কাটাকুটি । রাজিয়া নাজমী

0

বলতে অস্বস্তি লাগলেও বলাটাই দরকার মনে করে আবিদ বলেই ফেলে, তরুণ বাবু, অনেক রাত হয়েছে এবার মনে হয় আপনার বাড়ি যাওয়া উচিত।
তরুণ গলায় আরেক ঢোক ঢেলে দিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে উত্তরে বলে, ‘বাড়ি! মশাই বাড়ি মানে কি জানেন?’
আবিদ তরুণের কথার অর্থ ধরতে না পেরেও তরুণের দিকে তাকালো না। লোকটা এখন চলে যাক সেটাই চাইছিল সে।
তরুণ আবিদের কথায় আবার ফিরে এলো। বাড়ি বলতে কী বোঝায় সেই ডেফিনিশন না দিয়ে যায় কী করে। সোফায় আরও গা এলিয়ে দিয়ে বললো, বাড়ি কি জানেন? বাড়ি হচ্ছে একে অপরের সাথে আত্মার সম্পর্কে বাঁধাপরিবার। একগাদা কাঠ, রড সিমেন্ট দিয়ে একটা বাক্স বানিয়ে আসবাব পত্র, হাড়ি-কুঁড়ি থাকলেই সেটা বাড়ি হয়না। আপনার কথা জানিনা, তবে আমার যেটা আছে তাহলো থাকার জন্য একটা বাসস্থান। রাত হচ্ছে বলে ভাবার কেউ নেই, দরজা খোলার জন্য কেউ নেই ,খাবারের থালা সামনে নিয়ে অপেক্ষায় থাকার কেউ নেই।একটানা বলে একটু দম নেয় তরুণ। তারপর সিগারেটের শেষ প্রান্তটুকু চেপে ধরে হিসহিস শব্দ তুলে সুখটানটা দিয়ে বলে, মশাই অভিমান করে বিছানায় পাশ ফিরে থাকার জন্য কেউ নেই- তার নাম নাকি বাড়ি!
আবিদের ইচ্ছে হল বলতে, তেমন বাড়ি বানাতে যা দরকার তা কি ছিল আপনার কাছে?বললো না। বাড়ি বানাবার ইচ্ছে থাকলেই পারা যায় না, কথাটা মিথ্যে তো নয়।
হাতের মুঠোয় সেলফোন বেজেই চলেছে। না তাকালেও আবিদ জানে অঞ্চিতার ফোন।
ধরছেন না কেন? ধরুন! তরুণ অস্থির হয়ে ওঠে।
অসুবিধা নেই, পরে কলব্যাক করব। তরুণের অবাক চোখে তাকিয়ে বলেআমার এক কলিগের ফোন।
তরুণ আবারও বলল, ধরলেই পারতেন। আমার তেমন তাড়া নেই। তরুণের চোখে মুখে মলিন হাসি।
আবিদ চমকে উঠলো। এর মানে কী,কতক্ষণ থাকার মতলব করে এসেছে এই মাতাল। পরক্ষণেই মনে হল, নাহ ,হাজার হলেও অঞ্চিতার স্বামী। একে তো বারবার ফোন কেটে দিয়ে খারাপই লাগছে। অঞ্চিতাকে অপমানিত করতে চাইছে না তবু কেমন বাঁধোবাঁধো লাগছিল তরুণের সামনে অঞ্চিতার ফোন ধরতে।
তরুণ আজই প্রথম এসেছে আবিদের কাছে। এসেছে সেই সন্ধে নাগাদ।আবিদ অবাক হয়েছিল অপরিচিত একজনকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। লোকটি কোন ভূমিকা না করেই বলল,আমার নাম তরুণ,আমি অঞ্চিতার স্বামী। ভিতরে আসতে চাই। আপনার সাথে কিছু কথা বলার আছে।
আবিদ দরজার একপাশে সরে দাঁড়াতেই তরুণ হাতের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলে, অসুবিধা নেই তো একে ঘরে নিয়ে ঢুকলে? আবিদ মাথা নাড়তেই তরুণ হেসে বলে,বাঁচালেন মশাই, নয়ত অনেকবার যে ঘরবাহির করতে হত। আমার একে ছাড়া একদম চলে না। অবশ্য আরও একজনা আছে।
আবিদ বুঝতে পারলো,এই লোককে কিছু না বলাই ভাল। পরিচিত কাউকেই তাদের অভ্যাসের বাড়াবাড়ি নিয়ে লেকচার সে কখনোই দেয় না আর এতো কোথাকার কোন তরুণ কুমার।
তরুণ ততক্ষণে লিভিং রুমের সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে গেড়ে বসে গেছে। আবিদ জানে একে এখন চা কফির কথা বলার মানে বলার জন্যই বলা। রান্নাঘরে রাতের ভাত বসিয়ে এসেছে, এখনই নামাতে হবে।আবিদ যেতে যেতে বলল, আপনাকে পানি বা অন্য কিছু দেব?
