পাঠপ্রতিক্রিয়া
গল্প, নীতিশিক্ষা ও ভাঁটফুলসূত্র
মোস্তফা জামান
ভাষার সঙ্গতে মানুষের সকল সঙ্গম সম্ভব হয়ে ওঠে। মানুষের সাথে মানুষের সঙ্গম, মানুষের সাথে প্রকৃতি ও আসীমের সঙ্গমের সকল আয়োজনও ভাষার মধ্যে দিয়া ঘটে। এই আয়োজনের সফল ও অসফল, কিংবা আদিম ও আধুনিক কাঠামো রয়েছে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস- এসবই আধুনিক সমাজের পক্ষে নানামুখী তৎপরতার নমুনা বিশেষ। তবে, এই তিন পদের আয়োজনের মধ্যে গল্প ও কবিতার আদি রূপ যেকোন সমাজে এখনও টিকে আছে বললে সত্যের অপলাপ হয় না। গল্প কবিতার ফর্মে কাহিনী বয়ানের আদি সংস্কৃতি গ্রামে-গঞ্জে এখনও কিছুটা হলেও টিকে আছে। এদের প্রতি আধুনিক বিদ্যোৎসাহী সমাজের সম্ভ্রম কম। ফোক বা লোক ঐতিহ্য নামে এইসব ফর্মের শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়। এদেরকে অধঃশ্রেণীর বলে একধরনের নির্দিষ্ট আহলাদের মাত্রায় বিচার-বিশ্লেষণও করেন অনেক গবেষক। কারণ আধুনিকতার আরেকটি অবিসংবাদিত প্রপঞ্চ হলো সকল সৃষ্টিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক আচার-আচরণের তদন্ত করে তাকে জ্ঞানের আওতায় নিয়ে আসা। গবেষণা এই পদের বিশেষ রচনা।
এতো এতো নব্য ও সর্বব্যাপি আয়োজনের মধ্যে বিংশ শতকে আধুনিকদের হাতে যা ছিল অবহেলিত তা হল ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্রাইমর্ডিয়াল ফর্ম’, অর্থাৎ যে গঠন মানুষের মনোকাঠামো একদা গড়ে তুলেছে বলে ধারণা করা হয়। এই অভিধার সূত্রে দাবি করা চলে যে, সভ্যতার বিকশিত অবস্থায় যে সাংস্কৃতিক সংস্রবের সূচনা, যার ফল দাঁড়ায় আধুনিক কবিতা, গল্প ও উপন্যাস, তার পূর্ববর্তী সময়ের সভ্যতার মূলস্রোত যদি হয় এপিক বা মহাকাব্য, এরই অপর হিসাবে লোকালয়ে প্রচলিত গল্প চালু ছিল। মহাকাব্য ও প্রচল গল্প- এই দুইই আদি কাঠামো বলে দাবি করা যায়। কিন্তু এমন দাবির মাঝে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী রচনা- যা ঐশি কিতাব নামে চিনি, তার জায়গা থাকে না। যদি মন ও মননের স্তরভেদে সাহিত্যের আরোচনা পুনরায় শুরু করা হয়, তবে ‘স্থায়ী ও ‘অস্থায়ী মনন, এই দুই পদের সূত্রে অধঃ ও নিন্মমার্গের এপিক ও প্রচলিত কিচ্ছা-কাহিনীর ভেদাভেদ ভুলে এদের ডিপ স্ট্রাকচার বা মৌল কাঠামোতে চোখ রাখা জরুরি। এই মৌল কাঠামো ব্যক্তি ও সমাজ মানস শাসন করে। তবে আধুনিক প্রপাগান্ডা বা বিজ্ঞাপন যেভাবে মনোজগত দখল করে তেমন কোন কাঠামো এখানে জারি থাকে না। হয়তো উনবিংশ শতকের ভাবুক গুস্তাফ ফ্রেটেগের পিরামিডের সূত্রে গল্পের আভ্যন্তরিন বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান জন্ম লয়। তাঁর পিরামিড মডেলের প্রথম ধাপ শুরু হয় কোন