রুখসানা কাজল এর তিনটি অণুগল্প

0

মোতিমালা

বাড়ীর বগলে বসে নুনিয়াশাক তুলছিল মোতি।
হুসসস–ভেজা হাত মুখে বুলিয়ে চোখ টেপে ঠান্ডু, রাত্তিরে আসপানি বুঝিছিস !
ঢ্যামনা ! অজুর সুমাও পিত্তিভরা শয়তানি। জাত শয়তানের স্বভাব যাবে কোহানে!
মুখ খারাপের সঙ্গে আড়াইমনি পাতিলের সাইজ পাছা দুলিয়ে থু ফেলে মোতি। তিক্ত হয়ে উঠে ওর মন। তবু ভাবে, শুয়োরের বাচ্চাডা আসপে যহন আসুক! ঘরে চাল নুন তেল বাড়ন্ত। বাড়তি শরীরের মেয়েটার যখন তখন ক্ষুধা লাগে। কয়েক মাস ইশকুলের বেতনও বন্ধ। হাসপাতালে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে একা আর পেরে উঠছে না মোতিমালা।
অনেক রাতে কঞ্চি কাছনির পলকা গেট ঠেলে চোরা বিড়ালের মত ঘরে এসে ঢোকে ঠান্ডু। কাবাব তন্দুরের প্যাকেট টেবিলে রেখে এদিক সেদিক খুঁজে ফেরে। হতাশ হয়ে হাহাকার করে। মোতির হাত ধরে অনুনয়ে ভেঙ্গে পড়ে, তাতিয়ানাকে একবার ডাকপি মোতি ? খালি একবার!
ফুঁসে উঠে মোতি, রাত দুপ্পুরে সোহাগ মারাইও না তো তাতুর বাপ ! তাতু নাই। তুমি আসপা শুনি বাদলের বাসায় চলি গেছে।
বাদল মোতির ভাই। তিন রাস্তার মোড়ে পানবিড়ির দোকান দিয়ে লাল হয়ে উঠছে দিনকে দিন। সবাই বোঝে বাদল পানের আড়ালে টানের ওষুধও রাখে। তরুণ ছেলে ছোকরারা তাই ভিড় করে থাকে দোকানটায়। তাতিয়ানাও দোকানে বসে মাঝে মাঝে। সেদিন ভিড় বেড়ে ভিড়াক্কার। ঠান্ডু খবরটা যতবার শোনে ততোবার রাগে দুঃখে, হতাশায় মনটা মায়াময় হয়ে ওঠে। বুকের কোথায় যেনো মেয়ের ছোট ছোট হাতের আঁকশি আদর মনে পড়ে যায়!
ঠান্ডুর কেমন বাপ বাপ মার্কা টেনশন হয়, মোতিরে মেয়েটারে ইট্টু সামলি রাখিস তুই। যে দিনকাল পড়িছে!
ঝামরে উঠে মোতি, এহন আর বাপগিরি ফলাইও না। তালাক দিবার সু্মায় মেয়ার কথা ভাবছিলা একবারো ?
তাতিয়ানার জামা ঝুলছে আলনায় । লম্বা পাজামা । ফ্যানের বাতাসে সস্তা জর্জটের ওড়নার এক কোণা উড়ে উড়ে দুলছে। যেন আলনার আড়াল থেকে ছোট্ট তাতিয়ানা উঁকি দিয়ে বলছে, আব্বু টুকি ! বল ত আমি কোথায় ?
বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। মায়ের মতই সুন্দরী হয়েছে। তেমনি মুখরা। রাস্তাঘাটে ঠান্ডুকে দেখলেই বান্ধবীদের সাথে আওয়াজ দেয়, অই দেখ আমার বাপ শালা মেয়ে চাটছে। চল পালাই—
মোতিকে তালাক দিয়ে তিনবার বিয়ে করেছে ঠান্ডু। একটিও টেকেনি। এখন আর কেউ বিয়ে করার কথা বলে না। একলা বাড়িতে একলাই থাকে সে। নামাজ রোজায় মন দিয়েছে। শতবার ক্ষমা চেয়েছে, পা ধরেছে। দুরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছ মোতি। শাকপাতা খেয়েও হাত পাতেনি। ভাগ্যিস মেয়ের জন্যে কিছুটা নরম হয়েছে আজকাল। ঠান্ডুরও কি যেন হয়েছে । যখন তখন বুক জুড়ে হাহাকার নেমে আসে। খালি ঘরে মোতির কথা মনে পড়ে যায়। কান্না পায়। কাঁদেও সে।
মোতি এখন পরনারী। দেখা করতে হয় লুকিয়ে চুরিয়ে। রাতদুপুরে। অন্ধকারে। তাও অনেক সাধ্য সাধনার পর।
ডান কাতে ঘুমিয়ে আছে ঠান্ডু। মোতি বোঝে ঠান্ডুর তেজ শেষ। তার শরীর খোবলানোর আগেই ঝুলঝুলে ন্যাতা মেরে গেছে হারামজাদা ব্যাটা ।
ভোরের বাতাসের মত মায়া জাগে বুকের কোথাও। বুকের উপর ছোট্ট মেয়ে তাতিয়ানাকে বসিয়ে রোজ ভোরে ঠান্ডু গান গাইত, মেয়েও ঠিক সুরে উউউউউ করে গাইতে চেষ্টা করলে কি যে খুশি হয়ে উঠত ঠান্ডু, মোতি রে মোতি আমার মেয়েরে আমি গায়িকা বানাবো বুঝলি তুই।
আর গায়িকা ! তাতিয়ানা এখন নটি হচ্ছে। ছেলেদের ভাঙ্গিয়ে এটা সেটা খেতে, পেতে শিখে গেছে। কিছু বলতে গেলেই পনের বছরের মেয়ে এমন ঝাঁকি দেয়, চুপসে যায় মোতি। ভালোর ভালো এটুকুই, পড়াশুনায় দারুন মাথা মেয়ের। সেই মেয়ের তিন মাসের বেতন বাকি পড়েছে। ঠান্ডু কি বোঝে মেয়ে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ালে লোকে ঠান্ডুর মেয়ে বলেই জানবে ?
মায়ার সাথে কি এক ঘৃনা এসে জমে যায় বুকের ভেতর। ফজরের আজান পড়েছে। ঠান্ডুকে ডেকে দেয়, এই যে, এই যে শুনতিছো তাতুর বাপ। কেউ দ্যাখপার আগি চলি যাও দেহি !
ঘেয়ো কুকুরের মত ধুঁকে ধুঁকে হাটে ঠান্ডু। হোঁচট খায়, হাঁটু চেপে উঠে দাঁড়িয়ে বারবার পেছনে তাকায়। সুপারিগাছের পাশে মনে হলো যেনো মোতি দাঁড়িয়ে আছে ! মাথায় ঘোমটা ! আহা মোতির শরীরটা কেমন হাড়সর্বস্ব হয়ে গেছে। মেয়ের নাম করে সামনে মাস থেকে কিছু টাকা পাঠাবে। কোচিং করাতে হবে। মেয়ে ত তারও। হারুণ মাস্টার সেদিন কত প্রশংসা করলে তাতিয়ানার।
নিজের বাড়ির বারান্দায় উঠে ঠান্ডুর চোখে জল আসে, সেদিন কি যে হয়েছিল ওর ! কেন যে সে মোতিকে তালাক দিলো ! শুদ্ধ বাইন তালাক !