তরুণ লিভিং রুমের চারপাশ দেখতে দেখতে বলল, আরে না কিছুর দরকার নেই , যা দরকার তা সাথে করে নিয়ে এসেছি। আপনি আবার কিছু মনে করবেন না যেন।
রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে টেবিলের উপরে তিনটা মিনিয়েচার দেখে একটু বিরক্ত হয়েই আবিদ বলে, তরুণ বাবু আপনি আমার বাড়ি খুঁজে পেলেন কী করে ?
দেয়ালের একটি পেইন্টিঙের সামনে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে আস্তে করে বলল, অঞ্চিতাকে একদিন ফলো করেছিলাম। কিন্তুএই ছবিটি কার আঁকা বলুন তো, সাক্ষরটা খুব অস্পষ্ট হয়ে গেছে। ছবি আঁকার ধরনটা …
আবিদ সাহেব আপনি ছবি আঁকেন নাকি?
না, আপনি?
আঁকতাম একসময় । বহুদিন ধরে হয়নি। মাথায় ঠিক আসে না কিছু। না, ঠিক বললাম না। আসে তবে ইচ্ছে হয় না। যা আসে তা আঁকতে গেলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আঁকা আর হয় না।
আপনি বোধ হয় কিছু বলতে এসেছিলেন আমাকে। আবিদ সিগারেটের ছাই ফেলার জন্য আনা চায়ের কাপ তরুণের সামনে রাখতে রাখতে বললো।
আবিদ সাহেব, আপনার কি খুব তাড়া আছে? না থাকলে আমি বসি কিচ্ছুক্ষণ? জানেন আপনার এই বসবার ঘরটি কেমন চেনা চেনা লাগছে। তরুণ গুন গুনিয়ে উঠলো ‘কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম ‘…
এরপর আর কোন কথা কেউ বলেনি। আবিদ টিভি অন করল বটে তবে শব্দ নামিয়ে। হাতের কাছে রাখা গত সপ্তাহের ম্যাগাজিনটা টেনে নিলো আপাতত সময় পার করার ভরসায়।
বেশ কয়েকটা সিগারেট আর মিনি সাইজের তিনটা হুইস্কির শিশি শেষ করে তরুণ উঠে দাঁড়িয়ে আবিদেরঘাড়ে হাত রেখে বলল, আজ উঠি। আপনার ঘরটা বেশ ভাল, আসব আমি আবার,কথা দিচ্ছিআসব । শুভরাত্রি! ও হ্যাঁ আপনার সেই কলিগকে কল ব্যাক করতে ভুলবেন না।
তরুণ বের হয়ে গেলে আবিদ সিগারেটের ছাই ভরা চায়ের কাপ আর শিশিগুলো তুলে নিয়ে ট্রাশক্যানে ফেলে রাতের খাবার ফ্রিজে তুলে রাখলো। এত রাত করে খেলেই পেটে অস্বস্তি হয়। এই তরুণটা যদি এমন প্রায়ই এসে হাজির হয় তবেই হয়েছে। অঞ্চিতাকেও বলাটা ঠিক হবে না। দেখা যাক তরুণ নিজেই অঞ্চিতাকে বলে কিনা।
***
মাঝে মাঝে অঞ্চিতা পুরো বিছানার সবটাই ছেড়ে একদম একপ্রান্তে যতটুকু কম জায়গা নিয়ে শুয়ে থাকা যায় তাই থাকে। কেন করে এমন? কার কাছে থেকে সরে থাকতে চায়? নাকি গোটা পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে চায়?হয়ত তাই।
যেন জীবনের কাছে যত কম চাওয়া যায় ততই ভাল। জীবন তো হিসেবের মধ্যেই চলে। হিসেবের খাতার মত এও অদল বদল হয়। চাওয়া পাওয়া বা জীবনের চাহিদা অন্যখাতে ঘুরে গেলে ভালোবাসাও তারই সাথে তাল মিলিয়ে চলে। না হলে যে চোখে ভালোবাসা ছিলো এখন সেই চোখে সবসময় বিরক্তির হল্কা কেন বয়ে যায়। আবেগ, ভালবাসা চিরন্তন নয় তবে তা এতটাই ক্ষণস্থায়ী?
আগে ওর কষ্ট হত, মনে হত ও কেন এখনও ভালবাসে। এখন আর তাও মনে হয় না। ভালবাসে কি বাসে না তাও সে জানে না আজকাল। ধীরেধীরে সব অনুভূতি যেন বাতাসে উড়ে উড়ে মিলিয়ে গেছে অজানা অন্ধকারে। যেখান থেকে আর ফেরানো যাবে না। ফেরালেও কিছু কালো দাগ নিয়ে ফিরবে । সেই দাগগুলোতে দুঃখের, অপমানের ,অবহেলার কালোকালো ছাপ আর সেগুলো গায়ে মেখে তার ভার বহন করে কিছুটা স্বভাবগত অভ্যাসের কারণে চলা আর বলা।ব্যাস এর বাইরে কালো ছাপ আর কিছু করতে দিবে না। কিছুই না!
