গেরট্রুড কোলমারের কবিতা । মূল জার্মান থেকে ভাষান্তর নন্দিনী সেনগুপ্ত

0

গেরট্রুড কোলমারের কবিতা
মূল জার্মান থেকে ভাষান্তরঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

হাজার স্বপ্ন
[‘টাউসেন্ড ট্রুমে’ (Tausend Trume) অবলম্বনে লেখা]

হাজার স্বপ্ন আমার দুচোখে,
তুমি কি পাচ্ছো শুনতে?
দিন কেটে যায় তোমার জন্য-
হাজার স্বপ্ন বুনতে।
এক রাতে বুঝি নীড় ছেড়ে তুমি-
আকাশে মেলবে ডানা!
হাজার স্বপ্ন দেখতে আমার-
তবুও নেই তো মানা।

#
হাজার স্বপ্ন তোমার জন্য,
পারবে কি তুমি গুণতে?
তোমাকে ডাকবো শত শত নামে-
পাচ্ছো কি তুমি শুনতে?
প্রিয়তম ওগো, তুমি দেবদূত-
উড়ন্ত প্রজাপতি,
স্বর্ণখচিত ধূসর ডানায়
চঞ্চল দ্রুতগতি!

#
তোমাকে ডাকবো শত শত নামে-
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
তোমার জন্য পঞ্চাশ খুশি,
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?

#
পঞ্চাশ খুশি তোমার জন্য,
ভরেছি সুখের ঘর।
তোমারি জন্য মুখে হাসি ফোটে,
কেঁপে কেঁপে ওঠে স্বর।
সোনালি সকালে পাহাড়ের পথে,
অরণ্যপথ ধরে-
রঙিন পোশাক তোমারি জন্য
সাজিয়েছি থরে থরে।

#
পঞ্চাশ খুশি তোমার জন্য,
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
কিন্তু হৃদয় একটিই আছে,
শুধুই তোমার জন্য…
শুনতে পাচ্ছো?
তোমার জন্য, একটি হৃদয়-

আমরা ইহুদী
[‘ভিয়ার ইউদেন’ ( Wir Juden) অবলম্বনে লেখা]
শুধু রাত শুনছে,
ওগো আমাদের প্রাণের মানুষ, মনের মানুষ,
এসো আমরা সবাই ভালোবাসি।
এসো হাতে বেঁধে বেঁধে নিজেদের মুড়ে রাখি উত্তাপে।
সেই নারীটি যেভাবে পুরুষটিকে জড়িয়ে ধরেছিলো,
ফাঁসিকাঠের গর্তের মুখে দাঁড়ানো তার স্বামীকে,
একজন মা যেভাবে তার অপবাদগ্রস্ত ক্লিষ্ট সন্তানকে
একাকী ফেলে যেতে পারে না… এসো, ঠিক সেভাবে
জড়িয়ে মুড়িয়ে থাকি আমরা।

#
যদি তোমার কণ্ঠ থেকে উদ্গত চিৎকারের রক্তের নদীকে
কেউ রুদ্ধ করে দিতে চায়,
ডাক দাও সবাইকে,
চিৎকার করে ডাকো, অনন্তকালের গহ্বর থেকে ডাকো।
যদি তোমার কম্পিত দুটো হাত কেউ শৃঙ্খলে বেঁধে রাখে-
হয়ে ওঠো সেই হাত,
যা ঈশ্বরের স্বর্গের আসন টলিয়ে দিতে পারে।

#
গ্রিকরা পাহাড় কেটে তৈরি করেছিল শ্বেতশুভ্র ঈশ্বরের মূর্তি।
রোমানরা পৃথিবীকে ঘিরে তৈরি করেছিল এক অপ্রতিরোধ্য বর্ম!
মোঙ্গোলিয়ার সেনাদলের ক্ষমতা আর শক্তি
উঠে এসেছিল এশিয়ার গভীরতা থেকে।
আখেনের সম্রাটরা দৃষ্টিপাত করেছিল
দক্ষিণের বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অপরূপ ছবিতে।
জার্মানি আর ফ্রান্স হাতে তুলে নিয়েছে বই আর খোলা তরোয়াল।
ব্রিটিশরা চলেছে সমুদ্রতরণীর নীলচে রূপালি পথ ধরে।
রাশিয়া অন্তরে জ্বেলেছে আলো, বিস্তার করেছে বিশাল ছায়া,
আর আমরা?

