সুবিমল মিশ্র, শহীদুল জহির, মনোরঞ্জন ব্যাপারী’র সাহিত্যকর্মের অনুবাদক ভেঙ্কটেশর রামাশ্বামী’র সাথে আলাপচারিতা

0
Showing 1 of 1

সুবিমল মিশ্র, শহীদুল জহির, মনোরঞ্জন ব্যাপারী’র সাহিত্যকর্মের অনুবাদক ভেঙ্কটেশর রামাশ্বামী’র সাথে আলাপচারিতা

বিশিষ্ট অনুবাদক ও লেখক ভেঙ্কটেশ্বর রামাস্বামী কলকাতা নিবাসী একজন ভারতীয় তামিল। পিতামাতার সাথে বাল্যকাল থেকে কলকাতায় বসবাস। বাংলার ইতিহাস, ভাষা, বাংলাসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর রয়েছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। সাহিত্যপত্রিকা লেখালেখির উঠান এবং ভাঁটফুলসূত্র এর পক্ষে মাজহার জীবন এবং রফিক জিবরান তার সাথে অনলাইনে ৪ অক্টোবর ২০২১ যুক্ত হয়েছিলেন অনুবাদ এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলাপচারিতায়। আলাপচারিতাটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।

লেখালেখির উঠান ও ভাঁটফুলসূত্র এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাই। শুরুতে জানতে ইচ্ছা করছে একজন তামিল ভাষাভাষী হয়েও কোন ধরনের বিবেচনা থেকে বাংলা সাহিত্যকর্ম অনুবাদে আগ্রহী হলেন। আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও জানতে চাই।

অনুবাদ কী করে আর কেন শুরু করলাম সেই সূত্রটাকে ধরে একটু পিছিয়ে যাই। আমি অনুবাদ আরম্ভ করলাম ২০০৫ সালে। আমার বয়স তখন ৪৫। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স অবধি কী করছিলাম সংক্ষিপ্তভাবে তা বলছি। আমার পড়াশুনা ক্যাডেট কলেজে। ভারতের দেরাদুনে রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি কলেজ। আমার পড়াশুনা সেই স্কুলে। আমি মিলিটারিতে গেলাম না, আমার বন্ধুরা বাকি সবাই মিলিটারিতে গেল। তারপর কলকাতা ফিরে এসে ইকোনোমিক্স পড়ি, আন্ডারগ্রাজুয়েট এবং মাস্টার্স। এরপর আমি ইংল্যান্ডে চলে যাই চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সিতে কোয়ালিফাই করার জন্য। সেখানে পৌঁছে আমার মনে হলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি আমার জন্যে মোটেই উপযুক্ত না। আর এটাকে আমি কোনো মতেই ধরে রাখতে পারবো না। জাস্ট কোনোভাবে চেষ্টা করে তিন চার বছর সেই কোয়ালিফিকেশনটা অর্জন করে তারপর যা করার তা করবো, ততটুকুও পারলাম না। তত ধৈর্য ছিল না আমার। তো সেটা ছেড়ে আমার দেশে ফিরে এলাম। তবে দু’বছর ছিলাম ওখানে। সে সময়ে নিজেকে শিক্ষিত বানানোর জন্য চেষ্টা করলাম ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গিয়ে।

বৃটিশ লাইব্রেরিতে পৌঁছে আমি বুঝতে পারলাম আমি কত অশিক্ষিত। কার্ল মার্কসও ওখান থেকে বই নিয়ে পড়াশুনা করতেন। ইংল্যান্ডের মতো উন্নত, ধনী দেশে কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ছেলে হিসেবে কালচারাল শক ভীষণভাবে অনুভব করলাম। যে কালচারাল শকের তলায় ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি সব আছে। ঐ কালচারাল শক থেকে যে ইমপ্যাক্ট আমার ওপরে হলো সে জায়গা থেকে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, কেন বৃটেন ধনী আর ভারতবর্ষ গরীব। ঠিক কেন এই প্রশ্নটা থেকেই শুরু। খুব স্পষ্ট করে বিষয়টা যেন বুঝতে পারা যায়। এভাবে আরম্ভ হলো।

২২ বছর বয়সে গেলাম ইংল্যান্ডে। দু’বছর পর ফিরলাম। যে লোকটা ফিরল আর যে লোকটা গিয়েছিল সে আর একই লোক নয়। একটা পরিবর্তন ঘটল আমার ভিতরে। অনেকেই বিদেশে যায় পড়াশোনা ইত্যাদি উপলক্ষে। সবার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে না। আমার মধ্যে ঘটল। বড় বড় ডিসিশান নিলাম সেই অবস্থায়। আর আমার বাকী জীবন সেই ডিসিশানের ভিত্তিতেই এগিয়েছে। আর আমার কোনো রিগ্রেট নেই এ ব্যাপারে। তো দেশে ফিরলাম… দেশের যে পভার্টি, যে গরীবী আছে তা লজ্জার ব্যাপার। সেটা একটা অভিশাপ। কার্স, অর শেম অব পোভার্টি। হাউ টু ইরাডিকেট দিস কার্স অর শেম অব পোভার্টি সেটাই ছিল আমার এ্যাম্বিশান। অনেকের এ্যাম্বিশান থাকে এতটা বাড়ি, গাড়ি… তো আমারও অ্যাম্বিশান ছিল কিন্তু তা মনিটারি টার্মে নয়। আমার অ্যাম্বিশান পোভার্টি ইরাডিকেশন কীভাবে করা যায়, বিশেষত শিক্ষার দিক থেকে। সেই সব উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে ফিরে এলাম দেশে।

একটা কলেজে লেকচারের চাকরি পেলাম। কলেজে দায়িত্ব ছিল সকাল ৬টা থেকে ৯টা চল্লিশ। তারপর সারাদিন ফ্রি। তো সারাদিন বিভিন্ন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলাম। সেই সময় কলকাতার ঝুপড়িবাসীদের নিয়ে একটা সংগঠন গড়ে উঠছিল, ছিন্নমূল শ্রমজীবী জিজ্ঞাসা। ঝুপড়িবাসীদের উচ্ছেদ চালাচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার তখন। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ঝুপড়িবাসীদের সুস্থ পুনর্বাসন করা আর তাদের জন্য একটা আবাসন নীতি যাতে সরকার ঘোষণা করে যেটার মধ্যে এ ধরনের মানুষদের স্থান ও স্বীকৃতি আছে। এমন উদ্দেশ্যে একটা আন্দোলনের সাথে নিজেকে যুক্ত করলাম। তো এই এ্যাক্টিভিস্ট জীবন চলল প্রায় কুড়ি বছর। এই কুড়ি বছর অনেক চেষ্টা অনেক পরিশ্রম হলো কিন্তু কোনো জিনিস অর্জন হলো না। দেখানোর মতো বা বলার মতো কোনো জিনিসই অর্জন হলো না। এমন একটা সরকারের সাথে ডিল করছিলাম যেটা একদম ইন্ডিফারেন্ট। তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই এসব ব্যাপারে। দেয়ালে মাথা ঠেকানোর অবস্থা। সেই সময় পরিবারে কিছু ব্যাপার ঘটল। আমার বাবার একটা ব্যবসা ছিল। বাবার মৃত্যুর পর তার পার্টনার সেটা চালাচ্ছিল। তারপর সেই পার্টনার মারা গেলেন আর উনার কোনো সন্তান নাই। সেই ব্যবসাটা সম্পূর্ণ আমার মায়ের কাঁধে চলে এলো। আমার মা’র ব্যবসা করার কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। তিনি স্কুল প্রিন্সিপাল ছিলেন। তো আমি খুব রিলাক্টান্টলি সেই ব্যবসা পরিচালনা করার দায়িত্বটা নিজের ঘাড়ে নিলাম। আমার অ্যাক্টিভিস্ট জীবনের একটা পয়েন্ট আউট অবস্থায় ছিলাম তখন। ও রকম সময় ফ্যামিলি বিজনেস এর দায়িত্বটা চলে এলো। সেটা নিয়েই কাজ করতে শুরু করলাম আর তারপরে অনুবাদটা ধরলাম।