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসে এসে অঞ্চিতা তো মেনেই তো নিয়েছে এই পরিবর্তন। সত্যি কী ভয়ঙ্কর এক বেদনার মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে বের করে আনতে পেরেছে। তাই আজ কারো বিষবাক্যে অপমানিত বোধ করে না। তার স্মৃতির বারান্দায় শুধু ভুল।ভুল মানুষকে বিয়ে করেছে। ভুল মানুষকে ভালবেসেছে। ভুল করেই কি ভুল করেছিল? নাকি ভুল করাটাই ভবিতব্য ছিল? নয়ত কী করে সম্ভব হল? হুট করে কি প্রেমে পড়ে গেলো?
না প্রেমে হুট করে না পড়লেও রাস্তায় সেদিন হুট করে হোঁচট খেয়ে পড়তেই অচেনা এক বাহু তাকে জড়িয়ে ধরে তুলে নিলো । সে তাকে ধরে রাখেনি মুহূর্তের বেশি । শুধু গাড় কণ্ঠে বলেছিল আপনি ঠিক আছেন?
খুব আস্তে করে অঞ্চিতা বলেছিল আমি ঠিক আছি।কেন যেন একটু মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল।
আপনি তো এদিকেই থাকেন। আমি কি আপনার বাড়ি অবদি যেতে পারি?
আপনি, আপনি কী করে জানেন আমি এদিকে থাকি ?
আমি আপনাকে এর আগেদেখেছি।
ওরা সেদিনহাঁটতে হাঁটতেকী কথা বলেছিল মনে নেই। সেই বিকেলটা মনে আছে। অনেকদিনের শুষ্ক জীবনে যেন হাল্কা বাতাস বয়ে গিয়েছিলো। অঞ্চিতার সাথে বাড়ির গেটে এসে অঞ্চিতার চেয়ে চার পাঁচ ইঞ্চি লম্বা পাতলা লোকটি বললো, যাই এবার । আপনি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করবেন।

অঞ্চিতাও বিদায় নিয়ে বাড়ির ভিতরের রাস্তায় পা বাড়ায়। অর্ধেক রাস্তায় এসে যে কাজ সে কখনো করেনি তাই করলো। ফিরে তাকালো আরও একবার অচেনা লোকটিকে দেখার জন্য । ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখে গেটের মাথা থেকে কয়েক পা এগিয়ে লোকটিও ফিরে তাকিয়ে আছে।
অঞ্চিতা এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর পায়ে পায়ে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটি বলে, আমি কি অন্য কোন সময় আপনার সাথে কথা বলতে পারি ? দ্বিধার প্রশ্নে মাখা উষ্ণতা অঞ্চিতা ঠিক টের পায়।
অঞ্চিতা কিছু না বলেই ওর সেলফোনের নাম্বারটা দিয়ে বলে, এটা আমার নাম্বার। লোকটি চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই অঞ্চিতা একটু জোরেইবলে নামটা …
আবিদ। আমি কাছেই থাকি। আপনাকে কখন ফোন করলে ভালো হয়?
সন্ধ্যার পরে।
ও,আচ্ছা।
ফোনটা করতে আবিদ একদমই দেরি করেনি, পরের দিন অচেনা নাম্বার বেজে উঠলো ঠিক সন্ধ্যে সাতটার সময়।
আমি আবিদ বলছিলাম। আপনি এখন ফ্রি আছেন, কথা বলতে পারি?
হ্যাঁ, হাতে তেমন কোন কাজ নেই এখন।
কী করছিলেন?
