রাজিয়া নাজমী’র গল্প: কামরেখা

0

‘জরুরি কথা আছে, একটু আগে আয়। আমি বের হচ্ছি’। রিতা ফোনে মেসেজট আবারও দেখে – প্রায় ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই , পিছন থেকে একধাক্কা মেরে উষসী বললো, চলে যাওয়া জন্য এক্কেবারে রেডি! অন্যদের জন্যও অপেক্ষা করবি না।
আমার তো কাজবাজ আছে না-কী? তোর আসার কথা ঘণ্টা আগে। আর ওনাদের আসার তো আধাঘণ্টা পার ।
আরে বাবা, ঢাকা শহরে গাড়ি যে এখন গরুর গাড়ির মত চলে তা ভুলে গেছো না ! স্যরি রে, মোবাইল ফোনে একদম চার্জ নাই যে তোকে জানাবো। নিজে তো থাকো এখান থেকে পাঁচমিনিটের পথে। স্বার্থপরের মত তো নিজের সুবিধা দেখে এই রেস্তোরাঁ বেঁছে নিয়েছো।
একদমে কথা বলে, উষসী রেস্তোরার দেয়ালে প্লাগপয়েন্টে ফোন চার্জ দিয়ে বললো, নে বস। গাধা দুটা আসার আগে তোর সাথে আমার কিছু দরকারি কথা শেষ করি।
রিতা জানে একদিন না একদিন উষসীর প্রশ্নের চাপে সে পড়বেই। কোন উত্তেজনার ধার না ধেরে বললো, বলে ফেল।
উষসীও রিতার অনাগ্রহের পাত্তা না দিয়ে বলে, প্রেম করছি! চুটিয়ে প্রেম করছি। বলতে পারিস পরকীয়া প্রেম! গালি দিতে পারিস কার সাথে করছি শুনে কিন্তু তাতে আমার কিচ্ছু আসবে যাবে না।
রিতা নড়েচড়ে বসলো এবার। তাহলে উষসী এখন জানে না, ওর স্বামীর সাথে রিতার গত একবছর ধরে সম্পর্ক। উষসী’র ‘প্রেম করছি’ কথাটা শোনার সাথে সাথে ইচ্ছা করছে এই এখুনি যদি মানসকে কাছে নিয়ে দ্বিধাহীন সঙ্গমের আনন্দ কতটা তা বুঝতে পারতো। আহা মানসকে কখন জানাবে, ওরা এখন গ্লানি থেকে মুক্ত। উষসী না জেনেই মুক্তি দিয়ে দিয়েছে ওদের।
মনে মনে মুক্তির সেলিব্রেশন শেষ করে রিতা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে; কবে থেকে, কার সাথে? আর হ্যাঁ রে মানসের জন্য খারাপ লাগে না তোর?
উষসী ব্যাগ থেকে পেনড্রাইভ বের করে ল্যাপটপ মেলে ধরে বলে অফিসের একটু কাজ দেখতে হবে রে বলেই মাথা নিচু করে ল্যাপটপের কীবোর্ডে আঙুল ঠুকতে ঠুকতে বললো, কি বললি, কবে থেকে? ছয় মাস! কোনটা আগে শুনবি? কার সাথে না মানসকে ঠকাচ্ছি-সেটা ?
রিতা বললো, কার সাথে সেটাই আগে বল!
আগে বল, ক্ষেপে যাবি না। আগে আমার যুক্তি শুনে তারপর গালি দিস।
প্রেম করছি রোকেয়ার বরের সাথে।
মানে?
