সোরেন কিয়ের্কেগার্ড এর ১০টি প্যারাবল
ভাষান্তর: রফিক জিবরান
অস্তিত্ববাদী দার্শনিকধারার স্রষ্টা গণ্য করা তাঁকে। জীবনাচারনকে তিনি দার্শনিক উপলব্দির সাথে মিলিয়ে দেখেছেন. যদিও তাঁর চিন্তার মূল গতিপথ প্রধানত বাইবেল এবং যিশু কেন্দ্রীক, আবার গ্রীক সভ্যতার অন্দরে শুধু ঢুঁ মারেননি, সেখানেই যেন বসবাস করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ জীবিতকালে তেমন পঠিত হয়নি। মৃত্যুর প্রায় শত বছর পরে তার নবজন্ম ঘঠে প্রথমে জার্মানিতে, পরে সমগ্র ইউরোপে। দার্শনিক জ্ঞিজ্ঞাসা এবং চিন্তার কুহেলিকার ভেতরে সাধারণের প্রবেশ সহজ করার লক্ষ্যে তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার গভীর থেকে তুলে আনতেন এমন সব গল্প, যার ভেতরে সভ্যতার অভিজ্ঞতাসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে প্রজন্ম পরম্পরায়।
টমাস সি. ওডেন সম্পাদিত ’প্যারাবলস্ অব কিয়ের্কেগার্ড’, থেকে ১০টি প্যারাবল বাংলায় ভাষান্তর করেছি, আশায় আছি পুরো বইটি হয়তো শেষ করা যাবে।
১.
পোড়াদহের সুখীরা
কী হয়েছে তাদের ভাগ্যে; বর্তমানকে যারা সতর্ক করেছিল?
একটা নাট্যমঞ্চের ঠিক পেছনেই আগুন ধরেছিল। একজন কৌতুক-অভিনেতা সেই আগুন ধরার খবরটি দর্শকদের জানাতে আসে। খবরটাকে কৌতুক ভেবে দর্শকরা হাততালি দেয়। কিন্তু কৌতুক-অভিনেতা আগুন লাগার খবরটা বারবার জানাতে থাকলে দর্শকরা আরও জোরে তালি দিতে থাকে। এ কারণে আমি মনে করি, যারা বিশ্বাস করে যে ঘটনাটা একটা কৌতুকই ছিল, তাদের হাততালির কাছে হয়তো দুনিয়ার তাবৎ বুদ্ধিবিবেচনার অবসান হবে।
২.
কবি কে?
কবি হচ্ছে এমন একজন অসুখী মানুষ, হৃদয় যার গভীর বেদনায় দগ্ধ। কিন্তু তার ঠোঁটটা এমন ছাঁচে গড়া যে, তার কান্না ও হাহাকার মানুষের কাছে মধুর ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। তিনি সেই হতভাগা মানুষদের মতো যারা পরাক্রমশালী শাসক ফালারিসের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মৃত্যুকুঠুরিতে বন্দী থাকে, আগুনের শিখায় ধীরে ধীরে দগ্ধ হয়, তবু তাদের কাতর কান্না শাসকের কানে পৌঁছে না। কেননা এতে সম্রাটের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন তার কানে শব্দগুলো পৌঁছে তখন তা মধুর সঙ্গীত মনে হয়। আর লোকেরা কবির সামনে ভীড় করে বলে, “আমাদের জন্য আবার গান করো শিগগির”। বা হয়তো তারা বলতে চায়, ” নতুন বেদনায় তোমার হৃদয় পুড়ে যাক, কিন্তু তোমার ঠোঁট গেয়ে উঠুক মধুরধ্বনি, আগে যেমন গাইতে তোমার অনিন্দ্য সুন্দর কন্ঠে। কান্না আমাদের ব্যথিত করে, কিন্তু সঙ্গীত দেয় অপার আনন্দ।” সমালোচকেরা এমন সময় এগিয়ে এসে বলে, ‘‘দারুণ সুন্দর হয়েছে, নন্দনতত্ত্বের বিধান মেনে এমনই হওয়া উচিত।” এটা বোঝা গেল যে, সমালোচক কেবল কবি’র বহিরঙ্গ দেখেছেন, হৃদয়ের তপ্ত আগুনের খোঁজ পাননি বা তাঁর ঠোঁটে উচ্চারিত সঙ্গীতের মাধুর্য বুঝেননি। আমি এ কারণে বলতে চাই যে, কবি হয়ে মানুষের ভুল বুঝাবুঝির শিকার না হয়ে একজন শূকরপালক হতে চাই যার কথা শূকরেরা অন্তত ভাল বুঝবে।
৩.