ঘটনার বা অবস্থার প্রকাশ থেকে এবং তা পিরামিড শীর্ষে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছায়, আর তারপর ধীরে নেমে যায় অবিসংবাদিত উপসংহারের দিকে। কিন্তু এটি গ্রীক ট্র্যাজিডি থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারের নাটক- এমত ক্লাসিক কলেবরের ব্যাখ্যা মাত্র। গল্প ও গল্পের মধ্যে কি করে মানুষ তাৎপর্য পাঠ করে এমন বিমূর্ত যোগের ওপর এই পিরামিড কোন আলো ফেলে না।
তাহলে গল্প ও তা শোনার মধ্যেকার মূল মন্ত্রটা কোথায় বাস করে? গল্পের শরীরে নাকি শ্রোতার শ্রবণ ও তাৎপর্য খুঁজে পাওয়ার শক্তিতে? এই প্রশ্নের মধ্যেই রূপক গল্পের মাজেজা কিছুটা ঠাওরে আনা যাবে। [বোরহেস, যিনি আধুনিক যুগের লেখক হয়েও গল্পের আদি কাঠামো – অর্থাৎ রূপকগল্প বলা আয়ত্ব করেছিলেন – অক্সফোর্ডে এক বক্তৃতায় এ বিষয়ে একটি মূল সূত্রের অবতারণা করেন। বোরহেসের মতে স্বাদ বা সোয়াদ আপেলের মধ্যে নাই, এমনকি মানবের মুখেও তার হদিস পাওয়া যাবে না। সোয়াদ সুনির্দিষ্টভাবেই কামড়ে বিদ্যমান। এই হচ্ছে স্বত্বা ও স্বত্বা জাগানিয়া রস আস্বাদনের কাঠামো। দেহজ ও বৈদেহী যে অনুপ্রেরণা- অর্থাৎ গল্প থেকে যে ভাব-ভাবুকতা যাউৎপাদনের সূত্রে দেহ দেহের অধিক মর্মের দ্বারে পৌঁছায়- সবই কামড়ের সূত্রে ঘটে।
আমরা কথায় কথায় বলি, অমুকের অমুক লেখাটিতে কামড় বসাতে কষ্ট হলো। যা লেখক তথা ভাষ্যকার বলছেন, তা পাঠক বা শ্রোতা নিতে পারছেন না। রূপক কাহিনী পাঠ করা বা শোনার পর এ মন কথা বলতে শোনা যায় না। কারণ রূপক কাহিনীর কাঠামোতে একটি বিষয়ের অবতারণার মধ্যে দিয়ে অপর একটি বিষয়কে আলোকিত করার মৌলিক একটি ধারণা স্পষ্ট। অর্থাৎ রূপক তা-ই যার অর্থ গল্পের বর্ণনায় গর হাজির- যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামাজিক প্রেক্ষিতে, এমন কি আজকের দিনে ব্যক্তিগত মনকাঠামোর ওপর নির্ভর করে অর্থ উৎপাদন করে। এখানে অর্থ তৈরীতে আধুনিক মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানবা আধুনিক সাহিত্যতত্ত¡ হয়তো সাহায্য করতে পারে। আবার অর্থ উৎপাদনের সহজ রাস্তা ভুলে প্রবেশ করতে পারে অচেনা ময়দানে। আধুনিক বিদ্যার বৈভবের আলো অনেক ক্ষেত্রে তাৎপর্য হরণকারী বর্ণনা উৎপাদন করতে পারে। যেমন ইঙমার বার্গম্যানের খোদার অনুপস্থিতি কেন্দ্র করে যে ট্রিলজি তার একটি ‘দি সাইল্যান্স’। এতে নাৎসী বাহিনীর বিশাল এক ট্যাঙ্ক একটা সরু গলিতে জোরপূর্বক প্রবেশ করার দৃশ্য রয়েছে। সাইকো এনালিসিসের সূত্রে কেউ কেউ এই দৃশ্যে নাৎসী ট্যাঙ্ক ‘ফেলিক’ প্রতীক হিসাবে অনুবাদ করেন। এক লেখক প্রশ্ন তুলেছেন ট্যাঙ্কটিকে সরাসরি আগ্রাসনের প্রতিনিধি হিসাবে দেখবার অন্তরায় কোথায়?