না না ,আগেই বলেছি , সবটা না শুনে নয়।
শোন, রোকেয়াকে দেখে আমরা ভাবি, ইস কী সুখে আছে ওরা! তুই জানিস মনিরের সাথে ওর মাসেও কিছু হয় না। মেয়েটা সব পারে শুধু যৌনতার আনন্দেই বোঝে না । ওটাও ওর কাছে ঘরকন্নার মত নিয়মে বাঁধা। যখন স্বামীর ইচ্ছা হবে উনি শরীর পেতে দেবে। কোন ইচ্ছার প্রকাশ নেই, একবারে একটা রোবট। ওর ভাগ্য ভালো মনির পল্লিতে যায় না।
মানসের কথা জানতে চাস। সেক্স করার আগে কবিতার ধ্যান, করার সময় কবিতার ধ্যান, করার পরে ছুটছে লিখতে। আমার মাঝেমাঝে মনে হয় ওকি অন্য কারো সাথে আছে , আমার সাথেই কি ওর ভালোলাগে না? বলতে পারিস মানসের এই অবহেলা আমাকে মনিরের কাছে নিয়ে গেছে। নয়ত মানস ছাড়া আর কাউকে যা আমি ভাবতেই চাই নাই।
ওর কাছে আমাদের মিলনে কোন তৃপ্তি আর নেই – কবিত্বহীন শারীরিক মিলন। যেন বায়োলজিকাল নিড মেটাতেই করা। ওতে মনের কোন আবেগ নেই – ফিকে হতে হতে – প্রেম হারিয়ে গেলো। এখন আমি কখন বিছানায় আসলাম তা নিয়ে ও মাথা ঘামায় না, আমিও মানস বিছানায় আসলো কি না আসলো সেই দুঃখ আর টের পাই না।
সত্যি বলতে কি জানিস ,মনিরের কাছ থেকেই জানলাম সঙ্গমের আনন্দ কতটা । নিজের শরীর কি চায় কতটা চায়, কতটা দিতে পারে। মনির প্রথম পুরুষ যে আমার শরীরের প্রশংসা করে,যা আমার জন্য এক বিশাল কবিতার মত।
তোরা কি বিয়ে করবি?
না, মানসকে আমি ছাড়বো না। ও আমার জন্য অন্য সবদিক থেকেই ঠিক। এই একটি দিকে ছাড়া। সেই দিক আমার এখন আছে।
রোকেয়া?
মনিরও রোকেয়াকে ছাড়ছে না। মনিরকে ছাড়া রোকেয়া চলবে কি করে। ভালো রেজাল্ট করেও তো হাউজওয়াইফ থেকে গেলো। তিনটা মেয়ে। ডিভোর্সের কথায় তো হার্ট অ্যাটাক করবে মেয়েদের বিয়ের চিন্তায়। অবাক লাগে শিক্ষিত একটা মেয়ের এত ব্যাকডেটেড চিন্তাধারা।
বিশ্বাস কর মনিরের জন্য দুঃখ হয়। কি এক ছাপোষা জীবন। ভালো একটা চাকরির মোটাবেতন নিয়ে ঘরে ফেরা – বউয়ের হাতের ভালো রান্না খাও। এদিক ওদিক দাওয়াতে যাও। অন্যকোন লাইফ নাই।
তো তুই মনিরের জীবনে অন্যলাইফ এনে দিয়েছিস তা হলে!
মনিরকে দেখেছিস ইদানীং? বদলটা লক্ষ্য করে দেখিস। ও নিজেই বলে, লুকানো জীবনের এত প্রাণ কোন স্বাধীন জীবনে নেই।
যাচ্ছি রে কদিনের জন্য আরও প্রাণ পেতে?
কোথায়?
নেপাল।
রিতার মনে পড়লো, মানস বলেছিলো উষসীর নেপাল যাবার কথা। কী নাকি কনফারেন্স আছে।
কেন যাচ্ছিস,কোন কাজ আছে?
উষসী হাসলো, কাজ সামান্য তবে মনিরের সাথে টানা এক সপ্তাহ সময় কাটানো আসল কাজ! রোকেয়ার সামনে আমার নেপাল যাবার কথা তুলিস না যেন।
বলছিলি তোর মনে হয় মানস আর কারো সাথে…
আরে ধুর ও এমনি বলেছি, মানস কবিতার সাথে প্রেমে আঁটকে গেছে- নারীর শরীর ওকে টানে না। তা না হলে উষসীর উল্টো দিক করে ঘুমায়!
রিতার ইচ্ছা হলো বলতে মানস শরীর আর মন দুটোই চায়- যা তোর কাছে পায় নাই!