একজন ব্যস্ত দার্শনিক
সমাজের সবাই যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়, দার্শনিকের কী কিছু করার থাকে?
রাজা ফিলিপ কোরিন্থ নগরী অবরুদ্ধ করার হুমকি পাবার পর এর সকল বাসিন্দা নগরের নিরাপত্তা বিধানে লেগে যায়—কেউ অস্ত্র শান দিতে শরু করে, কেউ পাথর স্ংগ্রহে, কেউবা নগরীর নিরাপত্তা দেয়াল মেরামতে। দার্শনিক ডায়োজিনিস এসব কাজকর্ম দেখে তাড়াতাড়ি নিজের কাপড়ের পুটলি ভাঁজ করতে শুরু করে এবং শহরের রাস্তায় সেটা গড়াতে শুরু করে। এটা কেন করছেন জিজ্ঞেস করা হলে বলেন— তিনি কাপড়ের পুঁটলিটা ঘোরান এজন্য যে নগরীর পরিশ্রমী নাগরিকদের মধ্যে যেন একমাত্র অলস বলে গণ্য না হোন।
৪.
অগ্নিশলাকাতুল্য পন্ডিতেরা
সাংবাদিকতার মতামত-পন্ডিতদের আমরা কীসের সাথে তুলনা করব যাঁরা জগতের সমস্ত বিষয়ে তাৎক্ষণিক দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করতে পারে?
…তাদের তুলনা করা চলে একসাথে বিক্রি হওয়া অগ্নিশলাকার সাথে। এ লেখকেরা হলেন সেই গোত্রের যাদের মগজ বন্ধক থাকে এ রকম দাহ্য পদার্থের ভেতর (একটি প্রকল্পের ধরনে যেমন)। কেউ একজন সেখানে পা দিয়ে আঘাত করে, আর সংবাদপত্রের পাতায় পয়দা হয় তিনচার কলামের লেখা। আর এইসব অনুমান-নির্ভর লেখকদের সাথে অগ্নিশলাকার আশ্চর্য মিল— উভয়েই ক্ষণিকের তরে জ্বলার পর মুহূর্তে মিলিয়ে যায় ধোঁয়ায়।
৫.
একজন ব্যস্ত লেখক যে যথেষ্ট দ্রুত লিখতে পারে না
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী লোকদের মোকাবেলা করার উপায় কি?
কয়েক বছর আগে একজন লোক আমাকে তার বিশ্বাস রেখে সম্মানিত করেছিল। সে আমাকে ডেকে বলে যে, তার মাথায় নানান রকম চিন্তা ভর করেছে, কিন্তু তিনি কিছুই লিখতে পারছেন না। কেননা দ্রুত লিখতে পারেন না। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন যেন অনুগ্রহ করে আমি তার সচিব হই এবং তার নির্দেশনা মোতাবেক লিখে দেই। আমি সাথে সাথে একটা অন্য কিছুর আঁচ পেলাম তবে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম যে, আমি পাগলা ঘোড়ার মতো দ্রুত লিখতে পারি। আমার সামান্যই লেখার অভিজ্ঞতা, তবু আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম যে, আমি যা লিখবো তা পড়ে শোনাব। তার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না, একটা বড় টেবিল জোগাড় করেছিলাম, নম্বর দেয়া অনেকগুলো সাদা কাগজের পাতা— এজন্য যে, পৃষ্ঠা উল্টানোর জন্যও যেন সময় নষ্ট না হয়, অনেকগুলো কলম এবং কলমদানি, কলমটি ডুবিয়ে নিলাম কালির দোয়াতে আর লোকটি বলা শুরু করল— ‘‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনি জানেন, প্রিয় স্যার, আসলে আমি যে কথাটি বলতে চাই তা হলো….’’ কথা বলার মাঝখানে আমি তার বলা এই কথাগুলো পড়ে শোনালাম, আর তারপর থেকে তিনি আর কখনোই আমাকে তার সচিব হওয়ার জন্যে বলেননি।
৬.
