কবিতার অনুবাদ : প্রসঙ্গত কিছু কথা। স্বপন নাগ

0

কবিতার অনুবাদ : প্রসঙ্গত কিছু কথা
স্বপন নাগ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি লুইস গ্লাক। নামটি আজ বিশ্বপরিচিত। বিশ্বনন্দিত। বাঙালি পাঠকও জানেন, ‘অসামান্য কাব্যকন্ঠ ও নিরাভরণ সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে ব্যক্তিসত্তাকে সর্বজনীন করে তোলার জন্য’ ২০২০ সালে কবিকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে এ খবর আজ প্রায় সর্বজনবিদিত। মূলত আমাদের সাহিত্যতৃষ্ণার তাগিদেই আমরা ইতিমধ্যেই তাঁর কবিতা, তাঁর কবিতাকে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা খুব সহজেই পড়ে চলেছি। খুব সহজেই, কেননা যারা ইংরেজি জানেন, তারা পড়ছেন মূল ইংরেজিতে ; অন্যেরা বাংলা অনুবাদে। এভাবেই তো আমরা পেয়েছি শেক্সপিয়ার, শেলী, কীটস্, ওয়র্ডসওয়ার্থ, ল্যাংস্টন হিউজ়, টি. এস. এলিয়ট প্রমুখদের মহান সৃষ্টিসমূহ। কিন্তু রমা রোলাঁ, রসুল গামজা়তভ, ম্যাক্সিম গোর্কি, লু শ্যুন, জাঁ পল সার্ত্রে … এঁদের সৃষ্টি ? ক’জনই বা জানেন রুশ, ফরাসি, চিনা বা জার্মান ভাষা ! ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সব রচনার স্বাদ নিতে আমাদের শরণ নিতে হয়েছে অনুবাদের। অনুবাদ ছাড়া না-জানা ভাষার সৃষ্টির আস্বাদন একেবারেই অসম্ভব। তাই অনুবাদের হাত ধরেই সেই ভিন্ ভাষাটি বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে চলে আসছে বাঙালি পাঠকের কাছে। বাঙালির চিরকালীন সাহিত্যপ্রীতির তাগিদেই সেই ভিনভাষী কবি-লেখকও তার সংগ্রহে অন্তর্ভুক্তি পাচ্ছেন।

আমাদের একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ব জুড়ে পঠিত হয়েছেন মূলত অনুবাদের মাধ্যমেই। ফলে, অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকা সঙ্গত নয়। প্রশ্ন থাকতে পারে, অনুবাদে কি সেই আস্বাদন পাওয়া যায়, যা আছে মূলে ? এ বিষয়ে এর আগে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আলোচকের মতে, অনুবাদ সব সময় মূলের স্বাদ দিতে পারে না। এক্ষেত্রে দুটি ভাষার মেজাজ ও প্রয়োগ-বৈচিত্র্যের ভিন্নতা কখনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেক ভাষার শব্দের নিজস্ব যে আবেদন, অনূদিত ভাষার শব্দে সেই একই আবেদন প্রকাশে কখনো সখনো আড়ষ্টতার একটি জাল সৃষ্টি করে, যাতে মূল থেকে মৃদু সরে আসার প্রবণতা তৈরি হয়।সেরকম ক্ষেত্রে অনুবাদকের দরকার হয় আরও একটু স্বাধীনতার ; দরকার হয় ভাষানুবাদের পরিবর্তে ভাবানুবাদের। সেই স্বাধীনতার বলেই অনুবাদক তখন কোনো শব্দের সংযোজন অথবা বিয়োজন করে নেন। সফল অনুবাদক তিনিই, যাঁর অনুবাদটি যত মূলের কাছাকাছি হয়। অর্থাৎ মূলানুগ হবার প্রচেষ্টাই একজন দক্ষ অনুবাদকের লক্ষ্য। এই মূলের কাছাকাছি মানে তার শব্দে, তার বাক্যগঠনে, তার কাব্যভাষায়। এত সব সত্ত্বেও কোনো কোনো কবিতা অনুবাদের সময় দুরূহতা সৃষ্টি করে মূলত দুটি ভাষার মেজাজের ভিন্নতা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা অনূদিত হয় যে সাবলীলতায়, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সেই সাবলীলতা অর্জন তত সহজ নয়। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ (বনলতা সেন) এই শব্দবন্ধের আবেদন ও অভিঘাত অন্য কোনো ভাষায় অনূদিত হওয়া, এবং একইরকম আবেদন ও অভিঘাতে প্রকাশ করা এক প্রকার অসম্ভব। অনুবাদে কবিতার বক্তব্য অটুট রাখা গেলেও, কখনো সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে উপমা এবং অনুষঙ্গের ব্যবহারকে অক্ষুন্ন রাখা। আল মাহমুদের ‘নাড়ার অবিরাম দহন’ (কবিতা এমন) কি অনুবাদে স্পষ্ট করা সম্ভব ? সম্ভব কি ‘লক্ষ্মীর পাঁচালী’-র জার্মানি অনুবাদ ? আমার এক হিন্দিভাষী কবিবন্ধু একটি বাংলা কবিতার হিন্দি অনুবাদ করতে গিয়ে ‘সতীপীঠ’ শব্দটির মানে জানতে চেয়েছিল। বলেছিলাম, কিন্তু আমার সেই বন্ধু অনুবাদে শেষমেশ সেই কবিতার নির্বাচনকেই বাতিল করে দিয়েছিল।

