একগুচ্ছ স্ক্যান্ডিনিভিয়ান কবিতা । ভাষান্তর: কল্যাণী রমা

0

উইন্ডমিলের মালিক শেষবারের মত উইন্ডমিলের পাখাগুলোর ঘোরা থামিয়ে দিল:
শস্যচূর্ণ শেষ, শস্যের দানা উড়ে গেছে, বাতাস এখন বিশ্রাম নিতে পারবে।
যে বাতাস একদিন অলসভাবে বহু আগের ফুলের মত ফুটে ওঠা ফুলঝাড়ুকে নুয়ে পড়াত। ময়দার কুয়াশায় দুলে ওঠা লণ্ঠন সাথে নিয়ে বসে কাটানো এই সেই শেষ রাত। গরুর গাড়ি থেকে ভেসে আসছে কাঠের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ—এক অন্তহীন পথ…
যখন হঠাৎ বাতাস বয়ে এল তখন যেন এক দানব জেগে উঠল। নড়েচড়ে বসল। পেষাই কলে এই ছিল শা গরমকালের সন্ধ্যায় বিশ্রামের শেষ এক ছবিৃ
গমের ক্ষেত পেড়িয়ে সেখানে একদিন দোয়েলদের উড়ে যেতে দেখা গিয়েছিল,
দেখা গিয়েছিল দিকশূন্যহীন ঘুরে বেড়াতে খড়ের টুপি পরা মানুষদের।
ওখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই পাথরের দেওয়াল দেওয়া উইন্ডমিল। এক বেটে খাঁটো টাওয়ার, যেন তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়েছে। একদিন তার উপরের অংশটা ঘুরছিল আর মই উঠে গিয়েছিল নিচ থেকে উপরে। সেখানে উপরের দরজা দিয়ে কাঠের জুতা পরে উপরে নিচে গিয়ে চিলেকোঠায় শস্যের বস্তা ডাঁই করে রাখা হ’ত:
এখন এই পুরানো উইন্ডমিলকে গরমকালের অতিথিদেরকে থাকবার জন্য জায়গা দিয়ে কাজের বদলে আয় ক’রে দেওয়ার সু্যােগ করে দেওয়া হবে।
কিন্তু স্বপ্নের ভিতর এই উইন্ডমিলের মালিক অনেক দিন ধরেই শুনে যাবে যেন উইন্ডমিল ঘুরছে, উইন্ডমিল কাঁপছে।

তাকাও ওর দিকে—বিস্কুট, পাউরুটি আর কেক বানায় সে। প্রায় দেবদূতের মত দেখতে মানুষটি—পবিত্রতা আর কঠিন পরিশ্রমের প্রতীক; ময়দার পবিত্রতায় নিজেকে লুকিয়ে রাখে ও।
সাদা ময়দা তাকে ঢেকে রাখে ধোঁয়ার মত যখন সে খুব তাড়াতাড়ি নড়াচড়া ক’রে কিংবা
যখন কেউ তার কাঁধে হাতটা রাখে। কিন্তু এই মিথ্যা সাদা রঙ তার হাতের কালো লোমগুলো ঢেকে দিতে পারে না। ওকে অনেকটা গরিলার মত দেখতে। পেশিগুলো কুস্তিগীরদের মত নিষ্ঠুরভাবে ফুটে উঠেছে। ঠিক যেভাবে সাপ জ্যান্ত ইঁদুর গিলে খায়।
ও প্রতিদিন ময়দার খামিরের সাথে এভাবেই কুস্তি ক’রে। ঠিক যেভাবে কেউ খুব নরম নারী শরীরকে পিষে যায়। নারীর মাংস পেষা হ’তে থাকে, সে শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। এমন শব্দ হ’য় যেন মনে হ’য় সে নারীটির উরুতে আঘাত করছে। অবশ্য এ কথা ঠিক যে সে কসাই-এর থেকে কম নির্মম। ময়দার খামিরকে আগেই হত্যা করা হয়েছে । আর খুব মিহি করে পেষা শস্য দানা থেকে রক্ত ঝরে না। বিস্কুট, পাউরুটি আর কেক বানানো মানুষটি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজের ভিতরই নিজেকে গুটিয়ে রাখে। সে দাঁড়িয়ে থাকে তার পোশাকের ওপর একটি ছিটে ফোঁটা দাগও না ফেলে। ও ওভেন থেকে পাউরুটি বের ক’রে। সেই রুটি থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে জীবন্ত সব মৃত মানুষদের মত। তারপর তারা একসময় ঠাণ্ডা হ’য়ে শক্ত হ’য়ে যায়।
বিস্কুট, পাউরুটি আর কেক বানানো মানুষটি কিন্তু খুব গোপনে প্রায়শ্চিত্ত করে। নিজ শরীর থেকে স্পঞ্জ চেপার মত করে নিংড়ে পড়া ঘাম বের ক’রে। ও দাঁড়িরে থাকে ওভেনের উত্তাপের সামনে। অসুস্থ ফ্যাকাশে হ’য়ে যে কোন কিছুই জয় করতে পারে না।

