বিলি কলিন্স এর ৫টি কবিতা । ভাষান্তর বদরুজ্জামান আলমগীর

0

বিলি কলিন্স এর ৫টি কবিতা

ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর

বাতাস হালকা- কিন্তু তার আছে এক অফুরন্ত অদৃশ্য ভার : বিলি কলিন্স-এর কবিতা তেমনই নির্ভার, অথচ আছে এক জীবনদায়ী ভার। বাঙলায় আমরা হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙো দাদাঠাকুর- বলে যে একটা আপ্তবাক্য বলি, কলিন্সের কবিতা তেমনই এক আটপৌরে  চালে বাঁধা। জীবনের, অভিজ্ঞানের, দূরদর্শিতার এমন একটি অনায়াস যৌগ ধারণ করেন কলিন্স- যার নিরিখে তাঁকে লেখার টেবিলে কোন জোরাজোরি করতে হয় না; পানির পিঠে পানির প্রবাহ দেখতে বড় মনোহর লাগে- কিন্তু তার অন্তর্লীনে যা কার্যকরভাবে জমাট বাঁধে তার নাম প্লাবন। কলিন্স তাঁর নিজের সম্পর্কে যেভাবে বয়ান করেন তা বড় মোক্ষম- মনে হয়, সবসময়ই একজন পাঠক আমার সঙ্গে এক কামরায় থাকে, তাকে পিঠে হাত দিয়ে যত্নশীল সৌজন্যে প্রত্যেকটি কবিতার প্রথম লাইন শুরু করি, তারপর চোখ বন্ধ করে উন্মাতাল ছুটতে থাকি- যাত্রাপথে বিবিধ আতঙ্ক, ভাঙচুর, ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ি, আমি পাঠককে এই উত্তুঙ্গ সর্বনাশের মাঝখানে ফেলে পালিয়ে আসি- এভাবেই আমার কবিতাটি এক বিশ্বাসঘাতক মাধুরির উপর গঠিত হয়ে ওঠে। বিলি কলিন্স জন্মেছিলেন ১৯৪১ সনের ২২শে মার্চ নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে।

মৃতজন

মৃতরা নিয়ত আমাদের পানে তাকিয়ে দেখে
জুতা পরার সময়, কী স্যান্ডুইচ বানাবার প্রাক্কালে
তারা বেহেশতের তটিনী ‘পর বিহারি স্বচ্ছ তরণী
নেহারি আমাদের চলাচল, তারা নাও বায় ধীর লয়।

তাদের আকাশী দুনিয়ার নিচে দেখে আমাদের দল
চলে ফেরে মানুষের কোলাহল, হয়তো আমরা
বুঁদ হয়ে আছি বিকালের মধুক্ষরা গীতে
তারা ভাবে আমরা তাদের আনাগোনা তুলি আঁখিপাতে।

সাবধানে তারা হয় আমাদের বাজান ও জননী
মৃদু বৈঠায় আমরা যেন নিদ্রা যাই- ঘুমের মোহিনী।

The dead.

চন্দ্র কারিগর

ছোটবেলায় রাত্তিরে সে আমাকে ভয় দেখাতো
মুখটা কেমন আলগা করে উপরের দিকে তুলে ধরতো
এখন ভাবতেও পারি না- এতোটা নীরক্ত, গা ছমছমে।

আজ পাহাড়ের উঁচুনিচু টিলা বেয়ে বাড়ির দিকে
ড্রাইভ করছিলাম
তাকে দেখি গাছগাছালির পিছনে ক্রমে ডুবতে বসে
আবার আগের মতোই আমার দিকে মুখটি তুলে ধরে।

তার মুখ খোলা ময়দানে অবারিত হলে
মনে হলো অন্ধকার ব্রহ্মাণ্ডের সাথে
নিবিড় এক মিতালি গড়ে তুলেছে সে,

খাখা বুকের এক প্রসন্ন নৈঃশব্দ্যের নৃপতি যুবা
প্রাণের কথাটি আমূল রটিয়ে দেয়-
অন্তর চোবানো গানের ভিতর।

The man in the moon.

প্রকল্পহীন ভালোবাসা

আজ সকালে হ্রদের পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে
আমি ছোট্ট গায়ক পাখি রনের প্রেমে পড়েছি

আর বিকেলের দিকে মনে ধরেছে একটি ইঁদুর
বিড়াল বাহাদুর ধপাসকরে পড়েছে খাবার
টেবিলের নিচে।

শারদ সন্ধ্যায় এক সেলাই দিদিমনির রূপে মজেছি
এখনও দর্জি বালিকার জানালায় সেঁটে আছি
এবার চোখ ফেরাই একবাটি তরল খাবারের দিকে
এ-তো ধোঁয়ায় হরিলুট, বুঝি নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ।

আমার মন আওড়ায়- এমনটাই সেরা ভালোবাসা
কোন মুলামুলি নাই, রাগ গোস্বা দূর হও
লেনদেনের প্রশ্ন অবান্তর
একজন আরেকজনকে হরহামেশা সন্দেহ করছে না
ওরা ফোনের এপার ওপার কথাবিহীন ঠাণ্ডা নিরুত্তাপ।

সবকিছু ফুরফুরে গরম গরম অবসাদোত্তীর্ণ নির্ভার
মাথায় জ্যাজ টুপি শোভা পায়
একহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল- কী দারুণ!