অনুবাদটা আরম্ভ হলো বাইচান্স বা বাই এক্সিডেন্ট। আমার একটা বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছিলাম। তো, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কী পড়ছেন আজকাল আপনি? ও বলল, দূর বাংলা আজকাল আর পড়ি না। পড়ার মতো নয় কিছু। আমি বললাম সেটা কী করে হয়, নিশ্চয় পড়ার মতো অনেক কিছুই আছে। একটু ভেবে বললেন হ্যাঁ আছে, উনার নাম সুবিমল মিশ্র। তো, সেটাই প্রথম সুবিমল মিশ্রের নাম শোনা। আমি ওই কথার সূত্রে বলে ফেললাম ঠিক আছে আমি অনুবাদ করবো। সুবিমল মিশ্রের নাম শুনিনি তার আগে, তিনি কী করেন, কী তার লেখার বৈশিষ্ট্য- কোনো কিছুই আমি জানতাম না। তারপর ঐ বন্ধুর কাছে অনুবাদ করবো বলার পর সে বলল, ঠিক আছে, তুমি যেহেতু বললে সুবিমল মিশ্র অনুবাদ করবে। তাহলে করতেই হবে। বন্ধুর ঠ্যালায় আমি লেখকের সাথে কন্টাক্ট করে উনার বইগুলো সংগ্রহ করি। তারপর বইগুলো আমার টেবিলে দু’মাস পড়ে ছিল। হঠাৎ একদিন অস্থির ফিল করছিলাম। কিছু করার ছিল না। খুব বোর লাগছিল। তো হঠাৎ সেই বইগুলো তুলে পড়তে শুরু করলাম আর সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদও করা শুরু করলাম। সেটা ছিল ২০০৫ সাল। তো ঐভাবে আমার অনুবাদ-যাত্রা আরম্ভ।

তো, প্রথমধাপে সুবিমল মিশ্রের প্রথম পর্যায়ের ১৫টা গল্প অনুবাদ করলাম। ২০১০-এ বের হলো একটা বই হার্পারকলিন্স এর মাধ্যমে। তারপর আমি ঠিক করলাম যে, এটা নিয়ে আরও এগুবো, আরও সিরিয়াস হবো। প্রথম বইটা ঘটনাচক্রে বের হলো। দ্বিতীয় বইটা আরও সিরিয়াসলি অনুবাদ করা উচিত, মানুষের সুবিমল মিশ্রের লেখা পড়া উচিত… তার লেখক জীবনের শুরু থেকে শেষ লেখা অবধি কয়েকটা বই সিলেক্ট করে কয়েকটা বই বার করবো এটা ঠিক করলাম। ২০১০-১১তে দ্বিতীয় ধাপ আরম্ভ হলো আরও সিরিয়াস অনুবাদ করার।

এভাবেই কি শহীদুল জহির অনুবাদের ভাবনা আসে?

হ্যাঁ । জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বেরুবে। হার্পার কলিন্স ওটা সম্ভবত ২০২২ এর জানুয়ারিতে বের করবে। হার্পার কলিন্স এর বইতে দুটো ছোট উপন্যাস আছে। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আবু ইব্রাহিমে মৃত্যু। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তো খুব ছোট। ইংরেজীতে কুড়ি বাইশ হাজারের শব্দ, বাংলাতে আরও কম। ওটা দিয়ে তো বইয়ের স্পাইন হয় না, হার্পার কলিন্স এর বইয়ের যা ফর্ম্যাট। ওরা বলল আরও মাংস দরকার। আগে প্রস্তাব দিলাম, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আর কিছু গল্প থাকতে পারে। ওটা ম্যাচ হচ্ছিল না। তো, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু প্রস্তাব করলাম আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু পড়া ছিল না। প্রস্তাব করার পর তবে পড়লাম। পছন্দ হলো আমার। দুটোর মধ্যে একটা কন্ট্রাস্ট আছে। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ভীষণ পাওয়ারফুল। পুরোটা একটা প্যারাগ্রাফে লেখা। তার মানে লেখক ও তার চরিত্র, আব্দুল মজিদ, তার ভিতরকার যে রাগ ইত্যাদি একটা প্যারাগ্রাফে প্রকাশিত হচ্ছে। আবু ইব্রাাহিমের মৃত্যু আরও কোয়ায়েট, চুপচাপ। দ্ইু ভাই যদি থাকে স্পোর্টসম্যান, একটা যদি হয় লাজুক, বই পড়ে ইত্যাদি। তো এ দুই ভাইয়ের পাসোনালিটি ভিন্ন। দ্ইু ভায়ের মতোই উপন্যাসের ক্যারেক্টারটা ভিন্ন। কিন্ত একই লেখক লিখেছে সেটা স্পষ্ট। লেখকের সিগনেচার, নেচার- সেগুলো উপস্থিত। আর উনার যে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো দেখা- সেটাও উপস্থিত।

দাদা, ডুমুর গল্পটা পড়েছেন?

হ্যাঁ পড়েছি। দ্বিতীয় যে বইটা হার্পারকলিন্স বের করবে সেটা হবে ১০টা গল্পের সঙ্কলন। তৃতীয়টা হবে মুখের দিকে দেখি। কিছু লোক সেই রাতে পূর্ণিমা খুব পছন্দ করে। আমার, মুখের দিকে দেখি খুব পছন্দের। মনে হলো ইংরেজিতে মুখের দিকে দেখি-টাই জোরদার ইমপ্যাক্ট ফেলবে। এটা ম্যাজিক রিয়ালিস্টের আরও কাছে।
সুবিমল মিশ্রের পরে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর বই এবং তালাশনামা কেন অনুবাদে আগ্রহী হলেন। শহীদুল জহির সম্পর্কে আরও জানার ছিল।
সুবিমল মিশ্রের গল্প অনুবাদটা যখন শেষের দিকে পৌঁছুলাম, তখন এরপর কী করবো ভাবতে শুরু করলাম। তো, সুবিমল মিশ্রের গল্প পড়া শুরু করলাম আরও করবো বলে। আর, তার ছোটগল্প নিয়ে কাজ করবো ঠিক করলাম। কারণ উনার লম্বা উপন্যাসগুলো মনে হলো অনুবাদের জন্য আরও কঠিন। আর হয়তো অনুবাদ সম্ভব না। কারণ, ওটা এতো এমবেডেড বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা রাজনীতি যে, অনুবাদ করলে হাজারো নোট, ফুটনোট দিতে হবে, সেটা ঠিক সাহিত্য নয়। অনেকে হয়তো করতে পারে। তো, সুবিমল মিশ্রের নাম আমি হয়তো কিছুটা প্রচার করতে পারলাম ছোটগল্প অনুবাদে। কিন্তু এটার মানে হলো যে, আরও অনুবাদ করতে থাকবো। সুবিমল নিয়ে থামবো না।