ফরাসি রাষ্টনায়ক
দায়িত্বহীন ক্ষমতা কী থাকতে পারে?
আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ঘটনাটি। একজন ফরাসি রাষ্ট্রনায়ককে দ্বিতীয়বারের মতো একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া দেয়া হলে তিনি ঘোষণা করেন যে, ক্ষমতা গ্রহণ করবেন যদি রাষ্ট্রের সচিবকে এ জন্য জবাবদিহি করার ব্যবস্থা করা হয়। এ কথা সকলেই জানে যে, ফরাসিদের মন্ত্রীরাই দায়িত্ব গ্রহণ করেন, রাজা নন। কিন্তু মন্ত্রীরা আবার দায়িত্বটা সচিবদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। সচিবরা আবার সে কাজের দায়িত্ব নিচের দিকের কর্মচারী বা পাহারাদারদের ওপর অর্পণ করে। ফরাসি রাষ্ট্রের এরূপ দায়িত্ব হস্তান্তরের কান্ডকীর্তি দেখে মনে হয়— দায়িত্ব গ্রহণের এ চিত্রটা নাট্যকার এ্যারিস্টফেনিসের কমেডি নাটকের উপযুক্ত বিষয় হতে পারে!
৭.
বজ্জাত কুকুর
পাবলিক আসলে কী বস্তু?
যদি’পাবলিক’ হিসেবে যদি বেছে নিই এমন একজন মানুষকে, তবে হয়তো আমি ভাববো রোমানদের একজন সম্রাটকে, যে খেয়েদেয়ে মোটাতাজা হয়েছে, কিন্তু ভুগছে অবসাদ রোগে, যে কেবল ইন্দ্রিয়জ ভোগেই সুখ খোঁজে, যেহেতু স্বর্গীয় বুদ্ধিজাত সুখ এ নরাধমে তেমন সুলভ নয়। তো, সে এ অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে ভাবা শুরু করল। যদিও সে কুঁড়েদের চেয়েও খারাপ, কিন্তু সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার নেতিবাচক বাসনা আছে। চিরায়ত লেখকদের যারা পড়েছেন জানেন যে, সময় কাটানোর জন্য সম্রা্ট সিজার কত কিছুই না করতেন। যেমন, যদি অন্যদের চেয়ে ভাল কেউ থাকত, হয়তো মহত্তম কেউ, তার পেছনে কুকুর লেলিয়ে দেয়া হতো, তখন শুরু হয়ে যেতো কৌতুক। কুকুরটা তাকে তাড়া করে, কামড়ে কাপড় ছিঁড়ে দেয়, সমস্ত রকম এমন অসুস্থ কান্ডকীর্তি চলতেই থাকে যতক্ষন না ’পাবলিক’ ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দেয়। এটাই একটা দৃষ্টান্ত পাবলিককে বুঝবার। ভাল এবং শক্তিমত্তরা ভুলভাবে চালিত হয়। কুকুর কুকুরই থাকে, যদিও পাবলিক তাদের তুচ্ছ জ্ঞানই করে। কিন্তু পক্ষসমূহকে একই মধ্যবিন্দুতে হাজির করে একটি তৃতীয় পক্ষ, একটা অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষ। পাবলিকেরও কোন লাজশরম নাই। এই তো কুকুরটির অঙ্গভঙ্গকে তালি দিচ্ছে, কিন্তু তারা কুকুরটিকে কারো দিকে লেলিয়েও দেয় না, আবার তা বন্ধ করতেও বলে না।
যদি তাদের বিষয়ে বলা হয়, তারা বলবে, আরে- কুকুরটা আমার না। এটা বেওয়ারিশ। যদি কুকুরটিকে মেরে ফেলা হয় তারা বলবে, বদ কুকুরটাকে মেরে ভালই হয়েছে, সকলেই বলবে ওটাকে মেরে ফেলো, এমনকি যারা ওকে লেলিয়ে দিতো তারাও।
৮.
বেশ্যাবৃত্তির অনুমোদন
কাকে বলে কৌতুক?