যৌনতার জিদাজিদি, ঠাস করে মুখের উপর
দরজা লাগানোর ব্যাপার রইলো না
ছোটমোটো একটা সরেস কমলার চারা, এই তো।

হাঙ্গামা হুজ্জতির কারবার লাপাত্তা
ধবধবে সাদা শার্ট, বিকেলে ঝরঝরে গোসল
ফ্লোরিডার ভিতর ছোটে নির্বিঘ্ন হাইওয়ে।

রেশারেশি, বাজাবাজি, রাগে চান্দি গরম করা
এসব কিছুই নাই
মাঝেমধ্যে কিঞ্চিৎ মান-অভিমান রইলো না হয়
একান্ত সাময়িক ব্যথা।

ছোট্ট পাখি রেন যে-কীনা তার বাসা বানিয়েছে
খুব নিচু একটি ডালে
ডালটি কেমন পানি ছুঁইছুঁই করে
ইঁদুরটি নির্বিবাদ মরে পড়ে আছে
মনে হচ্ছে, এখনও তার বাদামি কোটটিই পরা।

আমার হৃদয় আমি বসিয়ে রেখেছি বেদীর উপর
একটু বাদে যে তীরটি আসবে
তা যেন এফোঁড়ওফোঁড় ছিঁড়ে বেরুতে পারে।

লেজ ধরে মরা ইঁদুর জঙলার দিকে টেনে নেবার পর
নিজেকে গোসলখানার টাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি
আমাকে সাফসুতরো করে তুলবো বলে
সাবানের দিকে জুলজুলে চোখে কেমন তাকিয়ে আছি।

Poem : Aimless love.

নিরঞ্জন

প্রতিদিন কুকুরটি দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়
মাথায় আরাম টুপি নেই
হাতে রোদবৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচার ছাতা নেই
নেই কোন টাকাপয়সা পিছুটান কিচ্ছু না
না আছে ঘরে তালা লাগানোর বালাই
কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার ঠিকই তার জন্য
মায়া লাগে, পিছুটান হয়।

মনে হয়, আমাদের চোখের সামনে
সে এক টাটকা নমুনা-
জীবনের প্রতিঘাটে মোড়ে মোড়ে এতোকিছুর দরকার কী-
ছোট্ট একটা ঢ্যাঁড়ায় একটা চামুচ একটা প্লেট
এই যেমন গান্ধী- সামান্য দানাপানি, একটা লাঠি আর ন্যাংটি।

কুকুরটি প্রতিদিন এই খাইখাই দুনিয়ার বাইরে চলে যায়
শইলের উপর একটা নেহায়েত জোব্বা
জামায় এই তো টেরি কাটা নীল কলার, ব্যস
গন্তব্য বলো নিশানা বলো- সবটা তার ভেজা ভেজা নাক
আর ওই যে টুসটুস করে শ্বাস ফেলে সেইটুক

পিছনে লেজখানি বুঝি পেখম-
ওঠে নামে এটুকু তাড়িয়ে তাড়িয়ে দ্যাখে।

সারাদিনের কর্মসূচিতে সামান্য বিপত্তি ঘটে
যদি কোন বিড়াল এসে পথের মুখে পড়ে
এমতাবস্থায় তার বিড়ালকে গুঁতো দিয়ে পাশে সরাতে হয়
তা না হলে তার হাঁটাহাঁটি, সংসারিয়ানা, খাবারদাবার
এক্কেবারে নির্ঝঞ্ঝাট, অনায়াস

এভাবে সে হয়ে উঠতে পারতো চামে জীবন কাটানোর
বাছাই উদাহরণ-
তা আর হয়ে উঠলো না- কেননা বারবার এসে মাছি বসে-

তাই তার কান দুটি ঘন ঘন নাড়তে হয়,
আর আমিও আছি- তার জিম্মাদার।

Poem : Dharma.

জাপান

আজ আমি জড়িয়ে আছি
একটি হাইকুর মীড়ে
কয়েকটি শব্দ বারবার আওড়াচ্ছি।

সতেজ মিঠা অনুভূতি এক
বারবার মুখে পুরছি
একই ছোট আঙুর ফল।

আমি বাড়ি জুড়ে হাঁটছি
মুখে ঝরে অক্ষরদানা
সব কামরা ভরে উঠছে আমার কথায়।

আমি পড়ছি পিয়ানোর নীরবতার কাছে
বাঙ্ময় সমুদ্রের ধারে
অপার নৈঃশব্দ্যের প্রাণে সুর ঝালিয়ে দিচ্ছি।

আমার অতলান্তের বুলি
কিছু না শুনেই বলছি বুদবুদ
বলছি না আর- এমনিই শুনছি।

কুকুর আমার দিকে মুখ করে
আমি হাঁটু গেড়ে বসি
তারপর ওর সাদা কানের কাছে বলি।

আমি একটি গির্জার ঘন্টার ধারেপাশে
তরজমা করছি নৈঃশব্দ্য

তার পিঠে একটি চুপচাপ মথ।

আমার মন বলে বেসামাল যন্ত্রণা হচ্ছে
বেচারি ঠাণ্ডা ঘন্টার
দিব্যি দাঁত কামড়ে বসে আছি মথ।

আমি জানালা বরাবর অনুক্ষণ বলি
বেলটা-ই দুনিয়া হয়ে যায়

তার উপরে মথ হয়ে জিরিয়ে নিই।

আয়নার কাছে বলছি মর্মর যখনই বা
আমি ভারী ঘন্টা

আর মথ সহজ পাখায় জীবন হয়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে যখনই তোমাকে অন্ধকারে বলছি

তুমি হয়ে উঠছো ঘন্টা
আমি তোমাকে বাজাচ্ছি কথাদের উন্মীলন।

মথ উড়ে চলে গ্যাছে
বেলের উপর থেকে বাতাসে
আমি ঘন্টার না বলা কথা- বলে যাচ্ছি।

Poem : Japan.

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.