এটার পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমার জীবনে … আট বছর আগে আমার তেইশ বছরের বড় ছেলে মারা গেল। তো, ন্যাচারালি আমার খুব কষ্ট, ডিপ্রেসন। একদিন একটা মিটিংয়ে ছিলাম। ডিপ্রেসন খুব জোরে ধাক্কা দিল, মিটিং ছেড়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে টেবিলে বসে যে অনুবাদ কাজটা করছিলাম, সেটা করতে শুরু করলাম। তখন থেকে অনুবাদ ব্যাপারটা আমার ক্ষেত্রে অন্য ব্যাপার হয়ে উঠল। এখন ডিপার লেভেলে অনুবাদ বিষয়টা কাজ করছে। অনুবাদ তো সহজে হয় না। সেটা ছিল ২০১৫ সাল। অনুবাদ করে যেতে হবে এরকম ব্যাপার হয়ে গেল মনের ভেতরে। তাই অনুবাদ করতেই থাকবো এরকম সিদ্ধান্ত নিলাম। এমন ভাবার সময় ফেসবুকে পড়লাম মনোরঞ্জন ব্যাপারী সম্বন্ধে আর কৌতুহল হলো বা ইন্টারেস্ট জাগল উনার ব্যাপারে। উনার জীবনের যে কাহিনী, গরীব বাড়ির ছেলে। স্কুলে যাননি বা লেখাপড়া শেখেননি আর অল্প বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলেন, আর সারাজীবন একটা পরিশ্রম, অত্যাচার নিয়ে উনার জীবন। আর নিজেকে তৈরি করলেন, আর সেটা ঘটল জেলে যাওয়ার পর। পড়তে লিখতে শিখলেন। সাইকেল রিকশা চালক হিসেবে কাজ করলেন আর তখন থেকে লেখার শুরু।

তো সুবিমল মিশ্রের অনুবাদ করার পর থেকে ভাবলাম অনুবাদ যদি করি তবে ভয়েসেস ফ্রম দি মার্জিন বা প্রান্তিক স্বর, সেটাই করবো। সেটা ঠিক করেছিলাম। মনোরঞ্জনের কাহিনী তো একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাহিনী। উনাকে কন্টাক্ট করলাম। উনি বললেন যে, উনার আত্মজীবনী কেউ একজন অনুবাদ করছে অলরেডি। আর তারপর চ-ালজীবন নামের যে উপন্যাস উনি লিখেছেন একটা পত্রিকায়, চার খণ্ডে সেই উপন্যাস আমাকে দিলেন। আর সেটা হয়ে গেল ইংরেজিতে তিন খণ্ডে ট্রিলজি, চণ্ডালজীবন ট্রিলজি । ২০১৬ সালে সেটা নিয়ে কাজ আরম্ভ করি আর ২০১৮ এসে শেষ হয়। আর তারপর দু’বছর সেটা ঝুলে ছিল। আমাজন মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে উনার লেখার রাইটস নিয়ে নেয়। পাবলিশারের কাছে সেটা একটা প্রবলেম হয়ে দাঁড়াল। দু’বছর লাগল সেটা কাটাতে। তারাই জানাল যে, তারা বইটা বের করবে। প্রথমটা বেরিয়ে গেছে ২০২০ ডিসেম্বর মাসে। দ্বিতীয়টা বলল আরও চারপাঁচ মাস লাগবে। তৃতীয়টা আমি এখনো অনুবাদ করতে শুরু করিনি। সেটাও আগামী একদুবছরে বের হবে।

কিন্তু, ২০১৫-১৬তে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ব্যাপারটা ঘটল। আমারও ম্যাচুরিটি, জ্ঞান বেড়েছে। বাংলা সাহিত্য, প্রান্তিক সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা জ্ঞান বেড়েছে। তালাশনামা, অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটি ঘটেছে আমার বন্ধু সৌমিত্র দস্তিদারের কারণে। আর তাই এটির কৃতিত্ব সম্পূর্ণটাই ওর। ও আমার পুরনো বন্ধু। প্রায় পনের-ষোল বছরের। আমরা দুজনই একটা গবেষণা কেন্দ্রের সাথে যুক্ত। ও এখন যুক্ত না, আগে ছিল। সেটা ক্যালকাটা রিসার্স গ্রুপ। রণবীর সমাদ্দার নামে একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী গঠন করেছেন পঁচিশ বছর আগে। উনার চেষ্টা ছিল যে এটা একটা সিভিল সোসাইটির রিসার্স ইন্সিটিটিউট হবে। সরকারী না, বা শুধু বুদ্ধিজীবীমহলের রিসার্স ইন্সিটিটিউট না। সিভিল সোসাইটির, যারা অ্যাক্টিভিস্ট, যারা গবেষক, যারা লেখক, সাংবাদিক, উকিল, ইত্যাদি। সব সময় তিনি একাডেমিক সার্কেলের বাইরে, যারা কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি বা সমাজ নিয়ে ভাবছেন বা কাজ করছেন তাদেরকে একত্রিত করার চেষ্টা এ রিসার্চ গ্রুপের। সৌমিত্র আর আমাকেও উনি জড়ো করেছিলেন সেই সংস্থার ছাতায়। সেইভাবে সৌমিত্রের সাথে পরিচয়। ফেসবুকে আমার একজন বন্ধু পোস্ট করল যে, সৌমিত্র দস্তিদারের একটা লেখা বেরিয়েছে পত্রিকায় বিভিন্ন লেখকের লেখা নিয়ে। তো সেই লেখায় দুটো বাক্য ছিল তালাশনামা আর ইসমাঈল দরবেশ এর ওপরে।
ঠিক যেভাবে আমার বন্ধু মৃণাল আমাকে বলেছিল সুবিমল মিশ্র নিয়ে, ঠিক তেমনি ইসমাঈল দরবেশের তালাশনামা নিয়ে সৌমিত্রের অভিমতকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করলাম। কারণ উনার সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয়। উনি একটা জিনিস যখন বলেন, নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই বলেন। সঙ্গে সঙ্গে বইটা আমি সংগ্রহ করলাম। পাবলিশার কে তা জানার পর তার সাথেও যোগাযোগ করলাম। পাবলিশারকে চিনি অনেক দিন থেকে। ফোন করলাম, উনার কাছ থেকে ইসমাঈলের ফোন নাম্বার নিলাম। কথা বললাম। তারপর আমার হার্পারকলিন্স এর কলিগদের সাথে কন্টাক্ট করলাম। তারা বলল একটা নোট লিখতে আর একটা স্যাম্পল পাঠাতে। সেটাও করলাম। তাদের ভেতরের সভায় সেটা পেশ করা হয় আর সেটা অনুমোদন করা হয়। ওরা আমাকে জানিয়েছে ওরা বইটা প্রকাশ করবে। যখন আমি ইসমাঈল দরবেশের তালাশনামা’র নাম শুনি আর হার্পারকলিন্স জানায় যে, তারা ওটা করবে- এটা ঘটে দশ সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে। খুবই খুশি হলাম যে এতো তাড়াতাড়ি এটা ঘটল।

