আফ্রিকার জুলুদের দেবতা উনকুলুনকুলু গিরগিটিকে ডেকে বললেন, গিরগিটি তুমি মানুষের কাছে গিয়ে তাদের বলো তারা মরবে না, তারা চিরকাল বেঁচে থাকবে কিন্তু মৃত্যু হবে না তাদের। কিন্তু অলস গিরগিটি চললো ঢিমে তালে পা ফেলে, তার উপর পথের মধ্যেই উবুকুয়েবেজানি গাছের পাকা বেগুনি রঙের ফল দেখে তাই খেতে শুরু করলো পেট ভরে। শুধু তাই নয় গাছের মগডালে চড়ে বসে নরম রোদে শরীর মেলে দিয়ে পড়লো ঘুমিয়ে। এদিকে দেবতা উনকুলুনকুলু ব্যাপারটা নিয়ে আবার ভাবতে গিয়ে মত বদলে ফেললেন আর টিকটিকিকে ডেকে বললেন, ওহে টিকটিকি মানুষের কাছে গিয়ে তাদের বলো তারা বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকার পর মরে যাবে আর সেটাই তাদের জীবনের শেষ। টিকটিকি কিন্তু দেরী করলো না সে দ্রুত ছুটতে ছুটতে অলস গিরগিটিকে পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে আগেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেবতা উনকুলুনকুলুর আদেশটা জানিয়ে দিলো। এদিকে হেলতে দুলতে গিরগিটি মানুষের কাছে এসে যখন তাদের অমরত্বের সংবাদ জানালো তখন সবাই বলতে লাগলো এ কি করে হয় দেবতা টিকটিকিকে দিয়ে জানিয়েছেন মানুষ হবে মরণশীল। মানুষেরা বলতে লাগলো আমরা আসল দৈববাণীটি পেয়ে গেছি এখন আর গিরগিটির কথা শুনে লাভ নেই। শোনা যায় সেই থেকে মানুষের জীবনে মৃত্যু দেখা দিয়েছিলো। জুলুরা ভাবে টিকটিকিটা অত জোরে ছুটে এসে যদি না জানাতো তাহলে মানুষ আর কখন ওই মরতো না, সব দোষ এই টিকটিকির। তারা টিকটিকি দেখলেই তাই মারতে যায়। জুলুদের কেউ কেউ অবশ্য ভাবে টিকটিকির চেয়ে দোষ বেশি গিরগিটির এই অলস অপদার্থটা যদি পথে অযথা সময় নষ্ট না করে ঠিক সময়ে টিকটিকির আগে এসে অমরত্বের খবরটা দিতে পারতো তবে আর কাউকেই কোনোদিন মরতে হতো না। বান্টু গোত্রের বেচুয়ানা, বাসুটোস, বারোঙ্গাদের মধ্যেও এই কাহিনি প্রচলিত আছে। বারোঙ্গার শিশুরা তাই গিরগিটি ধরতে পারলেই তার মুখ জোর করে খুলে এক চিমটি তামাক ঠুসে দেয়। গিরগিটি তখন যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কেবলই শরীরের রঙ পাল্টাতে থাকে। এই হলো মানুষকে অমরত্ব থেকে বঞ্চিত করবার শাস্তি।
কীভাবে যে মানুষের জীবনে মৃত্যু এলো এনিয়ে কাহিনির শেষ নেই। এই আফ্রিকারই বান্টু জাতির আকাম্বাদের একটা গল্পে পাচ্ছি সৃষ্টিকর্তা গিরগিটি আর থ্রাস পাখিকে বার্তাবাহক করে মানুষের সমাজে পাঠালেন একটা সুখবর জানিয়ে। সুখবরটা হলো মানুষ মারা গেলেও মৃত্যুর পরদিনই তারা আবার জীবন ফিরে পাবে। গিরগিটি তাই কয়েকটা মৃত মানুষের কাছে গিয়ে তাদের ডাকতে শুরু করলো। কিন্তু তার স্বরকে ডুবিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো পাখিটি বললো, কী সব আবোল তাবোল বকছো। গিরগিটি বললো, যারা মৃত্যুর পথে এগিয়ে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যই ডাকছি। এই কথায় লাশগুলো চোখ খুলে পিট পিট করে তাকাতে লাগলো আর কান খাড়া করলো সবটা শোনার জন্য। কিন্তু সে মুহূর্তেই থ্রাস পাখিটি চেঁচিয়ে উঠলো, যারা মরে গেছে তারা মৃতই থাকবে তারা আর কখনওই জীবন ফিরে পাবে না। এই কথায় লাশগুলো ফের চোখ বুঁজে লাশ হয়েই পড়ে থাকলো। গিরগিটির শত ডাকেও আর কেউ সাড়া দিয়ে জীবিত হয়ে উঠলো না। হতাশ গিরগিটি দেবতার কাছে ফিরে তার ব্যর্থতার কথা জানালে দেবতা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে এটা হলো। গিরগিটি তখন উত্তর