আর করেই যদি আমার কোন আপত্তি থাকবে না। আমাদের ছেলেমেয়ে নাই – ফ্রি ম্যারেজে যে যার মত হ্যাপি থাকলাম। ক্ষতি কী।
তাহলে ওকে সে কথা জানিয়ে দে।
পাগল তুই! সবসময় সব পরামর্শ দিতে নেই রে। কেন রে তুই করবি মানসের সাথে প্রেম! তোকে তো মানস বেশ পছন্দ করে! হা হা হা ।
এতে হাসার কি আছে! কেন আমি প্রেম করতে পারি না? ধর মানসের সাথে করলাম, তুই বলছিস তাতে তোর আপত্তি থাকবে না?
প্রথমত, তুই প্রেম এড়িয়ে চলেছিস যখন আমরা গণ্ডায় গন্ডায় প্রেম করেছি। প্রেমপত্র লিখতে লিখতে আমাদের হাত ধরে যেতো – আর তোর মাথা বইয়ের মধ্যে ডোবা
দ্বিতীয়ত…
দ্বিতীয়ত কী?
‘ভালবাসা চাই পরস্পর, আমারও হোক তোমারও ,প্রেমে দুঃখ হোক কি আনন্দ, আমারও হোক তোমারও’
মানে কী , বাহদুর শাহ’কে টানছিস কেন?
টানছি, কারণ এটাই দ্বিতীয়ত – রিতা, এমন না যে তিনিই এর একমাত্র উদাহরণ, তবুও কবি বলেই তাকে টানছি। আমাদের শেষ বাদশাহ এবং কবি বাহদুর শাহ’র প্রথম স্ত্রী বেগম আশরাফ মহল তাঁর নিজের বোনকে স্বামীর জন্য এনেছিলেন। চারজন স্ত্রী ও শতেক উপপত্নী থাকার পরেও। তো তোকে আমার ভাবতে অসুবিধা কী। আমি না হয় আমার কবি স্বামীর জন্য আমার প্রিয় বন্ধু তোকেই নিলাম। – হা হা হা
শোন রিতা, পরকীয়া প্রেম শুধু মাত্র মানস মনির পুরুষ বলে করতে পারবে – দোষ হবে না। দোষ হবে আমাদের- আগেও হয়েছে – এখনও – আগামীতে হবে।
হোক- আমি কেয়ার করছি না। প্রেম ভালোবাসা নেই কিন্তু বিয়ে টিকে থাকবে –তোর কি মনে এটা থাকে? আমার তো মনে হয় ন। বিয়ে আসলে থাকে না না রে বা বলতে পারিস প্রেমবিহীন বিয়ে আসলে বিয়ে নয় রে। বিয়ের মুল মন্ত্র কী তা ভেবে দেখে বল ভালবাসা মরে গেলে তা কি করে ভ্যালিড থাকে! আসলে কি জানিস সমাজ এবং তার নিয়মের কারণে আমরা ‘বিবাহিত’এই ছদ্মনামে চলছি নানা সুবিধার জন্য। ভয় ভীতির জন্য।
তার মানে তুই বলতে চাস,যাদের মধ্যে ভালোবাসা টিকে আছে তাঁরা ছাড়া অন্য যারা এর থেকে বঞ্চিত তাঁদের অধিকার আছে নিজেদের জীবনের কথা ভাবা? তা যেভাবে হোক?
এক্সাক্টলি, সেক্ষেত্রে কে তাঁর জীবনে সেটা ব্যাপার হতে পারে না। তবে যতক্ষন তুই কাউকে আঘাত করছিস না। তা না হলে এইটুকু অধিকার পুরুষ নারী সকলের থাকতে পারে। রীতিনীতি একদলকেই ধরে রাখতে হবে সেকথা লেখা আছে কোথায়?
সতী শব্দটার লিঙ্গভেদ উঠিয়ে দিতে হবে রে। উঠে যাবে একদিন!
ওদের কথার মাঝেই রোকেয়া স্যরি স্যরি বলতে বলতে এসে বসেই, দুজনের মুখের দিকে তাকায়ে বললো, কি নিয়ে কথা বলছিস তোরা? আমাকে দেখে চুপ মারলি কেন?