অনুবাদ করি স্বাধীনভাবে, কখনো ভাবিনি যে এটা কোন পাবলিশারের হয়ে করছি। আমি ঠিক করি, কী করবো, কী করা উচিত। কোনটার গুরুত্ব আছে। তারপর ঠিক করি যে, কোনো পাবলিশার আছে কী না খুঁজে দেখা। কোনো কোনো সময় রাজী হয় না। যেমন, সুবিমল মিশ্রের তৃতীয় বই যেটা হার্পারকলিন্স বের করেছে। ২০১৯ এ বেরুলো, কিন্তু ২০১৪ তে জানিয়েছে যে, ওরা করবে। তারপর ২০১৬তে জানাল যে করবে না। ২০১৭ তে নতুন এডিটর এলো ওখানে। সে তখন ঠিক করল যে, ওটা করবে। আরও একটা বই অনুবাদ করলাম, স্বাতী ভৌমিক নামে একজন লেখক। ওটারই প্রকাশক পাইনি। আমারই অনুবাদের ভিত্তিতে ওটা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ হবে আর ফরাসী দেশে বেরুবে। আর আমার বিশ্বাস ভাল চলবে উপন্যাসটা, বিশেষ করে মহিলাদের ভেতরে।

আপনি তো, ২০০৫ সাল থেকে শুরু করলেন। কিন্তু, সুবিমল মিশ্র বা শহীদুল জহিরের ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা… এগুলোকে জানার জন্য কী কোনো ট্রেনিং নিয়েছেন?

আমি কোনো ট্রেনিং নিইনি। কেউ যখন কথা বলে আমি সেটা বুঝি। সারাজীবন কলকাতায় বাস করে এখানকার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সংস্কৃতি সম্পর্কে ইনভলব থাকা, বা এগুলো সম্পর্কে ভাবা। সে জন্য মনে হলো যে, সেই যোগ্যতা আছে আমার বুঝতে পারার। অনুবাদ করাটা সেই বোঝার পর আরেকটা ধাপ পেরোনো। আমি বুঝছি আর সেটাকে অন্য এক ভাষাতে নিয়ে আসছি। আর ইংরেজি তো জানি, সেটা নিয়েই ২/৩ বছর বয়স থেকেই ইংরেজির গণ্ডিতে আমাকে ঠেলা হলো। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে। আর ভারতে একটা শ্রেণি আছে যাদের ইংরেজিতে দখল আছে। শুধু ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল আমিই নই, আমার মা বাবারাও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। আমার ঠাকুরদা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। চার্চের একটা স্কুলে। আমার মা’র মা বাবারাও শিক্ষিত, গ্রাজুয়েট। তো সেই ব্যাকগ্রাউন্ডটা ছিল। বাড়ি ভর্তি বই। বাড়িতে বই নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। তো, সেই ব্যাকগ্রাউন্ডে মানুষ হয়েছি বলে ইংরেজির ওপর দখল। স্কুলে পড়ার সময় বাংলা কম্পালসারি ছিল। তারপর পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে গেলাম উত্তর প্রদেশে। সেখানেই আমার স্কুল শিক্ষা কমপ্লিট হলো। ওখানে বাংলা পড়া নেই। আর ফিরে এসে কলেজেও কোনো কম্পালসারি বাংলা নেই। কিন্তু ফিরে এসে কলেজে ঢুকে তারপর ৮ বছর বিদেশে থেকে গরীব মানুষদের নিয়ে একটু আদর্শ নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসা।

তখন থেকে বলতে পারেন, আমার লাইফ লার্নিং, বাংলা নিয়ে, বাংলা ভাষা নিয়ে শুরু হলো আমার যখন ২৪ বছর বয়স। আমার সহকর্মী সব বাঙালি। সব কাজের ভাষা বাংলা। আমরা মিছিল মিটিং করলে শ্লোগানগুলো বাংলায়। বক্তব্য বাংলায়। লিফলেট বাংলায়। তো, বাংলা জগতে বাস করতে শুরু করলাম পুরোপুরি। ওদিকে আমার বিয়ে বাঙালি মহিলার সঙ্গে হলো। সেভাবেই বাংলা, বাঙালি পরিবারের ভেতরে প্রবেশ। কিন্তু যেহেতু আামি অবাঙালি থিওরিটিক্যালি, তো সব সময় একটা আউটসাইডারের চোখ ও মন আমার মধ্যে একটিভ।

সেটা তো আরও পজিটিভ?

হ্যাঁ। শেখা। যে জিনিসটা একজন বাঙালি লক্ষ্য করবে না, অত গুরুত্ব দিবে না আমি সেটা করছি। পশ্চিমবঙ্গে থেকে জীবন কাটিয়ে বাংলাটা বুঝলাম। বাংলাটা বুঝতে শিখলাম। আর তারপর ভাবলাম অনুবাদ করতে পারবো। কিন্তু কয়েকদিন আগে আমার ছেলেকে বলছিলাম, এখন যদি ভাবি যে, সুবিমল মিশ্র অনুবাদ করবো। এখন ভাবলে মনে হয়, ফেনাইল দিয়ে আমার জিভ পরিস্কার করা উচিত। তুমি কী ভেবেছ চান্দু! কিন্ত আমি স্বীকার করি, আমার শেখা উচিৎ বা নিজে থেকে শেখার চেষ্টা করা- সেই বিবেক বা বুদ্ধি আমার আছে বলতে পারেন।

বাংলাদেশের বা পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতটাকে আপনি কীভাবে অনুবাদ করছেন, ধরা যাক, কালি বা দূর্গা পূজার কোনো একটা বিষয় যখন ভিন্নভাষীদের জন্য অনুবাদ করছেন, তখন এ ধরনের চ্যালেঞ্জ কীভাবে সমাধান করেন?

হ্যাঁ, এসব দিক তো আছেই, এরকম চ্যালেঞ্জ তো আছেই। আমি যখন অনুবাদ করি, তখন অনুমান করি যে, বাঙালি পাঠক, ইংরেজিতে পড়ছে। ফলে কালি, অকালবোধন, ইত্যাদি তো সে জানেই, এটা প্রথম অনুমান। দ্বিতীয় অনুমান হচ্ছে সে বাঙালি না, কিন্তু ইন্ডিয়ান। তো, তারও কিছু ধ্যানধারণা আছে কালি, দুর্গা, বা এ জাতীয় বিষয় নিয়ে। তৃতীয়টা হচ্ছে বিদেশী বা ভারতীয় যারা এখানকার কিছু জানে না। তো, বিদেশীদের জন্য যখন কিছু অনুবাদ করি, তখন তাদের উপযোগী করে উপস্থাপন করতে হয়। যেমন, সুবিমল মিশ্রের যে অনুবাদ আমেরিকানদের জন্য করেছি, তাতে কিছু ফুটনোট বা বাংলা শব্দের পাশেই ব্র্যাকেটে বা কমা দিয়ে তার ইংরেজি মানে, এইসব করতে হয়েছে।

