শাহানা আকতার মহুয়া
গাছের সৌন্দর্য
বাতাসের স্নিগ্ধতা, ঘাসের
সুবাস, আমার সাথে
কথা বলে। দূরের ওই পর্বত শিখর,
আকাশের মেঘের গর্জন,
সমুদ্রের তরঙ্গায়িত ছন্দ,
আমার সাথে কথা বলে।
আমার সাথে কথা বলে
খসে পড়া নক্ষত্ররা
সজীবতামাখা উজ্জ্বল সকাল,
এবং ফুলের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু। (আমার
উড়ন্ত হৃদয়/ চিফ ড্যান জর্জ)
যেদিন থেকে ইভকে সঙ্গী করে আদম স্বর্গের বাগান ছেড়ে পৃথিবী নামক এই গ্রহে পা রেখেছিলেন, সেদিন থেকে প্রকৃতির সাথে মানুষের এক অচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হয়েছে। মানুষ তার প্রেম-ভালবাসা-আবেগ-শোক-দুঃখ-বেদনা প্রকাশের জন্য মিশে গেছে প্রকৃতির সাথে। প্রকৃতির সন্তান মানুষ শুধু জীবন যাপনে নয়, যুগে যুগে কথায়, কবিতায়, গল্পে, চিত্রে আশ্রয় খুঁজেছে প্রকৃতিতে।
প্রাচীনকাল থেকেই কবিতা প্রকৃতিলগ্ন। জীবনধারণ-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সজল মেঘের মতো প্রকৃতির উপস্থিতি সৃষ্টিশীল ও সংবেদনশীল কবিকেনিয়ে যায় শিকড়ের গভীরে। শিশিরের জলে চালতা ফুল ভিজে যে রহস্যময় সৌন্দর্য ও আনন্দের বিস্তার করে চলে যুগ-যুগান্তে তার কোনো শেষ নেই। ঠিক তেমনি আদিবাসী জীবনের আটপৌরে কাহন, তাদের জীবনানুভব এবং চেতনাস্রোতে, তাদের অসহায়ত্বে প্রকৃতিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আশ্রয়। আদিবাসীরা প্রকৃতির সাথে সবসময়ই মিলেমিশে একাকার থাকে। বাংলাদেশের আদিবাসীরাই শুধু নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অধিবাসীরাও প্রকৃতির সাথে, অরণ্যের সাথে যেন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে।
ভাষা, ভূগোল, ঐতিহ্য আলাদা হলেও অধিকাংশ দেশেরআদিবাসীদের ইতিহাস হচ্ছে শোষণ এবং বঞ্চনার ইতিহাস। নানাভাবে নানা যুগে তাদের ওপর চলেছে শোষণের স্টিমরোলার। পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের সত্তরটি দেশে প্রায় তিনশ সত্তর মিলিয়ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে। কানাডায় তাদের সংখ্যা প্রায় ১.৫ মিলিয়ন। আজ হয়তো কানাডার আদিবাসীরা নিজেদের খুঁজে নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু দীর্ঘদিন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মানবিকভাবে নিগৃহীত হতে হতে যেন ভুলে গেছে স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের গান। একটি জাতিকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে শাসক এবং শোষক প্রথমেই পরিকল্পিতভাবে আঘাত করেন ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর। কানাডার আদিবাসীরা আজো নিজ ভাষাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সময়ের সাথে লড়াই করছে। কবিতায় তাই সেই বেদনাতুর উদ্ভাস, যা কাঁপিয়ে দিয়ে যায়
আমাদেরকেও—
“আমার নিজের ভাষা তুমি কেড়ে নিয়েছো এখন
আমি তোমার মতো কথা বলি তোমার মতোই
চিন্তা করি তোমার মতো সৃষ্টি
করি; আমার শব্দের
সাথে জোর করে জুড়ে দেওয়া এক গাথা”।
(ভাষা হারিয়ে ফেলেছি/ রিটা জো)