কি আশ্চর্য তোকে দেখে চুপ মারবো কেন – দুজনার একসাথে বলে ওঠায়, রোকেয়া আরো জোর দিয়ে বলে, আমি জানি তোরা আমাকে নিয়েই কথা বলছিলি। বলবি তো । আমি দেরী করলাম আসতে – কারণ আমি তো তোদের মত আউটগোইং না। আমি আটপৌরে সংসারী – সারাদিন রান্নাঘর নিয়ে পড়ে থাকি। তা কি করবো বল। তিন মেয়ে আর তাদের বাবার একমুহুর্ত আমি না হলে চলে না …।
রিতা গ্লাস থেকে পানি মুখে দিতে গিয়ে বিষম খেলো। উষসী মুচকি হেসে রিতার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, এই অসময়ে তোকে কে মনে করলো আবার!
রিতা ওর পা দিয়ে উষসীর পায়ে পাড়া দিতেই উষসী আআ করে আস্তে চিৎকার করতেই রোকেয়া বললো, তোদের আজ কি হয়েছে বলতো।
আসার পরে থেকেই লক্ষ্য করছি কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছিস দুজনে। ভালোলাগছে না আমার।
কেন ভালোলাগছে না কেন আমাদের রকু বাবুর?
ও-মা মিনার তুই? কবে এলি তুই? এই তোরা দুজন আমাকে বলিস নাই মিনার আসবে আজকে। রোকেয়া এবার সত্যি রেগে গেলো।
মিনার বললো, না রে আমিই ওদের বলেছি তোকে না বলার জন্য। রকু, এখনও কত সুন্দর আছিস রে তুই । চুল তো মনে হয়ে আরে বেশি হয়েছে তোর।
এই যে দুজন তোমরা আমার ভোলাভালা রকুকে নিয়ে ঝামেলা পাকাচ্ছ কেন? সারাজীবন ওকে তোরা ক্ষেপিয়ে গেলি।
রিতা উষসীর দিকে তাকিয়ে বললো – আমাকে খামোখাই বকছো মিনার। রকুকে জিজ্ঞাসা করে আমি ওর পাকাধানে মই দিয়েছি কিনা।
রোকেয়া মিনারের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, আচ্ছা হয়েছে, এবার খাবারের অর্ডার দিবি না আমাকে নিয়েই পড়ে থাকবি।
রিতা ওয়েটারের দিকে হাত তুলে ইশারা করে।
তা আমি আসার আগ পর্যন্ত কী কথা হচ্ছিলো তোদের? সাবজেক্টে কারা কারা ছিলো ? রোকেয়া ওর কথা টেনে নিয়ে বললো , না বল, কে কে দাঁতের নিচে পড়েছে! ওর চারজনেই একসাথে হেসে ফেলে রোকেয়ার কথায়।
তুই কতদিন থাকবি মিনার ? এবার অনেকবছর বাদে এলি। অস্ট্রেলিয়া কত কাছে তাও আসিস না! রোকেয়া সবার জন্য গ্রিনটি ঢালতে ঢালতে বলে,
মিনারের কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বললো, অবশ্য এখানকার অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে। দেখছিস তো রাস্তাঘাটের কি জান জঞ্জাট, ভাল্লাগে না।
রোকেয়া, থামবি , মিনার এতদিন পরে এলো, ওর কথা শুনি না রে একটু।
স্যরি রে, জানিস তো আমি বরাবরই বেশি কথা বলি। তবে আর একটা কথা বলি? মিনার তোর শারিটা দারুণ রে। তোর মতই সুন্দর! আলতো করে মিনারের গালে চুমু দিয়ে বলে,
ইস এমন করে তাকাচ্ছিস কেন উষসী –নে নে মিনার খেতে খেতে এবার তোর কথা শুনি।
কি শুনবি , অস্ট্রেলিয়ার ওয়েদার না আমার জীবনের ওয়েদার!
সে আবার কি কথা মিনার ? কথাটা বলেই রোকেয়া বোকা চেহারা করে বলে, উফ এই চুপ করলাম আমি। কিন্তু এমন কথা বললে চুপ থাকা যায়!