কিছু না, গান শুনছিলাম আপনি কেমন আছেন? আর হ্যাঁ, কাল আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়াই হয়নি। সেজন্য পরে আমার খুব খারাপ লেগেছে।
তাই? কখন কখন এধরনের খারাপ লাগা অন্যের জন্য ভাল! আবিদের কথায় মনে হচ্ছিল ও একটু টিপসি মেজাজে আছে।
তারপর প্রায় প্রতিদিন আবিদের ফোন। আপনি থেকে তুমিতে এসে গেছে নিজেদের অজান্তেই।কথা বলার সময় অসময় নেই। ওর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আবিদকে উতলায় রাখা,অভিমান, রাগ- যা কিছু পাওনা ছিল জীবনের এই অধ্যায়ে সব তুলে নিতেই অঞ্চিতার ইচ্ছা হতো। কী করে কেমন করে ওরা মনের এত কাছাকাছি চলে এলো অঞ্চিতা টের পায়নি। শুধু ভীষণ ভালো লাগতো আবিদের সাথে কথা বলতে। জমে থাকা কথা, আবেগ সব যেন অপেক্ষায় ছিলো। চেষ্টা করেও যা সম্ভব হয়নি যেখানে নিয়মমতো বলার কথা। শুনতে চায়নি। জানতেও চায়নি । কিন্তু এখন সেই শুনালো অনৈতিকতার বেদবাক্য।কী এমন অপরাধ করেছে যাকে ভাল লাগে তাকে ভালবেসে?কোন কর্তব্য সে অবহেলা করেছে? করেনি। কেবল রুটিনবাঁধা জীবনেরমাঝে নিজের একটু ভালো লাগার দাম দিয়েছে। হ্যাঁ, ভাবতে চায়নি এতে করে সিঁদুরের অপমান হবে।
যেদিন সবার ইচ্ছেয় পুরোহিতের মন্ত্রের সাথে সাথে ঘুরেছিল সাতপাকে- কেউ কি জানতে চেয়েছিল ও মন্ত্র পড়ছে কিনা? কেউ কি জানতে চেয়েছিল ও মন আর শরীর এক করে হাঁটছিল কিনা? ওর দু’হাত ধরে অন্যরা যখন মালাবদল করালো তখন কেউ জানতে চেয়েছিল ওঁর মন করেছিল কিনা?
কী বলে গেলো ওকে তরুণ? ‘তাও আবার একজন ভিন্ন ধর্মের সাথে এত বন্ধুত্ব!’
অঞ্চিতার ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে স্বধর্মের হলে অনৈতিক হত না? বলেনি। তার কোন গ্লানি নেই, তো কেন বলবে।
তবে উচিৎ ছিলো তার এত বছরের স্বামীর কাছে জানতে, আমাকে কোনদিন আমার জন্য ভালোবেসেছিলে? স্বার্থপরের মতোশুধু চেয়েছিল আমি তোমার পরিচয় থেকে সব পালন করি। তাই করেছি আমি। আমাদের কখন কোন কিছু নিয়ে মান অভিমান, ঝগড়া হয় না। আর এখন আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোলাগাকে এভাবে নষ্ট করে দিতে ছুটে গেলে কেন?
আর আবিদ তুমি? ভালো যদি বাসবে তবে অপমান কেন মেনে নিতে পারলে না। অন্যের অপমানের দায় আমায় কেন দিলে? কি ভীষণ রুঢ় শোনায় তোমার কণ্ঠস্বর আজকাল। কি অবলীলায় বলে দিল আর এসো না, ফোন কর না।
উফ, নিজের চিৎকারেই অঞ্চিতার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আবিদকে এতবার ফোনে না পেয়ে এলোমেলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অঞ্চিতার কেন মনে হচ্ছে তরুণ আজ না হয় কাল আবিদের সাথে দেখা করতে যাবেই তাই আগাম বলে রাখতে চেয়েছিল আবিদকে। তরুণ অসভ্যতামি করবে না জানে। তবুও। কিন্তু এসব কি স্বপ্ন দেখলো!
তরুণের ভালোবাসাসত্যি চেয়েছিল? চেয়েছিল তরুণ অন্য অনেক স্বামীর মতো জেলাস হয়ে আবিদকে কিছু বলুক?
লাইট অফ করে শুয়ে পড়ার কথা ভাবতেই দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পেলো অঞ্চিতা। তরুণ ফিরেছে। জিজ্ঞাসা করবে তরুণ গিয়েছিল কিনা? মুহূর্তে অঞ্চিতা ভেবে নিলো সে তরুণ বা আবিদ কাউকে জিজ্ঞাসা করবে না । দেখা যাক কে বলে তাকে।
***
তরুণ আবিদের বাড়ি থেকে যখন বের হয়ে এলো তখন রাত বারোটা বাজে। কাছে-পিঠের পাবে গিয়ে আরও খানিকটা সময় কাটানো যেত। তবু কেন অঞ্চিতার কাছেই ফিরে আসতে ইচ্ছে করলো। অল্পই পথ তবু ট্যাক্সি ধরেই ফিরে এলো। আবিদ কেন অঞ্চিতার ফোন ধরলো না। তরুণ তো ভেবেছিল আবিদ অঞ্চিতাকে ভালোবাসে। অঞ্চিতা কতবার ফোন করল। বেচারি! সেই থেকে কেমন একটা কষ্ট কষ্ট লাগছে তরুণের।