দিলো, সে দেবতার বার্তাই বলতে শুরু করেছিলো কিন্তু পাখিটি এতো চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করলো যে তার বাণী আর লাশগুলো শুনতেই পায়নি। পাখিটি কিন্তু ভালো মানুষের মত জবাব দিলো, গিরগিটি দৈববাণীর সবটাই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলো তাই সে শুধু তাকে শুধরে দেবার জন্যই মুখ খুলেছিলো। সরল দেবতা পাখির চালাকি ধরতে পারলো না কিন্তু সেই থেকে মানুষের জীবনে মৃত্যু স্থায়ী হয়ে দাঁড়ালো। পাখিটা বাগড়া না দিলে মারা যাবার পরদিনই ঠিক আবার আমরা জেগে উঠতাম।
আফ্রিকার টোগোল্যান্ডের উপজাতির মধ্যে প্রচলিত আছে মানুষ একবার কুকুরকে পাঠালো দেবতার কাছে একটা আর্জি নিয়ে। আর্জিটা হলো মানুষেরা চায় মৃত্যুর পর আবার যেন সবাই বেঁচে উঠতে পারে। পথে যেতে যেতে কুকুর দেখলো একটা বাড়িতে চুলোর ওপর একটা হাঁড়ি চড়ানো হয়েছে। সে ভাবলো ভালো কিছুই নিশ্চয় রান্না হচ্ছে, তাহলে এখানে খাওয়া দাওয়া করেই যাওয়া যাক এই মনে করে সে সেখানেই বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। এদিকে ব্যাঙও কিন্তু দেবতার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তাকে কিন্তু কেউই দেবতার কাছে পাঠায়নি কোনো আর্জি নিয়ে। সে নিজে নিজেই নিজের কুট বুদ্ধির বশে কুকুরের আগে দেবতার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করলো মানুষেরা মৃত্যুর পর জীবন ফিরে পেতে চায় না, তারা চায় তারা মৃত হয়েই থাকবে। ঠিক এই সময় কুকুরও সেখানে পৌঁছে মানুষের আর্জিটা দেবতাকে জানালো। দেবতা এই দু’রকম আর্জি শুনে ভিরমি খেলেন। শেষটায় ভাবলেন ব্যাঙের আর্জিটা যেহেতু প্রথম শুনেছেন সেটাই তিনি মঞ্জুর করবেন আর করলেনও তাই। আর সেই থেকে মানুষ একবার মারা গেলে আর কিছুতেই জীবন ফিরে পায় না।
মৃত্যু নিয়ে হটেনটটদের মধ্যেও একটা গল্প আছে। সে গল্প চাঁদ আর খরগোসের গল্প। একবার চাঁদ খরগোসকে মানুষের কাছে পাঠালো এই সংবাদ দিয়ে, যেমন আমি চাঁদ মৃত্যুর পরও আবার জীবিত হয়ে ফিরে আসি মানুষও মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়ে উঠবে। এখন খরগোস লোকটা যে ভালো ছিলো না তা বেশ বোঝা গেলো যখন দেবী চাঁদের আশীষবাণীটা পাল্টে সে মানুষকে জানালো যে দেবী জানিয়েছে, যেমন আমি চাঁদ মৃত্যুর পর আর জীবিত হই না কোনো মানুষই আর মৃত্যুর পর জীবন ফিরে পাবে না। দেবীর কাছে যখন খরগোস ফিরে গেলো তখন দেবী এই শয়তানী করে উল্টো বাণী দেবার জন্য রেগে আগুন হয়ে উঠলো আর একটা লাঠি খরগোসের দিকে ছুড়ে মারলো। সেই আঘাতে খরগোসের উপরের ঠোট কেটে গেলো। সেই থেকে সব খরগোসেরই ওপরের ঠোঁটটা কাটা। আর খরগোসও কম যায় না সেও দেবী চাঁদের মুখ খামচে দিয়ে পালালো। সেই থেকে চাঁদের গালে আজও খরগোসের খামচে দেবার দাগ রয়েই গেছে। এখন খরগোসের কাটা ঠোঁট আর চাঁদের গালের খামচির দাগের চেয়েও বড় ক্ষতিটা কিন্তু মানুষেরই হলো মৃত্যুর পর জীবন ফিরে পাবার সম্ভাবনার পুরোটাই মাটি হয়ে গেলো।
