পাহাড় ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা নেমে আসছে।
এ মোটেলে ইলেকট্রিসিটি অনিয়মিত। এ বিষয়ে বিজ্ঞাপনে কিছু লেখা না থাকলেও, ট্যুরিষ্টরা জানে। তাই আর অনুযোগ করে না কেউ। কয়েকবার লাইট জ্বলেও নিভে গেছে। থিতিয়ে গেছে জেনারেটরের শক্তি। ঝুমা বুঝতে পারে না, মোটেলের কর্মীরা কিভাবে আসন্ন আদিম এই প্রাকৃতিক অন্ধকারকে আলোকিত করে তুলবে। আজ দুপুরে সে এখানে এসেছে। প্রচুর আলো ছিল তখন। অথচ ঝুপ করে কখন নেমে পড়েছে সন্ধ্যা। পাহাড়ি সন্ধ্যারা হয়ত এমনই স্বভাবের।
ঝুমার ভেতরে কোন তাড়া নেই। তাগিদ নেই। নামছে, নামুক অন্ধকার। থাকলে, থাকুক জমাট বেঁধে। যখন খুশি আলো আসুক। প্রকৃতির অন্ধকারে লজ্জা লুকিয়ে কিছুদিন থাকবে বলেই ত ও পালিয়ে এসেছে।
কেউ একজন হেঁকে গেলো, হুই নদীতে জল নেমেছে। জলদি জলদি ঘরে চল।
কি সুন্দর আহবান। যেন কেয়ামতের আগে কোন নবীন ফেরেশতা তার সোনালী ডানায় অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিতে মধুময় স্বরে ডেকে নিচ্ছে।
জানালার রেলিংএ মাথা গলিয়ে লোকটাকে খোঁজে ঝুমা। পাহাড়ি শণবন বাঁশবনের আড়ালে কাউকে খুঁজে পায়না। কে ডাকল নদীতে জল নেমেছে বলে? কাকে সে ডেকে নিল ঘরে ? ঘনায়মান অন্ধকারে বসে অদেখা লোকটার কথা ভাবে ও। লোকটির উচ্চারণে ছিল সুগভীর মমতা আর আন্তরিক ব্যগ্রতা। পাহাড়ি সে নয়। ঝুমা পাহাড়ি ভাষা জানে না। কিন্তু এ লোকটার ভাষা বুঝেছে। হয়ত পরিযায়ী কোন সমতলের শ্রমিক। পাহাড়ের এপার ওপার চোখ বুলিয়ে খুঁজে দেখল, নাহ্ কাউকে দেখা গেলো না !
ছাইমেঘ জমতে শুরু করেছে। আকাশ এবার রঙ্গীন পোশাক ছেড়ে আঁধারমানিক শাড়ি পরবে। এমন সময় জ্বলন্ত হারিকেন হাতে আদিবাসী মেয়েটি উঠে আসে। ওর ফর্সা গালের পাশে জমাট অন্ধকার। ছোট্ট লাল ঠোঁটে চাপা হাসি। রুমের এককোণে আঁচ কমিয়ে হারিকেন রেখে দেশলাই বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তুই কি একা আছিস ম্যাম ?
মাথা নেড়ে ভাব জমানোর সুরে ঝুমা বলে, তুমি চা খেতে ভালোবাস ?
মেয়েটি এবার জোরে হেসে উঠে। ঝুমাও হাসে, অহো স্যরি, চা খাও না বুঝি ?
খুব খাই। তোর কাছে বাদাম লাগানো বিস্কুট আছে ম্যাম ? মেয়েটির চোখে ছলকে ওঠে সরল লোভ।
— এখানেই থাকো ?
— হুম ! আমার মা এখন আছে সাত পাহাড় দূরে। হুই লালগিরি পাহাড়ে।
— তোমাদের বাড়ি ? আমাকে নিয়ে যাবে অই লালগিরিতে ?