আবিদকে যা বলতে চেয়েছিল তা বলার যোগ্যই ওকে আর মনে হল না। আবিদ ধরেই নিয়েছিল তরুণ মাতাল হয়ে সব ভুলে গেছে। তরুণ হাসলো! তবে সে আবারও যাবে অন্য কথা বলার জন্য। অঞ্চিতাকে যে আবিদ ভালোবাসে না সেটাই বলার জন্য। খুব মায়া হল অঞ্চিতার জন্য। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কী পাগল মেয়েটা। কিন্তু পেলো না।
বিয়ের পরপর তরুণ ভালবাসতে চেয়েছিল। ভাল একদম লাগত না তাও নয়, তবে সেই ভালোলাগাটা আরও গভীর না হয়ে দিনেদিনে কেমন পানসে হয়ে গেলো। কার কাছ থেকেশুরু হয়েছিলো? হয়ত সেই করেছে। অঞ্চিতাও আঁকড়ে ধরে, জোর করে বেঁধে রাখতে চায়নি আলগা হতে থাকা বাঁধনকে।
মন্ত্র পড়া বাঁধনের জোর মনের বাঁধনের কাছে অনেক কমজোরি সেটাই প্রমাণ হয়ে গেলো।
অঞ্চিতাকে আজ এত আঘাত করে যা বলেছে তা অঞ্চিতার ভালোর জন্য বলেছে। ভেবেছিলো অঞ্চিতা যদি তরুণকে ঘৃণা করে চলে যায় তবেই হয়ত আবিদের সাথে ও ভাল থাকতে পারবে। নয়ত তরুণের কি আসে যায় কে কোন ধর্মের। তরুণ কী কোনোকালেই ধর্মে বিশ্বাস করতো? কিন্তু এখন তরুণ কী করবে? অঞ্চিতা যে জানে না ও আবার ভুল করতে যাচ্ছে।
চাবিটা ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকেই বুঝতে পেরেছে অঞ্চিতা তখনও জেগে আছে তবে তার জন্য অপেক্ষা করে নয়। আবিদ যদি ওকে এতক্ষণে সব জানিয়ে থাকে তবে অঞ্চিতা হয় লিভিং রুমে ওকে আক্রমণ করার জন্য বসে থাকত, অথবা হু কেয়ারস ভাব দেখিয়ে ঘুমিয়ে যেত। এর মাঝামাঝি কিছু করার মেয়ে অঞ্চিতা নয়।
বেডরুমটা এখন আলাদা হয়নি। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে গিয়ে তরুণের মনে হল একটা কাজ অন্তত সে ঠিক করেছিল। একটা কিং সাইজের বেড কিনেছিল। কেনার সময় অঞ্চিতা হেসে বলেছিলো দুইজনেই ফিটফাট স্লিম, এত বিশাল বিছানা কেন? তরুণের কখন দুষ্টামি আসে না তাই সোজাসাপটা উত্তর দিয়ে দিল,আমার হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাতে ভাল লাগে। বড় বিছানা না হলে তোমার গায়ে অকারণেই আমার হাত পা লেগে যেতে পারে। বলেই মনে হল অঞ্চিতা কথাটা শুনতে পায়নি। ও তখন ব্যস্ত ছিলো ম্যাচিং আলমিরা দেখতে। এ সবই বিয়ের শুরুতে। বিয়ের পরপর বোধ হয় সবাই কদিন ভাল থাকে। মানিয়ে গুছিয়ে সংসার করার শপথ যতদিন মাথায় থাকে।
তরুণ পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে শোবার ঘরে এলো। কটকটে লাইটের আলো থেকে বাঁচাবার জন্য চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে পড়লো। অঞ্চিতা কিছু একটা পড়ছিল। একটু পরেই বইটা বালিশের নিচে রেখে লাইট অফ করে দিল। তরুণ এবার নিশ্চিত আবিদ এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি।
***
আচ্ছা, আবিদ সাহেব
সাহেবটা বাদ দিয়ে বলুন।
কেন?
কারণ আমি সাহেব নই, তাই
আচ্ছা, তবে আমিও শুধু তরুণ। বাবু নই।
আমি এই অপেক্ষাতেই ছিলাম। এই বাবু, সাহেব, ‘অধীন’ কথা মনে করিয়ে দেয়। সে যাই হোক তরুণ, আজ আপনি কিছু বলতে শুরু করেছিলেন। আমি শুনতে চাই।
আপনার ফোনটা কোথায়?
কেন বলুন তো?
নাহ, এ সময় ফোন আসার কথা তাই।
তরুণ, আপনি যদি জানেন এ সময় ফোন আসার কথা তবে এ সময়ে কেন আসেন? আপনি কি আমার ফোন এলো কিনা তাই দেখতে আসেন?
আবিদ, একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছে করে ও কেন সিঁদুর পরে। জানেন হিন্দু স্ত্রী কেন সিঁদুর পরে?
জানি, স্বামীর মঙ্গল কামনায়। তাতে অসুবিধা কোথায়?
হ্যাঁ তবে আমার জন্য সিঁদুর …
কথাটা আপনি ওকে জিজ্ঞাসা করেছেন? যদিও উত্তর আমি জানি কিন্তু আমি আপনাকে তা বলব না। এর উত্তর আপনাকেই জেনে নিতে হবে।
আবিদ আপনার খারাপ লাগে না? একমাথা সিঁদুর পরে যখন আপনার কাছে আসে?
