সাদাত সায়েম এর গল্প: পুঁথিপাঠের আসর 

0

অবশেষে একদিন মন্নাফ হারিয়ে গেলো। চৈত্র মাসের কোন এক রাতে সে আর বাড়ি ফিরে এলো না। তার বুড়ো মা সারারাত কাঁদল, ফলে প্রতিবেশীরা জানতে পারল যে মন্নাফ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মন্নাফের বাবার অবশ্য কোন হেলদোল দেখা গেল না, গরিবের সাত সন্তানের মধ্যে একটা হারিয়ে গেলে তেমন কী যায় আসে! সকালবেলা পান্তা খেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তার কাজে — পৌরসভা অফিসে ছোটখাটো পদে চাকরি করত মন্নাফের বাবা। তাকে কেউ কোনদিন দেরি করে অফিসে যেতে দেখে নি, সেদিনও  তার কোন ব্যত্যয় হলো না। তবে সবুজ ঠিকই জানত তার বন্ধু চলে গেছে মনুমিয়ার কাছে, পুঁথিপাঠের তালিম নিতে। কিন্তু কথাটা সে কাউকে বলল না। 

গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনের উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মের ডানপাশে টিকেট কাটার ঘর, বামপাশে সিগন্যাল কক্ষ। মনুমিয়া বসত সিগন্যাল কক্ষের পাশে যে বড় রেইনট্রি ছিল তার নিচে, দুইজোড়া রেললাইনকে মুখোমুখি রেখে। মন্নাফ আর সবুজকে দেখলে লোকটা অবাক হতো, কারণ তার শ্রোতা আর ক্রেতাদের মধ্যে ছাত্র তো কেউ আর ছিল না। অষ্টম শ্রেণিতে উঠার পর পরই তারা দুই বন্ধু স্টেশনে যেতে শুরু করে। স্টেশন লাগোয়া আশা সিনেমা হলে মর্নিং কি ম্যাটিনি শো মেরে তারা চলে যেত স্টেশনে, ফুটব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখতে। পুঁথিপাঠের আসরের সাথে এইভাবে তাদের যোগাযোগ ঘটে। মনুমিয়া সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিন গৌরীপুর জংশনে আসত, ঠিক কোথা থেকে তা কেউ বলতে পারত না। তবে মনুমিয়ার কাছে থাকত একটা পাটের তৈরি ঝোলা, যা ছিল লোকটার পোশাকের সাথে বিসদৃশভাবে নতুন। মন্নাফ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মনুমিয়ার পুঁথিপাঠ শুনতো। সে বুঁদ হয়ে থাকত আছিয়া বিবির দুঃখে, যার একমাত্র সন্তান মৃত্যুর সাথে লড়ছে, সাপের বিষে নীল হয়ে গেছে তার সারা শরীর। আছিয়া বিবির ক্রন্দনে এমনকি জগতের তাবৎ সাপ র্পযন্ত মাতম করছে, যদিও তাদের স্বজাতি কেউ একজনই আছিয়া বিবির দুঃখের জন্য দায়ী।

পিঁড়িতে বসিয়া বিবি কান্দে জারেজার

আর কান্দে পক্ষীকুল, সর্প বেশুমার।।

পুঁথিপাঠ শোনার পর মন্নাফ আর সবুজ মনুমিয়ার কাছ থেকে নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা পুঁথি কিনতো। মন্নাফ সিনেমা দেখা আর পুঁথি কেনার টাকা সংগ্রহ করত তার মায়ের পোষা মুরগির ডিম লুকিয়ে বিক্রি করে। সবুজ মাঝে মধ্যে মন্নাফের মুভি দেখা আর পুঁথি কেনার খরচ দিতো, সবুজের পরিবার ছিল সচ্ছ্বল। পুঁথি কিনে মন্নাফদের বাড়ির পাশে বসে তাদের পুঁথিপাঠ চলত। পুঁথিপাঠের কায়দা-কানুন মন্নাফ দ্রুতই শিখে ফেলেছিল। সে বলত সে বড় হয়ে মনুমিয়ার মতো স্টেশনে স্টেশনে পুঁথিপাঠ করে বেড়াবে। তবে পুঁথিপাঠের কায়দা-কানুন আরো ভালো করে জানতে তাকে ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে হবে। তাই সে চৈত্র মাসের কোন একদিন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলো।

মন্নাফের এই উধাও হয়ে যাওয়ার ফলে সবুজের পুঁথিপাঠ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। সপ্তাহের ঐ নির্দিষ্ট দিনে সবুজ স্টেশনে যায় মনুমিয়া আসে কিনা দেখতে, কিন্তু সপ্তাহ চলে যায়, মাস চলে যায়, বছর চলে যায়, মনুমিয়া আর আসে না। ফলে সে তার বন্ধুর কোন খবর আর পায় না।  