অন্তর্গত

রাইফেলের ট্রিগারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে আসে আইজ্যাক ইভানের আঙ্গুল। হেলমেটের নিচে ধুসর নীল দুটি চোখ। তাতে হঠাত করে হারানো কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দের সঙ্গে ভয়, ঘৃণা ধিক্কার আর আত্ম অনুশোচনার দ্রুত ওঠা নামা চলছে।
সামান্য কয়েক ফুট দূরে বুড়ো রাফাদ কম্যান্ডার টেনে হিঁচড়ে রেবেকাকে সামরিক জীপে উঠানোর চেষ্টা করে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। জীপের দরোজা জাপটে ধরে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে রেবেকা। অভিশাপের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। যেন মজা পেয়েছে সে ভাবে হাহা করে হাসছে কম্যান্ডার রাফাদ। আসলে এরকম তেজি মেয়ে পেলে ওরা খুব খুশি হয়। বেশ খেলে খেলে মেয়েটাকে ভোগ করা যায়। সেদিক দিয়ে ওদের ভাগ্য ভাল। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি মেয়েরাই তেজি আর একরোখা হয়। যতক্ষণ মেয়েদের দেহে প্রাণ থাকে, প্রতিপক্ষের কাছে হেরে যাবে জেনেও এরকম অসম লড়াই লড়ে যায় ওরা।
আইজ্যাক বুঝতে পারে রেবেকা আর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। পাহাড়ি রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে আরও কিছু ইসরাইলি সৈন্য। যুদ্ধের দামামায় মাছ শিকারের আনন্দে ওরা ফিলিস্তিনি মেয়েদের শিকার করে আনে। তারপর উৎসব বানায়। দিনের পর দিন। মাস। বছর। দশক পেরিয়ে আরও দশক।
আগামী কয়েক বছরের ভেতর পৃথিবীতে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র বলে কিছু রাখবে না এই প্রতিজ্ঞা আইজ্যাকসহ ওদের সকলের। তিন তিনবার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেছে আইজ্যাক। প্রথমবার রেবেকার আব্বা আইজ্যাককে কেড়ে নিয়েছিল নিজের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে। নইলে তিন বছর আগে হামাস গ্রুপের হাতে ওর মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে গেছিল। হেবরন থেকে সেদিন রাতেই জেরুসালেম পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল রেবেকার আব্বা ইউসুফ আঙ্কল । আইজ্যাক জন্মভুমি শহর, বিস্তীর্ণ আঙ্গুরক্ষেত, সদ্য নিহত বাবামার সমাধি রেখে পালিয়ে এসেছিল বেৎলেহম। বেৎলেহেমের ওয়াল পার হয়ে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে প্রায় এক মাস মৃত্যুর সাথে লুকোচুরি খেলে জেরুসালেমের কাছে ইহুদি বসতিতে এসে পৌঁছে গেছিল।
পালিয়ে আসার আগে ছোটবেলার বান্ধবী রেবেকা ওকে জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে বলেছিল, তুই পশ্চিমের কোন দেশে চলে যা আইজ্যাক। আমিও চলে আসব। ওখানে আবার আমাদের দেখা হবে। কেউ পারবে না আমাদের মিলন ঠেকাতে। কেউ না।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আইজ্যাক স্বেচ্ছায় ইসরাইল আর্মিতে যোগ দিয়েছিলো। এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো রেবেকার সঙ্গে সব যোগাযোগ। একুশ বছরের রক্তে জমাট বাঁধল দুঃসহ জাত ক্রোধ। উন্মত্ত প্রতিশোধ। শিরায় শিরায় নির্বিচার আগ্রাসন। যে করে হোক হেবরন ওদের দখল করতেই হবে। প্রিয় জন্মভূমি তার। কিছুতেই হেবরনকে প্যালেস্টাইনিদের কাছে ছেড়ে রাখা চলবে না। আর ফিলিস্তিন জাতি, থুঃ। যখনই কোন ফিলিস্তিনিকে ধরতে পেরেছে, তার উপর পুরো ম্যাগাজিন শেষ করে কুৎসিত উল্লাসে ভি চিহ্ন দেখিয়েছে ওরা । নির্বিচারে ধর্ষণ করে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে ধরে আনা ফিলিস্তিনি নারীদের দেহ । প্রেমিকা রেবেকার নাম মুছে গেছিল ওর হৃদয় মন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা থেকে। তিনটে বছর আইজ্যাক শুধু জপে গেছে ফিলিস্তিনিরা ওর শত্রু শত্রু শত্রু।