না, লাগে না। অঞ্চিতার উত্তর আমার জানা। আপনার চেয়ে আমি অনেক বেশি জানি ওকে।
রাগাতে চাইছেন!
না রাগাতে চাইছি না। জানি আপনার কোন রাগ নেই।
তা বেশ, আমাকে নিয়ে আপনাদের মধ্যে কথাও হয়। আবিদ, আপনি বিবাহিত?
হ্যাঁ
অঞ্চিতা জানে?
না জানার কোন কারণ তো নেই ।
আর আপনার স্ত্রী?
উত্তরটা আজ দিতে চাইছি না। আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আজ আপনি আসুন।
কাল আসব?
না ছুটির দিনে।
ওহ; সে তো কাল বাদে পরশু। বেশ যাই আজ।
***
তরুণ বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই আবিদের বাড়ির ডোর বেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আজ প্রথম তরুণকে বেশ অন্যরকম লাগছে। মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে। হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে আগুন নিভিয়ে তবে ঘরে ঢুকল। যেন আজ নিমন্ত্রিত বলেই এইটুকু ভদ্রতা।
তরুণ, চলুন অ্যাটিকে যাই।আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন সেখানে।
অ্যাটিকের মেঝের চারদিকে ছড়িয়ে আছে রঙতুলি, ক্যানভাসে,মেঝেতে অসমাপ্ত আঁকা ছবি, কাটাকুটি ছবি। যেন ঝড় বয়ে গেছে শিল্পীর মনে। কিসের এত যন্ত্রণা ছিল শিল্পীর মনে?
তরুণের বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটার শব্দ বেড়ে চলছে। এত চেনা কেন লাগছে আঁচড়গুলো?
ধুলো মাখা একটি ফটোফ্রেমের গায়ে হাত বুলিয়ে পরিষ্কার করে তরুণের সামনে ধরে আবিদ বলল, আমার স্ত্রী। ওরই আঁকা এইসব ছবি।
বুকের ভিতর হাতুড়ি আরও জোরে জোরে পেরেকের পর পেরেক ঠুকে দিচ্ছে। আজ কি বেশি খেয়ে ফেলেছে, ভুলভাল দেখছে না তো সে? সে তো মাতাল হয় না। কি ভাবছে সে?দিনের বেলায় সে তো এক চুমুক দেয় না। একফোঁটাও খায়নি এখনও। মাথাটা এমন ঘুরছে কেন তবে? নাকের কাছে তুলে ধরা ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে তরুণ বলল, উনি কোথায়, উনি কি…
আবিদ ছবিটি নামিয়ে রেখে বলে, নার্সিংহোমে আছে গত পাঁচ বছর ধরে। ঘুমের ভিতর স্ট্রোক করেছিল। বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে আছে। সেই থেকে ঘুমের মধ্যেই থাকে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে। চিনতে পারলেও কথা বলতে পারে না।
অঞ্চিতা?
হ্যাঁ, অঞ্চিতা জানে। অঞ্চিতা গিয়েছিল ওকে দেখতে।
আবিদ, আমি কি একবার যেতে পারি ওকে দেখতে? একজন শিল্পী বলেই…
তরুণ, এত কিছু বলার কি আছে।
নার্সিংহোমের কার্ড রাখা আছে কিচেনে। যাবার আগে নিয়ে যেতে পারেন। আমি ফোন করে ওদেরকে আপনার নাম জানিয়ে দেব ।
আবিদকে অবাক করে দিয়েই অ্যাটিকের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তরুণ বললো, আজ যাই।
এত তাড়াতাড়ি তরুণ বোধহয় এই প্রথম আবিদের বাড়ি থেকে চলে এলো। বুকের ধুকধুঁকানি থেকে মুক্তি পেতে ওর এখন খোলা বাতাস দরকার। বাসস্টপে দাঁড়িয়েথেকেও তরুণ বাসে ওঠেনি। বাস এসে থেমেছে,দরজা খুলেছে আবার বন্ধ করে চলে গেছে। তরুণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো যেন কেউ এসে তাকে তুলে নিয়ে যাবে।
বুকের ভিতরের হাতুড়ির পেটা থেমে গেলেও অস্থিরতা কাটেনি। ভগবান মানা সে ছেড়ে দিয়েছে কবেই তাই যে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, তাও করতে পারছে না।
***
তরুণ অস্থিরতায় নির্ঘুম রাত পার করে সকালেই বের হয়ে নার্সিংহোমের সামনেই বসে থাকলো হোমের অফিস খোলার অপেক্ষায়।
অফিস খোলে। তরুণ ভিজিটিং খাতায় নাম লেখে। নার্সের পিছে পিছে হেঁটে যায়।
এ কে শুয়ে আছে? একরাশ সাদা কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে আছে বালিশে। শুয়ে থাকতে থাকতেই কি শরীরটা এমন বেঁকে গেছে? এতকাল ধরে চোখের সামনে ভেসে আসে যে, তার সাথে এর যে আর কোন মিল নেই। দুইযুগ পরে এ কাকে দেখছে সে! তরুণ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই শুঁকনো হাতের ছোঁয়া পেলো। করুণ দুটি চোখ তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে হল বলতে চিনতে পেরেছ ,আমি তরুণ। তোমার তরুণ। সাহস হলো না বলতে। হৃদপিণ্ডে কতটুকু দম আছে কে জানে। থাক না হয় আর কিছু দিন বেঁচে।
চিলেকোঠায় বসে ছবি আঁকতে আঁকতে রাত ভোর করে দিত যে মানুষ, সেই মানুষটি এমন করে নিজেকে শেষ করলো?এ কেমন বেঁচেথাকা?তরুণের এটাও দেখার বাকি ছিল?