একদম চুপ, উষসী ধমকে উঠলো।
রিতা আস্তে করে বলে,মিনার যে ওয়েদারের কথা তোর বলতে ইচ্ছে করে তাই বল।
মিনার হাসলো, প্রকৃতির ওয়েদার নিয়মে চলে, মেঘ আসলেও জানি মেঘ কেটে যাবে – বৃষ্টি আসবে আবার থেমে যাবে। প্রকৃতির ওয়েদার বদল আমাদের দরকার বেঁচে থাকার জন্য। জীবনের ওয়েদারের যখন তখন বদলে বেঁচে থাকতে কষ্ট হয়। শুধু বেঁচে থাকা। ওতে কোন প্রাণ থাকে না।
রোকেয়া ওর স্যুপের চামচ মুখের কাছে ধরেই হা করে কিছু বলতেই, রিতা ওকে ইশারায় থামালো।
না রে, আমাদের কোন এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার নিয়ে কষ্ট নেই। সেসব কিছুই না। খুব উল্টোরে ব্যাপারটা। ধীরে ধীরে কেমন এক দূরত্ব এসে গেলো। মানসিক থেকে শারীরিক! দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এত বড় হয়ে গেলো যে ডিঙ্গানো সম্ভব হয়নি আমাদের। আমারটা জানি। ওরও একই হতে পারে, সেটা ধরে নিয়েছি। একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে আমাদের আলাদা বসবাস – বাইরে আমরা এখন আগের পরিচয় পরিচিত!
মজার ব্যাপার এই আলাদা থাকা নিয়ে আমাদের ভিতর গত দশবছরেও কোন কথা হয়নি। যেন এমন হওয়ার কথাই ছিল- এটাই স্বাভাবিক।
তুই? প্রশ্নটা করেই রোকেয়া সবার দিকে একবার অপরাধীর চোখে তাকালো। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করে , তুই কখনো জানতে চাস নাই, তুই কখনো জাকির ভাইয়ের বিছানায় যাস নাই কেন?
সম্ভব হয়নি। মিনার ওয়েটারকে ডেকে আরেক গ্লাস রেড ওয়াইন দিতে বলে বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে বলে, এসব কথা বলতে গেলে একটু বেশি লাগে। ভয় করিস না। দুই তিন গ্লাসে আমার ধরবে না আর আমি তো ড্রাইভ করছি না।
মিনার রিতার হাতে চাপ দিয়ে বললো, আমি বলি কি জানিস আমাদের মধ্যে রিতা সবচেয়ে বুদ্ধিমান – বিয়ের রাস্তায় পা দিলো না। প্রেম ট্রেম নিয়ে মাথা ঘামালি না । কি রে আমি ঠিক বলেছি তো? আছিস তো এখনো ভার্জিনটি ধরে – অমনি থাক – বিয়ে, বিছানা একদম বেকার রে। একসময় ওটা একটা রুটিন এক্সারসাইজের মত। এক্সারসাইজ করতে গিয়ে অসাবধান হলে যেমন এখানে সেখানে ব্যথা হয়, মচকায়, নয়তো লিগামেন্ট ছিড়ে যা আর জোড়া লাগে না – আমাদের শারীরিক সম্পর্কের বেলায়ও তা-ই; ব্যথা, মচকানো তো আছেই, লিগামেন্ট একবার ছিড়ে গেলে আর জোড়া লাগে না।
রিতা এবার পালটা প্রশ্ন করলো, মিনার, তোর উদাহরণ যদি মেনে নেই তবে এটা তো ঠিক ছিড়ে যাবার জন্য একটা কারণ দরকার। যেমন তুই বললি অসাবধান হলে লিগামেন্ট ছিড়ে যায়। তাহলে তোদের মধ্যে কি কারণ ঘটলো যে এমন জীবন তোরা মেনে নিয়ে চলছিস বছরের পর বছর?
সন্দেহ!