হাটুঁর ভেতর মাথা ঢুকিয়ে হাসতে হাসতে কাত হয়ে পড়ে মেয়েটি, তুই কিচ্ছু জানিস না। দূরের পাহাড়ে যেতে তোদের নিষেধ আছে রে।
অবাক হয় ঝুমা ! মোটেল কর্তৃপক্ষ কি সেরম কিছু বলেছিল ? মনে করতে পারে না সে। ফ্লাস্ক খুলে চা দেয় মেয়েটিকে। নিজেও নেয়। কেমন প্ল্যাস্টিক গন্ধ চা। ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু চা ছাড়া সে ত থাকতে পারবে না। এসব পাহাড়ি বাজারে কি ইলেক্ট্রিক হিটার পাওয়া যাবে ? মেয়েটির নাম সিরিল। কাল সকালে ওকে নিয়ে বাজার ঘুরে আসবে সে। পুরো একটি নাটি বিস্কিটের সেট দিয়ে দেয় সিরিলকে। খুশি হয়ে যায় মেয়েটি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানায়, এখানে পাহাড়ি বিপদ আছে ম্যাম। তোকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। মেরেও ফেলতে পারে।
ঝুমা ওর সরলতায় হেসে বলে, তোমার সাথে গেলেও ?
মাথা নাড়ে সিরিল। খুলে জানায় ওর বাবা সমতলের একজন বুদ্ধিষ্ট। এই মোটেলে দারোয়ানের চাকরি করে। রাইফেল চালাতে জানে। কেউ কেউ তাই খুব রেগে আছে। ওর মাও এই মোটেলেই চাকরি করে। জুমের ফসল তুলতে সেই যে লালগিরিতে গেছে এখনও ফিরে আসতে পারেনি। পাহাড়ি বিপদরা মাকে বাঁধা দিচ্ছে।
সিরিল নিজেই দুঃখ করে, কতদিন মাকে দেখিনা। লালগিরিতেও যেতে পারিনা। আমার মামাটা বিপদদের সাথে হাত মিলিয়েছে ম্যাম। খুব সাংঘাতিক ওরা।
এতক্ষণে মোটা হয়ে নেমে আসছে অন্ধকার। সিরিল হারিকেনের আলো বাড়িয়ে রুমের মাঝখানে রেখে চলে যায়। মশাজালের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে তিমির তমসা। এমন সুন্দর সন্ধ্যাকে আবাহনের অঞ্জলি দেওয়ার জন্য এখানে কেউ নেই। আজানের প্রলম্বিত পূণ্য সুরধ্বনি নেই। নেই কোন ঘর যেখানে শঙ্খধ্বনির সাথে উচ্চারিত হবে সন্ধ্যা মন্ত্র। অনাঘ্রাতা সন্ধ্যা ঝুমঝুম পায়ে ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের কোলে কোলে। ঝুমার হঠাত মনে হল বৌদ্ধরা কি করে সন্ধ্যাকে আবাহন করে? এত বই পড়েছে কিন্তু কই কোথাও ত এ ব্যাপারে কিছু লেখা পায়নি ! আসার পথে বুদ্ধ মন্দির চোখে পড়েছে। তাছাড়া এখানকার অধিকাংশ মানুষই বুদ্ধিষ্ট। সিরিল ডিনার নিয়ে এলে ওর কাছে জেনে নিতে হবে সন্ধ্যাকে ওরা কি করে আবাহন করে সে কথা !
পার্টিশন পেরিয়ে ভেসে আসছে পাশের রুমের কচি বাচ্চাটার কান্না। বড় দুঃসাহস এই তরুণ দম্পতির। এত ছোট বাচ্চাকে নিয়ে এই আদিম পরিবেশে বেড়াতে এসেছে। ওরা হয়ত জানে না এখানকার মশা জুত মত কামড়ে দিলে ম্যালিগান্ট ম্যালেরিয়া হতে পারে। মোটেলকর্মীরা চারবেলা স্প্রে করে যাচ্ছে মশা তাড়াতে। খাওয়া দাওয়াও খুব সিম্পল। তবে ইচ্ছামত চা কফি খাওয়া যায়। ভ্রমণকারীর সাথে বিস্কিট পাউরুটি থাকলে চিন্তা নেই। দরকার পড়লে পাহাড় ভেঙ্গে চান্দের গাড়িতে চড়ে কাছের শহরে চলে যাওয়া যায়। খাদ্যরসিক অনেকেই খেয়ে আসে। আবার কেউ ঘুরতে বা বাজার করতে চলে যায়। ঝুমা এখন এসব নিয়ে কিছুই ভাবছে না। ও এসেছে মরতে। গত পনের দিন হাজার লক্ষ কোটি বার মরেছে ঝুমা। লজ্জা থেকে বাঁচতে বার বার চেয়েছে ওর মৃত্যু হোক। হঠাত করে ও মরে যাক।
এখানে আসার আগে আবির ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলেছিল, তোমার কি এমন লেখা যে ওরম বিপদসঙ্কুল জায়গায় ছুটে যাচ্ছ ? আজ পর্যন্ত কখনও মশারি টানিয়ে ঘুমিয়েছ ? বড় কোন অসুখ বাঁধাতে ইচ্ছা করছে তাইনা ?