কোটরে ঢুকে থাকা শুখনো চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হল, একটু কাঁদো সেই আগের মতো আমার দেরি করে আসার জন্য।চোখের পাতায় তোমার অভিমানের জল জমে থাকতো,একটু অভিমান হলেই ঢেলে দিতে দুগালে।কত কেঁদেছ যে জল ফুরিয়ে গেছে?
দুই যুগ আগে ধর্মের দ্বন্দ্বের সাথে পেরে না উঠে বোকার মতো ওরা পালাতে চেয়েছিল দুরে কোথাও। ট্রেনে উঠে কাঁধের ঝোলানো ব্যাগ সামলাতে গিয়ে তরুণ দেরি করে ফেলেছিলো পালাবার সাথীর হাত ধরে ট্রেনের বগিতে তুলতে। পায়ে পেঁচিয়ে যাওয়া শাড়ি ছাড়াবার সময়টুকুতেই যা না হবার কথা তাই হল। পিছন থেকে দুই ভাই হাত ধরে টেনে নিয়ে অন্য আরেকটি ট্রেনে হিঁচড়ে টেনে তুলল।
তরুণ ট্রেনের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে অধর্মের জয় আর ভালবাসার পরাজয় দেখলো। ওরা সেদিন এক ট্রেনে নয়, পাশাপাশি দুইটি ট্রেনে একই জায়গা থেকে আলাদা আলাদা গন্তব্য চলে গেল।
তরুণ ফিসফিস করে বলল, আমি খোঁজ করেছিলাম। মাস পরে জানলাম, তুমি বাধ্য হয়েছ অন্য কারো ঘরের হতে। ধর্মই ছিলো আমার একমাত্র পরিচয়,আমার সেই অযোগ্যতায় সেদিন ট্রেনেও তোমাকে তুলতে পারলাম না।
তরুণ শুকনো জীরজীরে হাতের উপর থেকে মাথা তুলতে বাধ্য হলো অসময় বিরক্ত করা জুতোর খসখসে আওয়াজে।
নার্স এসে বললো, আপনি আজ গেলে ভাল হয়।
তরুণ সাদা চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বলল, আমি আসব, আবার আসব।
তরুণ অবশ পায়ে যেতে যেতে ভাবলো আজ একটা ছবি আঁকবে। মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটি মুখের ছবি আজ আঁকবে ।
***
পিছন থেকে তরুণ, তরুণ, ডাকটা যে আবিদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবু ইচ্ছে করেই না শোনার ভান করে তরুণ যেমন হাঁটছিল তেমনই হেঁটে চলল আবিদের হাতটা ঘাড়ের উপর এসে নাপড়া পর্যন্ত।
ওহ আপনি!
আরে মশাই সেই থেকে ডাকছি আপনাকে। কি ব্যাপার বলুন তো, একেবারে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন নাকি? কত মাস হয়ে গেলো আপনার দেখা নেই।
না না তা কেন, তা একবারেই নয় তবে একটু বিরতি দিচ্ছিলাম আমাকেও আপনাকেও। কেমন আছেন আবিদ?
