কুনবর নারায়ণের কবিতা
হিন্দি থেকে ভাষান্তর অজিত দাশ
এক জীবন কেটে গেল
এতকিছু ছিল জগতে—
লড়াই-ঝগড়ার জন্য অথচ
এমন মন পেলাম—
এক ছটাক প্রেমেই মশগুল
আর ফিরে দেখি,
এক জীবন কেটে গেল।
তুমি আমার চারপাশে
তুমি আমা চারপাশে প্রতিটি মুহূর্ত—
এতটাই উপস্থিত আমার দুনিয়ায়
তোমার প্রতিনিয়ত আনাগোনা
তবুও আমার তোমাকে ঠিকমতো
চিনতে না পারার অক্ষমতা—চাইলে তোমাকে
বলতে পারি না, দেখো—এটাই আমার পরিচয়
কেবল আমার, একান্ত আমার
একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত
যেকোনো দৃশ্যমান বস্তুর মতোই স্পষ্ট এবং নিশ্চিত
আর এখন তোমাকে চিত্রিত করতে
আঙুলের মিহি রঙের স্পর্শ, ক্যানভাস
আমার চিরচেনা দৃশ্যের প্রকাশ ভাষার মাঝখানে
নীরব এক শূন্য জায়গায় পড়ে আছে।
স্তব্ধ জলের গভীর নিমজ্জনে
এক ছায়ার সংকুচিত স্তর; যেন ঘনিয়ে আসা
সন্ধ্যার অন্ধকারের অবয়ব, ঠান্ডা হাত।
আমার কাঁধে বরফের স্পর্শের
মতো অনুভূত হচ্ছে।
অঙ্গ-অঙ্গ
প্রতিটা অঙ্গ
তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল
অগ্নিকে
জলকে
পৃথিবীকে
হাওয়াকে
মহাশূন্যকে
শুধু একটা বই বেচে গিয়েছিল
এমন একটা খেলাও
যেটা সে শৈশব থেকে এখনো
খেলে আসছিল
সেই বইটাকে রেখে দেওয়া হলো
খালি পায়ের নিচে
তার জায়গায় অন্য কাউকে খুশি করার জন্য
অসুস্থ নয় সে
অসুস্থ নয় সে
কখনো-কখনো অসুস্থতার ভান করে
তাদের খুশির জন্য
যারা সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে আছে
কোনোদিন মরেও যেতে পারে সে
তাদের খুশির জন্য
যারা মৃত্যুর কোলে পড়ে আছে
কবিদের কোনো ঠিকানা নেই
না জানি কতবার তারা
নিজের কবিতায় মরে আর বাঁচে।
তাদের মরে না যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে
তাদের খুশির জন্য
যারা কখনো মরে যায় না।
সমুদ্রের মাছ
এই তো সেখান থেকেই ফিরে এসেছি
নিজেকে অপূর্ণ রেখে
যেখানে রয়েছে—মিথ্যে, ভীরুতা, অন্যায় আর মূর্খতা—
প্রতিটি বাক্যকে ভেঙেচুরে, প্রতিটি শব্দকে একা ছেড়ে
নির্দয় অসুখের একচ্ছত্র অনুশাসনে
কোনোভাবে পুনরায় শুরু করতে যাচ্ছি
খবরের কাগজের শব্দগুলোর ভিড়ে
অনেক মুখছবির মাঝে কোনো এক ছবিকে
অপরাধীর মতো সাব্যস্ত করতে থাকি বার বার
অদ্ভুত রকমভাবে বেঁচে থাকার এক প্রবল চেষ্টায়—
কিন্তু প্রতিবার প্রায়শ্চিত্ত শেষে এক ভিন্নরকম যাতনায়,
সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছি যেখানে ভেঙে পড়েছি,
সেই নির্দয় পৃথিবীর অনিয়মিত প্রতিফলনে
নির্মম বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ভেঙে যাচ্ছে,
কোনোরকম বেঁচে থাকার জন্য ছুটে বেড়াই
এক থেকে দুইয়ের দিকে অথবা নিজেকে ছেড়ে
কোনো নতুন দিকে এত ছুটাছুটি করে নেই মাছের মতো
আর এভাবেই শুরু হয় অবিরাম ছুটাছুটি
এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রের দিকে…
ভালোবাসার সৌজন্যে
গাছের গুঁড়িতে পেঁচিয়ে থাকা
কুমারী লতা
দু চোখ বিশ্বাস করো—
আজন্ম তৃষ্ণায় মেঘের ঘনঘটা
লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে নগ্ন বিজলি
শুকনো পৃথিবীর মাটির বুকে
এ যেন সৃষ্টির আভাস বর্জিত গর্ভে
তুষ্টির অপকীর্তি—
কলঙ্কিত মালতীর দুগ্ধ কলি?
হাজার বছরের বৃদ্ধ মন্দির
তুমি চুপ থাক,
আত্মীয় হয় সে নাম যে অপরিচিত—
সে জিজ্ঞেস করলে পাপ হয়,
ফুল হলো তার খুশির দান
সে জিজ্ঞেস করলে কি দাগ লেগে যায়!
পতিত পাবন বৎসলা ধরণী
তোমার পুত্র যে জন্ম নিয়েছে…
সাক্ষী রয়েছে,
ফুলদানিতে রাখা হাসনাহেনা ফুল
কুণ্ঠিত সভ্যতার স্ফুলিঙ্গের মতো!
বনজাত হলো সৌন্দর্যের ভাষা!
তাকে স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে দাও
কত মনোযোগ নিয়েই না
এই গল্প শুনেছে তারাদের দল
ভালোবাসার সৌজন্যে।
কবি পরিচিতিঃ
কুনবর নারায়ণ [১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬-১৫ নভেম্বর ২০১৪] হিন্দি সাহিত্যে নতুন কাব্য আন্দোলনের অন্যতম কর্মী । মাত্র ২৯ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ চক্রব্যূহ প্রকাশিত হওয়ার পর সম্পাদক অজয় ১৯৫৯-এ তার সম্পাদিত আধুনিক হিন্দি কবিতা সংকলন সপ্তকে হিন্দি সাহিত্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কবি, কেদারনাথ সিংহ, সর্বেশ্বর দয়াল সাক্সেনা, বিজয়দেব নারায়ণ শাহির সঙ্গে কুনবর নারায়ণের কবিতাও গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি ২০০৯ সালে ভারতীয় সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত হন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো, চক্রব্যূহ্, তিসরা সপ্তক, পরিবেশ-হাম-তুম, আপনে সামনে, কই দুসরা নেহি এবং কবিতাকি বহানে।
কুনবর নারায়ণ তার রচনায় ইতিহাস এবং পুরাণের মিশ্রণের মাধ্যমে বর্তমানকে নতুন করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছেন। যদিও তার মূল ঘরানাটি কবিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবিতা ছাড়াও তিনি ছোটগল্প, গদ্য এবং আলোচনার পাশাপাশি সিনেমা, নাটকও রচনা করেছেন। ভাবনার সঙ্গে ভাষার সরলতা এবং রচনা শৈলীর কারণে তাঁর লেখার সঙ্গে পাঠকের সহজে যোগাযোগ তৈরি হয়। কবিতার পাশাপাশি চিত্রনাট্য ও গল্প নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজও করেছেন। তাঁর কবিতা ও গল্প বহু ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।