প্রবন্ধ
সিদ্দিক বকর
বাংলা নববর্ষ : বাঙালির মুক্তির শান মেশিন
১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উৎসবকে যদি বলি ইহা একটি স্রেফ উৎসব তাহলে হয়তো অনেকেরই চোখ ও দৃষ্টি বাঁকা হয়ে চিত্রায়িত হবে। উৎসব তো বটেই। স্রেফ উৎসব, শুধুই উৎসব বলার মাঝে কোনো একটা গন্ধ পাওয়া যায় সত্যি। গন্ধটা আবিস্কারের চেষ্টা পরে করি, উৎসবকে একটু ঘাটাই।
মানুষের জীবনে উৎসবের প্রয়োজন নেইÑ এটা বলা বোধ হয় সমীচীন নয়। উৎসব মানুষকে প্রাঞ্জল করে, উৎসব মানুষকে তার জরা দু:খ কষ্ট বেদনার ঘোলা গ্লাস ক্লিন করে। সেই ক্লিন গ্লাস সংসারের মায়ার বাঁধনের জালে আটকা পড়ে আবার ধুলোবালি পড়ে ঘোলা হয়, আবার ক্লিনার উৎসব দিয়ে ক্লিন করতে হয়Ñ জীবন চলে এভাবেই, তাই জীবনে পুনঃপুন উৎসবের প্রয়োজন। উৎসব তাই তাৎপর্যহীন নয়। উৎসব একা একা হয় না। উৎসব মিলনের সাজানো বাসর।
“… সংসারে প্রতিদিন আমরা যে সত্যকে স্বার্থের বিক্ষিপ্ততায় ভুলিয়া থাকি উৎসবের বিশেষ দিনে সেই অখ- সত্যকে স্বীকার করিবার দিন। এইজন্য উৎসবের মধ্যে মিলন চাই। .. .. মিলনের মধ্যেই সত্যের প্রকাশ- সেই মিলনের মধ্যেই সত্যকে অনুভব করা উৎসবের সম্পূর্ণতা। একলার মধ্যে যাহা ধ্যানযোগে বুঝিবার চেষ্টা করি, নিখিলের মধ্যে তাহাই প্রত্যক্ষ করিলে তবেই আমাদের উপলব্ধি সম্পূর্ণ হয়। [উৎসব,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
বাঙালির ঐতিহ্যগত চিরায়ত সংস্কৃতির সরোবরে ডুব দিলে চোখের আলোর গণ্ডিরর মধ্যে ছোট ছোট পুকুরে ফুটে থাকা পদ্ম ফুলের মতো যে সব উৎসবগুলো জেগে উঠে সহসা সেগুলোর মধ্যে পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি, নবান্ন,পৌষ মেলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মুসলমান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল অজহা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বার্ষিক উৎসবের মধ্যে রয়েছে জন্মাষ্ঠমী, রথযাত্রা, দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা ইত্যাদি। আরো অগণিত ছোট ছোট উৎসব বাঙালির জীবনে জড়িয়ে আছে লতাগুল্মের মতো।
পৃথিবী বদলের সাথে সাথে উৎসবেরও বদল ঘটেছে অনেকাংশে। উৎসবের ক্যারেক্টার আর আগের মতো নেই। বই পুস্তক থেকে আহরণ না করেও বলা যায় ৫০ বৎসর আগের ও পরের উৎসবগুলো কেমন ছিল। বাড়িতে নতুন সন্তান জন্ম নেয়ার পর কয়েকদিনের মধ্যেই আত্মীয়স্বজনের মিলন উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠতো স্ইে জন্মস্থান। সন্তান জন্ম হতো প্রসূতির বাবার বাড়িতে। জামাই, জামাইয়ের মা বাবা সাথে আত্মীয়স্বজন নিয়ে বউয়ের মা দাদীর জন্য শাড়ি, মিষ্টি, পান-সুপারী নিয়ে বেড়াতে আসতো। পাড়া-প্রতিবেশীদেরও নিমন্ত্রণ থাকতো সেই অনুষ্ঠানে। সেই উৎসব ও মিলনের উদ্দেশ্য আনন্দ ও প্রেম। পরস্পরের মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি। বিবাহের সময় ঘটা করে কেন উৎসবের আয়োজন করা হয়? অনন্দই শুধু এর একমাত্র কারণ কি? উৎসবের ভিতর দিয়ে মেয়ে বিদায়ের বেদনা লাঘব করা, নতুন দুটি ছেলে মেয়ের বিবাহ বন্ধনের সুখবরটি সমাজকে নোটিশ করা। মৃত্যুরও একধরনের নীরব উৎসব বাঙালির সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। এখানেও মানুষ সারভাইভকে সুখ ও স্বাচ্ছন্দে ফিরিয়ে আনারই সর্বান্ত রকমের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রাখেন নিজেকে সম্মিলিতভাবে। শোক এক ধরনের গার্বেজ। শোকসন্তপ্ত পরিবার যেন গার্বেজে নিমজ্জিত হয়ে না পড়ে তার জন্যই পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং সমাজের মানুষজনকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার এক নীরব উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যার মধ্যে দিয়ে শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সাথে ঘটে আনন্দ প্রেম ও ভালোবাসার বিনিময়। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে উৎসব এক বিরাট জায়গা দখল করে আছে। বহু উৎসব আজ বিলুপ্তির পথে। সামান্য খতনা পড়ানোর সময় প্রায় আয়োজন করা হতো ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলার উৎসব। এমন কি মেয়ে মেয়ে সই পাতানো, ছেলে ছেলে দোস্তি পাতানোর সময় আয়োজন হতো বাংলার বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের উৎসব। বিভিন্ন খেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো স্বতস্ফুর্ত মানুষের মিলন মেলা। যেমন হাডুডু, দাড়িয়াবান্দা, একছল্যা ছি খেলা, বলি খেলা, ফুটবল, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই। আর এসব খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে যেমন ঘটতো মানুষের সমাগম সাথে সাথে বসে যেত ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা। আরো কিছু উৎসব ছিল গ্রামে গ্রামে আয়োজন হতো- উজাগরী উৎসব, মশা-মাছির মুখ পোড়নো উৎসবÑ যা ছিল গ্রামীণ ঐতিহ্যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির লোক ঐতিহ্য ও লোক সংস্কৃতির অলংকার স্বরূপ। এর অনেক উৎসবই আজ আর গ্রামীণ জনপদে দেখতে পাওয়া যায় না। প্রায় বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এসব গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন এখন আর নেই বললেই চলে। অথচ আমরা মনে করতে পারি ্এসব গ্রামীণ খেলাধুলা যেদিন যেখানে অনুষ্ঠিত হতো সেখানে মানুষের পাহাড়ি জলের ঢল নামতো। দশ গ্রামের মানুষ এসে জড়ো হতো সেখানে। ক্ষেতে খামারে কাজ করে কৃষকরা তাদের সকল ক্লান্তি, সংসারের টানাপোড়েন থেকে নিজেকে মুক্ত করে এসে আনন্দ আর শোরগোল ও করতালির সাথে যোগ দিয়ে শুরু করতো এসব গ্রামীণ খেলাধুলা। বাঙালি লোকসংস্কৃতিতে আনন্দ উৎসবের অভাব ছিল না। “বারো মাসে তেরো পার্বণ” এ প্রবাদবাক্যটি বাঙালির লোকসমাজ জীবন ও লোক সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যরূপে যুক্ত হয়ে আছে। যেগুলো এখন আর চোখেই পড়ে না সেগুলি হলো ঘেটু গান, যাত্রাপালা, জারি গান ইত্যাদি। এগুলো বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে পুঁজিবাদি সমাজব্যবস্থার হাত রয়েছে যেভাবে সেখানে কোনোদিনও নজর পড়ে না এই গ্রামের কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের। পুরোনোকে বাতিল করতে নতুন নতুন লোভনীয় পণ্যের উদ্ভাবন করে মানুষকে উন্নয়নের পরাকাষ্ঠায় ফেলে বলি করছে। নামে মাত্র কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে কৃষি কাজ থেকে উচ্ছেদ করে দিচ্ছে নতুন প্রজন্মকে। শুধু তাই নয় নতুন প্রজন্মের একটা অংশকে করে তুলছে অতিমাত্রায় ইনডিভিজ্যুয়াল, যান্ত্রিক, রাজনীতিহীন, সংস্কৃতিবিমুখ, মেরুদণ্ডহীন, সার্টিফিকেটধারী ও অসৃজনশীল শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের সামনে ঝুলিয়ে দিচ্ছে পুঁজিবাদি নতুন বাজার অর্থনীতির ধারক বাহক কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বড় বড় পদের মূলা এবং অন্য একটি অংশকে- যারা অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত তাদের সামনে ঝুলিয়ে দিচ্ছে নেশার কৃত্রিম সুখের ঠিকানা। এভাবেই নতুন প্রজন্মকে দুইভাগে নেশাগ্রস্ত করে নিজেদেরকে অস্থায়ীভাবে হলেও টিকিয়ে রাখছে।
যে উৎসবগুলো এখনও টিকে আছে তা হলো মাজারকেন্দ্রিক মেলার উৎসব। মেলার সাথে গ্রামের লোকসাধারণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রেমের বন্ধন প্রগাঢ়। মেলার কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই। মেলায় সকল ধর্মেও মানুষই প্রেমে ও আনন্দে একাকার হয়ে যায়। মেলা এখনও হয় তবে আগের আমেজ আর নেই এখন। মেলা শুরু হওয়ার প্রথম রাতে বাউল ও দর্শকশ্রোতার মিলনমেলায় যে জমজমাট আসর জমে উঠে তাকে বলা হয় উরস মোবারক। এ রাতে দূর-দূরান্ত থেকে চলে আসে ছোট বড় সকল প্রকার বাউল শ্রেণি। সারা রাত ভর চলে বাউল গান, সাথে চলে র্যানডম সিদ্ধি সেবন, র্যানডম বাউল নাচ- আধ্যাত্মিক ঘোরের মধ্যে মগ্ন হয়ে নিজেকে নিজের মাঝে ডুবিয়ে রাখে। পরের একদিন দুদিন যাবৎ চলে মেলা। মেলার প্রধান প্রধান আকর্ষণের মধ্যে ছিল সার্কাস, বায়োস্কোপ, যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা ইত্যাদি। ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন খাবার-দাবারের মধ্যে ছিল বাতাসা, গুর, গুরের জিলাপি, মুরালী, মঠ, তিল্লায়, মুড়ি, বিন্নি ধানের খই।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “… উৎসবের দিন সৌন্দর্যের দিন। এ দিনকে আমরা ফুলপাতার দ্বারা সাজাই, দীপমালার দ্বারা উজ্জ্বল করি, সংগীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি। এইরূপে মিলনের দ্বারা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎসবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলির মুকুটমণিস্বরূপ করিয়া তুলি। যিনি আনন্দের প্রাচুর্যে, ঐশ্বর্যে, সৌন্দর্যে বিশ্বজগতের মধ্যে অমৃতরূপে প্রকাশমান। উৎসবের দিনে তাঁহারই উপলব্ধি দ্বারা পূর্ণ হইয়া আমাদের মনুষ্যত্ব আপন ক্ষণিক অবস্থাগত সমস্ত দৈন্য দূর করিবে এবং অন্তরাত্মার চিরন্তন ঐশ্বর্যে ও সৌন্দর্য্য প্রেমের আনন্দে অনুভব ও বিকাশ করিতে থাকিবে। এই দিনে সে অনুভব করিবে, সে ক্ষুদ্র নহে, বিশ্বই তাহার নিকেতন, সত্যই তাহার আশ্রয়, প্রেম তাহার চরম গতি, সকলেই তাহার আপন ক্ষমা তাহার পক্ষে স্বভাবিক, ত্যাগ তাহার পক্ষে সহজ, মৃত্যু তাহার পক্ষে নাই।
