মুক্তিযুদ্ধের গল্প ।। হৃদমাতার সন্তানরা।। রুখসানা কাজল

0
Showing 1 of 1


দ্রুত খাতা কাটছিল রুহি।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরতে হবে। আম্মুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কদিন ধরেই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অত বড় বাড়িতে আম্মু প্রায় একাই পড়ে থাকে। স্বল্প আয়ের কয়েকজন ভাড়াটে বসাতে চেয়েছিল রুহি। সারাক্ষণ লোকজন থাকলে খানিক দেখাশুনা করতে পারবে। আম্মু রাজি হয়নি। ম্লান হেসে আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, এইতো ভালো আছি। কী হবে মানুষজন দিয়ে ! আমার আর মানুষজন ভালো লাগে না রে। আই হেট মানুষজন! !
ওর বড় দুই বোন ঢাকায় থাকে। ভাইয়া বিদেশে। বহুদিনের প্রবাসী। রুহি স্থানীয় গার্লস ইশকুলের শিক্ষক। এই ইশকুলের ছায়ার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে ওর খুব ভালো লাগে। একাত্তরের কোন এক গরমের দুপুরে এই ইশকুলের পুরনো ভবনের একটি রুমে ধর্ষিতা হয়েছিল ওর আম্মু। প্রচুর বাঁধা দিয়েছিল। কিন্তু পারেনি। একটি অনিচ্ছুক জরায়ু কিছুতেই চায়নি ঘৃনার ভ্রুণকে ঠাঁই দিতে। তবু জন্মেছিল ভ্রুণটি। ছুটির পর কখনও কখনও এই নির্জন ইশকুলটাকে ওর মা বলে মনে হয়।
ভাইয়া খুব করে চেয়েছিল ওকে বিদেশ নিয়ে যেতে। কিন্তু এই শহর ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে করে না রুহির। এখানে ওর কত কাজ। ওকে একদিন না দেখলে সান্ধ্য ক্লাশের ছিন্নমূল শিশুরা ওর বাসায় চলে আসে। তাদের কত জিজ্ঞাসা, উৎকণ্ঠা, অনুযোগ ভালোবাসা ! ওদের দেখলে আম্মুও হাসিখুশি থাকে। কতকিছু খেতে দেয়। গল্প করে। পড়াশুনো করতে বলে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে বলে। কাউকে দেখতে অপরিচ্ছন্ন লাগলেই তক্ষুনি ধরে শ্যাম্পু সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে তবে ছাড়ে। কি যে মিষ্টি লাগে তখন।
রুহির বাবা নামের লোকটা মারা গেছে অনেক বছর আগে। মাঝে মধ্যে বোনেরা বেড়াতে আসে। বাসা ভরে ওঠে খুশি ও আনন্দে। আম্মু অবশ্য বোনদের কাছে পেলেই কাঁদে। কেঁদে কেঁদে ওর নামে নালিশ করে। রুহি হাসে। বোনেরাও মুখ লুকিয়ে হাসি কন্ট্রোল করে। আম্মু বুঝতে পেরে রেগেমেগে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সেই সাথে খাওয়াদাওয়া এমনকি দরকারি ওশুধ পর্যন্ত খায় না। সে এক বিরাট ছেলেমানুষি অবস্থার সৃষ্টি হয় বাসায়। জোলেখা খালা তখন বকেঝকে ওদের তিন বোনকে শুধু মারতে বাকি রাখে। খালা আবার চুপিচুপি ভাইয়াকেও জানিয়ে দেয় আম্মুর অভিমানের কথা।
সন্ধ্যায় আম্মুর সাথে কথা বলে ভাইয়া। আম্মু তখন শর্ত দেয়, রুহি যদি বিয়ে করতে রাজী হয়, তবে সে খাবে। রুহি মেনে নিয়ে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে, ওকে আম্মু বিয়ে করব তবে তোমার বাড়িতে আর থাকবো না তখন।
সেই সব সন্ধ্যায় চায়ের গন্ধ আর গানের সুরে বাড়িটা গমগম করে ওঠে। রুস্তমদা তার উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর বন্ধুদের নিয়ে আসে। রুহির ছিন্নমূল ইশকুলের ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে দেশের গান শোনে। মাথা নেড়ে তাল দেয়। এক সময় ওদের সাথে গলাও মেলায় কেউ কেউ। রুহির তখন মনে হয় এইতো বেশ আছি। কি দরকার মধ্য চল্লিশে এসে বিয়েশাদি করার !