না, প্রকৃতির সাথে মানবজীবনের নৈকট্য কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। মানবমনে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রকৃতি। আদিবাসী কবির ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিচিত্র রঙে রঞ্জিত প্রকৃতি শিল্পসুষমাময় হয়ে ধরা দেয় কবির তুলির আঁচড়ে। সৃষ্টির আদিলগ্নে গুহাবাসী মানুষেরা পাহাড়ের গুহায় এবং বৃক্ষের নিচে আশ্রয় নিতো বন্য পশুর আক্রমণ, ঝড়, বৃষ্টি ও নানা বিপদ থেকে রক্ষা
পাবার জন্য। এখনও মানুষের সে নির্ভরতা থেকে মুক্তি মেলেনি। প্রকৃতিই মানুষের প্রকৃত আশ্রয়দাতা, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চয়তা। আদিবাসী কবিতায় তাই দেখা যায় প্রকৃতির জন্য সহজাত ভালবাসা প্রকৃতিতেই কবির স্বস্তি, অন্তরাত্মার প্রশান্তি।
“যদি অরণ্যের পশুদের সাথে কথা বলো সেও কথা বলবে তোমার সাথে একে অন্যকে জানবে।
যদি তাদের সাথে কথা না বলো, বুঝতেও পারবে না তাদের।
আর যদি না বোঝো-ভয় পাবে, শংকা আঁকড়ে ধরবে। যে ভয়
একে অন্যকে ধ্বংস করে দেয়।” (পশুদের সাথে
কথা বলো/ চিফ ড্যান জর্জ)
এতো যন্ত্রণা, এতো লাঞ্ছনা তবু কোনো কোনো আদিবাসী কবির কণ্ঠ কেন যেন তীব্র হয় না। সয়ে সয়ে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে কবিও যেন সর্বংসহা প্রকৃতির অংশ। ক্লান্ত অবসন্ন জীবনে প্রকৃতির শান্ত ও শীতল পেলবতায় স্বস্তির পরশ খুঁজেছেন। কিন্তু মর্মমূল নাড়িয়ে ছটফট করে গাঢ় দীর্ঘশ্বাস—
“তার গান আমার জগতে আছে পাইন বৃক্ষের মতোই। সেই
হাওয়া-রমণীর মতো সে আজো গান গায় আর ক্ষুধার্ত
সন্তান নিয়ে আমায় অনুসরণ করে; আমি যেখানেই
যাই না কেন।” (হাওয়া- রমণী/ জেনেট
সি আর্মস্ট্রং)
কানাডার আদিবাসীরা জাতিগতভাবে মূলত ফার্স্ট নেশন, ইনুইট এবং মেটিস- এই তিনভাগে পরিচিত। তারা আবার বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং ট্রাইব-এ বিভক্ত। প্রসঙ্গত, কয়েকটি ব্যান্ড মিলে গড়ে ওঠে একটি ট্রাইব। কানাডায় সব মিলিয়ে প্রায় এগারশত ব্যান্ড আছে। সহজ সরল আদিবাসীরা নানাভাবে কূটকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে নিজদেশে পরবাসী । রিজার্ভে অন্তরীণ রাখা, জোর করে বাচ্চাদের ধরে এনে ধর্ম-শিক্ষার নামে বন্দি করে রাখা, নিজের ভাষা, আচার-আচরণ ভুলিয়ে দেবার ক্রূর কৌশল আদিবাসী কবিদের কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রেগভীর
রক্তক্ষরণ এনেছে—
“এই শীতে ঘনবন পরিপাটি কোনো বেডরুমের মতোই নীরব। তুষারের
চাদরের নিচে আমার অপহরণকারীরা ঘুমাচ্ছে প্রসন্নতা নিয়ে আর স্বপ্ন দেখছে হত্যার”
(বহির্গমন/ জোয়ান ক্রেট)
কিংবা,
“একসময় আমাদের মানুষেরা ভীষণ স্বাধীন ছিল
এখন তাদের সময় ব্যয় শেকলে বাঁধা সিয়ারস,
ম্যাকডোনাল্ডস, টয়’স-আর-আস
এমনকি ব্লকবাস্টার ভিডিওতে— যেখানে
অন্যের স্বপ্ন ভাড়া পাওয়া যায়।”
(শেকল/ লেনি এভারসন)
এতো বিরূপতা, মানুষের এতো নির্মমতা সত্ত্বেও সরল এবং নির্মল আদিবাসী কবির প্রবল আস্থা মাটির প্রতি, প্রকৃতির প্রতি। তার আস্থা আমাদের এই তথাকথিত সভ্য মানুষের মুখে লজ্জার চুনকালি মাখিয়ে দেয়। এতো যন্ত্রণা নিয়েও সন্তান যখন গভীর বিশ্বাসে বলে—
