আগুনপরি । অর্ণব পাল সন্তু

0

১.
সার্কাসের মেয়েরা সাধারণত সমাজের চোখে ‘ভালো’ কিছু নয়। তার ওপর আলিয়া যখন আগুনের খেলা দেখানোর জন্য মঞ্চে ওঠে, তখনই ফিসফাস শুরু হয়। কারণ?
আলিয়ার শরীরের অর্ধেক পোড়া, কুৎসিত! অন্য দিকটা মোহনীয়।
আলিয়া জানত সে পুড়ে গেছে গেছে, কিন্তু কামরান তাকে বলত আলিয়ার আসলে নতুন জন্ম হয়েছে, আগুনজন্ম।
পুড়ে যাওয়ার আগে সে অন্য আলিয়া ছিল। তার পুড়ে যাওয়ার ইতিহাসটা আমাদের অজানা। কামরান জানে কি না জানি না।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে, এই আগুনই তার জীবন হয়ে উঠেছে। শিখা নিয়ে যখন নাচতে থাকে পুড়ে কুৎসিত হয়ে যাওয়া মুখের অপর পাশটা দেখলে মনে হয় সে যেন এক জ্বলন্ত আগুনের পরি।
সবাই তাকে অপয়া ভাবে, অথচ না তাকিয়েও থাকতে পারে না।
সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়াত, পোড়া চামড়ার নিচে একটা নতুন চেহারা দেখতে পেত। হয়তো অন্য কেউ, হয়তো কোনো ছায়া, হয়তো কিছুই না। সে অনুভব করে, আগুনের শিখা যখন তার চারপাশে ঘোরে, তখন তার ভেতরেও কিছু একটা জ্বলতে থাকে।
আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। খেলার সময়, একদম শেষ মুহূর্তে শিখা তার হাত ফসকে যায়। আতঙ্কিত দর্শকদের মাঝ থেকে কেউ ফিসফিস করে বলে—
‘এই মেয়ে একদিন সবকিছু পুড়িয়ে দেবে।’

২.
বর্ষবরণের মেলা চলছে, মেলা প্রাঙ্গণ থেকে একটু দূরে শহরের শেষ প্রান্তে উপজেলা পরিষদের মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল দি স্টার সার্কাস। যেখানে রাত হলে আগুন নাচে, ছায়ারা কাঁপে, কেউ কেউ আবার বাতাসে পুড়ে যাওয়া রঙের গন্ধ পায়। একসময় যা ছিল আলো, উল্লাস আর বিস্ময়ের কেন্দ্র, আজ তা পুরনো, ধুলো জমা, ক্লান্ত। রাতের বেলা যখন শহরের লোকেরা ঘুমিয়ে যেত, তখনও সেখানে জ্বলত আলোর শিখা কিন্তু সেটা যেন ঠিক আলো দিত না বরং আরও অন্ধকার তৈরি করত।
বঙ্গভঙ্গের বছর ‘দি লায়ন সার্কাসে’র হাত ধরে এদেশে সার্কাসের যাত্রা শুরু। পেরিয়েছে শত বছর, বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম মানুষকে করেছে আরও সহজলভ্য, অলস, আর বাস্তবতা বিমুখী। ফলে রক্তমাংসের বাস্তব বিনোদনে মানুষ আর আগ্রহী নয়। আগে সার্কাসে নারীদের অংশগ্রহণ খুব একটা ছিল না। তখন নারীর ভূমিকায় পুরুষেরাই সার্কাস প্রদর্শন করত। সেদিন আর নেই। এখন সার্কাসে নারীর অংশগ্রহণ লক্ষ্য করার মতো।
স্টার সার্কাসের দুইটি প্রাণ ছিল আলিয়া আর বেঁটে খোঁড়া কামরান। সম্পর্কটা অনেকটা বাবা-মেয়ের মতো। কামরান আদতে ছিল সার্কাসের জাদুকর। কামরান জানে, তার জাদু ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, লোকে এখন আর তেমন জাদুতে বিশ্বাস করে না। প্রযুক্তির যুগে এসে তার পুরনো কৌশল ব্যর্থ। তাই বলে স্টার সার্কাস ছাড়ে নি সে। সে জাদুকর থেকে পরিণত হয় বিদুষকে। স্টার সার্কাস তার ধ্যান জ্ঞান, সে সার্কাসের মালিক সাত্তারের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সার্কাসটাকে।
কামরান জানে আলিয়ার চোখে যে আগুন, সেটার কৌশল এখনো কেউ বোঝেনি। তাই সে আলিয়ার ওপর বাজি ধরেছে।
সে বিশ্বাস করে, আলিয়ার আগুনের খেলা এবং তার জাদু একসঙ্গে মিশলে সার্কাস আবার জ্বলে উঠবে। কামরান আলিয়ার কানে কানে বলে—
‘এই আগুন শুধু আলো দেয় না, ছায়াও বানায়। আসল জাদু লুকিয়ে থাকে ছায়ার গভীরে।’ কেননা তারা দুজন যখন মঞ্চে আসত দর্শকেরা অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করত বেঁটে কামরানের ছায়াটা পড়ত বিশাল! আগুনের আলোয় আলিয়া যেন এক দেবী, আর কামরান এক ছায়াময় পুরোহিত।