বোনেরা চলে যাওয়ার সময় নরম হেসে বলে, কিরে রুহি তুই কী সত্যি বিয়ে করবি না ? অমন ভালোবাসার মানুষ তোর ! আরেকবার ভেবে দেখ না সোনাবোন !
রুহি অন্যকিছু ভাবে। ভেবে মনে করার চেষ্টা করে বাবা নামের লোকটির চেহারা। ঠিক মনে পড়ে না। বরং ভাইয়াকে দেখলে কেমন যেনো বাবা বাবা মনে হয়। ভাইয়া যেনো মহাসাগর। কি ভালো যে বাসে রুহিকে ! চেহারায় মিল থাকলেও বাবা লোকটা ভাইয়ার মত স্নেহময় ছিল না। বাবা ওকে কখনো কাছে ডেকে নেয়নি। আদর করেনি। এমনকি কোনোদিন কোন কথাও বলেনি ওর সাথে। রুহি কাছে গেলেই দ্রুত সরে গেছে।
ছোটবেলায় বাবার কাছে ছুটে গেলে ভাইয়া আপুরা ওকে সরিয়ে নিয়ে যেত। এটাসেটা দিয়ে ভুলিয়ে দিতে চাইত। মেজপা বনি আপুর মুখ ছিল খুব চালু। বাবাকে শুনিয়ে রুহিকে আচ্ছা করে কান মলে দিয়ে সাংঘাতিক বকে বলত, খবরদার রুহি। তুই বাবার কাছে যাবি না। কখনো যাবি না। এই বাবাটা ভালো না। পচা বাবা। আর একদম পচামানুষ। মানুষ খাওয়ার অভ্যাস আছে জানিস ত। তুই কাছে গেলেই হালুম করে গিলে ফেলবে বুঝছিস সোনাই।
একটু বড় হতে রুহি দেখেছে বাবা আর ভেতর বাড়িতে আসে না, খায় না, থাকে না। সারা দিন সামনের অফিস ঘরে মক্কেল সামলে রাতে ঘুমোয় অফিস ঘরের ছাদের ছোট্ট রুমে।
আস্তে আস্তে সবার থেকে দূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছিল বাবা নামের সেই নির্লিপ্ত অথচ নিষ্ঠুর লোকটা।



কোনো কোনো দিন ইশকুলে যাওয়ার পথে রুহি দেখতে পেতো, বাবা লোকটা কালো মাফলারে মাথা ঢেকে অফিসের চেয়ারে বসে দোকান থেকে আনা নাস্তা খাচ্ছে আর পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে আমানত মুন্সি। বাবার মুহুরি। বহুদিনের পুরনো মানুষ। বাবার খুব কাছের লোক। গ্রাম সম্পর্কে কেমন আত্মীয় হয়। আমানত মুহুরিকে রুহি দুচোখে দেখতে পারত না। ওর মনে হত, বাবার চাইতেও খারাপ এই লোকটা। বাবা যে তাকে ভালোবাসে না তার কারণ এই আমানত মুন্সির কুবুদ্ধি। শকুনের মত সারাক্ষণ গলা বাড়িয়ে থাকে। এমন বিশ্রী চোখ রুহি আর কোথাও কারও মুখে দেখেনি।
ক্লাশ সেভেনে ভর্তি হয়ে বাসায় ফিরছে রুহি। অফিস ঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে আমানত মুহুরি ডাক দেয়, অ রুই, রুইই ভরতি হইছ ? দেখি ভরতির কাগজখান দেও দেখিন।
ভর্তির কাগজ, বেতনের রশিদ হাতে নিয়ে সেকি হাসি শয়তানটার। রুহির ইচ্ছা করছিল দমাস করে লাথি মারতে । এমনিতে রাস্তা ঘাটে কোথাও দেখা হলেই রুই রুই করে ডাকে। লোকটাকে অসহ্য লাগে রুহির। এই লোকটা যে কি করে মনসুরের মত ভালোমানুষের বাবা হতে পারে, সে ভেবেই পায় না।
সেদিন কাগজগুলো ফেরত দিয়ে পচা চোখে রুহিকে দেখে আমানতচাচা বলেছিল, ইস্যিরে ! কি পিতলা সখ ! বাপের নাম লেখিছে এডভোকেট নাহিদ মির্যা ! কতকালের বাপ যেন তোর !