সব কবিতাকেই translated form এ লেখা যায় নিশ্চয়ই। শেষ অব্দি সেটি ভাষান্তরিত একটি লেখা হয়ও বটে, কিন্তু তা সর্বদা কবিতা হয়ে ওঠে না। কবিতার অনুবাদ করতে গেলে অনূদিত subject টি তর্জমাকৃত ভাষায় কবিতা হল কী না সেদিকে নজর রাখাও তাই একজন অনুবাদকের অবশ্যকর্তব্য। সেকারণেই কবিতার অনুবাদ করতে গেলে অনুবাদককে কবি অথবা কবিতার সমঝদার হওয়া অত্যন্ত জরুরি। একটি সনেটের অনুবাদকে অবশ্যই সনেট হতে হবে। ত্রিওলে কিংবা লিমেরিক — অনূদিত হয়ে নিখুঁত ত্রিওলে বা লিমেরিক ফর্মে পরিবেশনই একজন অনুবাদকের কাজ। একইভাবে পংক্তি-প্রান্তিক মিল সমন্বিত কোনো কবিতার অনুবাদেও সেই মিলকে বজায় রেখেই অনুবাদ করা দরকার। অন্যথায় কবিতার মাধ্যমে কবিকৃত সৃষ্টিপ্রয়াসটিকে অস্বীকার করা হয় এবং সেক্ষেত্রে অনুবাদকর্মটি চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ বলেই গণ্য হবে। এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এবং যাবতীয় শর্তকে মান্যতা দিয়ে একটি যথার্থ অনুবাদ তাই যথেষ্ট শ্রমসাধ্য একটি রচনা। ফলে সব কবিতাও অনুবাদযোগ্য হয় না।

আবার, কোনো একটি কবিতা যখন অনুবাদের অনুবাদ হয়, স্বাভাবিকভাবেই সেই অনূদিত কবিতাটি মূল থেকে বেশ খানিকটা সরে আসতে চায়। অনুবাদের অনুবাদ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, একটি কবিতা যেকোনো ভাষা থেকে প্রথমে ইংরেজিতে এবং পরে সেই ইংরেজি অনুবাদ থেকে আর এক অন্য ভাষায় অনূদিত হবার কথা। একটি কবিতার অনুবাদ করে অনূদিত লেখাটিকেও সেই ভাষার কবিতা করে তুলতে অনুবাদককে সাহায্য নিতে হয় ভাবের। ভাবানুবাদটি মূল কবিতার যত কাছাকাছি হয়, অনুবাদকের দক্ষতাও স্বীকৃত হয় ততই।

বক্তব্যটিকে স্পষ্ট করতে একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন, শেক্সপিয়ারের সনেটের অনুবাদ অনেক কবিই করেছেন। এখানে একটি সনেটের মূল এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন জন কবিকৃত অনুবাদ নিচে দেওয়া হল। একই কবিতা, অনূদিত হয়েছে একই ভাষায়ও। এর মধ্যে কোনটি ভালো, কোনটি তত-ভালো-নয়, তা দেখার জন্য নয়, দেওয়া হল অনুবাদের স্বার্থে কে কতটুকু স্বাধীনতা নিয়েছেন, তা লক্ষ্য করার জন্য