মোদ্দা কথা হলো, গল্প বলার ও গল্প শোনার স্বাভাবিক ও আদি একটি ফ্রেম আছে যাকে পুনরায় সামনে হাজির করতে পারলে অর্থ বা তাৎপর্য নির্মাণ বা মর্ম উদ্ধারের ‘সহজ’ প্রক্রিয়াটি সহজে বোঝা যাবে। আদি অভিধাটি হয়ত অনেকের কাছে, বিশেষ করে আধুনিকদের কাছে তেমন কোন তাৎপর্য বহন করে না, কারণ জ্ঞানের প্রশ্নে আত্মজ্ঞান বাদ দিয়ে জ্ঞানকে বস্তুমুখী ও উপযোগিতামুখী করে তোলা প্রগতিবাদীতার মৌল প্রকল্প। আধুনিকতার আওতায় গড়ে ওঠা এমত বিজ্ঞানবাদীতার বিপরীতে সকল প্রকার সৃষ্টির একত্রের ধারণা হলো আদি ধারণা। গল্প শোনা ও তার আস্বাদ গ্রহণ ঘটনাটি যে কামড়ের মধ্যে চিহ্নিত করা গেলো, এটি স্বাদ লওয়ার আদি ফ্রেম। এমন কথার মধ্যে মানব সত্য, যা অবস্থাগত সত্য, ও বস্তু জগতের একত্রের ধারণার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।
এতোসব কথা ভাঁটফুলসূত্র নামের এক ই-সাময়িকীর সূত্রে বলা গেল। ভাঁটফুলসূত্রের ফাল্গুন ১৪১৭ বা ফ্রেরুয়ারি ২০২১ সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে ‘প্যারাবল বা রূপক কাহিনীর থিম কেন্দ্র করে। প্যারাবল কেবল সোজাসাপ্টা রূপক কাহিনী নয়, এতে মরাল বা নৈতিক শিক্ষা একটি মৌল উপাদান। তবে, রূপক কাহিনী নিয়ে যে যে ভাবনার ওপর আলো ফেলা গেল, তার ভিত্তিতেই নীতিকাহিনীর সার ও শরীর বিষয়ে কথা বলা জায়েজ হবে ধারণা করা যায়।
নব্য শতকে ই-সাময়িকী ছাপাখানার জায়গা দখল করে নিয়েছে। ভাঁটফুলসূত্রের জন্ম যদিও বেশী দিনের ঘটনা নয় – নীতিকাহিনীর সংখ্যাটি তৃতীয় সংখ্যা।
শুরুতে ঘোষণা রয়েছে এই পত্রের কোন সুনির্দিষ্ট বা চেনাজানা গন্তব্য নাই। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডিরেকশনাল, কোন গমন নেই । কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বাক্যের শুরুতেই বলা হয়েছে- ‘ভাঁটফুলসূত্রের কোনো ধ্রুবতারা নেই। অর্থাৎ কোন ‘মাস্টার’ এমনকি ‘মাস্টার ডিসিপ্লিন’বা ‘মতবাদ’ অগ্রাহ্য করে কয়েকজন লেখক একত্রে এই মার্গহীন কথা-গল্প-কবিতার স্বর্গ গড়ে তুলেছেন। প্রাককথন আছে কিন্তু কে কথা কইল তার হদিস নাই। নাম অনুল্লেখ থাকা অস্বস্তিকর- হয়তো মার্গ হতে দূরে থাকবার বাসনার অংশ এটি।
ভাঁটফুলসূত্রের তৃতীয় কিস্তির প্রথম ভাগ প্যারাবল নামে উপস্থাপন করা হয়েছে, দ্বিতীয় ভাগে আছে প্রবন্ধ, যদিও ঠাঁই পেয়েছে একটিমাত্র লেখা। তৃতীয় পর্বে রয়েছে অনুবাদ প্যারাবল ও পরপর আরো তিনটি পর্বে কবিতা, গল্প ও শিল্পকর্ম উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভাঁটফুলসূত্রের চতুর্থ সংখ্যায়ও তৃতীয় সংখ্যার ছায়া পড়েছে। বিষয় হিসাবে প্যারাবল বা রূপককাহিনী বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ ও প্যারাবল শিরোনামে একটি পর্ব এতে যুক্ত হয়েছে। প্রবন্ধটি দীর্ঘ এবং এতে নানান অনুষঙ্গে রূপককাহিনীর চরিত্র তুলে ধরেছেন লেখক মাজহার