রুখসানা কাজল এর গল্প ‘বর্ষা বৃষ্টি মা ও সন্তান’

0
Showing 1 of 1

মন খারাপের বিশ্রী বৃষ্টিতে মেখে যাচ্ছে চরাচর। আর আমার চোখের সামনে সমানে কেঁদে যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা। ভেজা মাথায় ছোট্ট মেয়েটি মায়ের সঙ্গে নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি ভেঙ্গে। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। উথাল পাথাল দুলে যাচ্ছে দুটি বুড়ো পেঁপেগাছের সঙ্গে হাস্নুহেনার অবুঝ ডালপালা। বুক বাঁচাতে মাটিতে শুয়ে পড়েছে সন্ধ্যামালতির ঝোপঝাড়। ছোট মেয়েটির নাম কুটুম। ওরা আগে থাকত লালফকিরের বস্তিতে। এই পাড়াতে ফ্ল্যাট কিনে আসার পর প্রায় পাঁচ বছর কাজ করে গেছে আমার কাছে। কুটুম তখন দুই বছরের শিশু ছিল। এরপর বস্তি ভেঙ্গে দেওয়ায় ওরা অন্য পাড়ায় চলে যাওয়ায় অনেক দিন দেখা হয়নি। আজ এসেছিল কাজ খুঁজতে। বড় দরকার। কুটুমের বাবা পা ভেঙ্গে পড়ে আছে বিছানায়। রিক্সা চালাতে পারছে না। ঘরে অভাব। কিন্তু আমার ত কাজের বুয়া আছে। তোকে কি করে রাখি খুশিনূর ? একটু দাঁড়া — মা তুমি কাজ পেলে না। আমরা এখন কি খাবো মা ! আমার ইশকুলের বেতন দিবা না মা ? ওমা দিবা না ? বড় সুখি সুখি মুখ কুটুমের। মায়া লাগে । দুটি বিস্কিট আর কিছু টাকা দেবো বলে ভেতর থেকে এসে দেখি ওরা চলে যাচ্ছে। দোতালার বাঁক পেরিয়ে একতলার সিঁড়ি ছুঁয়েছে মা মেয়ের ভেজা পা। আমি ডাকতে গিয়েও থেমে যাই। কুটুমের মায়ের চোখে স্পষ্ট আগুন দেখেছি। আধভেজা আঁচল মাথায়। যেনো মেঘনারীর মত বিদ্যুৎ বাণে পুড়িয়ে দেবে এই বিশ্ব বৈভবের এক চোখো নিষ্ঠুর নির্ণয়। আমার হাত পুড়ে যাচ্ছে উদবৃত্ত বিত্তের আগুনে। পনেরোর কিশোর। রাত ফুরোলেই বায়োলজি এক্সাম। ইউট্রাসের গঠন আঁকছে । হাত থেকে পড়ে যায় পেন্সিল। বৃষ্টির তান্ডবের সাথে আবার মার খাচ্ছে ওর মা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ যেনো প্রতিবাদের চমক দেখাচ্ছে প্রকৃতিকে। মাকে বাঁচাতে ছেলেটি নিজেই মার খায় উদ্যত ক্রাচের। শেষে রুখে দাঁড়ায় । বনেদিয়ানার গৌরবকে ভেঙ্গে দিয়ে মধ্য রাতে ছুঁড়ে ফেলে লম্পট পিতাকে। মায়ের কপাল জুড়ে রক্তাভ ছাপ। পৃথিবীর সব সাহস দুহাতে বেঁধে, ছেলেটি বুকে তুলে নেয় মাকে, মা, মা এই শেষ। আর নয়। বি ব্রেভ মাম ! সৃষ্টি ছাড়া অবিরাম বর্ষা। পলিথিনের তেরপল বেয়ে ঝরে পড়ছে সাদা বৃষ্টির অজস্র জলধারা। মুখ শুঁটকো করে জেফরুল ঠিকাদার কাজ দেখছে ঢাউস ছাতা মাথায় নিয়ে। হাতুড়ির আঘাতে টুকরো হয়ে আছড়ে পড়ছে আস্ত ইটগুলো। আর বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে তারস্বরে গান গাইছে পরান মিয়া, ওরে নীল দরিয়া ! আমায় দে রে, দে ছাড়িয়া- পরান আসলে মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছে সেই করুণ দৃশ্য। মহাজনের ঘরে অসহায় মায়ের অবাধ্য