তারপর দু সিঁড়ি নীচে নেমে হিস্‌হিস্‌ করে ওঠেছিল, গরীবের ছেলে বলে সংসার ছাড়ি যাতি পারতেছে না নাহিদ। তাই তোর মত মিলিটারির মাইয়ের বাপ হতি হচ্ছে তারে। থুঃ ওয়াক থুক—
পান খাওয়া লাল থুথু দেখে শিরশিরিয়ে ওঠেছিল ওর মন। আচমকা কেঁপে গেছিল ওর মন। ফণা উদ্যত সাপের সামনে কিশোরী রুহি কেঁপে ওঠেছিল ভয়ে, সে কে ? কে সে, কার সন্তান সে ?
ঘৃণামাখা কথাগুলোর অর্থ সে সময় ভাল করে বোঝেনি রুহি। কিন্তু ক্লাশ নাইনে ওঠে বুঝে গেছিল, সে একজন যুদ্ধশিশু। তার জন্মদাতা বড়লোক শ্বশুরের পোষ্য এই এডভোকেট নয়। কোন এক পাকিস্তানী সৈন্যর সন্তান সে। সেই থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। পড়াশুনা, ইশকুল, বাসা আর বই নিয়ে ছিল রুহির জগত।
ছোটবেলায় ও দেখেছে, ইশকুলের ছুটিতে বাবা তার নিজের তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিজের গ্রামে বেড়াতে যেত। আর রুহিকে নিয়ে ওর আম্মু চলে আসত ওদের মামাবাড়ি। একটু বড় হয়ে ভাইয়াও চলে আসত মামাবাড়ি। তনু বনি আপুরা ইশকুল পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়ে বাবার সঙ্গে আর কোথাও যেত না। বাবা নামের লোকটি একদম একা হয়ে গেছিল। আরও বড় হয়ে রুহি নানুবুজির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল একাত্তরের সেই ঘটনাকে।



কোনো এক গরমের দুপুরে যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে ইশকুল কলেজ খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। ওদের বাসা থেকে দু’পা হেঁটে গেলেই গার্লস ইশকুল। সেদিন ইশকুল ছুটির পর ছেলেমেয়েদের বাসায় পাঠিয়ে ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস আর অন্য দুজন শিক্ষিকার সাথে গল্প করছিল আম্মু।
এমন সময় মিলিটারি জীপে করে চারজন সৈন্য এসে ইশকুলের হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করতে চায়। অল্পবয়েসী চারজন সৈন্য। টগবগ ফুটছে। হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে কথা বলে কি একটা কাগজ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। এসময় চোখ পড়ে রুহির আম্মুর উপর।
বান্ধবীদের ভেতর সব চে সুন্দরী, প্রায় মোমরঙএর শরীর ছিল ওর আম্মু নার্গিস আক্তারের। খুবই সরল সহজ নিস্পাপ কিছুটা কমবুদ্ধির শিশুর মত ছিল আম্মুর মন। তিন ছেলেমেয়েসহ গাইড বুক দেখে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করত, তানু ডোন্ট টাচ বালি। রেইন নামছে, ভিজে যাবে। কাম ফাস্ট, কিপ ড্রাই। ভুল ইংরেজি বলা স্মার্ট, সুন্দরী আর স্বভাবে ভীষণ সুখী মহিলা ছিল নার্গিস। বিত্তশালী বাবা ভাইরা গরীব ঘরের শিক্ষিত ছেলে দেখে নার্গিসের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজেদের আওতায় রেখে দিয়েছিল নাহিদ মির্যাকে।
কালো মত সৈন্যটা যে ছিল চারজনের ভেতর সবচে বড় আর সিনিয়র সে নার্গিস আক্তারকে দেখে থমকে গেছিল। তারপর রাইফেল উচিয়ে ফায়ারের ভয় দেখাতেই দারোয়ান জলিল ছুটে পালিয়ে যায় ইশকুলের বাগানের ভেতর। হেডমিস্ট্রেস বাঁধা দিতে গিয়ে নিজেও ধর্ষিত হয়। ধর্ষিত হয় সেই দুই শিক্ষিকা বান্ধবী যাদের একজনের স্বামী ছিল পিস কমিটির চেয়ারম্যান।