কিন্তু যে চ্যালেঞ্জটার আমি মুখোমুখি হই, তা খুব মাইক্রোস্ক্রাপিক। আলটিমেটলি একটা গল্প বা উপন্যাস কী? একটা শব্দের পর আরেকটা শব্দ, একটা বাক্যের পর আরেকটা বাক্য। তো ঐ শব্দ বা বাক্যের স্তরে নামিয়ে আনি সমগ্র লেখাটা। একটা শব্দ যার ইংরেজি অর্থ আছে। কিছু শব্দ আছে যার ইংরেজি হয়নি বা মানেটা হয়তো আশানূরূপ নয়। এক্ষেত্রে কাছাকাছি বা অন্যলোককে বোঝাতে পারি এ ধরনের শব্দ নিতে হয়। হয়তো ঠিক একই অর্থ বা মিনিংয়ের নয়। তো, সেই শব্দগুলোর ব্যাপারেও আমার নীতি বা দর্শন বলতে পারেন যে, সবাইকে শিখতে হবে। আমরা তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক, ঔপনিবেশিক নাগরিক। আমরা অনেক কিছু জানি, ইউরোপ বা আমেরিকা সম্বন্ধে। কিন্তু উল্টোটা হয় কী? আমেরিকার একটা ছেলে ইন্ডিয়া, চায়না বা বাংলাদেশ সম্বন্ধে কতটা জানে? উত্তরটা হচ্ছে জানে না। সেটাই তো একটা বৈষম্য। ওটা শুধু বৈষম্য না, ওটা রাজনীতি। কিন্তু পরিবর্তন ঘটছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে ওরাও শিখুক, ওরা জানুক। একটা বিখ্যাত বই অনুবাদ করবো ভেবেছি। তার নাম হচ্ছে ভারতে হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা। সেই বইয়ের লেখক হচ্ছেন ক্ষিতিমোহন সেন। ১৯৪৯ সালে লেখা। তিনি হচ্ছেন অমর্ত্য সেনের দাদু। দু’বছর আগে অমর্ত্য সেনের একটা আলোচনার পুরো বিষয় ছিল এ বই আর তার দাদু। তখন ভাবলাম এ বইটা অনুবাদ করতে হয়। তো, আমার এক বন্ধু বইটার একটা ফটোকপি দিয়েছিল। সেটা পড়ে আমার খুব ভাল লাগলো। তো, সেই বইয়ের টাইটেলের সাধনা শব্দটা আমি অনুবাদ করবো না। সাধনাই লিখবো। এইবার তুমি শেখো সাধনাটা কী। আমি তোমার দেশের সব শব্দ যদি জানতে পারি, তুমিও জানো। বিশ্বের শব্দকোষের মধ্যে সাধনা, এই ধরনের শব্দের অনুবাদ দরকার নাই।

এটা খুবই ভাল পয়েন্ট। রাজনৈতিকভাবেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ধরুন ইংরেজিতে যে শব্দ, ধরা যাক পুডিং। এটার কোনো বাংলা দরকার আছে? অনেক দেশের সংস্কৃতিতে আছে মেইন কোর্সের পর, ধরুন মিষ্টিটা। তো, নানান ধরনের মিষ্টি আছে। পুডিং সে রকমই কিছু। পুডিং হচ্ছে এক ধরনের মিষ্টি। সন্দেশ বা চমচমের কোনো অনুবাদ হতে পারে? চমচম চমচমই।

একটা উদাহরণ দিতে চাই। জীবনানন্দ দাশের। হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে- একটা অসম্ভব সুন্দর, সাধারণ কিন্তু পোয়েটিক লাইন বা রবীন্দ্রনাথ যখন গীতাঞ্জলির অনুবাদ করেন সোং অফারিং। তো, আমার কাছে গীতাঞ্জলি যে রকম অনুরণন ফেলে মনের মধ্যে, সোং অফারিং-এ তা করে না। কিম্বা বিম্বিসার ধূসর জগতে।

বনলতা সেন, মনে হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অনূদিত কবিতা। একজন আছেন ক্লিনটন বি শিলি। তো একবার কলকাতায় এক লেকচারে উনি নিজের অনুবাদ এবং অন্যদের অনুবাদ শোনালেন। উনি বনলতা সেন এর উনার অনুবাদ এবং অন্যদের অনুবাদ নিয়ে একটা ব্যাখ্যা করলেন। এতো কাজ করেছেন, নিজেও ভাল বাংলা জানেন। কীভাবে ইংরেজিতে কবিতার অনুবাদ হতে পারে, সেটাই ছিল উনার উদ্দেশ্য। সম্পূর্ণ এদিক থেকে ওদিক যাওয়া, দুটি ভাষাই বোঝে, তার পক্ষে অন্য ভাষায় নিজ ভাষার অভিজ্ঞতা হবে? সম্ভব না। খুব সাধারণ যে সব বণর্না যেমন, গাছে চারটা বাঁদর থাকতো বা গাছে ফল ছিল- এগুলো অনুবাদে হয়তো চ্যালেঞ্জ নেই। কিন্তু সিরিয়াস সাহিত্য তো সমাজেই প্রোত্থিত।

শহীদুল জহিরের মতো অনুবাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং লেখা বাছাই করলেন কেন?

শহীদুল জহির, টরোন্টো শহরে ইকবাল হাশমী বাংলা জার্নাল নামে একটি পত্রিকা বের করেন। তো উনার সঙ্গে আমার আরেক বন্ধুর মাধ্যমে যোাগাযোগ হয়েছিল। সুবিমল মিশ্রের অনুবাদ বাংলা জার্নালে বেরুলো। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখাও পাঠিয়েছিলাম তার কাছে। তখন তিনি একটা ইমেল করলেন, সেখানে তিনি বললেন, রামা তোমার যে অনুবাদের চোখ, তোমার উচিত বাংলাদেশের একজন লেখক শহীদুল জহিরের গল্পগুলো পড়া। তিনি ঢাকার একজন বন্ধুর মাধ্যমে গল্পগুলো আমার কাছে পাঠাতে বললেন। সেটা আমি পেলাম। আমি রেখে দিলাম পড়লাম না। পরে দেখবো। তার এক মাস পরে, করাচি থেকে পাকিস্তানের এক বন্ধু। তারা একটা পত্রিকা বের করে, দি সিটি। তিনি আমাকে বললেন যে, কনটেম্পরারি সাউথ এশিয়ান লিটারেচার নামে একটা সংখ্যা বের করবে। বলল, তুমি যদি কিছু অনুবাদ করো। আমি বললাম, তুমি যদি আমাকে পাঠাও কিছু তখন দেখবো। তো, খোঁজখবর নিয়ে কয়েকজন বাংলাদেশী লেখকের লেখা আমার কাছে পাঠালেন। যার মধ্যে ছিল শহীদুল জহির। ডলু নদীর হাওয়া সঙ্কলনটা আর সব লেখার সফ্ট কপি উনি পাঠালেন। তো, তখন আমার মনে হলো যে, হ্যাঁ, শহীদুল জহির হচ্ছেন সেই লেখক যার নাম ইকবাল হাশমী আমাকে বলেছিল। তো পড়তে শুরু করলাম।

আর পড়তে শুরু করেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রথম গল্প যেটা পড়লাম সেটা ছিল কোথাায় পাবো তারে। পড়েই আমি মুগ্ধ, বা লেখকের জালে আটকে গেলাম। আর এ ধরনের একটা পড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। লম্বা বাক্য। অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো শহীদুল জহির কোনো আবেদন নাও থাকতে পারে। তবে আমার ক্ষেত্রে আমি হিপটোনাইজড হয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে দুটো গল্প অনুবাদ করে ফেললাম। তো, ভাবলাম শহীদুল জহিরকে আরও সিরিয়াসলি নেয়ার এবং আস্তে আস্তে একটা প্রকল্প হয়ে গেল। বাই চান্স শহীদুল জহিরের সকল লেখা হাতে পাওয়া এবং সেগুলো পড়তে পারা।