আমরা হেঁটে চলেছি ভ্রাম্যমান ফাঁসিকাঠের চাকার পাশে পাশে।
এই বেঁচে থাকা, এই ধুকপুকুনি, এই স্বেদ,
এই অশ্রুহীন শুকনো চোখের হা হুতাশ, বিলাপ
সবকিছু বাতাসকে গ্রাস করতে চায় এক অদ্ভুত বিপন্নতায়,
অসীম অনন্তের মধ্য থেকে উঠে আসে শাশ্বত দীর্ঘশ্বাস।
কুৎসিত বাঁকা নখের থাবার মধ্যে,
বজ্রমুষ্টি ফাঁদের মধ্যে, দড়ির ফাঁসের মধ্যে,
চিতার স্তুপের মধ্যে
তার শিরা সবুজ হয়ে ওঠে বিষধর সাপের মত,
সে গুমরে গুমরে ওঠে,
ছোবল দিতে চায় তার শ্বাসরোধকারী জল্লাদকে।
জড়বৃদ্ধ দাড়ি, নরকের আগুনে পুড়ে যাওয়া আত্মা,
শয়তানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত কান আর অন্ধ চোখ পালাতে থাকে …

#
সবাই শোনো, যখন খারাপ তিক্ত সময় আসে,
তখনই আমি উঠে দাঁড়াতে চাই,
হয়ে উঠতে চাই বিজয়তোরণের মত
যার মধ্য দিয়ে যন্ত্রণাগুলি আমি পিছনে ফেলে আসতে পারবো।

#
না, যে হাত রাজদণ্ডের আশীর্বাদে পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে,
আমি চাইনা সেই হাতে চুম্বন করতে।
কঠিন সময়ের অন্ধগলির সামনে তার মাটিমাখা পায়ের কাছে
হাঁটু গেড়ে বসতেও চাইনা।
ওহ, আমি জ্বলে উঠতে চাই মশালের মত,
অন্ধকার শীতল মরুভূমিতে।
জানিনা কীভাবে জ্বলে উঠবো আমি!
জানিনা কীভাবে বলে উঠবো আমি?
‘ন্যায় চাই, ন্যায়বিচার! বিচার চাই!’
আমার গোড়ালি –
শৃঙ্খল টেনে টেনে চলছে আর মস্তিষ্ককে টেনে রাখছে পিছনে।
আমার ঠোঁটদুটো –
সেলাই করে গলিত মোমের শীলমোহর দিয়ে আটকানো আছে।
আমার আত্মা –
অজস্র আবেদন নিবেদনের গারদের খাঁচায় বন্দী হয়ে আছে।
আমি বুঝতে পারছি একটা হাত ধরেছে আমার চুলের মুঠি
আমার অশ্রুমাখা মুখ ঠেসে ধরা হচ্ছে ছাইয়ের গাদার স্তুপে।

#
শুধু রাত শুনছে।
আমার লোকেরা, আমার প্রাণের মানুষেরা,
আমি তোমাদের ভালোবাসি।
ভালোবাসি তোমাদের একঢালা আলখাল্লার মত পোশাকে দেখতে।
এই পৃথিবীর পৌত্তলিক উপাসনায় ভালোবাসি।
গ্রিক দেবী গাইয়ার পুত্র অবসন্ন হয়ে ফিরে গিয়েছিল মায়ের কাছেই,
তোমরাও নেমে যাও পাহাড়ের উতরাই ঢাল ধরে,
আরও নিচে।
আরও দুর্বল হয়ে যাও…
যতক্ষণ না তোমার অবসন্ন হাইকিং বুটজোড়া
ঐ শক্তিশালী মানুষদের ঘাড়ে গিয়ে পদাঘাত না করে।

রাতের রক্তগোলাপ
[‘ডি হ্রোজ ইন ড্যের নাখ্‌ট’ (Die Rose in der Nacht) অবলম্বনে লেখা]