রুহি বোঝে অই কালো সৈন্যটাই হচ্ছে ওর জন্মদাতা। ওকে দেখলে আম্মু কেমন ভয় চোখে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। আম্মুর যেদিন মাথাটা একেবারে খারাপ থাকে, রুহি কাছে যায় না। সেদিন হাতের কাছে যা পায় তাই রুহির দিকে ছুঁড়ে মেরে চেঁচায়, মেরে ফেলো, ওকে মেরে ফেলো। সি ইজ নট মাই ডটার। দ্য বাস্টার্ড। জোলেখা জোলেখা ! নুন ঢেলে দে ওর মুখে। কিল হার। নাউ এন্ড জাস্ট নাউ। গোওওওও—
জোলেখা খালা আম্মুর বাপের বাড়ি থেকে আম্মুর বিয়ের সময় সঙ্গী হয়ে এসেছিল। মায়ার শরীর। বড় স্নেহবতী মানুষ। গার্লস ইশকুলে আয়ার চাকরি করত। এতগুলো বছর ধরে আম্মুকে খালাই সামলে রাখছে। এই খালাই রুহিকে মারতে দেয়নি। আঁতুড়ঘরে নানুবুজির হাত আঁকড়ে ধরেছিল। কিছুতেই রুহির মুখে নুন ঠেসে দিতে দেয়নি। সেই যে বুকে তুলে নিয়েছে, খালা এখনও রুহিকে দুচোখে হারায়।
একটা বয়স পর্যন্ত রুহির খুব ইচ্ছা করত পাকিস্তান গিয়ে লোকটাকে খুঁজে বের করে খুন করে আসতে। কিন্তু কি করে চিনবে সে ? আম্মু তো কিছুই বলতে পারে না। তাছাড়া আম্মুর মাথাও ঠিক নেই অই ঘটনার পর থেকে। নাহিদ মির্যাকে দেখলেই চেঁচিয়ে মারতে আসত। চিৎকার করে বলত, দালাল দালাল। তুমিই না বলেছিলে পাকিস্তানীরা ইজ মোর গুড দ্যান বেঙলী। নাউ কি ঘটলো ? রুস্তম, রুস্তম ফায়ার হিম। হি ইজ দ্যা গ্রেট রাজাকার। কিল হিম। আগুনে পুড়িয়ে দে শয়তানটাকে।
রুস্তমদা আম্মুর ভাইয়ের ছেলে। ফুপির এমন অবস্থা দেখে দাঁত কিড়মিড় করে এডভোকেট ফুপাকে বলেছিলো, আমি মুক্তিযোদ্ধা হলে আপনাকে গুলি করে মারতাম। পাকিস্তানচাটা রাজাকারের বাচ্চাকে কিছুতেই বাঁচতে দিতাম না। সুযোগ পেলে আপনাকে আমি কঠিন শাস্তি দেব। দেবই।
এডভোকেট বাবাটা বেশিদিন বাঁচেনি। গ্রামের বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় ফেরার সময় নৌকা উল্টে পড়ে গেছিল নদীতে। খেয়াল করেনি অন্যেরা। কিম্বা খেয়াল করলেও ঘৃণায় তুলে আনেনি। একাত্তরে যেভাবে অগণিত লাশ ভেসে যেত সেভাবেই ভেসে গেছিল নাহিদ মির্যা। পরদিন এক মাঝি লাশ তুলে হাত ঝাড়া দিয়ে বলেছিল, ঠিক শাস্তি দিয়েছে আল্লাহ। মেলা মানুষকে তুলে দেছে মেলেটারিগো হাতে। বেডা শিক্ষিত বর্বর।
থানা পুলিশ হয়নি। রুস্তমদা শুনেই চলে এসেছিল বাসায়। শক্ত করে গেট লাগিয়ে দিয়ে ভাইবোনদের ডেকে বলেছিল, এই লোকটার জন্যে হাজার বছর ধরে আমাদের গঞ্জনা সইতে হবে। আজ থেকে আমাদের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হল।



খাতা দেখা শেষ। টেবিল গোছাচ্ছে রুহি। আয়া দারোয়ান ছাড়া সবাই চলে গেছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ জোলেখা খালা এক কাপ চা এনে সামনে দাঁড়ায়। খুশি হয়ে যায় রুহি, খালা চা দিলা যে। কিছু বলবা ?
খালার মুখ বেজার, মনসুর আইছে। দেখা করতি চায়।
তরঙ্গ বয়ে যায় রুহির মনে। এতক্ষণ যে তাড়া ছিল বাসায় যাওয়ার তার বদলে মনসুরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাটা তীব্র হয়ে ওঠে, আরেক কাপ চা দিও খালা প্লিজ !