দেবালয়! আমি কত যে দেবালয় দেখেছি! এ পৃথিবী দেবালয়ে ভরা (পৃথিবী কি দেবালয় নিয়ে কিংবা দেবালয় না নিয়ে ভালো হ’ত?)
দেবালয়গুলো জুতার দোকানের মত। পা থেকে জুতা খুলে তা এদিক সেদিক ছুঁড়ে দেওয়া হ’য়।
দেবালয়গুলো ভিক্ষুক আর পুণ্যপ্রার্থীদের জন্য। ওরা দাঁড়িয়ে আছে কবুতর আর বাদুড়ের বিষ্ঠার ওপর!
দেবালয়ে রঙ করা সব চোখ। হাওয়ায় উড়ছে যে ফিতা তাতে আগুন।
দেবালয় সেগুলোই যেখানে গরুদের দুধ দোওয়ানো হ’য়। মাছি উড়তে থাকে তার উপর।
ছাগলদের বলি দেওয়া হ’য়। দেবালয় জাদুমুগ্ধ হয়ে সেই রক্তপান ক’রে।
দেবালয়ে সুতা দিয়ে ঝুলছে পকেট আয়না, রেজর ব্লেড, আলোর বাল্ব (পুরানো হ’য়ে যাওয়া গ্লাভস, জং পড়া ব্লেড, জ্বলে শেষ হয়ে যাওয়া বাল্ব)।
দেবালয়ে পিঁপড়েরা কালো লাইনে বিভিন্ন দিকে চলতে থাকে। নীল আকাশের নিচে খুব কোমল সুরে উইন্ড চাইম বাজতে থাকে। ব্রোঞ্জের ঘণ্টা গমগম করে বাজে দেবালয়ে। শিং-সহ দেবালয় বিশ্রাম নেয় সবজে কামানের মত। ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে জেগে ওঠে পাহাড়।
দেবালয়ের দেবতারা পাহাড়ের মত উঁচু। তাদের কাটা হয়েছে শক্তিশালী গাছের গুঁড়ির মত। আর রঙ করা হয়েছে দগদগে লাল-নীল রঙে। দেবালয়ে দেবতারা একজন আর একজনকে জড়িয়ে আছে। জল গড়িয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে দেবতাদের গায়ে। সেইসব দেবতা যারা চিনামাটি আর ঘোড়ার চুল দিয়ে তৈরি, সেইসব দেবতা যাদের মুখ সাদা আর কালো পাথরে তৈরি ।
দেবতারা তাদের জিভ বের করে আছে কিংবা দেখাচ্ছে তাদের হিংস্র বিষদাঁত।
দেবালয়গুলো চিন্তাবিদদের কোঁচকানো ভুরুর মত। ভিমরুলের চাকের মত। রমণীর বুকের মত। তার আধ খোলা যোনির মত। তাঁবুর মত দেখতে দেবালয়গুলো কাঠ দিয়ে তৈরি, কিংবা পাথর দিয়ে গাঁথা তরুবীথির মত।
দেবালয়ের গায়ে জীবন্ত পাতার উপর লেখা আছে প্রার্থনা। দেবালয় বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে সাজানো চিত্র দিয়ে। দেবালয় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে পাপী মানুষেরা আগুনের দেওয়ালের ঢেউ-এর সাথে যুদ্ধ করে।
দেবালয়, দেবালয়, দেবালয়! সেখানে কত অসংখ্য দেবতাদের উপস্থিতি এবং আসলে তা দেবতাদের অনুপস্থিতি!
দেবতাদের তৈরি করা হয়েছে এমন ভাবে যে ও রাখায়, পান করে, জন্ম দেয়, যুদ্ধ করে। তারা লোভী আর উন্মত্ত। শরীরে তৈলাক্ত প্রলেপৃ তারা ছুটে বেড়াচ্ছে। ভালো দেবতা আছে, নিষ্ঠুর দেবতা আছে। আকর্ষণীয় দেবতা আছে। ভয়ংকর দেবতা আছে। দান করে এবং হিংস্রভাবে সব কেড়ে নেয় এমন দেবতা আছে। মাথায় তাদের সোনালি বর্ণবলয়—অলৌকিক, দীপ্ত! কিংবা গলায় জড়ানো বিষাক্ত সাপ। জীবন এবং মৃত্যুর উপর ক্ষমতাধারী দেবতাৃ অনর্থক, রক্তপিপাসু দেবতাৃ ক্ষমতায় মাতাল হ’য়ে যাওয়া দেবতাৃ এইসব দেবতা মানবসাগরের সমস্ত স্রোত খামচে নিয়ে তৈরি। সমুদ্রে ছুঁড়ে দেওয়া কাঠের টুকরোর মত দেবতারা, ঝর্ণার নিচে মসৃণ পাথরের মত দেবতারা। এরা সবাই তৈরি কামনা আর আত্মবিসর্জনের সৃষ্টি কিংবা গর্ভপাত দিয়ে। দেবালয় এবং দেবতারা।
কিন্তু সত্যিকারের প্রধান দেবালয় এবং একমাত্র ঈশ্বরকে অবহেলা করা হ’য়, সে অচেনা:
মানুষের জন্য সে এক মহাশূন্য। মানুষের জন্য সে বিহ্বলতায় ঘেরা। এবং দেবতার সীমাহীন অনুপস্থিতিই একমাত্র সম্ভাব্য ঈশ্বর!

