ঝরাপাতার গান
শাদা পাথরের মেয়েটা এখন শ্যাওলায় গেছে ডুবে
হাড়ের বাঁশিতে বেঁধেছে অজর বুনোপাখিদের গান,
পাতাদের মতো হাসি তার কবে ঝ’রে গেছে নিশ্চুপে!
তবু যেন খোঁজে আলোছায়া পথে সাবলীল নির্বাণ।
শাদা পাথরের মেয়েটা এখন পাথর হয়েছে আরো;
বুঝেছে যখন চারিপাশে তার সঘন একাকী মেঘ
বুঝেছে যখন তার পথে আর মিশবে না পথ কারো
মাঠে-বুনোঘাসে দোলা দেয় এক সুগভীর নিরাবেগ।
শাদা পাথরের মেয়েটা এখন নিজেকে ভাঙবে বলে
হাতুড়ি-বাটালি হাতে তুলে নেয় চূর্ণিত অভিমানে,
পাথুরিত পথে ধুয়ে যাবে সব সীমাহীনা মায়াজলে
সেই মেয়ে তবু পথে ঘোরে আজো অলীকের সন্ধানে।
ঝরাপাতা মেয়ে হয়নি এখনো সময়ের ক্রীতদাসী
যদিও বা তাকে চাবকায় ঢের সময়ের রূঢ়হাসি।
বালিকা
বালিকা তোমার কাচের চুড়িতে বেলোয়ারি-বন্ধন
ঘরকন্নার সাথীরা সবাই বেঁধেছে আপন ঘর,
স্মৃতির উঠোনে এখনো তোমার ধুলোবালি রন্ধন
তোমার উঠোনে সজীবতাহীন কেন এই বালুচর?
এখনো তো সেই মায়াময়ী দিন টেনে রাখে হুতাশনে
বিছানায় খোঁজো চেনা গন্ধের জুঁই-পারিজাতমালা,
নিজেকে পুড়িয়ে বেদনার ভিত গড়ে তোলো আনমনে-
কেন শুধু খোলো প্রতিদিন সেই স্মৃতিদের পাঠশালা?
বালিকা তোমার জলময় চোখে হারানো দিনের ছবি-
কেঁপে কেঁপে ওঠা চেনা কোনো মুখ বন্ধ কপাট খুলে
উঁকি দিলে যেন বোবা হয়ে যায় নিশ্চলা জল-রবি;
লতাদের মতো নুয়ে আসে মন সকল আড়াল ভুলে।
কত যুগ গেল বালিকা তবুও করছো হৃদয়ে বাস
যতদিন যায় ব্যাকুলতা যেন বেড়ে ওঠে ক্রমে ক্রমে
বেপথু দিনেরা পায়রার মতো খুঁটে আনে ফুল-ঘাস,
স্বপ্নের খোঁজে দিন ছুটে যায় পরিযায়ী পথ-ভ্রমে!
রাই সমাচার
এই দেখো কোনো প্রতিহিংসায় কাঁপেনি আমার বুক
দুর্মুখজনে কত কিছু বলে, হাসে কত নিন্দুক।
নিন্দার ঝাঁপি পাশে ফেলে তবু বারবার ছুটে যাই,
বোঝোনি তো তুমি; দুর্দম ক্রোধ ঝরিয়েছো অযথাই।
প্রেম কী শুধুই শরীরের গান? চোরাবালিঘেরা ভাষা
তারো বেশি কিছু চেয়েছি বলেই নিপতিত ভালবাসা।
শরীর ছাপানো আরো কিছু আছে, বোঝেনি তোমার চোখ
বোঝোনি আমার জলছবি আঁকা গতিময় স্রোতালোক।
তুমি তো জানো, ঘৃণাহীন আজো… এখনো তোমাতে আছি
দিবস-রজনী তোমাকেই রাখি স্মৃতিদের কাছাকাছি।
যদি বাঁশি বাজে তোমার ভেতরে; আমি শুনি তার সুর
সময় যদিও নিয়ে গেছে দূরে, দ্বিধাহীন বহুদূর…।
খাঁচা
আমাকে দিয়েছ অশেষ আকাশ, দিয়েছ ওড়ার ডানা
দিয়েছ নিপাট মুক্তির গান সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে
তার ওপারের বিহবলতায় নিজেকে জড়ানো মানা
সীমানা ছাড়িয়ে তবু চলে যাই কল্পিত রথে ভেসে।…
অকরুণ হাতে এঁকেছ নিজেই সময়ের কারুছায়া-
কৃষকের মতো কেন তবু বাঁধো মমতার গাঢ় নীলে!