আফ্রিকার মাসাইদের মধ্যে প্রচলিত গল্পে দেবতা নাইতেরুকপ লি-ইও নামের একজন মানুষকে ডেকে বললেন তাদের কোন সন্তান মারা গেলে লাশটা ফেলে দেবার আগে মন্ত্রের মত বলতে হবে মানুষ মারা যায় এবং আবার ফিরে আসে কিন্তু চাঁদ মৃত্যুর পর আর ফিরে আসে না। এই মন্ত্রটা বললে সেই মৃত সন্তান আবার বেঁচে উঠবে। কিছুদিন পরই একটা শিশু মারা গেলো কিন্তু তা লি-ইওর সন্তান ছিলো না বলেই লি-ইও মন্ত্র পড়ার সময় বললো, মানুষ মরে গেলে মৃতই থেকে যায় কিন্তু চাঁদ মৃত্যুর পর আবার ফিরে আসে। কিছুদিন পর কিন্তু লি-ইওর নিজের সন্তানই মারা গেলো। এবার লি-ইও মন্ত্র পড়তে লাগলো এই বলে যে, মানুষ মারা যায় এবং আবার ফিরে আসে কিন্তু চাঁদ মৃত্যুর পর আর ফিরে আসে না। বোঝাই যায় নিজের সন্তান আবার জীবিত হয়ে উঠুক এইটাই তার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু দেবতা সব দেখছিলেন তাই তিনি বললেন, উঁহু এটা হবে না অন্য মানুষের ছেলেটার বেলায় তুমি যে মন্ত্র পড়েছিলে সেটাই এখন নিয়ম হয়ে গেছে। এখন আর তোমার নিজের ছেলে জীবিত হয়ে ফিরে আসবে না। সেই থেকে মানুষ মৃত্যুর পর আর ফিরে আসে না কিন্তু চাঁদ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়েও জীবন পেয়ে আবার ফিরে আসে।
ফিজির অধিবাসীদেরা বলে চন্দ্র দেবতার ইচ্ছে ছিলো মানুষ হবে তারই মত, যেমন চাঁদ ক্ষয় পেতে পেতে নিঃশেষ হয়েও আবার ফিরে আসে মানুষও মৃত্যুর পর আবার ফিরে আসবে। কিন্তু সে সময় ইঁদুরও ছিলো একজন দেবতা সে কোনক্রমেই এটা মানতে চাইলো না। সে হেঁকে বললো মানুষও ইঁদুরের মতই মারা যাবে এবং আর ফিরে আসবে না। তার জন্যই মানুষের আর অমর হওয়া হলো না। অস্ট্রেলিয়ার উওটজোবালুক উপজাতির লোকেরাও বলে, অনেক আগে কোনো মানুষ মারা গেলে চাঁদ তাদের ডেকে বলতো আবার উঠে দাঁড়াও। ব্যাস তারা আবার জীবন ফিরে পেতো। কিন্তু একবার এক বৃদ্ধ বলে উঠলো তারা মৃতই থাকুক। সেই দিন থেকে আর কেউই মৃত্যুর পর আর জীবন ফিরে পায়নি।
এই অস্ট্রেলিয়ারই উনমাতিয়েরা ও কাইটিস গোত্রের মধ্যে প্রচলিত আছে অনেক অনেক কাল আগে কেউ মারা গেলে লাশটা গাছের খোঁড়লে বা মাটিতে কবর দিয়ে আসার তিন দিন পরই সে আবার জীবিত হয়ে উঠতো। এমনটাই চলছিলো কিন্তু একদিন কার্লিউ টোটেমের একজন যখন দেখলো ওয়ালাবি টোটেমের লোকেরা তাদের একজনকে কবরস্থ করছে তখন সে লাথি মেরে লাশটা সাগরে ফেলে দিলো। এমনটা করায় আর কোনো লাশই তিন দিন পর জীবন ফিরে পায়নি। চাঁদ যেমন ক্ষয় হতে হতে শেষ হয়ে যাবার পরও তিনদিনের মাথায় আবার ফিরে আসে এখানেও হয়তো সেই ধারণার বশেই তিন দিনের উল্লেখটা রয়েছে যদিও চাঁদের কোনো উল্লেখ নেই। চাঁদের এই যে পুনরায় জীবিত হয়ে ওঠার বা জীবিত করে তোলার ক্ষমতা আছে এ বিশ্বাসটা অন্যত্রও দেখি। যেমন ক্যলিফোর্নিয়ার সান-জুয়ান-ক্যাপিস্ত্রানোর ইন্ডিয়ানরা নতুন চাঁদ উঠলেই ছেলে বুড়ো সকলে মিলে বৃত্তাকারে নাচতে শুরু করে আর গেয়ে ওঠে চাঁদ যেমন মৃত্যুর পরও জীবন পেয়ে ফিরে আসে আমরাও মৃত্যুর পর তেমনি জীবিত হয়ে উঠবো আবার। কঙ্গোর আদিবাসীরাও নতুন চাঁদ উঠলে হাঁটু গেড়ে বসে তালি দিয়ে গেয়ে ওঠে, হে চাঁদ তুমি যেমন আবার নতুন হয়ে উঠলে আমাদের জীবনেও তেমনি করে নতুন প্রাণশক্তি পুরে দাও।
মেলানেসিয়ার গ্যাজেল উপদ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত মিথেও মৃত্যুর আবির্ভাব নিয়ে একটা কাহিনি আছে। টো-কাম্বিয়ানা মঙ্গলময় দেবতা মানব সন্তানদের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা আর তাই তিনি চান তারা অমর হয়ে উঠুক, মৃত্যু যেন তাদের জীবনে ছেদ না আনে। আর অন্য দিকে সাপ তার দু’চক্ষের বিষ, তিনি তাদের মোটেই পছন্দ করেন না। ভাই টো-করভুভুকে ডেকে একদিন বললেন সে যেন মানুষদের কাছে গিয়ে তাদের অমরত্বের গোপন সূত্র দিয়ে আসে। আর এর ফলে মানুষ প্রতি বছর তাদের চামড়ার পুরনো খোলস ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করবে আর এভাবেই তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। আর সাপেদের জন্য রইলো মৃত্যু যার পর আর তারা জীবন ফিরে পাবে না। কিন্তু টো-করভুভুর অভিপ্রায় ছিলো ভিন্ন সে অমরত্বের সূত্রটা পৌঁছে দিলো সাপেদের কাছেই আর মানুষের ভাগে দিল মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যাবার নিয়তি। আর তাই সাপরা প্রতি বছর খোলস ত্যাগ করে নতুন দেহ, নতুন জীবন পায় আর এভাবেই মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে অনন্তকাল অমর হয়ে আছে, কিন্তু মানুষ হয়ে দাঁড়ালো মরণশীল এক প্রাণী।
আনাম এর অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনিটা আগের কাহিনির মতই তবে দেবতার কাছ থেকে আসা সংবাদ বাহক কোন ছল-চাতুরির আশ্রয় না নিয়েই দেবতার আদেশ হুবহু বর্ণনা করে কিন্তু দুর্ভাগ্য তার একদল সাপ কাছে পিঠেই ছিলো তারা শোনা মাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সংবাদ বাহককে হুমকি দেয় তারা তাদের বিষাক্ত ছোবলে তাকে মেরেই ফেলবে যদি না সে দৈববাণীটি উল্টো করে ঘোষণা করে যাতে সাপ খোলস ত্যাগ করে প্রতি বছর নতুন করে জীবন পায় আর মানুষের অস্তিত্ব মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যায়।
সুমাত্রার নিয়াসের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত গল্পে দেখি সৃষ্টিকর্তা যখন বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করছিলেন তখন একজনকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন সৃষ্টিকর্মের একেবারে অন্তিম পর্বের কিছু সামান্য কাজ করে সৃষ্টির কাজটাকে সম্পূর্ণ রূপ দেবার জন্য। এই কাজটা করবার সময় একমাস ধরে তার উপোষ থাকার কথা কিন্তু সে বেচারা ক্ষিধের জ্বালায় কয়েকটা কলা খেয়ে ফেললো। ফল যা হবার তাই হলো, মানুষের আয়ু হয়ে দাঁড়ালো সেই কলা গাছের মত। কলা গাছে ফল আসার পরই যেমন কলা গাছ মারা যায় তেমনি নিয়তি হয়ে দাঁড়ালো মানুষের। মানুষেরও সন্তান সন্ততি জন্মের পর থেকেই সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কলা না খেয়ে ভাবার হিসেবে কাঁকড়া নির্বাচন করলে কিন্তু মানুষের এ দুর্গতি হয় না। মানুষ তখন কাঁকড়ার মতই খোলস পাল্টে পাল্টে প্রতিবার নতুন করে বেঁচে উঠতো তাকে আর মরতে হতো না।
নিউহেব্রাইডস এর ব্যাঙ্কস দ্বীপের অধিবাসীদের বিশ্বাস একেবারে প্রথম দিকে কোনো মানুষকেই মৃত্যুর মুখে পড়তে হতো না। বয়সে বুড়িয়ে আসতে শুরু করলেই সাপের মত চামড়ার খোলসটা খুলে ফেলে মানুষ আবার নব যৌবন ফিরে পেতো। সুতরাং বৃদ্ধ হয়ে মারা যাবার কোনো ব্যাপারই ছিলো না। কিন্তু একদিন এক মহিলা তার বুড়িয়ে যাওয়া চামড়ার খোলসটা খুলে নদীতে ফেলে কম বয়সী চেহারায় বাড়িতে ফিরতেই বিপত্তি ঘটলো। দেখা গেলো তার বাচ্চাটা তাকে চিনতে না পেরে ভয়ানক কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। মহিলা কি আর করে অগত্য আবার নদীর পাড়ে গিয়ে নিজের ফেলে আসা চামড়ার খোলসটা খুঁজতে শুরু করলো। দেখা গেলো ফেলে দেওয়া খোলসটা স্রোতে ভেসে দূরে চলে যায়নি একটা কাঠিতে বেঁধে কাছেই নদীর জলের মধ্যে আটকে আছে। সে সেই খোলসটা তুলে ফের গায়ে পরে বাড়ি ফিরলো তার বাচ্চাটা এবার তাকে চিনতে পারলো। কিন্তু তারপর থেকেই মানুষ আর চাইলেই চামড়ার খোলস খুলে নতুন শরীর পাবার সুযোগ আর পেলো না। বুড়ো হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর উপায় রইলো না।