এ পৃথিবীর যেখানেই বসবাস করে মানুষ সেখানেই আছে একটি ভূখণ্ড, আছে একটি দেশ- সে দেশের মানুষ একটি নির্দিষ্ট জাতিসত্তার পরিচয়ের মাধ্যমে দানা বেঁধে উঠে একটি জাতির। বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহ্যের অপরিহার্য প্রধান উপাঙ্গ হলো বাংলা নববর্ষ। আমাদেরও বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি যে সব একাধিক ছোট বড় গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার সকল পিলারের মধ্যে প্রধান পিলারটি হলো পহেলা বৈশাখের নববর্ষের উৎসব। এ নববর্ষের উৎসব বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নিজস্ব সংস্কৃতির গর্ভাধার।
বাংলা নববর্ষ এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের ভিতর দিয়ে যেসব উৎসব পার্বনের প্রচলন ঘটেছিল ধীরে ধীরে তার উদ্ভব মূলত প্রান্তজনের জীবন নিংড়ে রসের মতো যেখানে সেসব উৎসব কোনো রাজনৈতিক সংকীর্ণ মানসিকতা প্রসূত নয় অথবা অন্য কোনো হীন উদ্দেশ্য থেকে জন্ম নেয়নি। কিন্তু বৈশাখের উৎসব? এর প্রচলন কীভাবে, কে, কেন করেছিল ? এও আমাদের অজানা নয়। অজানা যে বিষয়টি তা হলো শ্রমের বিনিময়ে যে মানুষ জীবন ধারণ ও যাপন করতো তাদের চূড়ান্ত কোনো মুক্তির পথ এখানে খোলা ছিল না। বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসক এসেছে আর বন্দিত্বের জাল, শৃঙ্খল তৈরি করেছে যেন রাজা জমিদারদের স্বার্থের কোনো ব্যত্যয় না ঘটে, চুল পরিমাণ শংসয়ও যেন সৃষ্টি না হয় নিজেদের অস্তিত্ব টিকে থাকার প্রশ্নে।
আদিম যুগের একটা সময় পর্যন্ত মানুষের সম্পদের উপর যতদিন কোনো অধিকার গড়ে উঠেনিÑ ততদিন এক ধরনের স্বতস্ফুর্ত ও প্রাণবন্ত ব্যপার ছিল খাদ্য আহরণ ও সম্পদ ব্যবহারে। যখন থেকে উৎপাদন শুরু হয়, তখনই জন্ম হয় গোষ্ঠি প্রধান ও সর্দার প্রথার। আর তখন থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে সম্পদের উপর মালিকানার অধিকার। তাদেরই পরম্পরাগত প্রতিনিধি আজকের পূঁজিপতি শ্রেণি। যে শ্রেণি তাদের নিজেদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সাধারণ জনগণের উপর হরহামেশাই চালায় গুম হত্যা নির্যাতন।
যখন বাংলা নববর্ষকে বলা হতো ফসলি সন, যখন বাংলা নববর্ষ উৎসব পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে ততদিন পর্যন্ত এই উৎসবের চরিত্র ছিল শ্রমজীবিদের আমোদ-প্রমোদে মগ্ন থেকে সারা বছরের ক্লেদ-ক্লান্তি পরিহার করে পরবর্তী বছরের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করে শক্তি সঞ্চয় করা। যতদিন পর্যন্ত তখনকার ব্যক্তি মালিকানার উপর কোনো উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হয়নি ততদিন পর্যন্ত এসব উৎসব ছিল সেই জীবনেরই উজ্জীবনী সুধা। যখন থেকে খাজনা প্রথা চালু হয় তখনই এই উৎসবগুলিকে এবং বাঙালির সহজ সরল আবেগকে পূঁজি করে এই শাসকশ্রেণি তাকে হাতিয়ার করেছে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে।
