একটু ভাত খাবো । মুহসীন মোসাদ্দেক

0
Showing 1 of 1

‘বাবাগো, দশটা টাকা দিবেন? একটু ভাত খাবো!’
অফিসের ক্যাফেটেরিয়া থেকে মাত্রই দুপুরের খাবার খেয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন তিনি। পেছন থেকে শার্টের হাতা ধরে টান দিয়ে আচমকা কথাটা বলেন এক বুড়ি। কিছুটা চমকে তিনি পেছনে ফিরে তাকান। কালো বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা থাকলেও বুড়ি যে হাড়জিরজিরে তা টের পাওয়া যায়।
মায়া হলো তার, বললেন, ‘ভাত খাবেন?’
‘হ বাবা, দশটা টাকা দেন।’
‘দশ টাকায় কি ভাত খেতে পারবেন, চাচি? এক প্লেট ভাতের দামই তো বিশ টাকা! সাথে একটা ভর্তা বিশ, সবজি চল্লিশ-মাছ-মুরগি-ডিম আর কিছু না নিলেও তো ৮০ টাকা লাগে ভাত খাইতে!’
‘কী করমু, বাবা! ভাত খাইতে আশি-একশ টাকা চাইলে কি কেউ দিবো!’
‘আপনি কি সত্যিই ভাত খাবেন?’
‘হ বাবা, খাবো। দশটা টাকা।’
‘আসেন আমার সাথে’ বুড়িকে কথা বলতে দিলেন না তিনি। ইশারা করলেন তাকে অনুসরণ করতে আর বললেন, ‘চলনে, আপনাকে ভাত খাওয়াই।’
লোকটা সামনে হাঁটলেন, বুড়ি পেছনে। ত্রিশ-চল্লিশ ধাপ এগুলে একটা ভাতের হোটেল আছে। সেখানে তিনি বুড়িকে ভাত খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছেন।
দশ-বারো ধাপ যেতেই হাউকাউ করে উঠলেন বুড়ি, ‘বাবাগো, আমারে কোন মুল্লুকে নিয়া যান!’
‘এইতো চাচি, সামনেই একটা ভাতের হোটেল আছে, ওইখানে গিয়া আপনারে ভাত খাওয়াবো।’
‘আমার মাজায় সমস্যা, বাজান। এতো হাঁটতে পারি না। আপনে আমারে দশটা টাকা দিয়া দেন, অতদূর আমি হাঁটতে পারবো না।’
‘দূর কোথায়, চাচি! এইতো আর বিশ-পঁচিশ ধাপ দিলেই হোটেল।’
‘আমি তো হাঁটতে পারি না, বাপ।’
একটু মেজাজ খারাপ হলো লোকটার, ‘দশ জনের কাছ থেকে দশ টাকা করে নিয়ে ভাত খাওয়ার টাকা তুলতে পুরো এলাকা আপনারে হাঁটতে হবে। সেইটা হাঁটতে পারবেন, আর আমি একেবারে ভাত খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি, এটুকু হাঁটতে পারবেন না!’
বুড়িকে কথা বলতে না দিয়ে তিনি তাগাদা দিলেন, ‘আসেন, আসেন, আরেকটু হাঁটেন।’
বুড়ি বিড়বিড় করতে করতে তাকে অনুসরণ করলেন।
হোটেলে ঢুকেও বুড়ি বিড়বিড় করেন, ‘এইটুকু বইলা কতখানি হাঁটায় নিল! আমার মাজায় সমস্যা, হাঁটতে পারি না! বিবেক নাই মাইনষের…’
লোকটা পাত্তা দেন না বুড়ির বিড়বিড়ানিতে। বুড়ো মানুষ এরকম হুদাই বকে।
‘কী খাবেন?’ জিজ্ঞেস করার পর অবশ্য তিনি একটু বিপাকে পড়লেন। বুড়ি কোনো মাছই খান না, ব্রয়লার মুরগিও খাবেন না, সোনালী মুরগি নাই এখানে আর এত পথ হেঁটে এসে কিছুতেই তিনি ডিম দিয়ে ভাত খাবেন না! বাকি থাকে গরুর মাংস, তিনি সেটা খেতে রাজি হলেও নাক শিঁটকালেন, ‘অ্যালার্জি…’