মন্নাফ বাড়ি ফিরে আসে সবুজ ঢাকার একটা কলেজে যে বছর ভর্তি হলো তখন। সবুজের মা তাকে জানায় মন্নাফের বড়ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর কয়েক মাস পর মন্নাফ হঠাৎ একদিন বাড়ি এসে হাজির হয়। ভীষণরকম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, কারও সাথে তেমন একটা কথা বলতো না, নিজের ভেতরে গুটিয়ে গিয়েছিল। এতো দিন কী করেছে, কোথায় থেকেছে তাও স্পষ্ট করে বলতো না। জানার জন্য কেউ তেমন একটা চাপাচাপিও করত না, কারণ তখন মন্নাফের বাড়ির সবার ভাবনা ছিল তার বড়ভাইয়ের অকাল মৃত্যুকে ঘিরে। মন্নাফের ভাবীর বাবা সাফ বলে দেয় তার মেয়েকে সে এই বাড়িতে শশুর-শাশুড়ির সেবা করতে ফেলে রাখবে না। সে তার মেয়েকে নিয়ে যাবে, আবার বিয়ে দিবে। মন্নাফের ভাবী বাবার সাথে যেতে রাজি, কিন্তু সাথে করে তার চার বছররে মেয়েকে নিয়ে যেতে মরিয়া। কিন্তু মন্নাফের বাবার এক কথা— কোন অবস্থাতেই তার নাতনিকে নিয়ে যেতে দিবে না। এই পরস্থিতিতে মন্নাফের প্রধান র্কতব্য হয়ে দাঁড়ায় কোন একটা আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করা। তাই সে বাজারে একটা দোকানে কর্মচারির কাজ নেয়।   

সবুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মন্নাফ মারা যায়। দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মন্নাফের অসুখের  খবর সবুজ জানত না। যোগাযোগ ছিল না। মন্নাফ মারা যাওয়ার দুই কি তিনদিন আগে সবুজ বাড়িতে আসে কী একটা কাজে। অসুস্থতার খবর শুনে শয্যাশায়ী মন্নাফকে দেখতে গিয়েছিল। দেখিছিল আছিয়া বিবির সন্তানের মতো মন্নাফও মৃত্যুর সাথে যুঝছে। তবে তার শরীর নীল নয়, হয়ে উঠেছিল ভীষণ ফ্যাকাশে। সবুজকে দেখে শারীরিক যন্ত্রনায় গোঙ্গাতে থাকা মন্নাফ খানিকটা স্থির হল। কাঁপাকাঁপা গলায় বললঃ

‘দোস্ত, আমরা চলে গিয়েছিলাম………… দূর দূর স্টেশনে।‘

আবার হাঁপাতে শুরু করল মন্নাফ। কিন্তু আবার শক্তি সঞ্চয় করে বলল—

‘ওস্তাদ একদিন আত্মহত্যা করল। হ্যাঁ, মরে গেল, আমার চোখের সামনে, ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে। তার বউ চলে গিয়েছিল। অভাব, দোস্ত, অভাব!’

মন্নাফ আর কোন কথা বলতে পারল না, ভীষণ গোংগাতে শুরু করল।

সবুজকে যতটা সম্ভব মন্নাফের মুখের উপর ঝুকে কথাগুলো শুনতে হচ্ছিল কারণ কথা সে ফিসফিস করে বলছিল শারীরিক দূর্বলতার কারণে।

মন্নাফের ঘর হতে বের হতেই সবুজের সামনে পড়ল মন্নাফের বড়ভাইয়ের মেয়ে। মেয়েটার বয়স তখন ছয়। ফ্যাকাশে মুখ, অপুষ্টিতে ভোগা শরীর। তার মা বাধ্য হয়ে তাকে রেখেই অবশেষে চলে গিয়েছিল। মন্নাফের মা অর্থাৎ মেয়েটার দাদি তার পাশে দাঁড়ানো।

মন্নাফের মা বলল— বাবাজি, তুমি ত ঢাকা থাক, তাই তোমারে কই, কয়েকদিন বাদে ঢাকায় যে আমাদের আত্মীয় আছে তারা এসে নাতনিকে নিয়ে যাবে।

‘ওরা কি অনুকে স্কুলে পড়াবে?’ সবুজ জানতে চাইল।

‘না, শুধু ভাত দিবে।‘ ছয় বছরের অনু উত্তর দিলো।

মেয়েটার মুখে ‘শুধু ভাত দিবে’ কথাটা কেমন যেন ভয়াবহ শুনালো।

সেদিন রাতে সবুজ স্বপ্নে দেখে মন্নাফ একটা সুন্দর পাটের তৈরি ঝোলা কাঁধে সাইকেল চেপে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। আরও দেখল দূরে কোথাও হাঁড়িতে ভাত ফুটছে।

পরদিন মন্নাফ মারা যায়।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.