সুইডিস থেকে ইংরেজি অনুবাদ: ডায়ানা ওয়ারমুথ
কবির নাম বাংলা উচ্চারণ: অতনু নাথ

ভোরের তুষারকণা
দাঁড়কাকের ঝাঁক
বাতাসে ভেসে যাওয়া
পাখা

একবার মানুষে বোঝাই একটা
স্ট্রিটকার ধরবার জন্য আমি
দৌড়াচ্ছিলাম
বরফ ঝরছিল

একবার একটা স্ট্রিটকার ছিল
যেখানে ছিল বাড়িফিরতি
অচেনা সব লোক

একবার একটা স্ট্রিটকার ছিল
যেখানে ছিল বাড়িফিরতি
অচেনা সব লোক
বরফ ঝরছিল
শহরের ছমছমে হালকা রঙিন আকাশ থেকে

ঠিক তখন আমি তোমাকে চিনতে পারলাম
অচেনা সব মানুষদের মধ্যে
বাড়ি ফিরবার পথে

বিকেলে শরতের
পাহাড়গুলো নিয়েছে
বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সূর্যে
পীতাভ বাদামি তৃণমণির রঙ
পান করছে পাহাড়ের মাঝখানের
ছোট হ্রদ থেকে।

ফ্যারোইজ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: য্যান্ডি ওয়ার্ড
কবির নাম বাংলা উচ্চারণ: অতনু নাথ

—ঠিক আছে, তুমি এখন ভিতরে আসতে পার।
তারা তোমাকে সাদা পোশাকে সাজিয়েছে।
আমি তোমার নরম হাত ছুঁয়ে দেখেছিলাম।
কোন উত্তাপ সে হাতে নেই। আর কোনদিন হবেও না।
যে হাত আজকাল প্রায়ই আমার চুল এলোমেলো ক’রে দিত,
বিশেষত এই গরমকাল থেকে।
আমার পুরো কপাল থেকে আমার গলা পর্যন্ত। যেন তুমি অপেক্ষা করছিলে
কোনকিছুর জন্য।
তুমি কী জানতে?
(তোমার হাত, তোমার নরম, ছোট্ট হাত,)
আর একটা হাত ওরা তোমার বুকের ওপর রেখেছে
এক গোলাপফুল ঘিরে। সাদার উপর লাল। এক বধূ
কিন্তু আমার নয়।
তারপর দেখবার সময় শেষ। অন্য কেউ অপেক্ষা করছে।
(মুখ, কপাল, হাত)
আমি দরজার দিকে হেঁটে যাই;
অরোরার আলো, আলোর ঝলমলানি—
উন্মত্ত, খোলা।
দরজার কড়ায় হাত।
অল্প ক্লিক এক- শেষ ক্লিক।
করিডোরে পায়ের শব্দ। ক্লিপ-ক্লপ
ক্লিপ-ক্লপ. এভাবেই
একটি জীবন শেষ হয়।