মূল কবিতা :
Sonnet 18 / William Shakespeare

Shall I compare thee to a summer’s day ?
Thou art more lovely and more temperate :
Rough winds do shake the darling buds of May,
And summer’s lease hath all too short a date;
Sometime too hot the eye of heaven shines,
And often is his gold complexion dimm’d ;
And every fair from fair sometime declines,
By chance or nature’s changing course untrimm’d;
But thy eternal summer shall not fade,
Nor lose possession of that fair thou owest;
Nor shall death brag thou wander’st in his shade,
When in eternal lines to time thou grow’st;
So long as men can breathe, or eyes can see,
So long lives this and this gives life to thee.

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ :

বসন্ত দিনের সনে করিব কি তোমার তুলনা ?
তুমি আরও কমনীয়, আরও স্নিগ্ধ, নম্র, সুকুমার :
কালবৈশাখীতে টুটে মাধবের বিকচ কল্পনা,
ঋতুরাজ ক্ষীণপ্রাণ, অপ্রতিষ্ঠ যৌবরাজ্য তার ;
অলোকের বিলোচন কখনও বা জ্বলে রুদ্র তাপে,
কখনও সন্নত বাষ্পে হিরন্ময় অতিশয় ম্লান ;
প্রাকৃত বিকারে, কিংবা নিয়তির গূঢ় অভিশাপে,
অসংবৃত অধঃপাতে সুন্দরের অমোঘ প্রস্থান।
তোমার মাধুরী কিন্তু কোনও কালে হবে না নিঃশেষ :
অজর ফাল্গুনী তুমি, অনবদ্য রূপের আশ্রয় ;
মানে না প্রগতি তব মরণের প্রগলভ নির্দেশ,
অমৃতের অধিকারী যেহেতু এ-পঙক্তিকতিপয়।
মানুষ নিঃশ্বাস নেবে, চোখ মেলে তাকাবে যাবৎ,
আমার কাব্যের সঙ্গে তুমি রবে জীবিত তাবৎ।

বিষ্ণু দে-র অনুবাদ :

তোমার উপমা আমি দেব নাকি বসন্তের দিনে ?
তুমি আরো রমনীয়, হিম-উষ্ণে আরো যে সুষম।
চৈতালির রূঢ় বায়ু হানা দেয় মাধবীবিপিনে,
বৈশাখের চুক্তিপত্রে দিনের মৌরুসী বড় কম,
থেকে থেকে আকাশের চোখ জ্বলে মহাপরাক্রমে,
এবং সুন্দর সবই সৌন্দর্য খোয়ায় কালক্রমে
দৈবে কিংবা প্রকৃতির রূপান্তরে রূপসজ্জাহীন,
আবার কখনো দেখি স্বর্ণবর্ণ ভয়ার্ত মলিন।
অথচ তোমার নিত্য বসন্তের নেই ক্ষয়রোগ,
তোমার রূপের স্বত্ব হাতছাড়া হয় না ভূলোকে,
মৃত্যুর ছায়ায় তুমি মৃত্যুর এ দম্ভের সু্যোগ
হবে না সেদিনও, যবে কালোত্তর হবে নিত্যশ্লোকে;
যতদিন মানুষের প্রাণ আছে, আছে দু’নয়ান,
ততদিন আয়ু এর, এ তোমাকে করে প্রাণদান।

মণীন্দ্র রায়ের অনুবাদ :