জীবন। ‘প্যারাবল: বিন্দুর ভেতর সিন্ধু দর্শন’শিরোনামের প্রবন্ধটি অন্ধের হস্তি দর্শন বিষয়ক প্রচলিত প্যারাবল দিয়ে শুরু হয়ে এর নানান মাত্রা পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে এর ধর্মীয় ও আধুনিক ব্যবহার বিষয়ে পাঠককে সজাগ করে তোলে। অপরদিকে প্যারাবল পর্বে মনিরা রহমান ও রফিক জিবরানের প্যারাবল ছাপা হয়েছে। প্রথমজন গদ্য-চালে প্যারাবলের কাঠামো গড়েছেন, দ্বিতীয় লেখক কাব্যিক হবার প্রয়াস পেয়েছেন, অর্থাৎ গদ্যের মধ্যেই তিনি কবিত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। ভাষার সৌর্ন্দয্য বা নান্দনিকতা থেকে দূরে থেকে জীবনের নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হবার তাগিদে ভাষায় যে মেদহীনতা গড়ে ওঠে প্রচলিত প্যারাবলের জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করে, এমন কোন প্রক্রিয়ার সূত্রে এই প্যারাবলগুলো লেখা হয় নাই। যাহোক, ভাঁটফুলসূত্রের তৃতীয়সংখ্যা যেহেতু প্যারাবলকে বিষয় হিসাবে গণ্য করে গড়ে তোলা হয়েছে, সেই আর্কিটেকচারে প্রথমে ঢু দেয়া যাক।
ভূমিকায় ‘প্যারাবল সাহিত্যের এক প্রাচীন পরম্পরা’, এবং এই ‘পরম্পরায় যুক্ত হয়ে পাঠকের সনে সখ্য গড়ে তুলতে চায় এর লেখকরা’, এমন ঘোষণা থাকলেও রফিক জিবরানের লেখা পাঠকের কাছে সহজে জানালা-দরোজা খুলে ধরে না। প্রথম দুটি ছোট লেখা- ‘মধুপুর’ ও ’নআমা হিচুইয়ের শিল্পদর্শন’- যদি কাব্যিক বিচারে লঘু চালের হয়, তবে ‘দুটি প্রশ্ন’ ‘রামনি পঙ্খি’ ও ‘গন্তব্য’সভ্যতা, সত্তা এবং জীব ও জীবনের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে ভাবুকতা বিষয়ক।
রফিক জিবরানের ‘দুটি প্রশ্নে’যে ‘চিন্তাপার্থক্য’তিনি সেমেটিক ও মিশরীয়দের মাঝে লক্ষ্য করেছেন তা ভাষাগত কাব্যিকতার কারণে যথেষ্ট অস্পষ্ট। তবু, লেখকের পক্ষপাত যে মিশরীয়দের অনন্ত ‘আনন্দে বিহার’ করবার ক্ষমতার প্রতি তা অনুমান করা যায়। তাঁর নআমা হিচুইয়ের কাহিনীতে ‘বাস্তব-পরাবাস্তব দেয়াল- দালি, পিকাসো, মাতিসের রঙ ও রেখার বাঁধন পেরিয়ে জালালউদ্দীন রুমির গোলাপ বাগানে’, ‘অলৌকিক আনন্দ’ পাওয়ার খবর, মিশরীয়দের ক্ষমতা-কেন্দ্রীক শাসন ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নয় বলে ঠাওর হয়। যদি সভ্যতাতত্ত্ব দিয়ে দেখা যায় তবে পাশ্চাত্যের ধন ও আনন্দ ও প্রাচ্যের ধন-চুরি যাওয়ার কাহিনী এখানে প্রনিধানযোগ্য। কারণ ভারত, আফ্রিকা ও আমেরিকার ভূমিদখল ও সম্পদ চুরি না করে পাশ্চাত্যের অগাধ আনন্দের বাগান যেমন তৈরি করা সম্ভব হয় নাই, তেমন মিশরীয় ক্ষমতাকাঠামোর মাথায় বসে যারা মৃত্যুর পরও ঈশ্বর হয়ে থাকবার বাসনায় পিরামিড গড়েছেন দাসশ্রমের ভিত্তিতে, তাদের অফুরান আনন্দও মানবের মানবিক আচরণের ফল নয়। অন্যদিকে রুমির আত্মতত্তের সূত্রেও গোলাপে কাটা বিদ্যমান। আলো দেহের ক্ষতের মধ্যে দিয়ে সত্তাকে সজাগ করে- এমন বাক্য বিংশ শতকের কবি এমনকি গানের মহাজন লেনার্ড কোহেনকেও ভাবিয়েছে। ÔThe wound is where the light gets in’ তাই আজো ভাবুকের খোরাক।