কিন্তু শহীদুল জহির হচ্ছেন প্রথম বাঙালি লেখক, যার লেখা আমি পড়লাম পড়ার আনন্দের জন্য। পড়ার আনন্দ আমি বাংলা থেকে ইংরেজিতে করার সময় পেয়েছি। কিন্তু সেই পড়াটা অনুবাদের জন্য। আনন্দের জন্য নয়। তো, শুধু শহীদুল জহিরের লেখা স্বাধীনভাবে, পড়ার আনন্দ পাবো ভেবে পড়লাম। প্রায় দু’সপ্তাহ ডুবে ছিলাম তার লেখার মধ্যে। তো, আবার ভুলটা করলাম। সুবিমল মিশ্র করতে পারবো সেই আস্পর্ধার মতো শহীদুল জহির করতে পারবো সেই অনুমানটা একটা আস্পর্ধাই ছিল। বলতেই হবে, কারণ তারপর তার অনুবাদ করতেই থাকলাম। এখন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারি যে, সেটা আস্পর্ধা ছিল নিশ্চয়ই। অত সহজ ব্যাপার না। কিন্তু যেহেতু আমি মুগ্ধ, আর যেহেতু আমি করতে একদম ইচ্ছুক, করবোই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আর সেজন্য, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র জন্য ঢাকার একজন ছাত্রী, সাহরোজা, ওকে আমি যুক্ত করলাম এ কাজে। সেটা অসাধারণ একটা ব্যাপার হলো। দু’জন করাটা একজনের করার চেয়ে ভাল। আর, অনুবাদে কোন ইগোর স্থান নেই। দু’জন কাজ করলে আউটপুটটা উন্নত হয় সেটাই হলো। আর, বাংলাশের উপন্যাস, বাংলাদেশের কারো কারো করাই ভাল, ও নিজে উপন্যাসটা পড়েছে, আমি বাংলাদেশের ব-ও জানি না। আর, নিজেও অনুবাদটা করতে আগ্রহী। জামিল আহমদ এর নাটক দেখতে গিয়ে সে বইটা অনুবাদ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়ে। আর, আমি যখন লেখকের পরিবারের কাছে থেকে অনুমতিটা পেলোম, আর সে খবর সাহরোজা পেয়ে গেল। তারপর ও যুক্ত হয়ে গেল অনুবাদের কাছে। নিজেকে পুরোপুরি দিয়ে দিল অনুবাদের কাজে। তো, সাহরোজা পুরো দায়িত্বটা নিজে নিয়ে নিল নিজে থেকে, সারাক্ষণ নিজে থেকেই ভাবছে। আমাকে বলতে হচ্ছে না ওটাকে দেখ। ও নিজে থেকেই দেখেছে। যেন ওরই প্রকল্প এটাকে বলে ওনারশিপ। তো যৌথ অনুবাদ প্রচেষ্টা দারুণভাবে সফল হলো। আমি সে সেক্ষেত্রে খুব ভাগ্যবান।

আমি, আমরা চ্যালেঞ্জটাকে নিলাম। প্রতিটা শব্দ, বাক্যের খুঁটিনাটি দেখছি বারবার। তো, ওর উপস্থিতি খুব জরুরি ছিল। ও ওর বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে মন্দার্প, তার আসল মানে কী, ইত্যাদি। তো, লেখক, কিছু ডায়লগ গুলিয়ে ফেলেছেন পুরান ঢাকার সাথে অন্যান্য স্থানীয় উচ্চারণের সাথে। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় ডায়লগ তো খুব কম, সব থার্ড পারসন রিপোর্টেড স্পিচে আছে। আর, কয়েকটা জায়গায় ডায়লগ। যেখানে যেখানে ডায়লগ সেসব স্থানে রোমান হরফে ডায়লগুলোকে রিপ্রোডিউস করি। তো, পুরান ঢাকার ডায়লগুলোর ক্ষেত্রে উনি কিছু মিসটেক করেছিলেন। সাহরোজা গবেষণা করে মিসটেকগুলোতে সংশোধন করেন। আমরা কারেক্ট রোমানটা দিলাম। কারণ অথার কিছু ভুল করেছেন। ওর সহযোগতিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর, এই কোলাবরেন থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এরপর থেকে পরবর্তী সময়ে সকল অনুবাদ সহ-অনুবাদক নিয়েই করবো।

দীর্ঘদিন ধরে অনুবাদ করার পরে। মুক্তিবাহিনী অব বেঙ্গল গ্রুপ করেছেন। লেখালেখির উঠান, ভাঁটফুলসুত্র এসবের সাথেও পরিচিত হচ্ছেন। আপনার পরিকল্পনা কি?

আমি চাই যে, অনেক অনুবাদ হোক। এখনো জীবিত অনেক ধরনের লেখক আছে। অনেক ধরনের লেখা আছে। শহীদুল জহির এর নামটাই বা কতজন জানতো। উনার মৃত্যুর পরে জানা হয়েছে। এখনো বড় বড় লেখকদের যে খ্যাতি বা পরিচিতি, সেটা এখানো ঘটেনি তার ক্ষেত্রে। আর সেটা হয়তো ভাল। সবকিছুকে বাজারে বা মেইনস্ট্রিমে আনা যায় না। কিছু কিছু জিনিসের ভিন্ন থাকাটাই ভাল। বাংলাদেশের যে লিটারেরি জিনিয়াস, যে সাহিত্য প্রতিভা আছে তা পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমীদের জানানো দরকার। কারণ তারাও জানুক বাংলাদেশে কী ধরনের সাহিত্যপ্রতিভা আছে। সাহিত্যের ইতিহাসে মহান উপন্যাস আছে যেমন ওয়ার এন্ড পিস, ডক্টর জিভাগো, কিম্বা পঁচিশ বছর বয়সী একজন তার্কিশ উপন্যাসিক ইয়াসির কামাল তাঁর উপন্যাস নেমেদ মই হক পড়েছিলাম। আর পড়ার সময় মনে হলো, কী অসাধারণ কাজ। তার্কি ইতিহাসের একটা পর্যায়, ফিউডাল সমাজ কীভাবে একটা আধুনিক সমাজ, ক্যাপিটালিস্ট সমাজে পরিবর্তন হলো বা হচ্ছে, উনার গল্পটা সেই ক্যানভাসে প্লেস করা হয়েছে। ওটা শুধু একটা গল্প বা উপন্যাস নয়। একটা জাতির ইতিহাস বা জাতির গল্প পৃথিবীর অন্য লোকেদের সাথে ভাগ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের যে লিটারেরি জিনিয়াস তা পৃথিবীর মানুষের জানা উচিত। সে জন্যই অনুবাদকদের মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনী, কারণ তারাই তো বাংলাদেশকে মুক্তি দিল, তাদের স্যাক্রিফাইস ও সাহসের ফলে। তো, সেই স্পিরিট নিয়েই যারা কাজ করবে, তারাই তো একই স্পিরিট নিয়ে কাজ করবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে নানা ধরনের লেখক আছে, যেমন সুবিমল মিশ্র। আগে অনুবাদ হয়নি। আরও আছে অনুবাদ হয়নি। অনেক অনুবাদক দরকার। সাহরোজার সঙ্গে কাজ করার পর ঠিক করলাম অন্যদের সাথেও কাজ করবো। আর, এতে অন্যরাও কিছুটা অভিজ্ঞতা লাভ করবে। তারপর তারা নিজেরাই স্বাধীনভাবে অনুবাদ চালিয়ে যাবে। সেই উদ্দেশ্যেই মুক্তিবাহিনী অব ট্র্যান্সলেটর গড়ে তুললাম। অনুবাদ থেকে আমার অভিজ্ঞতা হলো যে, অনুবাদটাকে ক্যাজুয়ালি নিলে হবে না-ওটাকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। সকলেরই নিজস্ব কাজ আছে। আর কখনো কখনো একটু সময় দিলাম, একটা গল্প অনুবাদ করে ফেললাম, সেটা ঠিক আছে, সেটাও ভাল। কিন্তু তারচেয়েও বেশি সময় দিতে হবে, রেগুলারলি, মাসে, প্রতি সপ্তাহে বা প্রতিদিনেও হয়তো এক ঘন্টা সময় দিলে, যেমন ভোরবেলা উঠে কেউ যদি একঘন্টা অনুবাদ করে, সেটা এক বছর পর লম্বা উপন্যাস হবে। তো অনুবাদটাকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। যাতে সেই ধরনের একটা স্পিরিট বা ইচ্ছে জাগে সেটাই আমার উদ্দেশ্য।

