ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের রাজনন্দগাঁও-এ বিনোদ কুমার শুক্লার জন্ম ১৯৩৭ সালের পয়লা জানুয়ারি। ১৯৯৯ সালে ‘দীওয়ার মে এক খিড়কী রহতী থী’উপন্যাসের জন্য তাঁকে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। কবিতায় বিনোদ কুমার শুক্লার অবদানও পাঠক বিনম্র চিত্তে স্বীকার করে। এ বছর তাঁকে সর্বোচ্চ জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। পুরস্কার ঘোষণা শোনার পর নব্বই ছুঁই ছুঁই কবি ও সাহিত্যিক বিনোদ কুমার শুক্লার কন্ঠে আফসোসের স্বর : ‘বহুত কুছ লিখনা চাহতা থা, পর লিখ নহী পায়া’, বলছিলেন এক সাক্ষাৎকারে।
আমরা শ্রী বিনোদ কুমার শুক্লার দীর্ঘ জীবন কামনা করি। তাঁর দশটি কবিতার বাংলা তর্জমা নিবেদিত হল, পাঠান্তে আশা করি পাঠক ছুঁতে পারবেন কবির ভাবনার বিশাল এক আকাশের সামান্য এক অংশকে।
১.
হতাশায় ভেঙে পড়েছিল একটা লোক
লোকটাকে আমি চিনি না
হতাশাকে জানি
সেকারণেই তার কাছে যাই
হাত বাড়িয়ে দিই
আমার হাত ধরে সে উঠে দাঁড়াল
সেও আমাকে চেনে না
জানতো আমার হাত বাড়ানোকে
দুজনে চলতে শুরু করলাম একসাথে
কেউ কাউকেই আমরা চিনি জানি না
জানি শুধু একসাথে চলাকে।
২.
দেওয়ালের ওপর বসে আছি
অবসন্ন, খিদে নিয়ে।
আমার পাশেই একটা কাক—
ঠোঁটে ধরা একটা রুটির টুকরো
ভাবছি, এ তারই
ছিনিয়ে আনা ভাগ।
আমি কাক নই
তীক্ষ্ণ ঠোঁটও নেই আমার
কেমনতর চোখনাকমুখের মানুষ আমি
যে নিজের ভাগটি ছিনিয়ে আনতে পারে না !
৩.
বলতেই হলে যথাসম্ভব কম বলি
বলি কখনো সখনো, না-বলাই বেশি।
এতটাই কম যে
কোকিল যেমন বারবার কুহু ডাক শেষে
চুপ করে যায়
সেরকমই কোন কোন দিন
একই কথা বারবার বলি, তারপর চুপ।
আমার বেশিরভাগ চুপ করে থাকা সবাই জানুক
যা বলা হয়নি, সব বলে দেবার নীরবতা।
পাহাড়-আকাশ-সূর্য-তারার বিরুদ্ধে
আমারও এক নিষ্প্রভ শাশ্বত ছোট্ট নীরবতা।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে আঘাত করার স্তব্ধতায়
আমার এক নীরবতা—
নিক্ষেপের আগে বন্দুকের স্তব্ধতার মত।
আর কখনোই বন্দুক চলেনি
এমন অপার শান্তি নিয়ে
আমার সব সময়ের প্রত্যাশার মত নীরবতা।
বটগাছের নিচে নিভৃতে রাখা
একটি জ্বলন্ত প্রদীপের মত
আমার চুপ করে থাকা।
ভিড়ের কোলাহলে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা আমার নীরবতা।
আমাদেরই মিছিলে কিছু বলা থেকে
নিজেকে বিরত রাখা আমার নীরবতা।
৪.
‘এসো পাহাড়’বলে
কখনও ডাকিনি পাহাড়কে।
বলেছি, ‘পাহাড়, আমি আসছি।’
পাহাড় আমাকে দেখুক
সেজন্যই তার সামনে দাঁড়িয়ে
আমি পাহাড় দেখছি।
পাহাড়কে ঘরে আনার বাসনায়
পাহাড়েই ঘর বানাবো একটা।
থাকার জন্যে
খুঁজে নেবো একটা গুহা
অথবা মা-বাবার আশীর্বাদের মত
খুঁজে নেবো উপত্যকার ছায়া।
বলব, ‘এ-ই আমার পৈতৃক ঘর।’
৫.