সুটকেস গোছাতে গোছাতে ঝুমা বলেছিল, বেশ হয় মরে গেলে। আবার বিয়ে করে নিও নইলে পুরনো প্রেমিকাকে ঘরে নিয়ে এসো।
আবির হেসে ফেলেছিল, ধুর ! আবার বিয়ের জন্যে তোমাকে মরতে হবে কেন ? বিয়ে ত এখুনি করা যায়। আর পুরনো প্রেমিকা কেন আনব ? আনলে নিউ ব্র্যান্ড সুপার ফ্রেশ আনব।
ঝুমার মনে ছায়া জমেছিল বলে অন্যদিনের মতো না হেসে কিছু বই সুটকেসে ভরে দেয়। একটি গরম চাদর কিছুতেই ঢোকানো যাচ্ছে না। আবির চাদর নিয়ে ওকে সরিয়ে দেয়, ওঠো, আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। যাচ্ছো যাও। ওষুধগুলো নিয়েছ মনে করে ? ঝুমা কথা বলে না। উথাল পাথাল কান্না এসে ওর বুক চেপে ধরে। মায়াবি মানুষটা চাদর ঢুকিয়ে মেপে দেখছে সুটকেসের ওজন। পাহাড়ি পথে ঝুমা পারবে ত এই বোঝা বইতে ?
ছেলে আদনান কিছুতেই সাপোর্ট দিচ্ছিল না। রীতিমত উকিলের মত জানতে চাইছিল, মা তুমি কি এমন লেখো যে ভুরি ভুরি নির্জনতা দরকার তোমার ? টোটাল পাঁচজন কি পড়ে তোমার লেখা ?
আবির সেভ করতে করতে ফুটকি কেটেছিল, তোর মা রেয়ার লেখক। সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে।
শুধু মেয়ে বলেছিল, যাক না ঘুরে আসুক। মা ত কখনও একা কোথাও যায়নি।
আদনান রাগী চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে আগুন ঢেলে দিয়েছিল, তাতে তোর খুব সুবিধা হয় তাই না রে কাজু ?
কাজরীর গলায় হিম ঝরেছিল, তোরও ত হবে। ফাঁকা বাড়িতে আরামসে গাঁজা খেতে পারবি ! তারপর চেঁচিয়ে বলেছিল, আমি কিন্তু হোষ্টলে চলে যাব মা। পরীক্ষা আছে।
আমরা খাব কি আম্মু ? আদনান ছটফটিয়ে পড়লে আবির ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, শোন আদি, ওরা যেখানে খুশী যাক। তুই আমি নতুন নতুন রেষ্টুরেন্টের নতুন নতুন রান্না খেয়ে রোজ ঘরে ফিরব। কুছ পরোয়া মাত কর বেটা।
গৃহসুখে সুখী আবিরকে দেখে ঝুমার একবার মনে হয়েছিল, সব মিথ্যা ! যা জেনেছে সব মিথ্যা !! মিথ্যা !!! মিথ্যা !!!!