এ্যাডমিরালটি দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনিতেও দেখা যাচ্ছে মানুষ খোলস পাল্টে নতুন শরীর পেয়ে যেতো। এক মহিলার দুই ছেলে ছিলো। তার ছেলেরা গিয়েছিলো মাছ ধরতে আর মহিলা নদীতে গোসল করতে গিয়ে তার পুরনো বার্ধক্য জীর্ণ চামড়ার খোলসটা নদী পাড়ে ফেলে অল্প বয়সে সে যেমন রূপসী ছিলো ঠিক সেই চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। তার ছেলেরা বাড়ি ফিরে কিন্তু অবাক হলো। এক ছেলে বললো একে তো আমাদের মায়ের মত লাগছে। অন্য ছেলেটা বললো মা হবে তোর এই মেয়ে হবে আমার বউ। তাদের মা যখন জিজ্ঞেস করলো তারা কি নিয়ে কথা বলছে তখন দু’জনেই ভালো মানুষের মত বললো আমরা বলছিলাম তুমিই আমাদের মা। কিন্তু মা অত সহজে ভোলবার পাত্রী নয় অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে সে জবাব দিলো তোমরা কি বলাবলি করছিলে আমি শুনেছি। আমাদের আসলে বুড়ো হয়ে মরে যাওয়াই ভালো এই বলতে বলতে সে আবার নদীর পাড়ে গিয়ে তার ফেলে দেওয়া খোলসটা পরে বৃদ্ধা হয়েই বাড়ি ফিরলো। আর সেই থেকেই খোলস পাল্টে মৃত্যুকে এড়িয়ে যাবার সুযোগটা আর মানুষের হাতে থাকলো না।
সেন্ট্রাল সেলেব এর পোসোর অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত আছে পৃথিবীতে যখন কেবল এক মানব আর মানবী ছিলো, যারা ছিলো আমাদের প্রথম পিতামাতা। সৃষ্টিকর্তা তাদের কিছু দিতে চাইলে দড়িতে বেঁধে আকাশ থেকে তা তাদের নাগালের সীমায় নামিয়ে দিতেন। একদিন এভাবেই দড়িতে বাঁধা একটা পাথর নেমে এলো। পাথরটা দেখে বিরক্ত হয়ে তারা বললো, এই পাথর দিয়ে কী হবে আমাদের অন্য কিছু দাও। সৃষ্টিকর্তা অমনি দড়িতে বাঁধা পাথারটা তুলে নিলেন। দেখতে দেখতে পাথরটা উপরে উঠতে উঠতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই দড়িটা যখন আবার নেমে এলো তখন দেখা গেলো দড়িতে বাঁধা আছে কলা। তা দেখে প্রথম মানব-মানবী দৌড়ে গিয়ে দড়ি থেকে তা খুলে খেতে শুরু করলো। এবার আকাশ থেকে সৃষ্টিকর্তার কণ্ঠ ভেসে এলো, তোমরা যেহেতু কলা পছন্দ করেছো তোমাদের জীবন হবে কলাগাছের মতই। একবার ফল দিয়েই যেমন কলাগাছের মৃত্যু হয় তেমনি সন্তানের জন্ম দিয়ে তোমরাও মৃত্যুর কবলে পড়বে। আর তোমরা যদি পাথরটা গ্রহণ করতে তবে তোমাদের আয়ু হতো পাথরটার মতই অক্ষয়, অনন্ত, অমর। কিন্তু মানব সম্প্রদায়ের পিতামাতা কলা পছন্দ করাতেই মানুষ আর অমর হতে পারলো না।
কীভাবে জগতে বা আরো ভালো করে বলতে গেলে মানুষের জীবনে মৃত্যু দেখা দিয়েছিলো এই নিয়েই গল্পগুলো। স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার তাঁর ‘অমরত্বে বিশ্বাস ও মৃতদের উপাসনা’ বইটিতে এমনি আরো বহু মিথের উল্লেখ করেছেন। এই কাহিনিগুলো সেই বইয়েরই অজস্র কাহিনিরই কয়েকটা। আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতি, অস্ট্রেলিয়া আর তার আশেপাশের দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের, কখনও উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত একগুচ্ছ মৃত্যুর জন্ম কথা নিয়েই ফ্রেজারের বইটির একটা অধ্যায় রচিত হয়েছে। গল্পগুলোর আকৃতি প্রকৃতিই বলে দেয় এগুলো লোকবিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে। আর এই লোকবিশ্বাসের মধ্যে সেই আদিম পৃথিবীর গন্ধ। যে