দুটি অণুগল্প। মনিরা রহমান মিঠি

0

পুরাতন জানালা

নিত্য উচ্চগ্রামে নানা আঞ্চলিক ভাষায় ঝগড়া হওয়াটাই দস্তুর নিতুদের পাড়ার। আশেপাশের পুরোটাই বস্তি নতুন দালান ওঠানোর শ্রমিকদের। বড়ো রাস্তার ধার ঘেঁষে উঠছে দালান। নিচু বাসা গুলির রোদ চুরি করছে। আচার রোদে দেয়া দিদিমাদের কষ্টের শেষ নেই। নিতুদের ছাদে এখনো রোদ আসে। কিন্তু গায়ে গায়ে লাগা বস্তির ঘরগুলোর জন্য জানালা খুলে রাখার উপায় নেই। জানালা খোলা থাকলেই টিন এজ ছেলেদের ঘরের ভেতর উঁকি-ঝুঁকি, তা না হলে নেশাগ্রস্তদের নিত্য চুরিচামারি। নিতুর ঘরে পাশে এক চিলতে জায়গায় ওর মা কয়েকটা পেঁপে গাছ আর একটা সজনে গাছ লাগিয়েছে। সেসব গাছের ফল আশেপাশের লোকের ভোগেই যায়।
নিতুর ঘরে জানালার জায়গায় কয়েকটা ইট গাথা ছিলো ফাঁক ফাঁক করে। ওর বাবা কন্ট্রাক্টর এর সহকারী। কয়েকদিন আগে কোথায় পুরাতন বাড়ি ভাঙা হচ্ছিলো, সেখান থেকে একটা পুরাতন জানালা কিনে এনে নিতুর ঘরে লাগিয়েছে। শক্ত কাঠের জানালা। নিচে দুই পাল্লা, উপরে দুই পাল্লা। শিক দেয়া। নিতু এখন মন খারাপ হলে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। যদিও জানালা দিয়ে সজনে গাছের কাণ্ড আর পাশের বাসার রান্নাঘর ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। ও দেখেও না তেমন কিছুই। পাশের ঘর থেকে বাবার চেচামেচি আর মাকে মারার শব্দ আসলে, চোখে তখন জলের তোরে ভেসে যায় সব দেখাদেখি। বাবা যেদিন গুলোতে বাংলা মদ খেয়ে আসে, সেদিন মাকে মারে। মা টাও এমন বোকা শুধু শুধু বাবাকে কথা শুনায়। চুপ করে থাকলেই হয়!
নিতু তার মাকে বলে মাঝে মাঝে,’ তুমি যে গান শোনো সারাদিন, সেটাই মাথায় রেখো, বাবার সাথে লাগতে যাবার কি হলো?’ মা তা মানবে না,’ কেনো, তুই এখন বড়ো হয়েছিস, মাতাল লোকের মেয়ে বলে তোর কথা শুনতে হয় না?’
কিন্তু মায়ের উপর এই পীড়ন সহ্য হয়না নিতুর। ওর বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কলেজ থেকে ফিরতে ইচ্ছে করে না। আশেপাশের লোকজনও তার বাবার মতই মাতাল। কেউ কেউ ছোঁকছোঁক করে। গায়ের উপর এসে পড়তে চায়। ওর মনেহয় গায়ে নোংরা ভরে গেলো। জানালা লাগানোর আগে ইটের ফাঁক দিয়ে কেউ উঁকিও দিতো। তাই ও মাঝে মাঝে চৌকির নিচে যেয়ে ঘুমাতো।
তবে নিতু খেয়াল করেছে, জানালা লাগানোর পর হঠাৎ হঠাৎ ফুলের ঘন্ধ আসছে ওদিকটা দিয়ে। কখনও রাতে ঝিরি ঝিরি বাতাস। ছাদে উঠে ও দেখার চেষ্টা করেছে কোন বাড়িতে ফুলের গাছ।কিন্তু চোখে পড়েনি তেমন কিছু।
গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ ফুলের ঘ্রাণ বেড়েই চললো। কোনো কোনো রাতে মনেহয় বৃষ্টির শব্দ শোনা গেলো। সকালে উঠে চারিদিক শুকনো। স্বপ্ন। হবেও বা!
আষাঢ়ের ভোরে খুব বৃষ্টি। কলেজে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। মনোবিজ্ঞানের প্র‍্যাক্টিক্যাল। কলেজে যাওয়া জরুরী। ছাতা নিয়ে বের হবার খানিক পর বৃষ্টিই থেমে গেলো। কিন্তু গলিতে পানি জমে ছিলো হাঁটু অবধি। পাজামা তুলতে হলো। একজন জুলজুলে চোখে তাকিয়ে থাকলো। কি ভীষণ ঘেন্নায় নিতুর শরীর রি রি করে ওঠে। কলেজ থেকে ফেরার সময় রাস্তায় পানি ছিলো না, কিন্তু সেই লোকটা ছিলো বিশ্রী চাউনি নিয়ে। বাড়ি ফিরে দেখে মা বিছানায় পড়ে কাঁদছে। নাকে রক্ত।
ভালো লাগে না। নিতুও নিজের বিছানায় শুয়ে থাকে সন্ধ্যা অবধি।
সন্ধ্যার গুমোট গরমে খুলে দেয় জানালা। ঘর অন্ধকার। ফুলের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে ওঠে। বাইরে বেশ আলো। পূর্ণিমা বুঝি! নিতু জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাগান, পুকুর। এসব এলো কোথা থেকে! মাকে ডাকে। মা পাশের বাড়ির রান্নাঘর দেখে। নিতুকে বলে, ‘ এই জানালা যে বাড়িতে ছিলো সেখানে পুকুর বাগান ছিলো।’
মাঝরাতে চাঁদের আলো ঝরতে থাকে দুচার ফোঁটা বৃষ্টির সাথে। নিতু জানালার শিকে হাত রাখতেই শিক খুলে আসে। বাগান থেকে ফুলের ঘ্রাণ ওকে ডাকতে থাকে, ঝিঁঝি পোকা ডাকতে থাকে। জানালা গলে ও চলে যায় চন্দ্রস্নানে। ওর ঘর পড়ে থাকে নিঃসাড়।