সারারাত ঘুম আসেনা ঝুমার। ডিনার নিয়ে এসেছিল সিরিল। সাদা ভাত আর পাহাড়ি পেঁপে দিয়ে ঢলঢলে মুরগীর মাংস। দুচামচ মুখে দিয়ে সরিয়ে রেখেছে। রান্না খারাপ নয়। যে কোন রান্না খেতে ঝুমা ভালবাসে। ওর মন খারাপ। ঝুমা জানে কাজরী হোস্টেলে চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সে। এবছর নতুন একটি প্রেমও কুড়িয়ে পেয়েছে। এখন কিছুতেই ঘরে থাকবে না। ছেলে আদনান গায়ে পায়ে বড় হয়েছে। প্রেম হয় কিন্তু অই দুই চার ছয় মাসের মাথায় ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন মন খারাপ করে থাকে। আবার কি করে যেন জুটে যায় আরেকটি নতুন প্রেম। এসব দেখেশুনে ঝুমা অবাক হয়ে যায়, হ্যারে এ কেমন প্রেম করিস তোরা !
কাজরী হাসে, তুমি বুঝবে না মা। এখন মন খারাপের মেয়াদ তিনদিন। ফার্স্ট ডে ব্রেকের ধাক্কা, সেকেন্ড ডে ঝেড়ে ফেলা, থার্ড ডে নতুন কারও প্রেমে পড়া।
ঝুমা আদনান কাজরীকে দেখে ভাবে, এই প্রজন্ম প্রেমের জন্যে কোনদিন ঘর পালাবে না, বিষ খাবে না, ঝুলে পড়বে না, ছাদ থেকে লাফিয়ে মরতে চাইবে না। বাবা মা পরিবার আপত্তি করলে, পাত্তা না দিয়ে লিভ টুগেদার করবে। মর্জি হলে বিয়ে করবে। সময় কি দ্রুত বদলে গেছে। আজকাল ঝুমাও অনায়াসে বলে বসে, তোর শিহাবমামুর বই উদ্বোধন হল। যা মজা করলাম আমরা।
ছেলেমেয়ে আবির জানতে চায়, কে কে এসেছিল ? কেমন হল ? স্বামীরাও এখন মুখ ভার বা ঝগড়া করে না। তাহলে ঝুমা কেন পারছে না ? আদনান যে বলে, মা তুমি ওল্ড ফার্নিচার ! সে কি তবে তাই?
বাইশ বছর আগে আবির ধানমন্ডিতে মেস করে থাকত। চারুকলায় ছবি প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে ওদের পরিচয় হয়। তরুণ ইঞ্জিনীয়ার, ভাল চাকরী করে। বিয়েও হয়ে যায় দুই পরিবারের সম্মতিতে। এতগুলো বছর তারা বেশ ভাল থেকেছে। গেল বছর চিটাগাং এসে একটি সাহিত্যসভায় একজন তরুণকে দেখে চমকে ওঠেছিল ঝুমা। একেবারে আবিরের মত দেখতে ছেলেটি। মেডিক্যালে পড়ে। ছুটে ছুটে কাজ করছিল। ভাল লেগে যায় ঝুমার। এরপর ফেসবুকে কথা হয়। দারুন ভালো কবিতা লেখে সুমিত। এখুনি ওর নাম ধরে অনেকেই প্রশংসা করে। ঝুমার সাথে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ঝুমা বলেছিল, পাশ করে ঢাকায় আসবে ত সুমিত?
সুমিত হেসেছিল, আব্বু আম্মুর করা এই হসপিটালের দায়িত্ব নিতে হবে। এটা আমাদের স্বপ্ন। ঢাকায় আসা হয়ত হবে না।
এ বছর একুশ উৎসবে ঝুমারা আবার এসেছিল চিটাগাং। সুমিত ওদের নিয়ে গেছিল পাহাড়ের উপর ছিমছাম ওদের বাসায়। সুমিতের ডাক্তার আব্বু আম্মু আর ছোট বোন মিলে সুখী পরিবার। রাতে হোটেলে ফিরেও জম্পেশ আড্ডা হয়েছিল ওদের। এক ফাঁকে সুমিত ছোট্ট করে ঝুমাকে বলেছিল, আমার আব্বুকে দেখেছেন ম্যাম?