মানব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নৃবিজ্ঞানীরা এইসব কাহিনি সংগ্রহ করেছিলেন তারা কিন্তু সে অর্থে আদিমকালের লোক নন। প্রায় আধুনিক যুগের প্রথম পর্বের দিকেই এই লোকগুলো বেঁচেবর্তে ছিলো। ইউরোপের জাহাজগুলো যখন পৃথিবী পর্যটনে বেরিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলময় মহাদেশে, আমেরিকার নতুন মহাদেশে, অস্ট্রেলিয়া আর আশপাশের দ্বীপপুঞ্জগুলোয় পা রাখছিলো তখন এমন সব মানব সম্প্রদায়ের দেখা তারা পেয়েছিলো যাদের সাথে সভ্যতার কোনো সংস্রবই ছিলো না। সভ্য সমাজ থেকে তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, তার সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো এই মানব সম্প্রদায়গুলো। কেউ কেউ তখনও পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতো, তাদের জীবিকার মূল অবলম্বনই ছিলো শিকার আর ফলমূল আহরণ। কোথাও কোথাও কিছুটা কৃষি বা পশুপালন হয়তো দেখা দিয়েছে কিন্তু মোটের ওপর তাদের জীবন যাত্রার ধরনটাই ছিলো আদিম ধাঁচের। এই মানুষগুলোকে তাদের আদিম সংস্কৃতিসহ দেখতে পাওয়াটা ছিলো খুব ভাগ্যের কথা। ভাগ্যের কথা এজন্য যে আমরা আমাদের আদিম পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে যা জানি তা প্রত্নতত্ত্বের সাহায্যে উদ্ধার করা এলোমেলো, ছেঁড়াখোড়া বিভিন্ন তথ্য থেকেই। এই প্রথম আমাদের সৌভাগ্য হলো আদিম মানুষকে আমাদের এই আধুনিক কালেই সচক্ষে দেখতে পাওয়া। সে সময়ের নৃবিজ্ঞানীরাও জানতেন সভ্যতার সংস্পর্শে এই আদিম সংস্কৃতি আর আদিম থাকবে না সুতরাং মানুষের আদিম জীবনধারা সম্পর্কে যা তথ্য সম্ভব সমস্তটাই খুব দ্রুত সংগ্রহ করে নেওয়া চাই। স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের সংগ্রহটা এই নৃতাত্ত্বিকদের সংগ্রহেরই একটা ক্ষুদ্র অংশ।
এই গল্পগুলোর মধ্যে তাই সেই আদিম সারল্যের দেখা পাওয়া যায়। শিশুসুলভ আদিম মানুষের চিন্তাধারা থেকেই গল্পগুলোর জন্ম। আদিম পৃথিবীতে মানুষ যেমন তখনও অন্যান্য জীব-জন্তুকে নিজের চেয়ে হেয় ভাবতে শেখেনি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলেও মেনে এসেছে সে দৃষ্টান্তও গল্পগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে। ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষের কাছে দেবদূত পাঠাচ্ছেন তখন এই দেবদূতেরা প্রায়শই হচ্ছে বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ার। কোনো অতিমানবিক কাল্পনিক রাক্ষস বা ফেরেস্তা নয় আশেপাশের চলে ফিরে বেড়ানো গিরগিটি, কুকুর, খরগোসই হয়েছে সৃষ্টিকর্তার পাঠানো দেবদূত। আদিম মানুষের সীমিত জ্ঞানে জগতের এটা ওটা কীভাবে এলো, কীভাবে কেন সৃষ্টি করা হয়েছিলো এনিয়ে তাদের ভাবনা থেকেই গল্পগুলোর জন্ম। তাই মূলত সাদৃশ্যের ভিত্তিতেই তারা কারণ খুঁজেছেন কেন তাদের জীবন এমন হলো। কল্পনা করেছেন হয়তোবা আরো আগে মানুষের জীবনে এতো কষ্ট পরিশ্রমের বালাই ছিলো না। কোনো একটা ভুল বা বিপত্তির দরুণই সংসারে নানান সমস্যা আর ঝামেলা দেখা দিয়েছিলো। তারা এমনটাও ভেবেছে মৃত্যু জিনিসটাও হয়তো ছিলো না কিন্তু বর্তমানে যখন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি চেহারায় দেখা দিচ্ছে তখন নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছিলো যার ফলেই তারা নিশ্চিন্ত অমরত্বের জীবনটা হারিয়ে বসেছে। এখন কল্পনার সাহায্যে এই কারণগুলোকে তৈরি করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিলো না।