ভাঁটফুলসূত্রের প্রবন্ধ পর্বে বদরুজ্জামান আলমগীরও একই সূত্রে ভিন্ন চিত্রকল্প হাজির করেন। ‘পুড়ে ছিদ্র হয়েছে বলে বাঁশির সুরে আমাদের মনে এমন জোয়ার ভাটা ও চন্দ্রকলা লাগে।’এমন আপ্তবচন রফিক জিবরানের বাগানেও ফলেছে- তবে তা অনেক ক্ষেত্রে পাঠককে খুঁজে বের করে নিতে হবে। যেমন – ‘কোথায়ও যাওয়া হয় না, কেবল স্থানান্তর ছাড়া’ কিংবা ‘অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যবিন্দুতে অদৃশ্য এক বর্তমান ক্রমাগত দূরে সরে যায়’ – এসবই দার্শনিকতার দিকে নির্দেশ করে। ‘গন্তব্য’ নামের এই অনু-আলেখ্যে যদি এমত দার্শনিকতার আঁচ স্পষ্টতর, তা এ কথাই জানান দেয় যে লেখক চিন্তক বটে, তার ভাষার দরদালানের কাঠামোতে অহেতু কিছু গুঞ্জন হয়তো দূরে ঠেলে দিতে পারলে, মর্মই কাঠামো হয়ে ধরা দিবে। এমন মেদহীনতা তাঁর ‘দুটি প্রশ্ন’-এর কাঠামোতে লক্ষ করা যায়। এর সমাপ্তি পর্বে শেষ না হয়ে যাবার যে ভাব ফুটে ওঠে তা প্যারাবলের শক্তি। লেখক লিখছেন: ‘স্বর্গের গেটে হ্যাঁ ও না-এর মাঝখানে কোন উত্তর হবে না! হয় হ্যাঁ নয়তো না। আমি কী বলবো?’
বদরুজ্জামান আলমগীর যে প্রবন্ধের খাঁচা নির্মাণ করেছেন তা ব্যতিক্রম এক কাঠামো। ‘আয়নার ভিতর ময়না যে আছে’ লেখাটিকে তিনি এমন গড়েছেন যেন মন্তব্য বা বক্তব্যপথে গমন না করে, তা নিজেই এক গল্পের আধার হয়ে ওঠে।
কাজাখস্থানের একটি লোকগাথা দিয়ে পাঠক এই লেখায় প্রবেশ করার সুযোগ পায়। নাপিত চুল কাটতে গিয়ে রাজার মাথায় যে শিং দেখে ফেলেন তা গোপন রাখতে রাখতে তার পেট ফুলে ওঠে। অবশেষে এই মুসিবতের বা মুশকিলের আসান হয় এক জঙ্গলেরভিতর ইঁদারা বা কুয়ায় যে মনুষ্য অবয়ব দেখতে পায় তাকে রাজার মাথায় গরুর শিং এই সত্য বলে দিয়ে নাপিত তার স্বাভাবিক পেট ফিরে পায়।
এই গল্প প্রমাণ যে, যা আধুনিক মননে শিক্ষামূলক বলে দাবী করা যায়, তেমন বিশ্লেষণী প্রতিভা বা বর্ণনার মধ্যে দিয়ে এই প্যারাবল মানুষের মেধা বাড়াবার ভার নেয় না। বরং সত্য বলার মধ্যে দিয়ে এটি শিক্ষার এক চিরন্তন দিক তুলে ধরে। দেহ ও মনের যে সম্পর্ক, মনের অবস্থা যে দেহে উপসর্গের জন্ম দেয়- এসব বিষয়ে আধুনিক সাহিত্য কোন সত্য বলতে চায় না, কেবল বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে চায়। মনোদৈহিক দশার কোন সুরাহা বিষয়ে আধুনিকেরা উৎসাহী হয় নাই। আধুনিকতা এই অর্থে তৃষিতের কষ্ট নিয়ে কথা বলে, তৃষ্ণা বিষয়ে মারিফা, বা উচ্চমার্গীয় জ্ঞান উৎপন্ন করে, কিন্তু কোন ফায়সালার দুয়ারে কড়াঘাত করার চেষ্টা করে না। কৃতবিদ্য বাঙালি আধুনিক কুট রচনাভঙ্গি গ্রহণ করেছেন, কিন্তু বদরুজ্জামানের ভাষা ধার করে বলা যায়, চক্ষুষ্মানের দেখা যে অর্ধেক আধুনিক সাহিত্যে তার হদিস বিরল। দৃশ্যমানতা