খুব অমায়িক মানুষ। তুমি ত একদম তোমার বাবার ছায়া।
দুচোখে হাসি আটকে সুমিত জানিয়েছিল, ওর আব্বু ওর জন্মদাতা নয়। ও ওর আম্মুর প্রেমিকের সন্তান।
চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিয়েছিল ঝুমা। এত সহজে কেউ যে তার নিজের এমন পরিচয় উন্মোচন করে দিতে পারে ও ভাবতেই পারেনি ! এ প্রজন্মকে হ্যাটস অফ জানাতেই হয়।
ঢাকায় ফিরে গল্পটি জেনেছিল সে। ওর আম্মুর প্রেমিক ছিল সদ্য ইঞ্জিনীয়ার। সুমিতের নানার বাসায় মেস করে থাকত। ভালো চাকরি পেয়ে চলে যায় অন্য শহরে। এর কিছুদিন পর সুমিতের আম্মু বুঝতে পারে, মা হচ্ছে সে। প্রেমিককে জানালে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সে বলেছিল, নতুন চাকরি। আমাকে কিছুদিন সময় দাও প্লিজ।
সুমিতের আম্মু্র মনে অভিমান আর অনিশ্চয়তার ভয় জড়ো হয়েছিল। কেন ছুটে এলো না মানুষটা ! এটা ত সময় দেওয়ার ব্যাপার নয়। এদিকে সুমিতের নানাও সময় দিতে চায়নি। আত্মীয়স্বজন লোকলজ্জা সমাজ রয়েছে। দীর্ঘ সাতদিন প্রেমিকের দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সুমিতের আম্মুও আর ডাকেনি। প্রচন্ড স্বাভিমান নিয়ে বাবার বন্ধুর ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছিল। সুমিতের আব্বু খুব যত্নে রেখেছে সুমিতকে। কখনও কোনদিন অসন্মান করেনি সুমিত বা ওর আম্মুকে। বাইশতম জন্মদিনে সুমিতের একজন প্রেমিকা হয়েছে জেনে খুব খুশী হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে অন্যদের কান বাঁচিয়ে বলেছিল, ভালোবাসার মানুষকে কখনও অসন্মান করিস না বাবা। যে কোন বিপদে সাথে সাথে ছুটে আসবি তার পাশে।
ঝুমাকে এটুকু লিখে একটি ব্লাইন্ড ইমোর ছবি দিয়েছিল সুমিত।
গল্পের প্লট পেয়ে উত্তেজনা বেড়ে যায় ঝুমার। ওর জানতে ইচ্ছা করে কেমন লোক ছিল সুমিতের আম্মুর প্রেমিক। মানুষ এত ভিতু, কাপুরুষ হয় কেমনে ! একজন কাপুরুষ দেখবে বলে সে সুমিতকে বলে, লোকটার ছবি আছে কোন ? দেখো তো খুঁজে পাও কিনা ! ছবি না পেলেও নাম পরিচয় পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস পেয়ে ঝুমাকে জানিয়ে দেয় সুমিত, আমার কাছে লোকটি একজন বাতিল মানুষ। দেখুন আপনার গল্প লেখায় কোন কাজ দেয় কিনা !
ভুল করেও ঝুমা কখনো এমন হবে ভাবেনি।
ও খুঁজে পেয়েছে সুমিতের আম্মুর প্রেমিক সুমিতের কাপুরুষ জন্মদাতাকে। এবার কি করে সে জানায় সুমিতকে ? ফেসবুকে অনিয়মিত হয়ে পড়ে ঝুমা। লেখা আসেনা। আবিরকে সে গোপনে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কি নিষ্ঠুর মুখ। জীবনের কোথাও কোন স্মৃতি রাখেনি প্রথম চাকরির ! প্রথম প্রেমের ! প্রথম সন্তানের !
সুমিতের আম্মুকে দেখেছে ঝুমা। দুঃখলতাকে বাড়তে দেয়নি মহিলা। কিন্তু তাই কি সত্যি ? প্রতারণার অপমান কি এত সহজে ভোলা যায় যেখানে থাকে একটি সন্তান জন্মের ইতিহাস ! নাকি অপমানের যন্ত্রণাকে বিশেষ দুঃখের জায়গায় সংরক্ষিত রেখে মহিলা নিজের জীবনকে সাজিয়ে নিয়েছে ডাক্তারি, সেবা, স্বামী সন্তান সংসারের নিত্য মায়াজালে ! ঝুমাও ত সেভাবে অসুখি নয়। আবির দুহাতে ভরে দিয়েছে।
তবে ?