আমার ভেতরে ছড়িয়েছ যত মনোনীত মোহমায়া
তাকে ছাড়া কোনো নিমগ্নতায় নিজেকে ডোবাতে মানা!
হামাগুড়ি দিয়ে আঁধারেরা আসে,বিপন্নতার কালে
ঝাঁক বেঁধে আসে পাখিদের দল খুঁটতে শস্যদানা,
আমাকে ঢেকেছ ধ্রুবডানামেলা পুঞ্জিত মেঘদলে
বেঁধে দেয়া নীলে আমার সীমানা! তার বেশি যেতে মানা!
করাত বাতাসে ফালা ফালা হয় পাখিদের চুপকথা
আদিম আকাশ ছাড়িয়ে দূরে … বহুদূর বুনো দেশে…
পড়ে আছে কত ধুলিকুসুমের ব্যাকুলতা-কঙ্কর;
খুলে দাও ডানা’- খুঁজে নেবো সব বোহেমীয় রাত শেষে।
চন্দ্রাচ্ছন্নতা অথবা এক বিভ্রম
চোখের নীলে দূর বিদিশা গ্রীবায় চাঁপা ফোটে,
সারা শরীর ঝমঝমিয়ে রোদন বেজে ওঠে।
সবাই যখন মোহর খোঁজে মোহন গীতিকায়
আমি তখন দু’চোখ মুছি তোমার অবজ্ঞায়।
প্রসাধনের ছায়ায় বসে পাটরানীরা হাসে,
আমার চোখে শূন্যতা আর মেঘের ভেলা ভাসে।
সবার মাঝে একলা হয়ে নিজেকে খুঁড়ে, আর-
শেকড় ছিঁড়ে তোমায় কেন ডাকি বারংবার!
আমি তোমার রোদসী নই, কাঙ্ক্ষা তো নই মোটে
সংশুদ্ধা পদ্ম তবু নিলাজজলে ফোটে।
ছায়া
সে যেন তীব্র রাতের মতোই ছুঁয়েছে বুকের পাশ
গ্রীবার গহীনে টের পাই তার সুগভীর নিঃশ্বাস।
টের পাই তার ঠোঁটের মুদ্রা লোনাসাগরের জলে
তুড়ি দিয়ে নাচি শঙ্খবালিকা জালিবোনা ছায়াতলে।
শুকনো বকুল মুখ টিপে ঠিক তারি মতো ধুম হাসে
মুদ্রা-ময়ূরী ঝমঝম নাচে অকারণ উচ্ছ্বাসে।
সখ্যতা তার রাত্রির সাথে, বিদিশার সাথে আর
কবিতার মতো নারীদের সাথে ঢলাঢলি বেশুমার।
কখনো খুলে সে আচানক টানে ডাকিনীর থোকা চুল
ঘ্রাণ টেনে নিতো প্রকৃতির মতো শিহরিত সঙ্কুল।
চোখের তারায় সুনিবিড় কোনো বেদনা ঘনিয়ে এলে
বন্ধুর মতো মেঘেরা তখনো রেশমের ছায়া মেলে।
বেদনার বালি সরিয়ে যখনি তুলে আনি সেই মুখ
জলকলরোলে ভেসে যায় এই বেলাভূমি উৎসুক।
বনদেবী এবং মৃত বনভূমি
তাকে ভুলে যাও বুনো ঘাসফুল; ভুলে যাও বনলতা
ভুলে যাও দূরে নদীজলে ভাসা নীলতোয়া মধুরাত,
হয়তো দেখবে সবুজ ঘাসেতে লুটোপুটি নীল-ব্যথা
লতাদের মতো খ’সে পড়ে আছে অমলিন সেই হাত।
নাগরিক রোদে মরে গেছে তার টলটলে দেহঢেউ
ধোঁয়ার প্রবাহ থইথই জমে বনফুল সীতাহারে,
মাধুকরী জলে ধুয়ে তোলা ওই শরীর ছুঁয়েছে কেউ
পথভোলা রাতে ভাঙা চাঁদ হাতে উদ্ধত অভিসারে!