শরম বোধি

জলে-কাদায় একদল ব্যাঙাচি’র মতোই বেড়ে ওঠে সুন্দর বনের দ্বীপশিশুরা। দলছুট ভগবতী বাইন। লেজ খসানোর সাঁতারে সে এগিয়ে। নুনজলের নদী তার ঠেকা জাল গলে বের হয়ে যায়- আটকে যায় বাগদার পোনা।
নদী তার মা, খাল তার সখি। তাদের সাথেই যত কথা। রাগ-গোস্বা-অনুরাগ।
বাপকে নিলো যখন বাঘে, মা তার পোয়াতি। তাড়ালো সকলে দূর দূর করে। দোষ ছিলো কি মায়ের, ভগবতী বুঝতে অকূল, জোয়ারের কালে খোলপেটুয়ার অথৈ পারাবারে। হররোজ মা বনবিবির থানে ঢিপ দিতো, দিতো সিঁদুর- বাপ বনে গেলে।
ভাঙলো মায়ের শাখা, ডুবলো জলে, সিঁদুরও মিশলো যেয়ে নোনা জলে। জল হলো আরো নোনা- মা বসেই রইলো যে ঘাটলায়! কেউ দেখলো না অপয়া মা আর তার মেয়েটারে। সিঁদুর লাল রক্তে মাটাও গেলো ডুবে। টু-শব্দটিও করলো না। বনবিবি টেনে নিলো মায়েরে তার কোলে। ভগবতী মায়ের তরে ধাগা বেঁধেছিলো যে বনবিবির থানে!
লেজ খসেছে ভগবতীর। সে দেখে বাঘে হরিণ খায়- নাগাল পেলে মানুষও খায়, হরিণ খায় গাছের পাতা। জোয়ারের কালে লোনা জলে গাছের শেকড় আঁকুপাঁকু করে, ভাটায় শ্বাস নেয়। কাদার বুদবুদে পা ডুবায় বক, ঠোঁটে তোলে কাঁকড়ার ছা।
বনবিবি বাঘের পিঠে চেপে ঘুরে ঘুরে দেখে গাছ-পাখি-সাপ-হরিণ-শুয়োর-কুমির-নদীর মাছ। সবারে সেই বাঁচায়। ভগবতি ভাবে, কাউরে বাঁচতি হলি, বাঁচাতি হলি, কাউরে মরতি হবি মারতে হবিই।
তার এখন শরম করে ভগবানের কাছে কিছু চাইতে।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.