মানে? সন্দেহ? ওরা তিনজন একসঙ্গে এত জোরে বলে উঠলো যে আশেপাশের টেবিল থেকে কয়েকজন ওদের দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে রিতা আবার জিজ্ঞাসা করে ,জাকির ভাই করে না তুই করিস?
জাকির! মাত্রাহীন সন্দেহ রোগ ওর।
মিনার, ছেলেরা একটু সন্দেহপ্রবণ হয়রে সোনা কেউ ওদের বউয়ের দিকে তাকালে, প্রশংসা করলে ওদের হিংসা হয়। আর তুই এত সুন্দর আবার শরীর তো এখনও কুড়িতে রেখে দিয়েছিস। সেই কারণেই …। ধেৎ আমি যদি আগে জানতাম, কবে মিটমাট করে দিতাম ।
উষসী এতক্ষণ চুপ করেই ছিল, রোকেয়া থামতেই বললো, সন্দেহের মাত্রা কতো তে উঠেছিলো।
মিনার না হেসে পারলো না উষসীর কথায়, বললো, উঠেছিলো না; বল কতো তে ওঠে আবার কত নিচে নামতে পারে! উপরে উঠলেও গায়ে লাগে তবে যখন অনেক নিচে নেমে সন্দেহ করে তখন আর পারা যায় না। কাকে নিয়ে করে না? বাড়ির ড্রাইভার থেকে নিজের ছোটবেলার বন্ধু – আমার বন্ধু, ভাই,ভাগনে – কে না! কার সাথে কথা বলি, আড়াল থেকে কানপাতা – একসময় বাড়ির এখানে সেখানে টেপ-রেকর্ডার।
মিনার প্লেট থেকে চিংড়ী মুখে দিয়ে বলে, বহুদিন পরে দেশী মালাই চিংড়ী – আহ; মজাই আলাদা।
ওদের তিনজনের হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, আরও আছে রে … অনেক আছে। আমার অফিসের আশেপাশে গাড়ি পার্ক করে বসে থাকতো – আমি কার সাথে বের হই দেখার জন্য।
অফিসের পার্টিতে একসময় যাওয়াই ছেড়ে দিতে হলো। কেউ আমাকে হাগ দিলে, চিবুকে ওদেশীয় রীতিতে কিস করলে তো ওখানেই গুম মেরে যেতো। হ্যাণ্ডসেইক করলে বলতো এসব বাঙালী মুসলমান মেয়েদের কায়দা কানুন না। ওর সাথে কোথায় যাওয়া মানে সারাক্ষণ চুপ করে মনখারাপ করে থাকা। হাসতেও ভয় লাগতো।
না রে গায়ে হাত তুলতো না। গালিও দেয়নি কোনদিন। তবে না দিলেও যেভাবে তাকাতো তাতে অকথ্য ভাষা, গায়ে হাত তোলার চেয়ে কম ছিলো না। ওর চোখের দিকে তাকালে আমার গা পুড়ে যেত ওর সন্দেহের বিষে । অথচ একটি সন্দেহ যদি সত্যি হতো আমার চেয়ে বেশি নত কেউ হতো না রে।
বিয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে পনেরো বছর এক বিছানায় থাকলেও ওর সাথে সেক্স করতে আনন্দ পেতাম কম। ওর ওই সব নোংরা ইংগিত মনে হলে গা ঘিন ঘিন করতো।

মাঝে মাঝে আমার মনে হতো প্রতারকস্বামী আর সন্দেহপ্রবণ স্বামী – এর মধ্যে কোনটা সহ্য করা যায় – না কী দুটোই সমান যন্ত্রণার সমান অপমানের?
উষসী বললো, এমন জীবনে না থেকে ডিভোর্স ফাইল করলি না কেন?