ইতস্তত করে জোলেখা। কিছু বলতে চায়। সামান্য আয়া হলেও রুহির আম্মুর একমাত্র কাছের মানুষ। রুহিকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে। জন্মের পর রুহিকে মেরে ফেলবে নাকি বাঁচিয়ে রাখবে তাই ভাবতে ভাবতে ওর মা কেমন পাগল হয়ে গেলো। সেই সময় রুহিকে সেই তুলে নিয়েছিল বুকে। বড় ভালো মেয়ে রুহি। এই মনসুরের পাল্লায় পড়ে জীবনটা গেছে মেয়েটার। আজও দুজনের কেউ বিয়ে করেনি। সমাজসেবা করে মনসুর হইছে এক পাগল ছাগল মানুষ। বছর বছর কতগুলো মেডেল এনে ঘরে জমা করছে আর রাস্তার ছেলেপেলে কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে। রুহিও পাগল হয়ে গেছে। মনসুরের কথায় রুহির মরণবাঁচন।
গজগজ করে জোলেখা, তুমরা কি বিয়েশাদী করবা নাকি এই ভাবেই থাকবা সারাজীবন!
রুহি এবার জোরে হেসে ফেলে, খালা গো বিয়েটাই কি সব খালামনি ?
তয় ? মাইয়া মানুষ না তুমি !
মাইয়া মানুষ হইলেই বিয়ে করতে হবে কে বলেছে তুমারে ? এইই ভাল আছি খালা। কিছুটা ত মানুষের উপকারে লাগছি।
মনসুর ঢুকে পড়েছে টিচার্স রুমে। আমানত মুহুরির এই ছেলেটা অন্যরকম। বড় সুন্দর দেখতে। মায়াভরা দুটি চোখ। লোকে বলে পাজির ঘরে কাজি। রুহির সঙ্গে বিয়েতে আপত্তি করায় আমানত মুহুরিকে ছেড়ে চলে এসেছে। রাস্তার শিশুদের নিয়ে দিনরাত এক করে দিচ্ছে দুজন। লেখাপড়া শেখানোর সঙ্গে দেশ, মানুষ আর এই বুড়ো পৃথিবীর সঠিক ইতিহাসটাও নাকি জানাতে হবে শিশুদের। এটাই নাকি ওদের একমাত্র কর্তব্য। বিয়েশাদি ঘর-সংসার বাদ। জোলেখা মনে মনে প্রচুর রাগ হয়।
প্রতিবারের মত লাল সবুজ শাড়ি হাতে মনসুর রুহির সামনে বসে গপ্‌ করে চা টা খেয়ে ফেলে। রাগে মনসুরের জন্যে আনা চায়ের কাপ ঠক করে টেবিলে রেখে চলে যেতেই জড়িয়ে ধরে মনসুর, খালা ও খালা আমার সোনা খালা তুমিই তো আমার মা সত্যি কিনা বল খালা ! আচ্ছা আজকেই আমরা বিয়ে করব। তুমি খুশি ?
মনসুরের আলিঙ্গনে জোলেখা বিহবল দিশেহারা। রাগ গলে চোখ ভেসে যায়। কেঁদে ফেলে হুহু করে। স্বপ্নগুলো জলে মিশে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে গাল বেয়ে। কত বছর ধরে সে একটা সোনার চেন আর আংটি লুকিয়ে রেখেছে। মনসুর হোক আমানত মুহুরির ছেলে। সে তো তার রুহিকে ভালবাসে। আহা, সোনা বাচ্চারা আমার! আন্তরিক মায়ায় সেও জড়িয়ে ধরে মনসুরকে।
রুহি অবাক হয়, এই মনসুরা, তোর মাথামুথো ঠিক আছে ত ?
একদম ঠিক। টেবিলের উপর ঝুঁকে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ঢঙে মনসুর বলে, চল্‌ রুহি এই বিজয় দিবসকে আমরা গেঁথে নিই আমাদের জীবনের সঙ্গে !
রুহির বুক কেঁপে ওঠে। ক্লাশ নাইন, ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে রুহিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল গেম মিস। ভূগোল মিস কেমন যেন হেসে ফিসফিসিয়ে পাশের মিসকে বলেছিল, পাকিস্তানীদের ধর্ষণের ফসল। সাহস কত জাতীয় সঙ্গীত গাইতে চায় !
মনসুরের কথা শুনে ওর বুকের ভেতর সুরে সুরে উড়ে আসে ভ্রমর। পাখনার ভাঁজ খুলে তারা দুলে দুলে ওঠে। আর রুহির মন নিঃশব্দে প্রাণভরে গেয়ে ওঠে, অনেক অনেক দিনের অনেক আবেগে জমিয়ে রাখা সেই পূণ্য সঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি——
জোলেখা কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে রুহিকে। দীর্ঘ দুহাতে দুজনকে জড়িয়ে ধরে
মনসুর বলে, চল্‌ রুহি, খালা চলো, আগে আমরা রুস্তমদার কাছে যাই—–

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Showing 1 of 1
Share.

Comments are closed.