আপনার অনুবাদ শুরু আর এখন যে অভিজ্ঞতা- এ দুটো বাস্তবতার ভেতরে আপনি কী ধরনের পার্থক্য উপলব্ধি করেন?

যে লোক ষোল বছর আগে ঠিক করল যে, সুবিমল মিশ্র অনুবাদ করবে আর এখন যে অভিজ্ঞতা- এ দুটো বাস্তবতার ভেতর অনেক ডেডেলপমেন্ট ঘটেছে। আগের চেয়ে অনেক গভীরতা চলে এসেছে আমার মধ্যে। আর বাংলা ভাষাকে আরও গভীরভাবে বুঝতে শিখেছি। ভাষা সম্বন্ধে ভাবার ব্যাপারটা শিখেছি। আর, কন্টিনিউয়্যাস লার্নিং এর অ্যাটিচ্যুড চলে এসেছে। আর, হ্যাঁ, যে কোনো একটা জিনিস শুরু আর শেষের মধ্যে তো পরির্বতন আছেই। যখনই কেউ কোনো সাধনায় ব্রত হয়, একটা পরির্বতন ঘটে তার নিজের ভেতরে। তো অনুবাদ একটা সাধনা।

সুবিমল মিশ্র যে ধরনের গদ্য সাহিত্যের জন্ম দিয়েছেন…। এটার পাশাপাশি ইংরেজি বাক্য গঠন, বাংলা বাক্যের যে গঠনপ্রণালী তা স্বাভাবিকভাবে আলাদা…

যে ভাষাতে অনুবাদ করছি, তার তো কিছু রুলস আছে। ঠিক যেভাবে বাংলা ভাষাতে লেখা হয়, আমার সেভাবে শেখা হয়নি, শুধু বুঝতে পারি। বাংলা গ্রামার আমি জানি না। তো, সেভাবে ইংরেজির গ্রামারও আমি জানি না। যা গ্রামার শিখেছি স্কুলে সব ভুলে গেছি। তো, গ্রামার সম্বন্ধে যদি কোনো প্রশ্ন করা হয়, আমি সেভাবে উত্তর দিতে পারবো না। কিন্তু ইংরেজি ভাষাটা মাথার ভেতর, কানের ভেতর, চোখের ভেতর, মুখের ভেতর চলে এসেছে। কোনটা বলা যায়, কোনটা বলা যায় না, কোনটা সঠিক, কোনটা সঠিক না তা সেন্স করতে পারি। তো, ইংরেজি ভাষা সম্বন্ধে আমার একটা সেন্স আছে কোনটা গুড ইংলিশ, কোনটা বেটার তা সেন্স করতে পারি। সেটাকেই ব্যবহার করি। আর, এই শব্দের জায়গায় ঔ শব্দ বা যদি ব্যবহার করি যেটাতে একটা পোয়েটিক কোয়ালিটি আছে বা মজার কোনো ব্যাপার আছে তখন সেই সেন্স ব্যবহার করি। একটা এস্থেটিক সেন্স কাজ করে আর সঠিক ভাষাটা কী সেই সেন্স কাজ করে।

সুবিমল মিশ্র এমন ধরনের লেখক যিনি ভাষাকে নিয়ে কী করা যায় সেটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন, ভাষাটাকে নিয়ে কত জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় সেটা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। তো, তাকে নিয়ে কাজ করে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে যে, ইংরেজি ভাষার যে লিমিট্স আছে, সেটাকে কত স্ট্রেচড করা যায়, কতটা প্রসার ঘটানো যায় সেটা নিয়েও আমাকে ভাবতে হয়েছে। একটা বাক্য কীভাবে লেখা যায়, অলিখিতভাবে পাঠকের মনে, বাক্যের গঠন কীভাবে হওয়া উচিত- সেটাকে কত দূরে নিয়ে যাওয়া যায়। তো শহীদুল জহির সেটাকে নানাভাবে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। একটা লম্বা বাক্য, সেখানে হয়তো পনেরটা ব্যাপার আছে, একটা জিনিস দিয়ে শুরু হয়ে নানান কথা বলার পর সেখানে আবার ফিরছেন। তো, ইংরেজিতেও একইভাবে বাক্যের রূপটাকে অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করি। তো ইংরেজি বাক্যের যে নিয়ম তাকে কতটা প্রসারিত করা যায় সেই চেষ্টাটা থাকে। আর ওটা করতে একটা আনন্দ পাই। ওটা একটা মজার ব্যাপার আছে। শহীদুল জহির ইচ্ছে করেই লম্বা বাক্য লিখেছেন। ওটা করেই উনি আনন্দ পেয়েছেন। আমিও সেটা পড়ে আনন্দ পাই।

আমাদের একজন শিক্ষক, কবি অসীম কুমার দাস, তাঁর সাথে এক আলাপচারিতায় বলছিলেন যে, বাংলাতে কিছু শব্দ আছে ইংরেজি ভাষাতে অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। যেমন আনন্দ। এ ধরনের শব্দ ইংরেজিতে অনুবাদের ক্ষেত্রে কী বিবেচনা করেন?

উনি ঠিকই বলেছেন। আনন্দ একটা স্পিরিচুয়ার শব্দ । শব্দটা সেক্যুলার নয়। ইংরেজি জয় (Joy) শব্দটা ঠিক আনন্দ নয়। তো, যে শব্দটা আনন্দের কাছাকাছি আসতে পারে সেটা হচ্ছে ব্লিস (Bliss)। সেটাও ঠিক আনন্দ নয়। একজন সাধক, একজন সুফি বা একজন ভক্ত যখন উনার সাধনার গভীরে আছেন, আর সেখানে থেকে উনার মুখে একটা হাসি চলে আসে, সেটা হচ্ছে আনন্দ। যিনি কিছু একটা বুঝে উঠেছেন, সব প্রশ্নের উত্তর তার মনে স্পষ্ট হয়ে গেছে, কোনো কিছু আর জানার বাকি নেই, যেন উনি উপরওয়ালার কোলে বসে আছেন – সেটাই তার আনন্দ।

আপনি বাঙালি না আবার ইংলিশও না। এটা আপনাকে একটা বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে কি-না?