সন্ধ্যাটা ছিল জোনাকপোকায় ভরা
যখন আমরা অপেক্ষা করছিলাম ভেলেইট্রির বাসের জন্য
দেখলাম প্লেইন গাছের নিচে চুমু খাচ্ছে দু’জন বৃদ্ধ বৃদ্ধা। ঠিক তখন
তুমি বললে, কিছুটা বাতাসের দিকে কিছুটা আমাকে:
যারা বহুবছর ধরে ভালোবাসছে তারা শুধু শুধু বেঁচে থাকে নি।
আর ঠিক তখনই আমার চোখে পড়ল
অন্ধকারের প্রথম জোনাকপোকাটাকে, ঝিলমিল করছে
তোমার মাথার চারপাশ ঘিরে আলোর ঝলকানিতে
এ ছিল ঠিক তখন!

পৃথিবীতে সব বালু কণার এক অবিস্তৃত, অখণ্ড সমষ্টি আছে।
একইভাবে আছে মাথার উপরের তারকাখচিত বিশ্বে।
(মনে হ’য় প্রতিটি বালুকণার জন্য আছে একটি তারা), শুধু আমরা যদি জানতাম,
কিন্তু জানা বেশি জরুরি যে বালুর কণাগুলো
সংখ্যায় ক্রমশ বেড়ে চলে আর মরুভূমিগুলো বড় থেকে বড় হ’য়ে যায়।
গোলাপি সূর্যাস্তে মিশে যায় বেগুনি রঙের ছোঁওয়া।
বালু দুধের মত সাদা আর নরম
বেহালার ছড়ের ওঠানামার মত তা।
বালু তোমার পায়ে চুমু খেয়ে যায়।
তোমার হাতের তালুর ওপর পরিষ্কার জলের মত ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে।
বির আল দাহাররেম আর উপত্যকাগুলো তামার তৈরি।
থিবিস আর আসমারায় বালুর নিচে শুয়ে আছে মৃত নগরীগুলো।
বালু চূর্ণ হ’য়ে যাওয়া পাহাড় আর যা কিছু সৃষ্টি হয়েছিল সেই সবকিছুর ছাই।
উত্তপ্ত দেশগুলোর উপর দিয়ে আগুনের ডোরাকাটা দাগের মত পাড় হ’য়ে যায় বালিয়াড়ি
বালু ঢেকে ফেলে সৌরজগত। বালুর উপরের প্রতিবিম্ব হচ্ছে চাঁদের আলো।
পৃথিবীর শেষ সত্য হচ্ছে বালু।
সময় ঘুমিয়ে আছে।

এতই নরম, ‘আলো’।
আর এতই অল্প তা। অন্ধকার
সব ছাপিয়ে, বিশালতায়।
আলো নরম, তীক্ষ্ণ,
এক অন্তহীন রাতে।
আর আলোর কতটা পথই না যেতে হবে
সে এক নিঃসঙ্গ পথ বেয়ে।
চল, আমরা আলোর সাথে নরম হই, মৃদু হই।
তাকে ভালোবাসি।
তবেই তা আবার সকালে ফিরে আসবে।
আশা করি।

নরওয়েজিয়ান থেকে ইংরেজি অনুবাদ: রজার গ্রীনওয়াল্ড
কবির নাম বাংলা উচ্চারণ: অতনু নাথ

বাড়িতে যে পেন্টিংগুলো
ঝুলে আছে শুধু সেখানেই
ল্যান্ডস্কেপের অস্তিত্ব
আর সেখানেই ধ্বংস হয়ে গেছে
ল্যান্ডস্কেপ।

লেখার পাতাটি
জীবন্ত হ’য় ওঠে…
জেগে ওঠে
আমার জন্য।
খাঁচার ভিতর আমাকে
বন্দী ক’রে সে বলে যে
নিজ হাতের লেখাই
আমার সব একাকীত্বের উৎস।

ফ্যারোইজ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: য্যান্ডি ওয়ার্ড
কবির নাম বাংলা উচ্চারণ: অতনু নাথ

প্রচ্ছদ । রাজিব রায়

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.