যে দৃশ্যহীনতা – এই দুয়ের মধ্যস্থতায় যে জগতের সত্য পূর্ণরূপে ধরা দেয়, এই কথা লেখক তাঁর একজন অন্ধ বুদ্ধের সাথে আরেকজন অন্ধ বুদ্ধের দেখা হওয়ার পর যে দেখার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার কাহিনীর মধ্যে দিয়ে বলেন। লেখক কাহলিল জিবরানের অন্ধ জ্যোতির্বিদের উদাহরণও টানেন – যিনি বুকে হাত রেখে দুষ্পাঠ্য জগৎ পাঠ করতে পারেন। [তবে, নীতিশিক্ষায় বা নৈয়ায়িক শক্তির বিকাশে ধর্মীয় রূপক কাহিনীর বিকল্প নাই। আশরাফের ক্ষমতা ও সংস্কৃতির বিপরীতে যেমন আতরাফের পক্ষে স্রষ্টার সমতা-নির্ভর সংস্কৃতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে অবতার বা নবীরা শ্রেণিকেন্দ্রীক ক্ষমতা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস পান। যদিও ভাঁটফুলসূত্রের ৩য় সংখ্যায় ঈসা নবীর মসীহ খেতাব মশীহ ও মসীহ এই দুই রকমফের দেখা যায়। রুবাইয়াত রিক্তার অনুবাদে ফ্রানৎস কাফকার ‘মশীহ’র আগমন’ নামের প্যারাবলে এমন ব্যত্যয় লক্ষণীয়। তবে, ভাবের ব্যত্যয় এতে ঘটে নাই। বরং আধুনিক ইউরোপীয় প্যারাবলে ভাবের ব্যত্যয় লক্ষণীয়। যেমন ‘মশীহ’র আগমন’ এ হেঁয়ালীর মাত্রাটি ধর্মীয় প্যারাবলে বিরল। ‘মশীহ যখন আসবেন… তিনি আসবেন, শেষ দিনে নয়, কিন্তু একদম শেষে… ।’ এমন হেঁয়ালির পিছনে গূঢ় অর্থ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে, এমন নয় যে, অর্থের দূয়ারে যাওয়ার সোপান তৈরী করে দেওয়াই গল্পকারের কাজ। বরং অনেক ধর্মীয় গল্পে ধাঁধাঁর উত্তর খুঁজে নিতে গিয়ে এখনও দার্শনিক প্রজ্ঞার জন্ম দিয়ে চলেছে। বাইবেলে উল্লেখিত গুড সামারিটানের কাহিনী তুলনামূলক সোজাসাপ্টা অর্থ তৈরী করে কোন ধন্দ কিংবা হেঁয়ালির আড়াল ছাড়াই। এতে যিশুর মর্মবাণী খুব সহজে ধরা দেয়। উচ্চমার্গের ধর্মচারী হওয়ার কারণে যখন দুজন ব্যক্তি সহজেই এক আক্রান্ত, আহত আগুন্তককে সেবা না দিয়ে হেঁটে চলে যান, তখন সামারিটান গোষ্ঠীর এক ব্যাক্তি এই অচেনা বিপদগ্রস্ত লোকটিকে সেবাশ্রুশ্রষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। গল্পটি অপরকে আপন করে ভাববার অনুপ্রেরণাদায়ী কাহিনী হিসেবে যেমন পাঠ করা যায়, তেমন সমাজে যার স্থান নাই এমন মানুষের মধ্যে যে মহৎ কর্ম করার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, তার দিকেও নির্দেশ করে। এমন অনেক গল্পই মানুষের চোখ খুলবার উপলক্ষ্য তৈরী করে। আদম-হবার জ্ঞান-বৃক্ষের ফল খাওয়ার ঘটনা ও ভাষা বা জ্ঞান অর্জন পরবর্তী জীবনের শুরু কিংবা কোরানে উল্লেখিত নবী ইব্রাহিম ও তাঁর পুত্র ইসমাইলের উৎসর্গের কাহিনী- যা বাইবেল থেকে যথেষ্ট ভিন্নমাত্রার – এমন সকল রূপক ও নৈয়ায়িক কাহিনী নানান ব্যাখ্যার সূত্রে এখনও সাম্প্রতিক সমাজ ও সমাজমানস বিষয়ক আলোচনায় কাঠখড় যোগান দিয়ে যাচ্ছে। দার্শনিকদের মধ্যে হাজি ক্যানান তাঁর ‘দি এথিকস অব ভিজুয়ালিটি’নামের বইতে ইহুদী ও খৃষ্টীয় গল্পের দ্বারস্থ হয়েছেন, অন্যদিকে রেনে জিরার্ড তাঁর সারা জীবনের গবেষণায় ধর্মীয় মিথের জ্ঞানের আলোয় মানব সভ্যতা ও সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্ত্রাস ও স্কেপগোটের ধারণা বিষয়ে সারাজীবন বই লিখে গেছেন।