তোমার উপমা আমি দেব কি সে বসন্তের দিনে ?
তুমি যে সুন্দর আরো, তুমি আরো স্নিগ্ধ-কমনীয়।
বৈশাখী হাওয়ায় যতো মঞ্জুল মঞ্জরী ঝরে তৃণে,
বসন্তের সে দখল অস্থায়ী মেয়াদে স্মরণীয়।
কখনো বা মহাতেজে নভশ্চক্ষু সূর্যের প্রতাপ
কখনো সুবর্ণ কান্তি রূপ তার ঢাকে মেঘদলে,
প্রতিটি সৌন্দর্যে জেনো সুন্দরের ঘটে অপলাপ,
হোক সে হঠাৎ, কিম্বা, প্রকৃতির পদ্ধতি বদলে
কিন্তু তব বসন্ত যে চিরন্তন লাবণ্যে ভাস্বর,
হারাবে না কোনোদিন ও-সৌন্দর্য যা আছে তোমার
মৃত্যুরও বড়াই ভাঙে, পাবে না সে ছায়ার ভিতর,
যখন চিরন্তন কাব্যে বেড়ে ওঠে তব সারাৎসার।
যতোদিন এ সংসারে মানুষেরা বাঁচে, দেখে চোখে,
ততোদিন এ কবিতা, ততোদিনই তুমি তার শ্লোকে।

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর অনুবাদ :

তোমার তুলনা সে কি বসন্তের সমুজ্জ্বল দিন ?
তোমার মাধুর্য আর মৃদুলতা তাকেও হারায়।
ঝড়ের পুরুষ হাতে কুঁড়িদের অস্তিত্ব সঙিন,
কদিন যেতে না যেতে বসন্তের মেয়াদ ফুরায়।
কখনো কখনো দেখি আকাশের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর,
প্রায়শ দেখেছি তার সোনারঙ পান্ডুর, ফ্যাকাশে।
যা কিছু সুন্দর তাও চিরকাল থাকে না সুন্দর,
বিশ্বনিয়মের বশে, দৈবচক্রে, ম্লান হয়ে আসে।
অনন্ত বসন্ত নিয়ে তুমি কিন্তু বিবর্ণ হবে না,
যে রূপ এখন ধরো, তাই রবে নিত্য সহচর,
যমের ছায়ায় আছো হেন বাক্য যমেও কবে না,
যতো দিন যাবে ততো কবিতায় তুমি অনশ্বর।
যতোকাল মানুষের চলা-ফেরা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস
যতোকাল এ কবিতা, সে তোমার আয়ুর আশ্বাস।

সত্যপ্রিয় মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ :

বসন্ত কালের সঙ্গে তুলনা কি চলে গো তোমার ?
তুমি আরও রমনীয়, আরও বেশি অবিক্লব তুমি :
বসন্তের ফুলও ঝরে, বারংবার করে চুরমার
ঝড় তাকে — ক্ষণস্থায়ী তারও এই যৌবনের ভূমি।
কখনো প্রখর সূর্য ঢেলে দেয় দারুন আগুন,
অপূর্ব কাঞ্চনকান্তি জ্বলে যায় তীব্র অভিমানে ;
সুন্দর মাত্রই ম্লান ক্রমে ক্রমে — কালের কানুন,
প্রকৃতির পারিপাট্য ক্ষয়ে যায় — অর্বাচীনও জানে;
অথচ তোমার রূপ অনশ্বর, হবে না মলিন,
তোমার বসন্ত ঋতু পাকাপোক্ত, শাশ্বত ও স্থির।
করাল মৃত্যুও মৃত, পরাভূত সমাপ্তির দিন,
এ অমর পংক্তি হেতু — তুমি পাবে মৃত্যুঞ্জয়ী নীড়।
যতোদিন প্রাণ আছে, যতোদিন আছে নারী-নর,
ততোদিন তুমিও সত্য, ততোদিন তুমিও অমর।

অনুবাদ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার যে, অনুবাদের ভূমিকা শিল্প সংস্কৃতির অন্য ক্ষেত্রে তত গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা প্রায় অনস্বীকার্য। ফিল্ম বা নাটকে শিল্পীর শরীরী ভাষা, দৃশ্য-দর্শনের অনুভূতি পৃথিবীব্যাপী একই, অর্থাৎ সর্বজনীন ; সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তেমনই সুর-তাল-লয়। কিন্তু কবিতা ? রসাস্বাদনে যেখানে অনুবাদই বিকল্প হিসেবে অদ্বিতীয়। আর সে কারণেই সম্ভবত অমিতাভ বচ্চনের অভিনয়ের সঙ্গে যত পরিচিত বাঙালি, তত পরিচিত নন তাঁর পিতা কবি হরিবংশ রাই বচ্চনের কবিতা বা গীত-এর সঙ্গে।