আজ যখন চারজন ফিলিস্তিন নারীর একটি দলকে ওরা ধরতে পেরেছে, বুড়ো কম্যান্ডার আনন্দে চুমু খেয়ে নিয়েছে নিজের অস্ত্রে । আইজ্যাক কিছুটা পেছনে ছিল। গ্রেনেড ছুঁড়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল অই চারজন নারীকে বহনকারী মাইক্রোটিকে। হঠাত কম্যান্ডারের উল্লসিত ডাকে ছুটে আসতে গিয়ে চমকে ওঠে আইজ্যাক। বুড়ো কম্যান্ডারের বুকে দুহাতে কিলচড় ঘুষি মারছে রেবেকা। হ্যা রেবেকাই ত ! জীপের পাল্লা ধরে রেখেছে শক্ত করে। কিছুতেই জীপে তোলা যাচ্ছে না।
বাঁ হাত থেকে ডান হাতে রাইফেল তুলে নেয় আইজ্যাক। রেবেকা আর কিছুক্ষণ পরেই হেরে যাবে। কিছুতেই পালাতে পারবে না । পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যে ইসরাইলি সৈন্যরা ছুটে আসছে তারা আইজ্যাকের মত মনুষ্য সন্তান হলেও মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছে বহু আগে। রেবেকার দুপায়ের মাঝখানে ডান পা ঢুকিয়ে দিয়েছে বুড়ো কম্যান্ডার । এবার একটি মাত্র ঝাটকা কেবল ! রেবেকা মুহুর্তে উলটে পড়বে মাটিতে। কম্যান্ডার ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে খামচে কিল ঘুষি মেরে বেহুঁশ করে ওখানেই ধর্ষণ করে অন্যদের সুযোগ করে দিবে। এরপরেও বেঁচে থাকলে রেবেকার ঠিকানা হবে ইসরাইলি ক্যাম্প। মরে গেলে পাহাড়ের ঢাল থেকে ফেলে দেওয়া হবে পাহাড়ি শেয়াল কুকুর বন্য জন্তুর মুখে। কে না জানে, যুদ্ধ এবং প্রেমে সব কিছুই জায়েজ।
শেষ বারের মত গোলাপী স্কার্ফে ঘেরা রেবেকার মুখখানা কম্যান্ডারের কাঁধের পাশ থেকে একবার ঝলকে উঠল। রেবেকাকে জড়িয়ে ধরেছে বুড়ো কম্যান্ডার।
পুরো ম্যাগাজিন শেষ করে রিভলবার নিজের মাথা বরাবর তাক করার আগেই আইজ্যাক উড়ে গিয়ে পড়ল বুড়ো কম্যান্ডারের মৃতদেহের উপর। রেবেকার আধখানা দেহ ঢেকে আছে কম্যান্ডারের শরীরের নিচে। শেষ কয়েক সেকেন্ড জীবিত আইজ্যাক কেবল স্কার্ফ ছুঁতে পারে। লালগোলাপি স্কার্ফ। হেবরনের বাড়ির পেছনে রেবেকা আর ওদের যৌথ বাগানে ফুল্ল হয়ে ওঠা আঙুরফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ নরম কচি ফুল যেনো !
ইসরাইলি সৈন্যদলের সাথে আসা ইহুদি বংশোদ্ভুত ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিকটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। রণাঙ্গনে এই প্রথম সে মানুষের রক্ত দেখছে । রক্তের রঙ এত লাল হয় ! ফিলিস্তিনি আর ইসরাইলি রক্ত মিলেমিশে পাথুরে মাটিতে এক অদ্ভুত মানচিত্র তৈরি করে ফেলেছে। তিনটি লাশ যেন যুদ্ধ অথবা শান্তির একটি মনোগ্রাম।
সামরিক জীপের ভেতর বন্দী, ভয়ার্ত অন্য তিনজন ফিলিস্তিনি নারী কাঁদছে। হাতের কম্পন লুকিয়ে তাদের ছবি তুলতে ক্যামেরা অন করতেই একজন ইসরাইলি সৈন্য ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিকটির সামনে দরোজা বন্ধ করে বলে ওঠে, নোওওওপ।


ভাতের লাহান

পান্থপথ থেকে সামান্য ভেতরে বিশাল এক তেঁতুলগাছ। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছায়া বিলোচ্ছে। সেই গাছের নিচে হুহু বাতাস বয়ে যায়। তীব্র দাবদাহে সেখানে ছালার বস্তা বিছিয়ে মুচি তার অস্থায়ী দোকান বিছিয়ে দিয়েছে। রিকসাওয়ালা, ফেরিওয়ালারা এসে খানিকক্ষণ জিড়োয়, গল্প করে কেউ বা ঝিমোয় আর ঘুমোয়। সেদিন গল্প করতে করতে টুপ করে ঝরে পড়ল একজন। কি হলো ? কি হলো রে ?