রোকেয়া এবার উদাস কণ্ঠেই বলে, প্রতারকস্বামী ভাবতেই কেমন গা শিউরে ওঠে রে।
উষসী এই প্রথম রোকেয়ার কথায় মাথা নিচু করলো । রিতার মনে হলো উষসী কিছুটা অজান্তেই করলো।

ওরা তিনজনই মিনারের দিকে তাকিয়ে রইলো – মিনার ওদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যরকম সুন্দর – ইউনিভার্সিটিতে ছেলেরে একবার ওর দিকে ঘুরে তাকায় নাই এমন হয় নাই । তারপরেও কঠিন ব্যক্তিত্বের জন্য ওর সাথে কেউ কখনো ফাজলামি করতে পারে নাই। পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতো সবসময়। জাকির কি করে মন জয় করলো সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় সবারই লেগেছিলো। সেই মিনার আজ এত অসুখী। বিবাহিত আবার বিবাহিত না – এর মাঝে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে পড়ে রয়েছে।
রোকেয়া হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, শোন রে তোরা থাক, মেয়েদের মায়ের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আমার বাড়ি ফিরতে হবে। মনির কাল সকালে নেপাল যাবে এক সপ্তাহের জন্য। ওর ব্যাগ গোছাতে হবে। আর বেচারা এতদিন বাইরে খাবে তাই আজ রাতে ডিনারের জন্য ওর পছন্দের আইটেম রান্না করবো। গোছাতে হবে সব।
তবে যাবার আগে একটা কথা বলি , যদিও তোরা আমার কথার দাম দিস না। তবু বলছি – একটু মানিয়ে নিতে হয় রে।
মিনার রোকেয়ার হাত টেনে বললো, আর দুই মিনিট বসে যা। আমার শেষকথা না শুনেই যাবি!
আরও আছে মিনার! আমার ভয় লাগছে রে – রোকেয়া প্রায় কেঁদেই ফেললো।
হ্যাঁ-রে আছে! উষসী, তুই জানতে চাইলি ডিভোর্স করলাম না কেন? কারণ কয়েকটা: প্রথম দিকে করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাচ্চাদের কষ্ট হবে ভেবে চুপ ছিলাম। তবে যখন করতে চাইলাম তখন জাকির একবারেই বেকে বসলো। ঝামেলা শুরু করলো আরেক ধারায়। অসহায় মনে হতো ওকে তখন । ও যেন মানতে পারছিলো না আমি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেবো। আস্তে আস্তে জাকিরের স্বভাবে কিছুটা বদল হলো – কারণ আমাকে বলার মতো অধিকার কিছুটা হারিয়েছে।
ও বুঝেছে যে অধিকার সে হারিয়েছে সে অধিকার ধরে রাখার চেষ্টা নেহাতই বোকামী।
রোকেয়া কিছু বলতেই মিনার ওকে আদর করেই বললো রকু তোর জীবনে এমন হোক আমি চাই না তবে স্বামী স্বামী করে নিজের সব মানসম্মান হারাতে নাই-রে। স্বামী বা স্ত্রী মানে এই নয় যে যা খুশি তা বলে যায়- সবটুকু অধিকার দিয়ে দিলে নিজের জন্য কী থাকে রে! অত নেংটা হতে পারলাম না ।
উষসী মিনারের কথার পিঠে বললো, কেউ যদি সেভাবে থেকে ভালো থাকে থাকুক না। যার যার ব্যক্তিত্বের ক্ষমতার উপরে তার তার চলাই ঠিক। তবে এটাই তোর শেষ কথা হতে পারে না- শেষকথা কী? তুই ফাইনালি ডিভোর্সড ? তাহলে সেলিব্রেশন হয়ে যাক! কি বলিস তোরা ?
তোদের মাথায় কি ডিভোর্স ছাড়া আর কোন সমাধান আসে না? কেন আর কিছু ঘটতে পারে না আমার জীবন! তোদের কাছে আমার ব্যক্তিত্ব কঠিন বলে আমার প্রেমে কেউ পড়তে পারে না?
রিতা উষসী চারদিকের কাঊকে তোয়াক্কা না করে হাই ফাই বলে মিনারের হাতে হাতের ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। আর রোকেয়া অসহায়ের মত ধপাস করে বসে পড়লো।
মিনার ওর তিন বান্ধবীর হাতের মধ্যে নিজের হাত রেখে বলে, এই প্রথম চুটিয়ে প্রেম করছি রে – একই প্লেনে ওর সাথেই ঢাকায় এলাম।
রোকেয়া চোখ মুছতে মুছতে বললো – লোকটি বিবাহিত? তোরা বিয়ে করবি?