বিসর্জন। সেদিনও বৃষ্টি ছিল এমন। সেদিনও ছিল বর্ষাকাল। ঘোলা জ্যোৎস্নায় মিনমিন করছিল আকাশের বেহায়া চাঁদ। মহাজনের বারান্দায় বাপের সাথে ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় ছোট্ট পরান কাঁদছিল, ও বাপ, মায়েরে ডাকি আন তুই। বাড়ি যামু না আমরা ? আমার যে খিদে লাগিছে বাপ ! মা আসে। পরানকে কোলে তোলে না। কথা বলে না। হেঁটে চলে অন্য মনে। পথ জুড়ে ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নার ভেজা ছায়া। চিরল পাতার বাঁশ ঝাড় ভিজে জরোজরো। সেই বাঁশ ঝাড়ে টিটিম টিটিম করে ডাকছিলো কোন অজানা পাখি। দূরে কোল পেতে বয়ে যাচ্ছে পাড় ভাঙ্গা এক রাক্ষুসি নদী। টিটিম পাখীগুলোকে চমকে দিয়ে হা হা করে কেঁদে ওঠে পরানের মা, আমি চইল্লাম। চইল্লাম গো পরানের বাপ। আর ত পারিনা। শইলে যে সয় না গো আর ! এক হাতে শিশু পরান অন্য হাতে চালের পুটুলি ধরে অসহায় বাপ। দূরে বর্ষায় ক্ষেপে ওঠা সেই ক্ষুরধার নদীর দিকে ছুটে যাচ্ছে মা। ভেজা জ্যোৎস্নায় মুছে যাচ্ছে মায়ের শরীর। অবরুদ্ধ হাহাকারে প্রেমহীন সেই অগাধ জ্যোৎস্নায় পরানের অসহায় বাপ উবু হয়ে বসে কেঁদে ওঠে, আল্লারে ও আল্লা ! আমাগের ক্যান প্যাট দিলি রে আল্লা ! ক্যান খিদে দিলি, ক্যান মানুষ নামের নামানুষ বানায়ে রাখলি রে ও বেবদ আল্লা ! ঘড়িতে চারটা বেজে পনেরো মিনিট। ঘরে ঢুকতেই ভাঙচুরের শব্দ। চীৎকার, গালাগালি। ও বাড়ির অন্য মা দ্রুত নিজের রুমে ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের মত ছেলের বউকে। ড্রাইভার চাচা এবার সময়ের হিসাব দেবে। অফিস, মিটিং, আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকান। থইথই বৃষ্টি। রাস্তা ডুবে সাগর হয়ে গেছে। ষ্টীল জ্যাম। দেরি ত হবেই! সত্যি মিথ্যের কথকতা। আসলে এই ঝোড়ো বর্ষায় ঘুরে ঘুরে বই কিনতে কি যে আনন্দ লাগে বউটার। বইগুলো তখন রিমঝিম সুরে কথা বলতে শুরু করে। বইয়ের আড়ালে গোলাপবালা হাতের আভাস। তাতে দুপুর দুপুর মা গন্ধ। মায়ের ডান পাশে লাল শালুতে কিনার মোড়া তালপাখা। বউটার মনে হয়, বইগুলো যেনো ওর মা। বড় কিছু ভাঙ্গার শব্দ ভেসে আসে। কেঁপে উঠে বউটি। বালক ছেলেটি এসে জড়িয়ে ধরে, ডোন্ট অর‍্যি সুইটহার্ট। উই উইল লিভ দিস প্লেস ওয়ান ডে। লুক আয়াম য়্যুর ডালিম কুমার মাম! মাথার ভেতর স্বপ্ন জমে অংকুর ছড়ায়। পাতা গজায়। লতিয়ে ওঠে অদম্য উল্লাসে। ভেসে চলে সাদা ফ্লোর। যেনো নুহের নৌকা ! বউটি ভাবে, বন্দর আর কত দূর ! বৃষ্টি জল হাওয়া মেঘ মেখে উঠে আসে মায়েরা। জলজ। পিচ্ছিল। পরাজিতের চিরায়ত বেদনায় মুহ্যমান। তারা ডাকে। শ্বাস ফেলে হাত রাখে ভরন্ত বুকে, প্রমিথিউস। বাবা, বাবাই— মানুষের ঘরেই আগুন রেখেছিল প্রমিথিউস ! মায়েদের মানস সন্তান।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Showing 1 of 1
Share.

Comments are closed.