ভাষান্তরিত রূপক কাহিনীসূত্রে ভাঁটফুলসূত্রের এই সংখ্যা সাধু হয়েছে। ভিড়ের মধ্যে পরিচিত মুখ যেন এইসব রচনা।
৩য় সংখ্যার দূর্বলতম পর্ব হলো এর কবিতাংশ। এতে থৈ পাওয়ার মতো মৌলিক বা খাটি বস্তু নাই। স্থায়ী মননের খোঁজ তো আরো পরের হিসাব। স্থায়ী মনন মানুষ ও জীবন বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্নের অবতারণা করে মনের মধ্যে এসবের সমাধান খুঁজে বের করার তাড়না জারি রাখে। কবিতাপর্বের আধুনিক কবিতা গুলান এর বিপরীতে দ্বিবিধ তলে বিরাজ করে – ভাষার বল্কল ও চাক্ষুষ বাস্তবতা। ব্যতিক্রম হলো রুমির তিনটি অনুবাদ কবিতা যাতে কাল্পনিক প্রেমিক মজনু ও তার মিউজ লাইলিকে উপলক্ষ্য করে মানুষকে কিছু সত্যের সামনে দাঁড়া করিয়ে দিয়েছেন এই সাধক-কবি।
গল্পের চাকে যা ভনভন করছে ভাঁটফুলসূত্রের ৩য় সংখ্যায়, সেখানেও অনুবাদ গল্পই অধিক সম্ভ্রম জাগায়। ‘প্রণয়’, যার প্রণেতা সাদাত সায়েম, তাঁর অস্তিত¦বাদী অধিবিদ্যা তিনি সুফি কান্তিবিদ্যা বা সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে হাজির করেছেন। গল্পটি সাদাত সায়েম ইংরেজিতে লিখেছিলেন। তর্জমার দায়িত্ব সার্থকতার সাথে পালন করেছেন ইশতিয়াক ফয়সল। ‘লাভ নামের এই গল্পটি লেখকের প্রকাশিতব্য ‘ডিসগ্রেস এন্ড আদারস্’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত। যে সুফি কান্তিবিদ্যার কথা পাড়া হলো তা প্রেমের অপ্রতিরোধ্য শক্তির পাশাপাশি এর লাস্য, মাধুর্য ও কান্তি যে দেহ-মন-দুনিয়ার চরিত্রে প্রভাব ফেলতে সক্ষম এমন প্রত্যয়ে হাজির আছে। প্রেমসঞ্জীবনী নামে এক কাল্পনিক বস্তু ও তার বিক্রেতার বিশেষ এক ব্যক্তিত্ব নির্মাণের মধ্যে দিয়ে প্রণয় গল্পে ভালোবাসার সুবাতাস বইছে – হয়তো এর কিছুটা আমাদের সকলের প্রয়োজন আজ। মহামারির মধ্যে বেঁচে থাকার নতুন শব্দবীজ দরকার নেই, কায়ার মধ্যে কবি জীবনানন্দ যাকে ‘বৈদেহী পবিত্রতা’তার জন্ম কয়েকটি ভাবউদ্দীপক আবেগই যথেষ্ট প্রণোদনা – প্রেম, যা লেখকের এই রহস্যময় চরিত্রের ভাষায় ‘হৃদয়কে পুড়িয়ে পুড়িয়ে সোনায় পরিণত করে’।এই সূত্রেই লেখকের জীব ও জীবন বিষয়ক তত্তে¡ ভালোবাসার রহমত তার দুনিয়াদারীতে বাগানবিদ্যার অনুপ্রবেশ ঘটে। সঞ্জীবনী বিক্রেতার মুখে গল্পের প্রোটাগনিস্ট এই তত্তে¡ প্রথম কান দেন – প্রাণীজগতের আনন্দবেদনাও অনুভব করতে পারবেন। শুনতে পাবেন উদ্ভিদের হাসি-কান্না। গল্পের শেষে যে আপ্তবাক্যের পুনরাবৃত্তি লক্ষণীয় তা এমন: ‘প্রেম কোন যুদ্ধ নয়, স্যার। মানে যুদ্ধ আর প্রেমকে আপনি একই বাক্সে রাখতে পারেন না। এমনকি যুদ্ধেও আপনি যা খুশি তা করতে পারেন না।’ আমিন।