তরুণ, আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে। চলুন কফিসপে বসি।
তরুণ আন্দাজ করতে পারলেও একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে, আমার সাথে? চলুন চলুন বসা যাক।
আবিদ দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে এসে বসতে বসতেই বললো, আমি বেশ লম্বা সময়ের জন্য আফ্রিকাতে চলে যাচ্ছি। ভাল অফার পেলাম তাই ছাড়লাম না।
তরুণ কফিতে চিনি নাড়তে নাড়তে অলসভাবেই বলল, নিউইয়র্ক থেকে সুদূর আফ্রিকা, ভাল বেশ ভাল, ভাল কিছু ছাড়া যায় না। কিন্তু আপনার একজন যে পড়ে আছে নার্সিংহোমে।
সেই সবই আপনার সাথে আলাপ করব। আপনি জানেন কিনা জানিনা, অঞ্চিতা আমার সাথে যাচ্ছে না, বলতে গেলে আমাদের বন্ধুত্বটা আগের মতো নেই। আমার মনে হয় ও আপনার কাছেই ফিরে গেলে ভাল।
তরুণ মনে মনে ভাবল, কি সহজে বলা যায় যা একবারেই সহজে বলার নয়। ইচ্ছে হলো অট্টহাসি দিয়ে আবিদের চারপাশের সবার মুখটাকে কিচ্ছুক্ষণের জন্য বোকাবোকা করে দিতে। সুধু বললো, সে ভাবনাটা আমাদের; আপনার নয়। আপনি আপনার কথা ভাবুন।
আবিদের কফির কাপটা একেবারে ঠোঁটের কাছে ছিলো। তরুণের কথায় কাপটা ঝাঁকি খেয়ে দুই এক ফোঁটা পড়ে যেতেই আবিদ টিসু পেপার দিয়ে সামলে নিলো।
তরুণ খুব ধীরে কফির কাপে চুমুক দিয়ে কাল বিকেলে অঞ্চিতার বলা কথাগুলো ভাবল। অঞ্চিতা দেশে ফিরে যাচ্ছে। একেবারেই যাচ্ছে। তরুণ জানতে চায়নি অঞ্চিতার সিদ্ধান্তের কারণ। অঞ্চিতা নিজ থেকেই বললো, জানি কিছু জানতে চাইবে না তবু বলছি, আবিদকে আমি পছন্দ করতাম, আজও করি। তবুও পারলাম না অথবা যা আমি চাই তা ওর কাছ থেকে চাই না।
কি চেয়েছিলে, তা জানতে?
জানতাম, তবে তুমি জানতে না বা জানতে চাওনি। একটা মেয়ে যখন সিঁদুর পরে তখন সে সিঁদুরের অর্থ শুধু সে বিবাহিত তাই নয়। সিঁদুরের অর্থ সম্মান, ভালবাসা, নির্ভরতা, ভরসা। মাঝে মাঝে মনে হত হয়ত আমাদের কোন সন্তান নেই বলেই হয়তো, কিন্তু এটাও কারণ মনে হয়নি।
অঞ্চিতার গলায় সামান্য কান্নার কাঁপন ছিল। হয়ত মা না হতে পারার কষ্টের কান্না। এরপর কিছুক্ষণ চুপ ছিল অঞ্চিতা। হয়ত ভেবেছিল তরুণ কিছু বলবে অথবা মুহূর্তের আশা আবেগকে দমন করার জন্য চুপ ছিল। খুব অল্প সময়ই চুপ ছিল অঞ্চিতা। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,তুমি চাইলে ডিভোর্স ফাইল করতে পার। আমি সই কর দিব।
আবিদ এতক্ষণ ধরে কি বলছিলোকানে যায়নি, হঠাৎ করেই আবিদের একটি লাইন কানে যেতেই অঞ্চিতার বলা বাকি কথাগুলো সরে গেলো। আবিদ রীতিমত তরুণের হাত ধরে বলছে,তরুণ আমার হয়ে আপনাকে এই কাজটা করতেই হবে। নার্সিংহোমে ওকে দেখতে যাবেন। টাকাপয়সা সব আমি পাঠাবো।শুধু খেয়াল রাখবেন প্লিজ ।
আবিদ কিছুটা গ্লানি মাখা মুখেই বলে,প্রথম প্রথম রোজ যেতাম তারপর আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। বুঝতেই পারছেন পাঁচ বছর এক লম্বা সময়। তরুণ হাত তুলে আবিদকে কঠিন বাস্তবের দর্শন দেওয়া থেকে মুক্তি দিলো।
আবিদ তরুণের তোলা হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে উঠে গেলো আরেক কাপ কফি আনতে।
আবিদকে খুব অস্থির লাগছে আজ। কী জানি আবিদও হয়ত এক শূণ্যতায় বাস করতে করতে ক্লান্ত। হয়ত যে ঘর সে খুঁজছে তা আজও পায়নি। তবে অঞ্চিতা জীবনকে উলটে পালটে দেখতে গিয়ে ভুল কিছু করেনি। হয়ত বাকি জীবনে চলার ঠিক রাস্তা পেয়ে যাবে। তরুণের আজ খুব ভালো লাগলো অঞ্চিতার জন্য।
তরুণ, আমাকে কথা দিচ্ছেন তো আপনি ওরখোঁজ-খবর রাখবেন?
রাখব, ভাববেন না,আমি জোহরার খেয়াল রাখবো।
জোহরা! আপনি ওর নাম কি করে জানলেন। ওহ; ভুলে গিয়েছিলাম আপনি তো গিয়েছিলেন ওকে দেখতে।
এক সাথে কফিসপ থেকে বের হলেও উল্টো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তরুণের মনে হল পড়ন্ত বিকেলের রোদের আলো যেন বড্ড বেশি ঝকঝকে। ঝিরঝির বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে তরুণ গুনগুনিয়ে উঠলো- কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম …

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.