“এতো পেষণেও সে আমাকে নিরাশ্রয় করেনি। এভাবেই সে আমায় আজীবন রক্ষা করে যাবে, আগলে রাখবে বুক দিয়ে।
বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু
প্রয়োজন সবই সে
দিয়েছে আমাকে।” (জগৎ
মাতা/ ডেনিস ম্যাককে)
দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেল বিজয়ী ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটু বলেছেন- ‘ইউরোপিয়ান ধর্মযাজকরা এসে আমাদের হাতে ধর্মগ্রন্থ ধরিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে প্রার্থনা করতে বলে। আমরা ধ্যান ভেঙে চোখ খুলে দেখি আমাদের হাতে শুধু বাইবেল, তাদের হাতে চলে গেছে আমাদের সব জমি, সম্পদ।’ চোখ খুলে আদিবাসীরা দেখে বন্ধু বলে যাদের ঘরে তুলেছিল তারা কেড়ে নিয়েছে অরণ্যের অধিকার, শস্যদানা, সন্তান এবং উত্তরাধিকার আর কথা বলার শক্তি। আজ এতোটা দিন গেল, এখনো আঁধার কাটেনি, এখনো চোখের জলে বর্ণমালা ভিজিয়ে দিতে দিতে আদিবাসী প্রবীণা— যাকে শিশুকালে মায়ের কোল থেকে জোর করে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ডুকরে ওঠেন-
“পারি না, আমি পারিনা, নিজের ভাষায় কথা বলতে পারিনা। ছোট্ট শিশুর মতো আবার বর্ণমালা শিখছি। আমি আমার
নিজের ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে চাই। আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য প্রকৃতি আর প্রেমের বার্তা রেখে যেতে চাই।”
“এ আমার দেশ, ভাবতাম নিজের দেশটাকে খুব
ভালভাবে জানি। বনের
মধ্যে মসৃণ বার্চগাছে বাকল খুঁজতে খুঁজতে বড়
নিঃসঙ্গ,
বড্ড একা হয়ে উঠি নিজের ভেতরে।
আমার নিজের দেশে এ এক একাকী অনুভুতি”!
(ভাষা শিক্ষা/ রিটা জো)
মানুষের গড়া পৃথিবীর অনেক সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। কত-শত সভ্যতা এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছু
নয়। কিন্তু প্রকৃতি তার আপন রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে চিরকাল প্রাণময় হয়ে থাকে। যে কারণে কবি
পুণর্জন্ম পেলে মানুষ নয়, পাহাড় হয়ে জন্মাতে চায়, বৃক্ষ আর প্রাণীকূলকে আশ্রয় দিয়ে জঠরে পেতে
চায় মাতৃত্বের ওম, তার জন্য তো চন্দ্র-তারার ভালবাসা থাকবেই।
“যদি আবার ফিরে আসতে হয় এই পৃথিবীতে
তাহলে মানুষ নয়, আমাকে পাহাড় করে দিও
ভাবছ—পাহাড় কেন হতে চাই?
কারণ তাহলে আর নিজেকে একলা লাগবে না।
সূর্য ও মেঘদল থাকবে;
থাকবে চাঁদ-তারা
মেঘের গর্জন আর বজ্রপাত আমাকে সঙ্গ দেবে।
ভালুক এবং পাহাড়ি সিংহেরা টিকে থাকার জন্যে নির্ভর করবে আমার ওপর
পাখিরা বাঁধবে বাসা”
(পাহাড়ের কবিতা/ জোনাথন টেইলর)
অপসভ্যতার যে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল কানাডার আদিবাসীদের মুক্ত সত্তা, তার বাঁধন অনেকটাই
খসে পড়েছে। অবদমিত আবেগ আর শব্দেরা পায়রার মতো ঝাঁক বেঁধে উড়বে নির্মল আদিবাসী আকাশে।
(অনূদিত কবিতাগুলো লেখকের অনুবাদ গ্রন্থ ‘দূরের ক্যানভাস (২০১৬)’থেকে নেয়া)
শাহানা আকতার মহুয়া: কবি, অনুবাদক। সম্পাদক: ছান্দস