যত সভ্য, ততই অস্বাভাবিক।
আদিবাসী, যারা স্বাভাবিক
তাদেরও হতে হবে আমাদের মত অস্বাভাবিক
জঙ্গলের চাঁদ
অসভ্য চাঁদ
এ বার পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়
আদিবাসীরা ভয় পাচ্ছে
ফাঁকা মাঠে জড়ো হতে।
ঘন গাছের অন্ধকারে ডুবে
হাহাকার করছে তারা:
এই জঙ্গলেও সভ্যতার মঞ্চ
গড়েছে আলো ঝলমলে এক খুনি শহর।
৬.
ঘরবাড়ি ছেড়ে আমি সন্ন্যাসী হব না
আমার সন্ন্যাসে আমি বরং আরও গেরস্থ হব
গেরস্থ হব পাড়া-পড়শীতেও
অচেনা বস্তির কোন একটি বাচ্চা
মায়ের কোলে বসে
আমাকে দেখে দাদু বললে
তার মায়ের চোখে
খেলে যাবে এক খুশির ঝিলিক
সেই ঝিলিকে এক অবোধ্য আত্মীয়তা।
৭.
কোনো অসম্পূর্ণতাই পূর্ণতা পায় না কোনদিন
আর এক নতুন শুরু হয় শুধু
ছেড়ে যায় এক নতুন অসমাপ্তি
শুরু থেকে এত এতবার যে
গুনতে গেলেও তা অসমাপ্ত থেকে যায়
অথচ এই অসমাপ্ত অসম্পূর্ণতায় ভরা জীবনকেই
সম্পূর্ণ বলে মেনে নেওয়া হয়, অসমাপ্ত নয়—
যেন ভরপুর বেঁচেই কেটেছে জীবন।
ভরপুর এই জীবনে
মৃত্যুর ঠিক আগে
নতুন একটি কবিতা শুরু করতে পারি
মৃত্যুর অনেক আগের এক কবিতার মত
জীবনের নিজস্ব প্রথম কবিতার মত
নতুন কোনো অসমাপ্তিকে যেন
অন্তিম না মনে করে কেউ।
৮.
কোনদিন আর দেখা হবে না
এরকমটাই ছিল
তবু আমাদের দেখা হয়েছিল
এমন হয়েছিল দু দু’বার।
প্রথম দেখা হয়েছিল পনেরো বছর পর
তারও আট বছর পর আবার
জীবন যেন সেরকমই থেমে-থাকা মৃত্যু
সেই মৃত্যুই একইভাবে এসে
আমাদের সরিয়ে নিয়ে যায়
পাঁচ বছর পর তৃতীয় বার এমন হল
পড়শী হয়ে থাকার জন্যে সে এসেছে পাড়ায়
সে সময় আমার ঠিকানা ছিল না তার কাছে
এমনকি আমার কাছেও তার
একটুখানিই বেঁচে আছে জীবন দুজনের
পড়শী হয়ে বেঁচে থাকার
এর আগে একই ঘরে থাকতাম আমরা।
৯.
দুটি পা—
আলাদা আলাদা ওঠে
তবু, এগিয়ে তো যায় !
পায়েদের এই পৃথক ওঠানামায়
আমার কিছু যায় আসে না।
আমি খুশি—
আমার যৌথ পরিবার।
১০.
আজ কোনো শিশু জন্ম নিলে
সে আমার নাতনিদের থেকেও ছোট—
এখন আমি তেমন বয়সের।
ঘরদোর জুড়ে কোলাহল
‘সকাল হল’— কেউ যদি বলে
শুনে মনে হয় যেন ছেলে হয়েছে।
বেশ জোরে যদি বলে কেউ
‘শুরু হলো দিন’শুনে আমার মনে
কন্যাপ্রাপ্তির খুশি উছলে ওঠে।
আমার মেয়েরও দুই মেয়ে
সবচেয়ে ছোট নাতনিটি জেগে উঠে
সকালটাকে জাগিয়ে তোলে
ওর পুতুলের মত
আর বড় নাতনি জেগে উঠলে
জাগিয়ে তোলে দিনকে।
প্রচ্ছদ । হিরন্ময় চন্দ