আপনি বলার আগে কখনো ভাবিনি যে, আমি বাঙালি না। আবার ইংলিশ না। তো যে দু’টো ভাষা নিয়ে আছি আমি দু’টোই আমি পেয়েছি। আর, আমার নিজের যে ভাষা যেটা নিয়ে জন্মেছি, বলতে পারেন সেটা আমি ত্যাগ করেছি। তো, সবাই সবকিছু পারে না। কিছু করতে গেলে কিছু ত্যাগ করতে হয়। কয়েক বছর আগে আমার যে স্থান, দক্ষিণ ভারতে, তামিলনাড়– সেখানে গিয়েছিলাম। আর ভাবতে ভাবতে আমার মনে হলো যে, এ জায়গাতে আমি থাকিও যদি, ভাষাটা আমার কাছে সহজ হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু যেভাবে আমার পশ্চিম বাংলার মানুষ, জীবন, ভাষা, ইতিহাস জানি, সেটা আমার এ জীবনে তামিল মানুষদের নিয়ে অর্জন করবো না এ জীবনে।

এখানে দাদা, আপনার সাথে যুক্ত করি। বাঙালি জাতির একজন অন্যতম চিন্তক বঙ্কিমচন্দ্র, উনি এক জায়গায় বলছেন, বাঙালি একটা বহু জাতির সমষ্টি। তো সেই অর্থে আপনিসহ অনেকেই আছেন দীর্ঘকাল ধরে বাংলাতে বসবাস করছেন, অনেক শত শত বছর ধরে। আবার, একটা জাতি তো অবিমিশ্রভাবে একই রক্তধারায় প্রবাহিত কোনো জনগোষ্ঠী না…. অনেক জনগোষ্ঠী মিলেই একটা জাতি হয়। তো, সেক্ষেত্রে আপনার কী মনে হয়, বাঙালি কী একটা বহুজাতিক জাতি হয়ে উঠছে?

আপনি যদি ভৌগলিকভাবে অবিভক্ত বাংলাকে দেখেন, একদিকে পুরুলিয়া থেকে কুমিল্লা, বরিশাল, চট্টগ্রাম। একটা প্রায় মহাদেশ। কোথাও পাহাড়, কোথাও জলাভূমি, কোথাও লাল মাটি- একটা বিরাট বৈচিত্র্য। ভারতে যেভাবে জিওগ্রাফিক্যাল ডাইভার্সিটি আছে, অবিভক্ত বাংলাদেশেও তাই আছে। তবু সেই ভাইভার্সিটির মধ্যে কিছু কমনালিটি আছে, গান আছে, সাহিত্য আছে। ইদানীং বাংলাদেশে যাতায়াতের পর থেকেই একটা আগ্রহ জন্মেছে অবিভক্ত বাংলাকে বোঝা। সাতচল্লিশের পর থেকে যে পরির্বর্তনগুলো হয়েছে, যোগাযোগ কমে গিয়েছে বা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তো, এই দুই দেশ তার নিজের পথেই এগিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রায় চেনাই যায় না। একেবারে আলাদা, এত ভিন্ন! তো, বাংলাদেশে যাওয়া আমার জন্য খুবই একটা এক্সসাইটিং ব্যাপার ছিল। সব সময় লক্ষ্য করেছি ভিন্নতা বা সমানতা। চিন্তা করেছি এক সময় কীরকম ছিল বা ভব্যিষ্যতে কী রকম হতে পারে। বর্ডার তো সাময়িক।

একটি আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত সাহিত্যকে যখন ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, তখন কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন।

অনুবাদক হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ডায়লেক্ট। তো, ডায়লেক্ট বলতে পছন্দ করি না। বুলি বলতে পারি, সবই ভাষা। ওগুলো সবই জীবিত। লাখো মানুষ, কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন তা ব্যবহার করছে। সে ভাষা আছে জগতে, কাল্পনিক নয়। তো যখন ইংরেজিতে আনবো, তখন কে সেই ইংরেজ? ইউকে আছে, অস্ট্রেলিয়া আছে, ইউএস আছে। আবার, বাংলাতে যেমন নানান রকম ডায়ালেক্ট আছে, ইউকেতেও নানা রকম আঞ্চলিকতা আছে। কীভাবে চাঁটগাঁইয়া বা পুরান ঢাকার ভাষা, ইংরেজিতে অনুবাদ করবো- তার কোনো সমাধান আমি পাইনি স্টান্ডার্ড ইংরেজি এবং ডায়লেক্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তো উপায় বার করলাম অনুবাদের ক্ষেত্রে। যেখানে ডায়লেক্ট থাকে, সেখানে ইংরেজির পাশাপাশি রোমান হরফে ডায়লেক্টটা রাখা। তাহলে কিছুটা সেই ভাষার রসটা চলে আসবে অনুবাদে।

আমি নিজে থেকে একটা কারেক্ট সিনথেটিক ইংরেজি ক্রিয়েট করতে পারি অনুবাদের ক্ষেত্রে, সেটা স্টান্ডার্ড ইংলিশ থেকে একটু ভিন্ন। কিন্তু সেটা কৃত্রিম. জীবিত নয়, চাঁটগাঁইয়া বা পুরান ঢাকার মতো মুখের ভাষায় ব্যবহৃত নয়। আর আমার অনুবাদও আমার গঠন করা এক একটা সেমি ইংরেজি ভাষা, সেটা আমার তৈরি করা, ওটার কোনো বাস্তবতা নেই, তার কোনো অস্তিত্বই নেই। অনুবাদকের জন্য ডায়লেক্ট একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একটা সমাধান হতে পারে ডায়ালেক্ট থেকে ডায়লেক্টে অনুবাদ করা। বাংলাতে যেমন ডায়লেক্ট আছে, ইংল্যান্ডেও তেমন ডায়লেক্ট, ইত্যাদি আছে। অনুবাদের পাশে রোমান হরফে মূল ভাষার বুলিটা রাখা। বা ইংলিশ স্টিকিং ওয়ার্ল্ড, ক্রিয়ল নামে যে ভাষা। আফ্রিকা, ফ্রেঞ্চ ভাষার মিশ্রণে যে ভাষাটা তৈরি হয়েছে।

কারিগরি অগ্রগতির বর্তমান পর্যায়ে অনুবাদের ভবিষ্যত কী?

অনেক দূর অবধি অনুবাদকের দরকার আছে। গুগল ট্যান্সলেশন এতো বাজে অনুবাদ করে, আমি ওটা কখনো ব্যবহার করি না। ওটা থেকে থেকে দূরে থাকি। সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রে, কবিতা বা গল্প, অনুবাদক ছাড়া হবেই না। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে হতে পারে যদি ডিপব্লু’র সাথে গ্যারি কাসপারভের দাবা খেলায় পরাজিত করা সম্ভব হয়। তো, অনুবাদে নিশ্চয় একদিন পারবে।
আমরা কীভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারি?

প্যান্ডেমিকের সময়ে গুগল মিট, জুম, ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে। এখন সহজেই নিজেদের ভেতর আদানপ্রদান বাড়ানো যায়। এপার বা ওপার থেকে কোনো একটা উদ্যোগ নিলে সেখানে কাউকে আমন্ত্রণ করা যায়। এখন এগুলো সহজ হয়ে এসেছে।

দারুণ একটা সময় কাটল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Showing 1 of 1
Share.

Comments are closed.