৩.
আলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল ‘আগুনের আয়না’। সে আগুনের শিখা দিয়ে বাতাসে তৈরি করত এক বিশাল গোল ফ্রেম। সেই ফ্রেমের ভেতর দর্শকরা নিজেদের মুখ দেখতে পেত। কখনো কখনো তারা দেখতে পেত ভিন্ন মুখ, মৃত প্রিয়জন, ধসে যাওয়া অতীত, আগুনে পোড়া সুখের দিন, দুরন্ত শৈশব-হারিয়ে যাওয়া প্রেম কিংবা এমন গোপনীয় কিছু যা তারা লুকিয়ে রাখতে চাইত।
‘চলমান আগুনের পথ’ মাঠের একপ্রান্ত থেকে শুরু করে সে আগুনের রেখা টেনে তৈরি করত এক সরু পথ, যার ওপর দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় সে হাঁটত। মাঝে মাঝে শিখাগুলো লাফিয়ে উঠত তার পায়ের নিচে, তবুও সে কখনো পুড়ত না।
‘আগুনের থিয়েটার’ একাই একাধিক চরিত্র হয়ে আগুনের সাহায্যে মঞ্চস্থ করত এক পুরনো প্রেম-দ্রোহের কাহিনি, যেখানে পুরুষ চরিত্রের মাথায় ঘুরে লাল আগুনের মুকুট আর নারী চরিত্রের শাড়ি হয়ে উঠে শিখায় গঠিত বস্ত্র।
‘অগ্নি-পুতুল’ ছোট ছোট আগুনের গোলা দিয়ে তৈরি করত মানবাকৃতি পুতুল। যাদের নাচাত সে বাতাসের ছোট ছোট ঘূর্ণির সাহায্যে। তারা হাঁটত, মাথা ঘুরাত এবং মাঝে মাঝে আলিয়াকেই অনুসরণ করত।
‘নির্বাণের আগুন’ খেলা চলাকালীনই একদম নিঃশব্দে সব আগুন নিভে যেত, আলিয়া মাঝপথে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আর তখন দর্শকদের মনে হতো, তারা কেউ নেই, কেবল ভেসে বেড়াচ্ছে অন্ধকার ও পোড়া ঘ্রাণের মধ্যে। হঠাৎ তার দুই চোখ জ্বলে উঠত লালচে আলোয়, যেন আগুন আবার তার ভেতরে ফিরে গেছে।