বাংলা নববর্ষে আরো একটি উৎসব ছিল ব্যবসায়ীদের হালখাতা উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব। একসময় বৈশাখের উৎসবের চেয়ে চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব অনুষ্ঠান ছিল অধিক পরিমাণে বর্ণিল ও আকর্ষণীয়। আবহমানকাল ধরে জমিদারির খাজনা আদায়সহ চৈত্রসংক্রান্তিকে কেন্দ্র করেই হালখাতা উৎসব হতো। এই হালখাতা উৎসবে ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাসাধারণদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসতো তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। ক্রেতাসাধারণদের মিষ্টিমুখ করিয়ে খাতার পুরোনো হিসেব শেষ করে নতুন হিসেবের পত্তন করতেন। এটি ছিল ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যেরকার আন্তরিক ও ভালোবাসাপূর্ণ এক মিলন উৎসব। এমন হালখাতা উৎসব শুরু হতো চৈত্রের শেষ দিন থেকে। এই হালখাতা মিলন উৎসবে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়েরই কোনো হীন উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল না কোনো শাসন শোষণের খরগ বর্ম। যা কিছু অংশে এখনও টিকে আছে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে, কিছু অংশে শহরেও।
সম্রাট আকবরের শাসন আমল শুরুর পর থেকে তাদের শাসন শোষণ জারি রাখতে এবং প্রথা ও রীতি পরিচালনার সুবিধার্থে বৈশাখী উৎসবকে তাদের খাজনা আদায়ের নিগড়ে বন্দি করে নেয়। সম্রাট আকবরই সর্বপ্রথম বাঙালির চিরায়ত হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফসলি সন ও প্রাণের ঋতুধর্মী উৎসবের রূপ ও সৌন্দর্যকে হাতিয়ার বানিয়ে বাংলা সন ও ১লা বৈশাখ নববর্ষ উৎসবের প্রচলন চালু করে জমিদার শ্রেণি তাদের খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়াকে সুসংহত ও সফল করার নিমিত্তে।
জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জমিদারশ্রেণি ও ভূস্বামীরা পরম যতনে বাংলা নববর্ষের উৎসবকে তাদের বাড়ির প্রাঙ্গনে তুলে নেয়। তখন বাঙালি কৃষকশ্রেণি নতুন কাপড় পড়ে সেজে-গুজে চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার ও ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতো। পরেরদিন ১লা বৈশাখের উৎসবের অংশ হিসেবে কৃষকশ্রেণিকে জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায় আপ্যায়নের মহাব্যবস্থা করতো। প্রধানত কৃষক শ্রেণিকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও প্রিয় আদর ও সম্মানের খাবার হরেক রকম মিষ্টি দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হতো। এমন লোভনীয় আপ্যায়নের ভিতর দিয়ে মূলত আদর-যতেœ ছেলে ভোলানো কৌশলে, তাদের শাসন শোষণকে পরের বছরের জন্য অলিখিত ও অদৃশ্যভাবে মজবুত করার এক হীন প্রক্রিয়ারই পাকাপোক্ত সাফ কাওয়ালা দলিল করে নেয়। কৃষকশ্রেণির নাকে ‘মিষ্টিমুখ‘ এর নথ, গলায় উৎসব এর দড়ি পড়িয়ে জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গনে তাদেরই পৃষ্টপোষকতায় গ্রামীণ মেলার প্রচলন করে একে এক মহা উৎসবে পরিণত করে। এ উপলক্ষে মেলায় কৃষিজাত পণ্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী, মৃৎশিল্প ও নিত্য প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী কৃষক, কামার, কুমার সবাই বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিয়ে এসে মেলায় পসরা সাজিয়ে বসত। তার সাথে আরো থাকতো হরেক রকমের মিষ্টি, গুর, গুরের জিলেপি, বাতাসা, মঠ, তিল্লায়, মুড়ি, বিন্নি ধানের খই। গ্রাম থেকে কিছু অপেশাদার কিশোর অতি উৎসাহের সাথে বিক্রির জন্যে নিয়ে আসতো পাকা গাবফল ও পাকা