যখন একজন নারী নিজেকে সর্বজনের বেশ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে, তখন সেটা বেশ হাশ্যকর।কেননা, এর মাধ্যমে সম্মানজনক কিছু অর্জন করা কষ্টকর (যেমন যখন একজন পুরুষকে শিকারের জন্য নেতৃত্ব দেয়ার অনুমতি দেয়া না হয় তবে তা হাস্যকর নয়) আবার, অনুমতি চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া- যা নিন্দিত। এটা একটা দ্বন্দ। এটা নিশ্চিত যে, যদি তিনি অনুমতি প্রাপ্ত হোন, তবুও তা হাশ্যকর। এখানে দ্বন্দটা আলাদা রকমের। তা হলো, আইনী কর্তৃপক্ষ তার অসম্পূর্ণতা প্রকাশ করে যখন এটি তার ক্ষমতা দেখাতে চায় অনুমতি প্রদান করে। আবার, এটিকে বৈধতা দিতে সক্ষম না হয়ে এটিকে অনুমতি প্রদানযোগ্য করে।
৯.
ঈশ্বরের একঘেয়েমি
একঘেয়েমি কী মানুষের বারমেসে সমস্যা?
ঈশ্বরেরা ভুগছিলেন একঘেয়েমিতে, তাই তারা সৃষ্টি করে মানুষ। আদম ছিলেন একা তাই তিনিও ছিলেন একঘেয়েমিতে আক্রান্ত। সৃষ্টি করা হলো ইভকে। [ এ সময় থেকেই দুনিয়ায় একঘেয়েমি বা অবসাদ রোগের প্রবেশ্য এবং যে অনুপাতে মানুষ বাড়ে সেই একই অনুপাতে বাড়ে একঘেয়েমিও ।
আদম একাই অবসাদগ্রস্ত ছিলেন, তারপর ইভ ও হাওয়া একসাথে অবসাদে আক্রান্ত হলেন। তারপর আদম-হাওয়ার সাথে কেইন ও আবেল মিলে পুরো পরিবার । জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে, আর ক্রমে সমগ্র দুনিয়ার সকল মানুষ অবসাদে আক্রান্ত হয়। একঘেয়েমির সমস্যাকে পাশ কাটানোর জন্য তারা একটি টাওয়ার বানানোর ধারণায় একমত হয়। যেটি এমন উচ্চতা সম্পন্ন হবে, যেটা দিয়ে বেহেস্তে পৌঁছানো যায়। টাওয়ারটির উচ্চতার এমন চিন্তাও খুব বোরিং ছিল এবং এটা থেকে ধারণা করা যায় যে তাদের একঘেয়েমির মাত্রাটা কত ভয়ঙ্কর ছিল।
আমি কোন অনুসারী চাই না। তবে যদি আমার মৃত্যুশয্যায় কেউ উপস্থিত হয়, এবং আমি নিশ্চিত হই যে শেষ সময় এসে গেছে— তাহলে আমি পরোপকারী প্রলাপের চাপে পড়ে তার কানে আমার তত্ত্বটি ফিসফিস করে বলতে পারি, যদিও আমি নিশ্চিত জানবো না যে তার জন্য আমি কোনো উপকার করেছি কি-না।
১০.
ব্যয়বহুল বই ক্রয়
যদি বিবেককে বোকা বানানো হয়, পরিশেষে কী সে প্রতিশোধ নেয়?
এটি সেই মহিলার মতো যিনি রোমান সম্রাট তারকুইনের কাছে বইয়ের একটি সংকলন বিক্রির প্রস্তাব করেন এবং কিন্তু যখন তিনি বইটির পুরো মূল্য দিতে অস্বীকার করেন তখন সেগুলোর এক তৃতীয়াংশ পুড়িয়ে ফেলেন কিন্তু দাবী করেন আগের দাবীকৃত মূল্য। এবং আবার যখন সম্রাট তারকুইন সেই পরিমাণ মূল্য দেবেন না বলেন তখন মহিলাটি বইগুলোর আরও এক তৃতীয়াংশ পুড়িয়ে ফেলেন এবং একই পরিমাণ মূল্য দাবী করেন। এটা শেষ হয় অবশেষে যখন সম্রাট শেষ তৃতীয় ভাগ বইয়ের জন্য পুরো অর্থই পরিশোধ করেন।