এত ভাষার বৈচিত্র্য এই ভারতবর্ষে, না-জানা সে সব ভাষার কবিতার আস্বাদনেও তো অনুবাদেরই অনিবার্য ভূমিকা। তবু কী আশ্চর্যজনক ভাবে আমরা, বাঙালি পাঠকেরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে আছি। আমাদের আছেন রবি ঠাকুর, আমাদের আছেন কাজী নজরুল — এই অহংবোধে আমরা বন্ধ করে রেখেছি ঘরেরই লাগোয়া সবকটি জানালা। আন্তর্জাতিক সাহিত্যে আমরা আগ্রহ দেখাই, অথচ প্রতিবেশী সাহিত্যের দিকে ফিরেও তাকাই না। এই স্বেচ্ছা-উদাসীনতার কারণেই আমরা জানতেও পারি না — কী আর কেমন লেখালেখি হচ্ছে হিন্দিতে, ওড়িয়ায়, অসমীয়ায়। জানতে পারি না এ সময়ে ব্যতিক্রমী ভাবনায় তামিল ভাষায় কবিতা লিখছেন কোন কবি। কেমনই বা হচ্ছে গুজরাতি, মারাঠি কিংবা তেলুগুতে কাব্যচর্চা ! তেলুগু ভাষার কবি ভারভারা রাও-কে জেনেছি অন্য কারণে। মুক্ত কন্ঠস্বরের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসকের দমন প্রসঙ্গে জেনেছি কবি ভারভারা রাও-এর নাম। জেনেছি বছরের পর বছর জামিন মঞ্জুর না করে প্রবীণ অসুস্থ এই কবিকে জেলে ভরে রাখার কথা। পর্যাপ্ত অনুবাদের অভাবে জানতে পারিনি তাঁর কবিতাকে।

আমরা ইংরেজিতে বিক্রম শেঠ পড়ি, চেতন ভগত পড়ি, অমিতাভ ঘোষ পড়ি অথচ পড়তে চাইলেও কন্নড় অথবা মালয়ালম ভাষার লেখা পড়তে পাওয়ার সুযোগটি তেমন সহজলভ্য নয়। নয়, কেননা সে সব ভাষার বাংলা অনুবাদ হয়ই না প্রায়।

সেই আশির দশকের গোড়ায় কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘দেশের এক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অবস্থান নিয়ে অন্য অঞ্চলের কোনো সজীব কৌতূহল’-এর কথা, যা ‘মনের সৌন্দর্যময় এক স্বাস্থ্য।’ তারও আগে, এই নির্লিপ্তির দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী, ‘আমাদের সবচেয়ে বড়ো দূরত্ব আধুনিক নানা প্রদেশীয় প্রকর্ষ সম্বন্ধে আমাদের নিরুৎসক মন।’ উপায়ও বাতলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যকে বিচিত্র প্রতিষ্ঠিত প্রাণবন্ত করবার একটি উপায় তাকে সমসাময়িক ভারতীয় মৃত্তিকায় সংশ্লিষ্ট করা।’

আলোচনার শুরুতেই মার্কিন কবি লুইস গ্লাক এবং তাঁর কবিতার প্রসঙ্গ এনেছিলাম। এনেছিলাম এ সংশয় থেকেই — তবে কি অন্যান্য পণ্যের মত বাঙালি পাঠকের কাছে সাহিত্যেরও দেশি অপেক্ষা বিদেশির প্রতি ঝোঁক সহজাত ! প্রতিবেশী সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা আর আন্তর্জাতিক সাহিত্যের প্রতি এই আগ্রহ প্রসঙ্গেই প্রশ্ন তুলেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ, ‘বিশ্বপট যতখানি, আমাদের সাহিত্যের সামনে ভারতীয় পট কি ততোটা উন্মোচিত ? না কি আমরা সংকীর্ণ এক আত্মতৃপ্তির গন্ডির মধ্যে নিজেদের বেঁধে রাখতে পেরেই খুশি ?’ সংশয় ছিল তাঁরও, ‘অনুবাদের অভাবেই উদাসীনতা, না কি উদাসীনতার ফলেই অনুবাদের অভাব ?’

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.