ভুলে যেও তাকে লুব্ধক তারা, বাতাসের কানাকানি
মায়া ভুলে গিয়ে পাশ ফিরে শোয়া গভীর বেদনাবোধ
গিলে নেয় তাকে বুক ফুঁড়ে আসা বাঁধভাঙা লোনাপানি
গ’লে গ’লে যায় আবেগের মোম ভেঙে সব প্রতিরোধ।
নারীপুরাণ
নারী তুমি হবে বেদনার জল চেতনার মাপকাঠি
তুমি হবে যত প্রেরণার রূপ, সারাবেলা পরিপাটি।
কামনার মতো জ্বলজ্বলে তুমি কামিনী ও কলাময়ী
মমতামাখানো নারী তুমি হবে সকল বাসনাজয়ী।
তুমি হবে বাঁশি, হবে তানপুরা, বাজাবে হয়তো কেউ;
ধরণীর গান – সেইসাথে হবে বিশালাক্ষীর ঢেউ।
পিছু পিছু এসে নীরবে জ্বালাবে মঙ্গল দীপালোক
নরম আলোয় ভরিয়ে রাখবে পদ্মের মতো চোখ।
পায়রার মতো বুকে পুষে রেখে প্রিয়তর সংলাপ
অথবা গোপন কামনার মত হিসহিসে কোনো সাপ
হেসে হেসে তুমি ঢেলে দেবে যত অবদমনের বিষ
সাথে সাথে তুমি রোদে ভরে দেবে স্যাঁতসেঁতে কার্নিশ।
তোমার আলোতে পুড়তেও পারে শামাপোকাদের লোভ
কী হবে তাতে জ্বলে ওঠে যদি দ্বিধাহীন সংক্ষোভ!
কী-ই হবে আর; যদি কেঁপে ওঠো আবেগের বুনোজ্বরে
বিটোভেন যদি সারারাত ঝরে তৃষাময় নির্ঝরে।
দেখবে তোমার চারিপাশ জুড়ে প্রশ্নের ঘোরাফেরা
সকল রূপেই তোমাকে যে চাই- আহা! তুমি অপ্সরা!!
ধৃষ্টতা
হঠাৎ কীভাবে রটে যায় যেন অহেতুক সংবাদ
গুঞ্জনে কাঁপে শহরের রোদ একলা নিরুদ্দেশে
হইচই করে ছুটে আসে মেঘ-বৃষ্টির জলস্বাদ
দু’পায়ের নিচে গ’লে যায় মেঘ- ঘনপিচ অবশেষে
মাংসের খোঁজে কসাইখানায় ভিড় করে যত কাক
প্রাচীন গলিতে গ’লে গ’লে পড়ে লাল মাংসের লোভ-
ঘুলঘুলি থেকে চুপিসারে উড়ে সাদা পায়রার ঝাঁক;
কীভাবে কোথায় ফেলে রেখে যায় রক্তের গাঢ় ছোপ।
সেই ছোপ দেখে সারমেয়কূল খুঁজে খুঁজে দিশাহারা-
কাঁসর বাজানো হল্লায় মেতে লুটোপুটি রোদ হাসে
নির্জন এই শহর জুড়েও আগুনের স্রোতধারা
উগরানো ক্রোধে ঢেলে দেয় বিষ বিপুল সর্বনাশে।
কবি
মাঝে মাঝে অন্য আলোর গান
অন্য আলোর কুসুম ভেঙে খাওয়া
ভিন্ন ক্ষেতের রুপশালি সব ধান-
লুকিয়ে রেখে নিপাট চলে যাওয়া ।
মাঝে মাঝে স্রোতের কাছে ঋণ
যেমন খুশি আগল ভাঙার
দীর্ঘ বেতাল দিন।
অন্য রকম সুরের কারুকাজে
মাথার ভেতর ধুন পাখোয়াজ বাজে।
মাঝে মাঝে অন্যরকম পাঠে
রুক্ষ-কঠিন শব্দ নিয়ে খেলা
ধুসররঙা শস্যবিহীন মাঠে
ক্লান্ত চাষীর বিপুল অবহেলা!
মাঝে মাঝে আকাশ ছোঁয়ার সাধ
তীব্র ব্যাকুল কাঙ্ক্ষা হয়ে
বাড়ায় অপরাধ।
শাহানা আকতার মহুয়া: কবি ও সম্পাদক, লিটিল ম্যাগাজিন ছান্দস