স্পেনে ঘুরতে গিয়ে চৌকস রমণীয় চটপটে এক রমণীর সাথে সাক্ষাত হয় আমার। তার একটা প্রশ্নের উত্তর করতে পারিনি আমি। কিন্তু প্রশ্নটা আমাকে মাঝেমাঝে ভাবায়। স্পেনের মানুষ এমনিতেই সুন্দর। চুল আর চোখ এশিয়ানদের মতো কালো, গায়ের রঙ চিনেবাদামের মতো গা সওয়া ফর্শা। এটা আমি প্রথম খেয়াল করি কোন এক বিশ্বকাপ খেলা দেখতে গিয়ে। আসলে কয়েকটি খেলা দেখার পর প্রত্যেক টিমের আলাদা আলাদা চেহারার গড়ণ মাথায় গেঁথে যায়। যেমন চিলি-উরুগুয়ে, পূর্ব ইউরোপ, লাতিন বা মেক্সিকো সম্পূর্ণ আলাদা চোয়াল, নাক, মুখ ভিন্ন ভিন্ন একটা কাঠামো। তারপর একটা নাতিদীর্ঘ নৃতাত্ত্বিক আলোচনার সুচনা করলেন মিন্টু ভাই। নৃ-তত্ত্বের গুরুত্ব মায়া সভ্যতা নিয়ে আলোচনাটা যখন গুরুগম্ভীর পর্যায়ে, তখন বললেন, আহা শুরুতে কি যেন বলছিলাম!
মিন্টু ভাই এভাবে আলাপ শুরু করলেন। প্রবাসী মিন্টু ভাই ইদানীং বাংলাদেশে এলে কোন আত্মীয়র বাসায় ওঠেন না। হোক আত্মীয়, তাদের পাতা সংসারে ঝামেলা বাঁড়াতে চান না। এক, একদিন একেক বন্ধুকে ডাকেন, মন খুলে আড্ডা দেন। দীর্ঘ আড্ডা। এরকম হয়ত অনেকেই ওঠেন ঢাকায় স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টগুলোরও দিন দিন ভাড়ার চাহিদা বাঁড়ছে।
বললাম, বলছিলেন চটপটে এক রমণীর হঠাৎ সাক্ষাত নিয়ে-
না, হঠাৎ না। আমি একটা পর্যটন শহরের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপেছি। উঠে বসা মাত্র শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করল। ক্লান্ত অনুভব করলাম। আমার দম ফেলতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি চশমা খুললাম, টাইয়ের নব ডিলেডালা করলাম, চোখবুঁজে রইলাম, বেশ অস্থির হয়ে উঠলাম। ট্রেনে আমার সামনে যে নারী বসেছিল সেও বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল আমাকে নিয়ে। আমি স্বাভাবিক হতে বেশ খানিকটা সময় নিয়েছিলাম। একটু সুস্থ বোধ করার পর আমার মনে হতে লাগল পৃথিবীর সকল নারী কি আমার মায়ের মতো উদ্বিগ্ন হয়! নারীরা জাতগত ভাবেই কী সংবেদনশীল! আমি ঐ নারীকে বললাম চিন্তা করবেন না, ‘আমি এখন ঠিক আছি। তিনি মুচকি হাসলেন, যেন নির্বিঘ্ন হলেন। তার মানোসিক চঞ্চলতা সুস্থির হল। দৃষ্টি স্থির হল। আমি বললাম ‘আপনার এই সহমর্মিতা আমার মায়ের মুখ স্মরণ করে দিল। আমি তাঁর নাম জানতে চাইলাম, বলল- ‘এমেলিয়া এলেনা।
আমার জন্য একটু কফির ব্যাবস্থা করলেন। বললেন ‘তোমার মা বেঁচে আছে?
না, ‘বেঁচে নেই।
তোমরা কি ইন্ডিয়ান?
না, ‘আমি বাংলাদেশী।
হুম, চটপট গুগল সার্চইঞ্জিন দেখে বললেন… তোমাদেরকে ঘিরে আছে ইন্ডিয়া। ম্যাপে তাই দেখাচ্ছে।
আমি সায় দিলাম, বললাম- আমাদের বর্ডারের একটা অংশে বার্মা আছে। আমি আগ বাঁড়িয়ে আরো বললাম, ‘আমাদের ওখানে প্রচুর পোষাক তৈরি হয়। ইউরোপ বড় বাজার। ট্যাগ দেখলে বুঝবে।
তোমাদের ওখানে গার্মেন্টস হয়। আর কি কি হয়? এক সময় পাট হতো। কিছু কিছু ঔষধও রপ্তানি হয়।
আবার পুরনো কথায় ফিরলো, বললো-
আচ্ছা, তোমার মায়ের জীবন কেমন ছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। মায়ের জীবন তো আমার ক্যানভাসে বিশাল। কিন্তু আমি বলতে গিয়ে একটা চৌহদ্দির মধ্যে আটকে যাচ্ছি। তিনটা কক্ষ, পাকঘর। শাড়ির আঁচলে একগোছা চাবি। চাবি তো নয় এ তার গর্বের দাপুটে সংসার। আলমিরা খুলছে টাকা বের করছে, আবার আলমিরা আটকে দিচ্ছি। তেল-চাল-ডাল-নুন পাকঘরের উপর ছিল অসীম নিয়ন্ত্রণ। একটু একটু করে বলা শুরু করলাম কীভাবে তিনি তাঁর সংসর আগলে রাখতেন। আমার পিতার প্রত্যেকটি বিষয়; সকালের চা-নাস্তা, অফিসের খাবার হট পটে গুছিয়ে দেয়া, পছন্দের খাবার তৈরি করা, জামা ইস্ত্রি করা, কাপড় ধোলাই করা, যা যা মনে পড়লো মানে আমাদের সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ কেমন করে সামলাতেন তার একটা বর্ণনা তুলে আনতে থাকলাম। কথা বলে বলে দীর্ঘ একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করলাম। ইনিয়ে বিনিয়ে, লেন্থ বাড়াঁতে চাইলেই তো হবে না। আটকে গেলাম তাঁর পতি সেবায়। সেখানে প্রধানত এক নারী যিনি আমার মা, আমার বাবার প্রতি সর্ব্বোচ্চ যত্নের সম্পৃক্ততা উঠে আসলো।
ট্রেন যখন স্টেশনে পৌঁছুলো, ‘আমরা যার যার মতো নামার প্রস্তুতি নিলাম। এলেনা আমার কাছে তার শেষ প্রশ্ন রাখলো, বললো- ‘তোমাদের দেশের পুরুষরা কী কখনো স্বর্গ প্রার্থনা করে! আমি কোন উত্তর করলাম না। এলেনার মুখে লেগে ছিল স্মিত হাসি। সেই হাসির রহস্য ভেদ করা আমার কম্ম নয়!