজে সাপের ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে আসে স্ফীত নিতম্ব আর গুরুবক্ষা অপরূপ এক রমনী। দেহের ভাঁজে ভাঁজে অজান সাগরের ঢেউ তুলে মোহিত করে দর্শকদের। নাচিয়ের সুদীর্ঘ আর পরিপুষ্ট বেণী ধীর অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরে সৌভাগ্যবান কোন কোন দর্শক । অশ্রুত বাঁশীর সুর আর নাচিয়ের দীঘল চুল আরও বিস্তৃত হয়। বিস্তৃত হতে হতে একসময় পুরো নগর সরণি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় জোয়ার ডাকা নদীর মতো সেই দীঘল কেশে। পাঁক খেয়ে খেয়ে ওঠা বাঁশীর উত্তেজক সুরে আরও গভীর হয়ে ওঠে এই নৃত্যক্রীড়া।

এখানে সকল রকমের অনুভূতি অপূর্ণাঙ্গ- অনুভূতি বলতে আমরা যা বুঝি। যেমন যৌনতার বোধহীন একটি কিশোর কোন নিঝুম দুপুরে স্নান সেরে এসে কাপড় মেলতে দেয়া কোন মাঝবয়েসীর দিকে একটা ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি নিয়ে ধুকপুকে বুকে চেয়ে থাকে আড়াল থেকে।
এখানে রাজা হতে হলে একমাত্র বিশুদ্ধ দানব রক্ত লাগবে, কিন্ত রাজা মনা পাগলা একজন তৃতীয় প্রজাতির দ্যাও। নিজের মেধা, ধৈর্য ও বিচক্ষনতা দিয়ে তিনি তাঁর অবস্থান করে নিয়েছেন মহিপুটে।
কালের পরিক্রমায় তিনি এখন বৃদ্ধ, সন্তানের হাতে বুঝিয়ে দিতে চান সিংহসন।
কিন্তু চৈতার সেখানে মন নেই। আদি মানুষের ফেলে যাওয়া সেই পরিত্যাক্ত পুঁথিঘরে তার আসা যাওয়া। দিনের একটা বিরাট সময় কেটে যায় তার এসব বই পত্তর আর অকেজো কলকব্জা নিয়ে। অনুসন্ধিতস্য মন বিজয়ী মানুষের প্রাচীন ইতিহাসের ফাঁকফোকর আবিষ্কার করে পুড়ে যায় প্রতিশোধের প্রবল জ্বরে।

হাজার বছরের রূপকথা পড়ে দেখেছে সে, মানুষ তার নিজের বীভৎসতা কিভাবে দ্যাও দানবের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজের মহানুভবতা ও মহানুভবতার মিথ্যে গল্প বুনে রেখেছে । একগুঁয়ে রাজকুমার একসময় নিজেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং আলকেমিতে পারদর্শী করে তোলে … দুর্ভাগ্যক্রমে একটু বেশিই। অনেক গবেষণার পরে সে আবিস্কারও করে ফেলে সেই জাদু বলয় ভেদ করে কিভাবে মহিপুটের বাইরে যাওয়া যায়। \
একদিন সেও তীব্র আলোর ঝলক ছড়িয়ে, অদ্ভুত এক যানে চেপে রওনা দ্যায় মানুষের নতুন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে—প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে।

অপহরণ পর্বঃ
দ্যাওকুমার চৈতা আত্মগোপন করে মেঘের সবচাইতে উপরের স্তরে। সেখানে বসে সে পৃথিবীর সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতে থাকে নিবিড় মনোযোগে।
দিন রাত্রির এমন তারতম্য সে কোথাও দেখেনি। এক বিকট ভয়ের জগত থেকে আসা দানব অবাক হয়, এতো সুন্দর একটা জগতের মানুষ কিভাবে অবলীলায় এত অসুন্দর কাজগুলি ঘটাতে পারে?
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। রাজকুমার গোলজারের সাথে রাজকুমারী গোলবদনের বিয়ে পাকাপাকি। অনেক উঁচু খানদানের পাত্র গোলজার। মানুষ ও দৈত্য মহাযুদ্ধের শ্রেষ্ঠতম বীর তুঘলক জাহানের চতুর্থ প্রজন্ম। বংশের মান সম্মান আরও সমুন্নত রেখেছেন তিনি। প্রজাদের প্রতি অপরিসীম মমতা তাঁর চরিত্রকে এনে দিয়েছে এক দেবতুল্য স্থানে। পৃথিবীর মানুষ এখন এক বাক্যে যেকোনো সঙ্কটে তাঁর উপর আস্থা রাখতে পারে। তিনি সেই যোগ্যতার প্রমান রেখেছেন তাঁর নানা কাজে। অন্যায়ের সাথে কখনই তিনি আপোষ করেননি।
রাজকুমারী তখন সুখস্বপ্নে বিভোর। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর বাগানের বেঞ্চিতে,যেমন কোন শিশু ভরপেট স্তন পান করে পরম নির্ভরতায় আর নিরাপত্তায় ঘুমিয়ে থাকে মায়ের বুকে । দুধ সাদা জোছনায় তেমনই ঘুমিয়ে আছেন চন্দ্রকন্যা গোলবদন । এত সুন্দর কোন চলমান শরীর চৈতা দ্যাখেনি কখনো।
… রাজকুমারী নিখোঁজ পরদিন সকালে ।

রাজকুমার গোলজারের অভিযান:
সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত রাজকুমার দেখা পান এক ডাইনি বুড়ির ।তিনি স্ফটিক গোলক দিয়ে ঠিকানা জানান রাজকুমারীর অবস্থান।
গোলজার যাবার বেলায় একটু পেছন ফিরলে হয়তো দেখতে পেত সেই বুড়ির ভেজা চোখ ।
যে কথা বলা হয়নি অথবা আমাদের জানা দরকার নেই তা হোল, গোলবদন এবং চৈতা পাগলার প্রেমের উপাখ্যান, কিংবা রাজকুমার গোলজারের হাতে চৈতা পাগলা বধের নৃশংসতা । যা আমদের জানার দরকার নেই তা হোল কিভাবে ক্ষয়া মহিপুট একটি ভূস্বর্গে রূপান্তরিত হয়েছিল।
আমদের জানার দরকার নেই বিদায়ের আগে গোলবদন একবারও জড়িয়ে বুকে নিতে পারেনি কাঁটাময় দানব রাজকুমারের দেহ। অথবা শেষ চুমু হয়নি অধর বিহিন ক্ষুরধার দানবীয় মুখে।
ঠিক ঠিক সব রূপকথার মতন পরিত্যাক্ত পড়ে থাকে গুছিয়ে ওঠা একেকটি দানবীয় সভ্যতার ধবংশাবশেষ – বিজয়ী মানুষের ইতিহাস বলে কয়ে।
যা আমাদের জানা প্রয়োজন তা হোল ……………………….. “অতঃপর তাহারা সুখে ও শান্তিতে বাস করিতে লাগিল”।

শেষকথা :
মানুষের মনের অচেনা সাম্রাজ্য নিয়ে আজও তো মনোবিজ্ঞান এক মহাসমুদ্র সমস্যায় ব্যস্ত । দানবদের ভেতরে ঠিক কি রসায়ন তা জানার কি সময়, অথবা দরকার কি আমাদের আদৌ আছে? থাকনা রূপকথা , ঘুমপাড়ানি হয়ে। ঘুমাক খোকি এবং খোকনছানারা । কিছু চোখ থাক জেগে তবুও ………

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.