আদিম এই মানুষগুলো তাই কলাগাছের নশ্বরতার সাথে তাদের জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছে। কলাগাছ যেমন একবার ফল দিয়েই মারা যায়, মানুষও তেমনি সন্তান সন্ততির জন্ম দিয়ে ক্রমে বুড়ো হতে শুরু করে আর শেষে মারাও যায়। অথচ নশ্বর কলাগাছ ছাড়াও এমন কিছুও ছিলো যা নশ্বর ছিলো না। রাতের আকাশে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তারা উপলব্ধি করেছে চাঁদ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়েও আবার আকাশে ফিরে আসে আর ফের বাড়তে শুরু করে। তাদের নিজের জীবনের নশ্বরতার বিপরীতে এই অমরত্বের প্রমাণটা তাদের চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছিলো। এই অমরত্বের অনুষঙ্গেই তাদের কাহিনিতে এসেছে মানুষও এমন চাঁদের মত ছিলো একসময়। চাঁদ যেমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে আকাশ থেকে হারিয়ে গেলেও তিন দিন পর ঠিক যেমন রাতের আকাশে আবার জন্ম নেয় আর বাড়তে শুরু করে তেমনি মানুষও মারা যাবার তিন দিন পর আবার জীবিত হয়ে উঠতো। পরবর্তী কালে কোন এক ভুল বুঝাবুঝি বা কারো শত্রুতায় এই অমরত্ব মানুষ হয়তো হারিয়ে বসেছিলো কিন্তু চাঁদের এই যে নিজেকে বারবার নবীন করে তোলার অলৌকিক ক্ষমতা এ সংক্রান্ত বিশ্বাসটা তাদের মেনে দৃঢ় ভাবে আসন গেড়ে নিয়েছিলো।
আমাদের এই আধুনিক যুগের আদিবাসীদের মধ্যেই নয় শুধু নয় এই আদিম বিশ্বাসটা যে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ছিলো তারও প্রমাণ আমাদের ইতিহাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহাভারতে দেখি অমৃতের ভাণ্ডটিকে চাঁদেই রাখা হচ্ছে, আবার এই অমৃত চুরি করে খেতে এসে রাক্ষস রাহু আবার এই চাঁদের হাতেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। চাঁদের সাথে এই যে অমরত্বের ঘনিষ্ট অনুষঙ্গ তা কিন্তু সেই আদিম বিশ্বাস থেকেই উঠে এসেছে। চাঁদের মত মৃত্যুর তিন পর আবার জীবিত হয়ে ওঠার অনুষঙ্গটিও পৃথিবীর আনাচে কানাচে অনেক মিথেই বারবারই চোখে পড়ে।
চাঁদের মতই আদিম মানুষ সাপদেরও অমর ভেবে এসেছে। সাপ যেমন খোলস ছেড়ে নতুন শরীর পেয়ে যায় তাই সাপদের কখনও বার্ধক্য গ্রস্ত হতে হয় না, মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয় না। আর সাপ যেহেতু মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে জানে সুতরাং সাপের মধ্যে এমন কিছু অমরত্ব বিষয়ক গোপন সূত্র আছে যা মরণশীল মানুষকেও বিভিন্ন মারণ রোগবালাই থেকেও মুক্তি দিতে পারে। আর এই ভাবনা থেকেই সাপ তাদের চিন্তা চেতনায় প্রাণী হিসেবে শুধু রহস্যময়ই হয়ে ওঠে না অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীও হয়ে ওঠে। সাপের মত মানুষের খোলস ছেড়ে নবীন দেহ পাবার কল্পনাও দেখি নিউহেব্রাইডস আর এ্যাডমিরালটি দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের গল্পে। এই গল্পগুলোয় কিন্তু সাপের উল্লেখ নেই শুধু খোলস বা চামড়া পাল্টানোর অনুষঙ্গটাই এসেছে। অন্য গল্পগুলোয় কিন্তু কারণ দেখানো হয়েছে কীভাবে সাপেরা এই অমরত্ব মানুষকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরাই বাগিয়ে নিয়েছিলো তার গল্প। বোঝাই যায় নিউহেব্রাইডস আর এ্যাডমিরালটি দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের গল্পে সাপের অনুষঙ্গটি একধাপ এগিয়ে গিয়েছে। সাপের অমরত্ব সম্পর্কে বিশ্বাসটি এই গল্প দুইটির পেছনেও প্রচ্ছন্ন ভাবে বর্তমান ছিলো।
আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের চেতনাতেও যে সাপের অমরত্ব নিয়ে এ ধরনেরই বিশ্বাস ছিলো এবং তা প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়েছিলো লিখিত ইতিহাসের সময়কাল পর্যন্ত তার যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত প্রচুর। মহাভারতের প্রসঙ্গেই আবার ফিরে আসি কেননা এখানেও আমরা পাচ্ছি গরুড় সাপেদের জন্যই অমৃত চুরি করে আনছে। আবার গ্রিক দেবতা হার্মিস, রোমানদের কাছে যে হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মার্কিউরি তার ছিলো একটা ডানাওয়ালা যাদুদণ্ড যাতে এক জোড়া সাপ পেঁচিয়ে থাকে। এই হার্মিসকেই দেখি পাঠানো হয়েছে মৃত্যুর রাজ্যে কাউকে উদ্ধার করে আনতে, আবার গ্রিক বীর ইউলিসিসকে গাছগাছড়ার ভেষজ ওষুধ পৌঁছে দিতে দেখি যার সাহায্যে ইউলিসিস সার্সির যাদুকেও প্রতিহত করতে পেরেছিলো। গ্রিক মিথে এস্কুলাপিয়াসকে বলা হয় এ্যাপোলোর পুত্র আর তিনি ছিলেন এক অসাধারণ চিকিৎসক। কেউ কেউ মনে করেন মিথের চরিত্র হলেও হয়তো এক সময় এই নামে সত্যিই একজন মরণশীল মানুষ ছিলো ইতিহাসে। মিথে আছে একবার এক সাপকে সুস্থ করে তুলেছিলেন এস্কুলাপিয়াস আর সাপও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রহস্যময় গুপ্ত জ্ঞান দান করেছিলো তাকে। আর এই ক্ষমতার দরুণই এস্কুলাপিয়াস নাকি মৃত মানুষকেও জীবিত করে তুলতে পারতেন। এই চিকিৎসকের মূর্তিতে তাই দেখি তার সঙ্গের লাঠির সাথেই একটা সাপ সব সময় পেঁচিয়ে আছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতীক হিসেবে এই জন্যই এস্কুলাপিয়াস আর হার্মিস দু’জনের জাদুদণ্ডই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এস্কুলাপিয়াসের আগেও সুমেরীয়, মিশরীয়, মিনোয়ান সভ্যতাতেও সাপের এই অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো। আর এই বিশ্বাস প্রায়শই মানুষের লৌকিক ও অলৌকিক রোগ বালাইয়ের চিকিৎসায় বারবারই প্রয়োগ করা হয়েছে। মুসা নবীর ব্রোঞ্জের সাপের ধারণাটির পেছনেও এরকম বিশ্বাস সক্রিয় থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমার মনে হয় বিশ্বের বিভিন্ন মিথকথায় খুঁজলে সাপ সংক্রান্ত উপাদান প্রচুর পাওয়া যাবে এবং তার বিশাল অংশই কোনো না কোনোভাবে অমরত্বের অনুষঙ্গেই উপস্থাপিত হয়েছে।
সাপ নিয়ে এই জটিল রহস্যময় মিথ কথার কচকচির মূলে কিন্তু ছিলো সাপের খোলস ছেড়ে নতুন দেহ পাবার ঘটনার প্রেক্ষিতে সাপকে অমর ভেবে নেওয়ার একটা ভুল বিশ্বাস। আর এই ভুল বিশ্বাসটার জন্ম আদিম যুগে, আদিম মানুষের মনে। আদিম একটা বিশ্বাস কীভাবে যুগ পরম্পরায় রূপ পাল্টাতে পাল্টাতে আধুনিক যুগ অবধি এসে পৌঁছায় এটাই একটা চমৎকৃত হবার মত বিষয়। আমাদের এখনকার ধর্মীয় অনেক অলৌকিক বিশ্বাসের জড় তাই খুঁজে পাওয়া যায় আদিম সংস্কৃতির নানান উপাদানের মধ্যে। নৃবিজ্ঞানের গবেষনায় এ জন্যই পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর মানুষের বিভিন্ন প্রথা, অনুষ্ঠান, বিশ্বাস সহ তাদের আদিম সাংস্কৃতিক চরিত্রটার আলোচনা এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ঋণস্বীকার: THE BELIEF IN IMMORTALITY AND THE WORSHIP OF THE DEAD : J. G. Frazer. MACMILIAN AND CO LIMITED 1913
প্রচ্ছদ । রাজিব রায়