বৈশাখ ও সংস্কৃতিতে শ্রেণিঘাত

0
সৈয়দা রুখসানা জামান শানু

ব্যক্তি বিশেষকে ভুলে থাকা গেলেও নিজের জাতির সংস্কৃতিকে ভোলা সহজ নয়। তবে মনে রাখা এখন কিছুটা আত্মঘাতী বাঙালিতে রুপ নিয়েছে। সংস্কৃতিতে এখন শ্রেণিঘাত। তাই ব্যক্তি জীবনের সাথে জাতির জীবনও অদৃষ্টের নিয়মে আবদ্ধ। বাঙালি সংস্কৃতির বাগানে বর্তমানে ভালো গুণকে চাপা দেয়ার জন্য অসংখ্য আগাছা-পরগাছার জন্ম হয়েছে এবং সেসব নতুন সুরে নতুন রঙে শাখা-প্রশাখায় এতটায় বিস্তার লাভ করেছে যে এ সংস্কৃতির বর্তমান ধারক-বাহক একেবারেই জানেন না যে এটা একটি সংস্কৃতি নাকি শুধুই উৎসব। অথচ বৈশাখকে ঘিরে বর্তমান প্রজন্ম কম শব্দ চয়ন করেননি। বৈশাখি তান্ডব, কাল-বৈশাখি ঝড়, বৈশাখি কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, বৈশাখি সংকলন বের করা। লাল-সাদা রঙের পোশাকে শিল্পকলা চত্তরসহ সারাদেশের আনাচে-কানাচে আনন্দ-উৎসব উদ্যাপন হয়। এমনকি বিদেশেও যেখানে বাঙালিরা রয়েছেন সেখানেও দিন-ভর পিকনিক, গান, নৃত্য পরিবেশন এমন ছোট-খাট অনুষ্ঠান বৈশাখের সারা মাসব্যাপি হয়ে আসছে। এতকিছু হওয়া সত্বেও আমরা বাঙালি জাতি ভুলুষ্ঠিত বিবেকের কাছে জাত নিমের পাতাকে ভুলে বসেছি।

বৈশাখ শব্দটি কত ছোট, অথচ এর মাহাত্ম কত বড়। পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাসের প্রথম তারিখ। আমরা শুভ নববর্ষ বলে থাকি। এটা পৃথিবীর বাঙালির সর্বজনিন একটি লোকসংস্কৃতি উৎসব। কেননা উৎসবের সাথে সংস্কৃতি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। বিশ্বময় সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীতের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময়ময় হয়ে উঠুক। আর তাই বাঙালির এটি সর্বজনিন উৎসব।

.ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এ নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরু নিয়ম চালু করে। বৈশাখের পিছনের ইতিহাস দেখলে আমরা পাই, হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন বাংলা শুভ নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভও করতে হতো। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুভাবে প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। মূলত: আকবরের সময় কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়।

তৎকালীন সময়ে বাংলা নববর্ষ পালনের এক বিশেষ তাৎপর্য ছিল। মূলত এটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক ব্যাপার ছিল। চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষ করে স্বর্ণ দোকানদারসহ বড় বড় দোকানিগণও তাদের ক্রেতাদের সাথে লেন-দেনের হিসাব অর্থাৎ বকেয়া আদায় করে নতুন হিসাব চালু করেন। তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপনের চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
নববর্ষ উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পুজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।

নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। লোকজ মেলায় গ্রামের মানুষের ভিড় জমত। কিন্তু এখন বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম প্রায় শেষ। মেলা নানা ধরণের সাজ-সজ্জায় পরিনত হয়ে লোকজ মেলা এখন শহরমূখি। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়, প্রিয়জনদের উপহার দেয়া শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত।

এখন শহরে এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকজশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকল ধরণের হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী মেলায় পাওযা যায়। এছাডাও শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্যসহ বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়কগণের উপস্থিতি থাকে। তাঁরা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরণের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। অঞ্চলভেদে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ হয় মেলায়। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজে বৈশাখী মেলা বাঙালিদের কাছে এক অনাবিল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক। কিন্তু বর্তমান যুগ স্যাটেলাইট হওয়ার কারণে অনেক সময় দেখতে পাই, মেলাজুড়ে চলে হিন্দী গানের পরিবেশন এবং এ গানের সাথে ডিক্সো নৃত্য পরিবেশন। তখন মনে হয় বাঙালি জাতির বিবেক লুন্ঠিত হওয়ায় জাত নিমের পাতাকে ভুলে বসেছে। এটা কী সংস্কৃতিতে শ্রেণিঘাত নয়?

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.