বেতফল। এর সাথে যুক্ত হতো জমিদার বাড়ির খোলা চত্বর জুড়ে যাত্রা, গাজির গান, কবি গান, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, ঘুড্ডি কাটাকাটি। এ সকল আয়োজন ও অংশগ্রহণের ফলে বৈশাখী উৎসব পরিণত হতো এক মহা উৎসবে। এমন মহা উৎসবে মেলার চতুর্পাশের মানুষ দল বেঁধে এসে সারাদিন উৎসবে আনন্দে মেতে রাখতো। এ উৎসবের ভিতর দিয়ে তাদের ক্লেদ, ক্লান্তি, দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে আনন্দ ও সুখে অবগাহন করে জেগে উঠতো নতুন মানুষরূপে। এর ভিতর দিয়ে সামন্তীয় দুঃশাসনের ঘানির যাতায় যে তাদের সকল শ্রমরস শুষে নিত সে খেয়াল বাংলার কৃষককূল কোনোদিনও রাখেনি। উপরন্তু, কোনো বছর যদি তাদের ফসল ঝড়, বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির কারণে ঘরে তুলতে না পারতো তখন খাজনা আদায়ে নেমে আসতো অমানবিক অত্যাচার, নিপীড়ণ, নির্যাতন, গুম, খুন। তার কারণে কখনও কখনও কৃষকরা সম্মিলিতভাবে যে বিদ্রোহ করতো না তেমনটি নয়। এইসব কারণে পূর্ব বাংলায় বেশ কিছু আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যেমন ফরাইজি আন্দোলন। ফরাইজি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু এবং জমিদার শাসক শ্রেণিকে প্রতিরোধ করা।
সেই জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরও তাদের প্রতিনিধি আরও শক্তিশালীভাবে অন্যরূপে বিরাজমান আজও। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি আজও আসেনি। আজও শাসন, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, রাহাজানি, গুম, খুন সবই জারি আছে বহাল তবিয়তে। আজও আছে বৈশাখ, আজও বৈশাখকে ঘিরে আনন্দে মেতে উঠে বাঙালি। এখনও বাঙালির একমাত্র সার্বজনিন বড় উৎসব হলো বৈশাখী নববর্ষ উৎসব যেখানে বাঙালি মিলিত হয় মুক্ত মন নিয়ে, অসাম্প্রদায়ীকের অহিংস মন্ত্র আত্মায় জারিত করে।
বাঙালির একমাত্র চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়ীক অবয়বের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের যে উৎসব সে উৎসব রক্ষা করা এবং একে সুসংহতরূপে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ধরে রাখা ক্রমশই ইঁদুর চ্যালিন্জ্ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্রমশই বিড়াল হয়ে উঠছে। বর্তমান পূঁজিবাদী, নিপীড়নমূলক ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের উৎসবের আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। যেমন করে প্রয়োজন ছিল জমিদার আমলের খাজনা আদায়ের প্রয়োজনীয়তায়। তার জন্য চিহ্নিত সাম্প্রদায়ীক শক্তিগুলো ও তার সমর্থনপুষ্ট শক্তি ক্ষণে ক্ষণে মাথাছাড়া দিয়ে উঠে একে প্রতিহত করার বিভিন্ন কায়দা কৌশল ও অজুহাতের উপর ভর করে। পহেলা বৈশাখের এ মহতি উৎসবকে ঘিরে তাই তারা বিভিন্নভাবে বলার দৃষ্টতা দেখাতে চায় যে, ‘এ উৎসব হিন্দুদের’ এ আপ্তবাক্যকথাটি এ উৎসবকে একটা সামপ্রদায়িক চরিত্র দিয়ে লেপন করে বাংলার লোকসমাজের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় বহনকারী নববর্ষ উৎসবকে জবরদখল উচ্ছেদের এক হীন প্রক্রিয়া।