হায় হায় করে ছুটে আসে অন্যেরা। পথচারীরাও দাঁড়িয়ে যায়। সিরাজগঞ্জের সুমন মন্ডল কুলফি খাচ্ছিল আর ইয়ার্কি মারছিল লাল ফ্ল্যাটের দারোয়ানদের সাথে। কেউ একজন ডাক দেয়, সুমন রে সুমন শীগগির ছুটে আয়। তোর দাদা ফিট গেছে রে। ডাক শুনে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুমন, লাকুদাদারে তোর কি হইছে রে দাদা। ওরে তোরা পানি আন। পানি ঢালি সোঁতায়ে দে। গরম লাগিচ্ছে আমার দাদার।
তেঁতুলতলা পানিতে ছপছপ হয়ে যায়। লাকুর সাড়াশব্দ নাই। লাল ফ্ল্যাটের দারোয়ান বরফ এনে দেয়। লাকু মরার মত পড়ে থাকে। পান্থপথের ওপারে স্কয়ার হাসপাতাল। সুমন একবার ভাবে নিয়ে যাবে কিনা। কিন্তু ওদের সাহস হয় না। বড়লোকের হাসপাতাল। টাকার জন্যে বড়লোকদের মরা লাশও নাকি জেতা বলে কি এক ঘরে নাকে নল দিয়ে আটকে রাখে।
এক ছুটে পাড়ার মায়া ফার্মেসির কম্পাউন্ডার রাজুর হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসে সুমন। নাড়ি দেখে টেখে রাজু বলে যায়, স্যালাইন খাওয়া। মরে নাই। তবে অবস্থা বিশেষ ভাল না। আল্লাহ আল্লাহ কর তোরা।
লাকুর মাথা মুছে দিতে দিতে থমকে যায় সুমন। আল্লাহ ত মুসলমানদের। লাকুদাদা যে হিন্দু। লক্ষ্মণ কুমার দাস। ইশকুলে এক ক্লাশ উপরে পড়ত ওর। দুজনেই ক্ষেত মজুরের ছেলে। তবু পড়তে ভালোবাসত বলে ইশকুলে যেত। কিন্তু খরা, বন্যা আর নদীর ভাঙ্গনে ওরা সব হারিয়ে বড় রাস্তার ধারের বস্তিতে ঘর বানিয়ে নিয়েছে। নিদান কালে ইশকুল ছেড়ে দুজনেই বেরিয়ে এসেছে পেটের ধান্ধায়। রিকশা চালিয়ে যা পায় কিছু রেখে দুজনেই বাড়িতে বিকাশ করে দেয়। সাত সকালে দেড় মাইল হেঁটে দুজনের মা বেরিয়ে পড়ে কাজের বাড়িতে। ভাইবোনগুলো ইশকুলে যেতে চায়। যায়ও। বেতন বাকি থাকে বলে শিক্ষকরা বকাঝকা করে। লাকুদাদার দিদি রমলা হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। বস্তির ঘরে প্রায় রাতেই ফিরে আসে না। কেউ কেউ হাত ধরে টান দেয়। খারাপ কথা বলে। বিয়ে দেবে তার সাধ্য কই ! ওদের বিয়েতে অনেক টাকা লাগে। সুমন ভেবে পায়না এখন কি করবে। লাকুদাদার এরম অবস্থায় হিন্দুধর্মে কি বলে ওরা তো কেউ জানে না। কোন দোয়া পড়বে ওরা ?
এ সময় এগিয়ে আসে পদ্মাপারের সেলিম মির্যা। কুলফির বাক্সো বন্ধ করে লাকুর পায়ে বরফ ডলতে ডলতে হাঁক দেয়, এই তোরা সরে যা। এত ঘন হয়ি দাঁড়াইছিস ক্যান সবাই। বাতাস আসতি দে। কি কচ্ছিস তুই সুমন ? ডাকপি ? তা ডাক না ! আল্লারে ডাক, ভগমানরে ডাক। পারলি কলেমা পড়। কিডা কইছে তোগের, আল্লাহ আর ভগমান আলাদা ? গরীবের জন্যি তেনারা হচ্ছেন ভাতের লাহান। ও লাকু, সোনাভাইডি আমার। এইবার চক্ষু মেলি তাকাও তো দেহি একবার ! এত সহজে জানডা দিয়ে দিবা ! এডা কোন কামের কথা হলো ! চোখ মেলি তাকাও ভাইডি। ওঠো দিকি। আসো বিড়ি ফুকাই আমরা।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.