মিনার তার সোজা সরল রকুর গালে টোকা দিয়ে বললো বিয়ে ডিভোর্স কোনটাই এখন মাথায় নেই – ভালোবাসতে ভালোলাগছে রে – ওখানেই থাকি না রে!
এই যে আমি এখন একটু ভালো আছি তাতে তোর ভালো লাগছে না ! আর না রে, বিবাহিত না। আমার চেয়ে প্রায় বিশ বছরের বড় এক অস্ট্রেলিয়ান। পড়াশুনা আর রিসার্চ করতে করতে পাত্রী দেখা হয় নাই – এখন ভগ্নস্বাস্থ্য! আমাকে বলে, আমি তোমার কেপ্ট। মানে আমার রক্ষিতা হয়েই বাকী জীবন কাটিয়ে দেবে!
ওরা তিনজন একসাথে হা হা হা করে হেসে উঠলো । উষসী বললো, অন্তত তুই প্রথম বাঙ্গালী নারী একজন পুরুষকে রক্ষিতা হিসাবে রাখবি।
না রে সেটা করবো না। আমি সত্যি ওকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কথাটা বিবাহ কথার চেয়ে আরো বেশি জ্যান্ত!
শেষমেশ রবীন্দ্রনাথ! রোকেয়া হেসেই বলে কিন্তু ওর হাসি যেন বিষাদে ভরা ছিল।
হ্যাঁ রে জীবনের এমন উজানে গুরুর বৈঠা যে টানতেই হয়। মিনার ও উদাস কণ্ঠেই জবাব দিলো।
রোকেয়া উঠতে উঠতে বলে, মিনার আমি অত বুঝি না রে – তবে তুই ভালো থাকলেই আমার ভালো লাগবে।
রকু দাঁড়া। , মিনার রোকেয়াকে বসিয়ে দিয়ে বলে, সেটেল্ডম্যারেজের বর মনিরকে নিয়ে সত্যি তুই ভালো আছিস? না -কী অ্যাইডিয়াল ম্যারেজের উদাহরণ হয়ে সমাজকে দেখাতে চাস? আমার মাথায় হাত দিয়ে বল, রবিনের জন্য মন কাঁদে না? আমরা তোর বন্ধু- কোথাও কাঁদতে না পারিস তাহলে আমাদের কাছে কাঁদ – হালকা কর নিজেকে। রোবোটের মত কত আর চলবি!

ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রোকেয়া ওদেরকে পিছে ফেলে রেস্তোরার দরজার হ্যান্ডেল একহাতে ধরে অন্যহাতে ওড়নার আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে বের হতেই উষসী রকু বলে দৌড়ে গিয়ে রোকেয়াকে কাছে টেনে নিয়ে আবার ওদের মাঝে ফিরিয়ে এনে বললো, যেহেতু মনির নেপালে যাচ্ছে ,কাজেই কালরাতে আমরা রকুর বাড়িতে সবাই মিলে রাত কাটাবো – রাজি? ধেৎ রাজি কী আবার – আমরা সবাই কাল রুকুর বাসায় স্লাম্বার পার্টি করছি ব্যস।
রিতার অবাক চোখে উষসী চোখ টিপে হাসলো। উষসীর সেই হাসিতে অপরাধবোধ, ব্যথা, পরাজয় নাই । কী আছে ওর হাসিতে!
রিতার ভাবনার মধ্যেই রোকেয়া ধাক্কা দিয়ে বলে, কী রে তুই কোথায় হারিয়ে গেলি – কাল রাতের ডিনার মেন্যুতে তোর জন্য কি রাখবো – উফ কতদিন পরে আমরা আবার একসাথে রাত কাটাবো
রিতার সেলফোনে ভেসে এলো মানসের মেসেজ- আগামী এক সপ্তাহের প্লান! রিতা তাকায় উষসীর দিকে – রোকেয়া হাতের উপরে হাত রেখে উষসী হাসছে –
সেই হাসিতে শুধু রোকেয়ার জন্য মায়া।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.