এ বিষয়ে গুরুস্থানীয় প্রাবন্ধিক শ্রীশ্রী যতীন সরকারের ‘নববর্ষ : ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব’ প্রবন্ধ থেকে আমরা কিছু অংশ পাঠ নিলে এর সত্যতা এবং স্বচ্ছতা আরও বদ্ধমূল হবে।
‘’ আবহমান কাল ধরেই বাংলার লোকসমাজ নববর্ষ উদযাপন করে এসেছে। লোকসমাজের সেই উদযাপনে একটুও কৃত্রিমতা ছিল না। লৌকিক ধর্মনিরপেক্ষ রীতিতে চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারাবাহিত অনুবর্তিতাতেই উদযাপিত হতো বাংলা ও বাঙালির নববর্ষ্ কিন্তু ‘পাকিস্তান’ নামক কৃত্রিম ও জঘন্য রাষ্ট্রটির চাঁইয়েরা বাঙালির এই ঐতিহ্যানুসারিতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। তারা নববর্ষের মতো সকল ধর্মনিরপেক্ষ লৌকিক ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসবের মধ্যেই হিন্দুয়ানি ভূত দেখতে পেল। নববর্ষ ও ঋতুবরণমূলক উৎসবকে তারা চিহ্নিত করল প্রকৃতিপূজা বলে। এ-রকম উৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকেই তারা প্রকৃতি-পূজক তথা ইসলাম বিরোধী তথা ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের শত্রু বলে অভিযুক্ত করল।“ [ বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি,যতীন সরকার,পৃ ৭০]
এখন প্রয়োজন অসাম্প্রদায়ীক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে কুচক্রী, হীন সাম্প্রদায়ীক মৌলবাদী শক্তিকে কঠোরভাবে জবাব দেয়া ও দমন করা। এখনই ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে বাঙালির হাজার বছরের প্রাণের উৎসব, নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসব, নিজের শিকড়ের পরিচয় বহনকারী উৎসব একদিন ধুলায় লুটাতে পারে এবং কোথাও এ দেশের মানুষের মুক্তির ঘন্টা না বাজলেও এ উৎসব- নববর্ষ উৎসব টিকে থাকলে মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার তরবারিটা শান দেয়া বজায় থাকবে।
সবশেষে এখানে যে বিষয়টির উল্লেখ করতে চাই সেটি হলো, ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যে রোষানলে পড়ে আমাদের বাঙালি ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি। প্রথমত রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার কালো পথ দিয়ে ধীরে ধীরে আরো অগ্রসর হতো বাঙালির হাজার বছরের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমূলে ধ্বংস করতে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তখন ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহী হয়ে উঠে বাঙালি জাতি এবং এর প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ উৎযাপন শুরু করে। এই উদযাপনে যে বিদ্রোহের আগুনটা ছিল সেই সময় সেই আগুনই বাঙালির জাতিসত্ত্বা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তখন রক্ষা করেছে, এখনো রক্ষা করে চলেছে। সে কারণেই বাঙালির লোকসমাজের ঐতিহ্যবাহী বাংলার নববর্ষ উৎসব বাংলার ঘরে ঘরেই না শুধু বাঙালির প্রাণে প্রাণে পৌঁছে গিয়েছে। বাঙালি অন্য শত জায়গায় মার খেয়ে বসে থাকতে পারে কিন্তু নিজের পরিচয়, নিজের জাতিসত্ত্বা, নিজের ঐতিহ্য, নিজের সংস্কৃতিকে ধ্বংস হতে দিবে না কোনোদিন এবং এই বিদ্রোহের আত্মায় একই সাথে বাঙালি জাতির মুক্তির লড়াইটাও জিওল থাকবে।