আলো ছড়াচ্ছে। কেশদাম ঢেউ তোলে,
লাল ভেলভেটে কালো সাপ খেলে যদি,
সৌরভতৃষা জাগিয়ে ক্লান্ত করো,
হে রমণী, তুমি… হৃদয়, শুধু এ হৃদি…

#
উষ্ণ হৃদয় ফুটেছে প্রেমের ক্রোড়ে
স্বর্গ ছোঁবে কি কোমল পরশখেলা!
সে হৃদয় আজ দুই গালে রঙ মাখে,
বাদামি সন্ধ্যা ভাসায় সাগরে ভেলা।

#
পেচকের প্রেত আঁধারে হেসেছে জেগে,
তন্দ্রা ছুটিয়ে উড়ে যায় দ্রুতবেগে,
মানুষের সব স্বপ্ন বেঁধে ডানাতে।

#
কাল ভোরে গাছে শুকিয়ে হবে যে কালো,
রাত্রে ছড়াবে গোলাপের মত আলো।
রক্তগোলাপ দাঁড়াবে আবার রাতে।

পোশাক
[‘দাস ক্লাইড’ (Das Kleid) অবলম্বনে লেখা]

এটা আমার সারা সপ্তাহের কাজের পোশাক। দ্যাখো তোমরা।
ফুটোফাটা, দাগ ধরা, অজস্র তালি মারা পোশাক।
ময়লা তেলচিটে দাগের উপরে জমেছে ধুলো,
মাকড়সার জালের দাগ একেবারে এঁটে রয়েছে।
মরচে ধরা সেফটিপিন দিয়ে আড়াল করে রাখতে হবে
ছিঁড়ে ফেটে যাওয়া অংশটা।

#
কিন্তু যখন ছুটির দিন এবং আমার প্রিয় বন্ধু,
দুইই একসঙ্গে আসে, তখন
আমি আর এই পোশাকটা পরি না।
আমি আমার হৃদয় ঘিরে বেঁধে রাখি
এক সুন্দর পুষ্পস্তবক
আর খুশিমনে দেখা করতে যাই বঁধুর সাথে।

#
পোশাকের ছেঁড়া জমির উপরে
গজিয়ে ওঠে নরম সাদা ফার,
ছেঁড়াফাটা অংশগুলোর মধ্য দিয়ে ঠিকরে ওঠে
রূপোলি আলো।
মরচে ধরা সেফটিপিনগুলো ঢেকে যায় তারার মালাতে,
গাঢ় নোংরা দাগগুলো হয়ে যায় মুক্তোর ঝালর,
হাল্কা দাগগুলো হয়ে যায় হীরে বসানো ফুল
মাকড়সার জাল বদলে যায় সোনাজরি আর
সাদা সুতোয় বোনা নক্সাতে।

#
কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর হল সেই ছোট পুষ্পস্তবক
যার রূপ দেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে
প্রিয় বন্ধুর গোলাপি মুখ
সেই স্তবক জন্মেছে আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে।

#
আমার হৃদয়ের চারপাশে
ফুটে উঠেছে এক সুন্দর ছোট পুষ্পস্তবক।

কবি পরিচিতিঃ
গের্ট্রুড কোলমারের জন্ম মধ্যবিত্ত ইহুদী পরিবারে ১৮৯৪ সালে বার্লিনে । ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই। ১৯২০ সালের পর থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তার কবিতা। সমালোচকরা বলেছিলেন যে গের্ট্রুড সম্ভবত ইহুদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জার্মান ভাষার লেখিকা। ত্রিশের দশকের শেষ দিক থেকে যখন নাৎসিবাহিনীর অত্যাচার জোরদার হতে থাকে ইহুদীদের উপর, গের্ট্রুডের বহু কবিতার বই নষ্ট করে ফেলা হয়। নিজের বাসস্থান ছেড়ে বারবার স্থানান্তরিত হতে হয় নাৎসিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচবার জন্য। ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসের পরে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না । কার্যকারণ, সূত্র সবই বলছে সম্ভবত, ঐ সময় তিনি আউসভিৎসে খুন হয়ে যান।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.