অন্ধকার সয়ে গেছে ওর চোখে। জানলার গ্লাস দিয়ে অন্ধকার গোলা প্রকৃতি দেখে মুষড়ে পড়ে সে। নিকষ কালো প্রেতছায়া মেশানো ছমছমে অন্ধকারকে সরিয়ে চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। যদিও কোন কিছুই দিনের মত স্বচ্ছ নয়। তবে এখানে সেখানের বাঁশবন, ফলবতী পেঁপেগাছ আর শণবনগুলো যেন মৃদু দুলছে। আলোর সাথে আলোমোতি খেলছে পাহাড়ি বৃক্ষ, ঘাস, দূরবর্তী ছায়া শূন্যতা। এতক্ষণে ওর মনে হয়, নিজের সাথে যে যুদ্ধ করে এখানে এসেছে সে যুদ্ধ একেবারে অকারণ।
কেন এলো সে ? সমস্ত রাত্রি অসংখ্য ব্যাখ্যা আর যুক্তিতর্ক তৈরি করে একা একাই বিতর্ক করেছে সে। কেউ কি দিব্যি দিয়ে ওকে বলেছিল, এসো ঝুমা। না এলেও ত পারত সে। কি দরকার ছিল অন্যের পুরনো ক্ষতকে খুঁচিয়ে জানার ! এ ক্ষতের সঙ্গে ওর ত কোন দায় নেই। তবে ? ও কি জোর করে জড়িয়ে পড়তে চাইছে ?
কিন্তু যে সত্যকে ও জেনেছে তার জ্বালা যে নিতে পারছে না ঝুমা। সুমিতকে ত বলেই ফেলেছে, লোকটাকে সে খুঁজে পেয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, আগ বাড়িয়ে বলাটা কি ঠিক হবে ? ঠিকানা জানা সত্ত্বেও সুমিত ত খুঁজে বের করেনি ওর প্রতারক জন্মদাতাকে !
তবে কি চেপে যাবে ? তাতে যে ওর আত্মার শুদ্ধতায় আঁচড় লাগবে। ঝুমা যে হেরে যাবে !
হেরে গেলেই বা কি ! জীবনের সবক্ষেত্রে কি জিততেই হবে। এরকম শতশত পরাজয় নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। তাছাড়া ওর সংসার ত স্মুদলি চলে যাচ্ছে। স্বামী বা পিতা হিসেবে আবির ত কোন খামতি রাখেনি ওদের। বাইশ বছর আগে হয়ত কোন অসুবিধা ছিল আবিরের। হয়ত গ্রামীণ বাবামায়ের মধ্যবিত্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আবির ফিরে গেছিল। ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে সুমিতের মায়ের। ভালো বিয়ে হয়েছে সে ত দেখাই যাচ্ছে। আবিরও সব মুছে ভালো আছে। তবে কেন সে এলো পুরনো ইতিহাস ঘাটতে ! থাক না পুরনো যা কিছু। অপ্রিয় ঘটনাগুলো না হয় পুরনো দিনের গর্তে থাকুক।
ঘুম কেটে গেছে ঝুমার। ইলেক্ট্রিসিটি এসে সব অন্ধকার ধুয়ে দিলেও কেরোসিনের গন্ধ জেগে আছে রুমে। ঝুমা সিদ্ধান্ত নেয়, সকালেই চলে যাবে। এ এক বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। সুমিত ভালো আছে। পিতা হিসেবে আবিরকে ওর কখনও প্রয়োজন হয়নি। ভবিষ্যতেও লাগবে বলে মনে হয় না। কিন্তু যদি আবির জেনে যায় ? জেনে যদি ঝুঁকে পড়ে এক সময়ের ব্রাত্য সন্তানের দিকে? ঝুমার সংসার পুড়ে যাবে। পুড়ে যাবে ছেলেমেয়েসহ ওর এতদিনের জমাটি শান্তি। সে কি ভালো হবে ? ঝুমার শুদ্ধ আত্মায় শঙ্কা কাঁপে। স্বার্থপরের মতো কুঁচকে ওঠে মন। আদনান কাজরীর মুখ মনে করে কিছুটা ঝিমুনি পায় ওর।