প্যারাবল জীবনের এক প্রকারের নেকটার বা অমৃত আস্বাদনের স্বাদ দেয়। ফলে নৈতিক শিক্ষার বাহন হওয়া সত্তে¡ও এর আবেদন আধুনিক সাহিত্যের তুলনায় অনেক বেশি উচ্চতর। ধর্মতত্ত¡ থেকে শুরু করে গণরুচির পর্যায় পর্যন্ত এর ক্ষুদ্র অথচ শক্তিশালী কাঠামের ভিতটি বিস্তৃত। এর সম্মোহনী শক্তিটির ব্যাখ্যায় বোর্হেসের আপেলে ও কামড় বিষয়ক তত্ত¡ই সবচেয়ে লাগসই। সমাজের মধ্যে যে ক্ষুধা তা মিটাবার জন্য ক্ষমতাধর যে নবী, কথক বা ভাষ্যকার, কিংবা গল্পকার যে ফল জোগান দেন তাতে কামড় বসাতে তেমন কসরত দরকার পড়ে না, লাগে ‘প্রণয়’- যে প্রেম আসিক-মাসুকেরে একবৃত্তে ধরে রাখে, এমন জনগোষ্ঠীর মানস বা অচেতনকে ব্যাক্তির চেতনের মধ্যে অথবা ব্যাক্তির চেতনকে গোষ্ঠীর নিঃশ্চেতনায় পর্যবেশিত করে। এমন জাগতিক স্থানান্তরণ হয়তো বিমূর্ত বা মহাজাগতিক কোন সূত্রই হয়। ভাঁটফুলসূত্রের চতুর্থ সংখ্যায় মাজহার জীবন যখন লেখেন ‘প্যারাবল সুনির্দিষ্ট মূর্ত ঘটনা বর্ণনা করে যার মাধ্যমে বিমূর্ত যুক্তি পাঠক সহজে বুঝতে পারে।’ মহাজাগতিক অভিধার ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে যা নির্দেশ করবার চেষ্টা করা গেল, তা শুধু বিমূর্ত যুক্তি নয়। বরং যুক্তির ধর্মের চাইতে এতে বোধের ক্রিয়া বেশি প্রযোজ্য। আরেকটু আলো ফেলতে আমরা বাইবেলে বর্ণিত নবী ইসায়ার প্রতি খোদার নির্দেশ থেকে কিছুটা সজাগ হয়ে উঠতে পারি। হয়তো দুনিয়ায় চোখ রেখে, কান পেতে এর গতিপ্রকৃতি যে বুঝতে পারা যায় না, এ বিষয়ে আমরা আরো সচেতন হয়ে উঠব। ইসায়ার কাছে নির্দেশটি এমন – যাও, তোমার জনতাকে বল যে তারা শুনবে কিন্তু বুঝতে পারবে না, দেখবে কিন্তু অনুধাবন করতে পারবে না। অর্থাৎ সত্য অনুধাবনে কেবল শোনা আর দেখাই যথেষ্ট নয়, নিরাবরক কোন এক কাঠামো আছে যার মধ্যে দিয়ে সত্য অবয়ব পায়। প্যারাবল এমনই এক অবয়ব।
প্ল্যাটোর বহুল আলোচিত গুহা-তত্ত¡ এই প্রেক্ষিতে স্মরণে আনা যায় – মানুষ বাস্তবতা বলে যা খেয়াল করে, তা আসলে একটা গুহার অভ্যন্তর থেকে দেখা গুহামুখের আলোর বিপরীতে ছায়া মাত্র। আলোর উৎস সন্ধানীরই রূপককাহিনীর ভাষা, অভিব্যক্তি ও সহজিয়া কাঠামো- অর্থাৎ নিরাবেগ স্থাপত্যে¡র- জন্ম দিয়েছেন। আধুনিক সাহিত্যে বোর্হেস এমত নবুয়তীর শ্রেষ্ঠ সূত্রধর।
পরিশেষে বর্তমান বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে অনলাইন তৎপরতার পক্ষে দুটি কথা বলা জায়েজ বলে মনে হয়। ছাপাইকৃত বই ও সাময়িকীর পক্ষে থাকার বহুবিধ কারণ চিহ্নিত করা যায়, বলা যায় যে সয়ংক্রিয়তা মানব কায়ার পক্ষে তেমন জুতসই নয়। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে, বিশেষ করে মহামারীর এই চুড়ান্ত অবস্থায় অনলাইন তৎপরতার বিকল্প নাই। ভাঁটফুলসূত্রের আগামী সংখ্যার অপেক্ষা করে এই লেখার সমাপ্তি টানা যাক।