বুড়ির জন্য গরুর মাংস, আলু ভর্তা আর লাউয়ের তরকারি অর্ডার দিলেন তিনি। খাবার এলে বুড়ি আবার বিড়বিড় করেন, ‘হুদাই আমারে এত কষ্ট দিয়া খাওয়াইতে আনল!’
লোকটা এবারও পাত্তা দিলেন না বুড়ির কথায়। বললেন, ‘আর কিছু লাগবে চাচি?’
‘নাহ, বাজান।’বুড়ির অবশ্য একটু সদয় হলো, জানতে চাইল, ‘আপনে খাইতেন না?’
‘না চাচি, আমি খেয়েছি।’
‘আপনে নিজে না খাইলে শুধু শুধু আমারে কষ্ট দিয়া খাওয়াইতে না আনলেও পারতেন।’
মুখটা বেজার করে বললেন বুড়ি। লোকটা মুচকি হাসেন।
‘আপনি তাহলে খান, চাচি। খেয়ে বাড়ি চলে যাইয়েন। আমি আসি।’
‘বাজান?’
বিদায় নিয়ে বিলের কাউন্টারে যেতে নিচ্ছিলেন তিনি, ফিরতে হলো বুড়ির ডাকে, ‘বলেন চাচি, আর কিছু লাগবে?’
‘দশটা টাকা দিয়া যান, বাজান। ভাত খাইয়া একটু দুধ চা খাবো।’
মুচকি হেসে তিনি বুড়ির হাতে দশ টাকা দিয়ে দিলেন। তারপর খাবারের বিল দিয়ে চলে এলেন। মনের ভেতরে তার খচখচ করতে থাকে, রাস্তায় দশ টাকা দিয়ে দিলে বুড়ি যতটা খুশি হতেন, দুইশ টাকা দিয়ে পুরো একবেলার খাবার খাইয়েও মনে হয় ততটা খুশি করতে পারলেন না! তিনি অবশ্য আর ভাবতে চাইলেন না। বুড়িকে একবেলা ভাত খাইয়ে তিনি নিজে তৃপ্তি বোধ করেছেন, এটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে সবার বোধ তো আর একরকম না, যার যার বোধ তার তার মতো। গুরুত্ব ও প্রয়োজনটাও। বুড়ির কাছে হয়তো একবেলা খাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, দশ জনের কাছ থেকে দশ টাকা করে পাওয়া একশ টাকা হয়তো তার কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ।
ঘণ্টা খানেক পরে একটা কাজে লোকটা আবার অফিসের নিচে নামলেন। রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটছিলেন, এমন সময় পেছন থেকে শার্টের হাতা ধরে টান দিয়ে এক বুড়ি আচমকা বলে ওঠেন, ‘দশটা টাকা দিবেন? একটু ভাত খাবো!’
পেছনে ফিরে দেখেন, সেই বুড়ি যাকে তিনি কিছুক্ষণ আগেই ভাত খাইয়েছেন!
মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি ক্ষুধা লেগে গেল, চাচি! সত্যিই ভাত খাবেন? চলেন আমার সাথে…’
বুড়ির মুখ ঢাকা থাকলেও মনে হলো তিনি থতমত খেয়ে গেছেন। কোনো কিছু না বলে বুড়ি উল্টো দিকে হাঁটা ধরলেন। মাজায় ব্যথা নিয়ে এত দ্রুত হেঁটে গেলেন যে, মায়াই লাগল লোকটার।
তিনি ভাবলেন, ভিক্ষা করা যার খাসলত, তাকে একটা সাম্রাজ্য দিয়ে দিলেও সে হয়তো ভিক্ষাই করবে!

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Showing 1 of 1
Share.

Comments are closed.