ভোরের শান্তি ভঙ্গ করে চেঁচিয়ে ওঠে কাকদল। নতুন সকালের নরম আলোতে ঝুমা ভাবে, এতগুলো বছর বাদে অন্যদের অশুদ্ধ করে কি লাভ ! তার পরিপাটি সাজানো সংসার। তিন বেড তিন বারান্দার ফ্ল্যাটে রৈরৈ করে ঘুরে বেড়ায় তার ছেলেমেয়ে। মায়াময় এক স্বামী। স্ফীত ব্যাংক ব্যালান্স। সামাজিক পরিচিতির উষ্ণ সম্মান। নিজের চাকরী আর লেখালেখি জগতের সহকর্মী আর বন্ধুমহল। জীবনের মোহময় এই সবকিছু কাঁচের মত ভেঙ্গে ফেলতে চাইছিল ঝুমা। কি বোকা সে। ভুলে গেছিল, নিত্যদিনের সংসারে কিছু ভেজাল বা গোঁজামিল থাকেই। সংসারে নিত্য সং সেজে কত রকমের যে কন্টক এসে ভেঙ্গে দিতে চায় এই মায়ার বাঁধন!
সারারাত জেগে থাকা প্রবল নদীটি এখন শান্ত । জল বয়ে যাচ্ছে খরখর শব্দে। ওপারে শণবনের মাথায় সূর্য উঠে গেছে। গুচ্ছ গুচ্ছ লালরঙ হারিয়ে যাচ্ছে কালো জলের অতল তলে। আলো স্পর্শে কাঁপছে নদী! দিন উঠে আসছে দীপ্তপ্রবল মেখে। ঝুমা কেঁদে ফেলে। যে অপমান ওকে ছেয়ে ফেলেছিল একজন কাপুরুষের স্ত্রী হিসেবে তা এখন গলে গলে ঝরে পড়ছে। কাঁচা বেতফলের কষের মত কষ্টে দুমড়ে যাচ্ছে ওর হৃদয়। কষ্টটাকে নামিয়ে দিতে নীচে নেমে আসে। নদীটিকে খুঁজে বের করে। খাড়া পাড় ধরে ঝুকে ঝুকে নেমে আসে নদীজলের সমতলে। কালো জলে ছায়া ভাসে না বলে ওর স্বার্থে অন্ধ মুখখানি দেখা যাচ্ছে না। তবু ভোরের দুলুনিতে দুলে যাওয়া এই জলে বুনো শণপাতার ছেঁড়া টুকরোর মত ওর ভেসে যেতে ইচ্ছা করে। নদী আমাকে নে ! ঢেকে রাখ তোর বুকের গহন জলে!
দুপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে সুমিত আর রূপা।
সরল রাগে বকা দেয় রূপা, আপনি কি পাগল ম্যাম! এভাবে কেউ পাহাড়ি নদীতে নামে। এ নদী কত ভয়ঙ্কর জানেন?
–কি কান্ড করেছেন ম্যাম— সারপ্রাইজ দেব বলে এসে দেখি আপনি রুমে নেই। গল্পের খোঁজে বেরিয়ে ইন অ্যা মোমেন্ট আপনি নিজেই ত গল্প হয়ে যাচ্ছিলেন।
সুমিতের গলায় প্রগাঢ় বন্ধুতা। ঝুমাকে শক্ত করে ধরে মজা করে বলে, বুঝলি রুপু, সাহিত্যে এবারের নোবেল ম্যাম পাচ্ছেনই পাচ্ছেন। তো এবার উঠে আসুন দেখি, অ্যাডভান্স সেলিব্রেশনটা সেরে ফেলি আর আপনার ইন্টারভিয়ু নিই।
রুখসানা কাজল: কথাসাহিত্যিক