৪.
আজ মেলার শেষ দিন। হয়ত এক বছর পর আবার এখানে ফিরে আসবে সার্কাসটা। কামরান আর আলিয়া আজ পুরাতন খেলার সাথে নতুন একটা খেলা দেখাবে। যে আগুনের খেলা আগে কেউ কখনো দেখায়নি।
মঞ্চে আগুনের রিং জ্বলে ওঠে।
আলিয়া দাঁড়িয়ে থাকে একদম মাঝখানে, চোখ বন্ধ করে। কামরান একপাশে, হাতের মধ্যে একটা পুরনো তামার কয়েন ঘোরায়।
‘খেলা শুরু হবে।’— ঘোষণা হয়।
আলিয়া আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার নতুন খেলা ‘আগুনের আত্মদহন’—নাচটা শুরু করে। নিজেকে আগুনে জড়িয়ে ফেলে সে ঘূর্ণি নৃত্য শুরু করে, মাথা নিচু, দুই হাত আকাশে। আগুন ক্রমে তার শরীরকে ঢেকে ফেলছিল, কিন্তু সে নাচ থামায়নি। সে যেন আগুনকে ডাকছে। শিখাগুলো দাউ দাউ করে উঠছে, আশেপাশে অনেকগুলো ছায়া দেখতে পায় দর্শকেরা। আগুন ছায়াদের চারপাশ ঘিরে ফেলতে থাকে।
একটা বিকট চিৎকার শোনা যায়, যা ঠিক মানবীয় নয়।
হঠাৎ আলিয়া চোখ খুলে। আগুনের মাঝখানে তার ছায়া নড়তে থাকে কিন্তু তার ছায়াটা কি একটু লম্বা হয়ে গেল?
না, ওটা ছায়া না।
ওটা আরেকটা মানুষ?
আলিয়া পিছিয়ে যায়। কামরান ফিসফিস করে বলে—
‘ভয় পেয়ো না। আগুনের মধ্যে যা থাকে, তাকে ভয় দেখানো যায় না। তুমি আগুনের মেয়ে। তোমার ভয় পাওয়া মানায় না।’
মঞ্চের চারপাশের মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, অবাক হয়ে দেখে।
কিন্তু কারও চোখে চোখ নেই।
তারা বিস্মিত অথচ মুখে হাসির রেখা, কিন্তু তাদের ঠোঁট এতটাই কালো যে আগুনের আলোয় ধরা পড়ে না। তারা হাততালি দিচ্ছে, কিন্তু শব্দ হচ্ছে না।
কামরান চিন্তিত হয়—হয়ত সে একটা ভুল করেছে।
একটা প্রাচীন ভুল।
আগুন কেবল আলো দেয় না, আগুনের একটা ক্ষুধাও আছে।
এই সার্কাসের বয়স অনেক, সার্কাসের জীবন সাইকেলে অনেক অপ্রিয় মৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। এখানে আগুনে পুড়ে হয়ত অতীতে অনেকেই মরে গিয়েছিল।
কিংবা শুধু ছায়া হয়ে গিয়েছিল।
আজ কি তারা ফিরে এসেছে?
তারা কামরান আর আলিয়াকে নেবে? সার্কাসের জন্য? আগুনের জন্য?
আলিয়া আর কামরান পরস্পরের দিকে তাকায়।
পেছনে ছায়ারা এগিয়ে আসছে।
কামরান সামনে এগিয়ে এসে তার তামার কয়েনটা বাতাসে ছুঁড়ে দেয়।
মঞ্চের মাঝখানে হঠাৎ একটা কালো দরজা ফুটে ওঠে।
ছায়ারা চিৎকার করতে করতে সেই দরজার ভেতরে পড়ে যেতে থাকে।
দর্শকেরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু যখন আগুন নিভল, তারা দেখল আলিয়া নেই।
বাতাসে পোড়া চুলের গন্ধ আর একটি ছোট্ট আগুনের প্রজাপতি, ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
এইসব খেলার মাঝে আলিয়া ছিল যেন এক পরাবাস্তব শিল্পী, আগুনের দেবী, যাকে কেউ বুঝত না, আজকের এই অগ্নিনৃত্য কেউ ভুলতেও পারবে না।
পরের দিন, শহরের লোকেরা এসে দেখে, সার্কাসের তাঁবু আর নেই।
শুধু পোড়া মাটি আর মাঝখানে পড়ে থাকা একটা মুখোশ।
তবে বাতাসে এখনো একটা ঘ্রাণ ভাসছে—
আগুনের নয়।
জাদুর নয়।
বরং কিছু একটার শেষ হয়ে যাওয়ার ঘ্রাণ।
কেউ কেউ বলে, সার্কাস পুড়ে গেছে।
কেউ বলে, আগুন ওদের গ্রাস করেছে।
আর কেউ কেউ বলে, ‘ওরা বেঁচে আছে তবে মানুষ হিসেবে নয়, আগুন আর ছায়ার আকারে। কিংবা তারা এখনো বেঁচে আছে
কিন্তু তারা আর মানুষ নেই।’
কিছুদিন পর খবরে প্রকাশ পায় ইংল্যান্ডের সোয়াম্প সার্কাসের না কি নতুন এক অদ্ভুত আগুনের খেলা হয়। যেখানে মাঝে মাঝে মঞ্চের বাইরে এক পঙ্গু মানুষকে ছায়ার মধ্যে দেখা যায়।

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.