গল্প
দ্যা কেট
সোনিয়া হোপ
অনুবাদ: লুনা রাহনুমা
১৯৬৪: যে বছর তার বিবাহিত জীবন সমাপ্ত হয়েছিল। যে বছর তার রেকর্ড ঘুর্ণন বন্ধ হয়েছিল, রেকর্ড যন্ত্রের খাঁজে আটকে থাকা সূঁচটি আলগোছে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল, এবং একটি ছোট্ট স্ন্যাপের সাথে তার স্বরের হাতলটিকে জায়গা মতো তুলে রাখা হয়েছিল।
তিনি কখনই মেরিলিনকে চাননি। চাননি তার মুখের উপর যত্ন করে বসিয়ে রাখা প্রিম-গার্ল চুলের ভাঁজ। চাননি মেরিলিনের পূর্ণিমার মতো উজ্জ্বল মুখটি তার নিজের মুখের এতটাই কাছে, যে সেই মুখটি তার কাছে দারুন রকম বিরক্ত লাগতো। তিনি মেরিলিনের মুখে আর শুনতে চাননি সেই কথাগুলো, আমার এখন আট সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে, আমাদের বিয়ে করতে হবে। কথাগুলো বলতে বলতে মেরিলিনের মুখের কোণা কুঁকড়ে যেত বিরক্তিতে। তিনি হ্যাকনি টাউন হলের অনুষ্ঠানটি করতে চাননি, যেখানে রেজিস্ট্রি অফিসের খাতায় আছে মেরিলিনের স্বাক্ষর এবং তার নিজের স্বাক্ষর (তবে তিনি টনিক মোহায়ের স্যুটটি চেয়েছিলেন যেটি পরে তাকে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছিল)। তিনি দোকানের উপরে ভাড়া করা এক কামরার ঘরে থাকতে চাননি, যখন মেরিলিন জিজ্ঞাসা করেছিল, তাহলে বাচ্চাটি কোথায় ঘুমাবে? তিনি এসবের কিছুই চাননি। তিনি ইংল্যান্ডে এসেছিলেন একটি কাজ পেতে, নিজের জীবনে ভালো কিছু করতে, তার অনিন্দ্য সুন্দর দেশ জামাইকায় অপেক্ষা করে থাকা দাদীর কাছে কিছু ছবি তুলে পাঠাতে, যে ছবিগুলো তার দাদিকে গর্বিত করতো। প্রিয় দাদিমা, আমি আশা করি যখন এই কয়েকটি লাইন আপনার কাছে পৌঁছেছে তখন তারা আপনাকে ভীষণ আনন্দিত করেছে…
আপনি ভাবেন, সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজ করে ঝক্কর ঝক্কর করে ঢিমা তালে টটেনহাম থেকে ভিক্টোরিয়া যাওয়ার পথে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থেকে এবং আবার ফিরে এসে, টিকিট মেশিনের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে প্যাসেঞ্জারদের জন্য টিকিট বের করে আনা, এবং টিকিটের মূল্য হিসেবে ইংলিশগুলোর তার হাতে পয়সা ড্রপ করে দেয়া, কারণ তারা তার ত্বক স্পর্শ করতে চায় না, তিনি নিজের উপার্জিত সেই অর্থের কিছুটা নিজের জন্য ব্যয় করার অধিকার রাখে। কাজের শেষে ঘোড়া দৌড়ের খেলায় নিজের আনন্দকে প্রশয় দেয়ার অধিকার রাখে। ব্রুস গ্রোভের কাছাকাছি রুবেন থেকে একটি নতুন শার্ট, কয়েক জোড়া স্মার্ট জুতো কেনার অধিকার তার আছে। স্টামফোর্ড হিলের দিকে আরএন্ডবি রেকর্ডের দোকানে ঘুরে জাজ এবং ব্লুবিট কাটের নতুন কপি এসেছে কিনা দেখে আসা। আপনারা নিশ্চয়ই বলবেন যে, এগুলো কাজ করা তার জন্য ঠিক আছে এবং উচিত আছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে মেরিলিন একজন গৃহবধূ ছিল এবং তার কোন অর্থ উপার্জন ছিল না। যদিও সে ছিল একজন স্টুডেন্ট নার্স। কিন্তু মেরিলিন বলেছে, ছেলেটির এই কাজগুলো করা ঠিক না, খুব অনুচিত। মেরিলিন জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি কি ঘর ভাড়া দিয়েছ? পানির বিল? ব্যাংকে এখন কত আছে, সেভিংস অ্যাকাউন্টে? তুমি দেরি করে বাড়ি ফিরেছো তার মানে তুমি বেটিং শপে গিয়েছিলে? তাই না?
টিম স্পিরিট গর্জন করে উঠে এবং ছেলেটি সেদিন কিছু বোনাস পেয়েছিল। ধনী হবার অনুভূতি তাহলে এমন হয়, সেটি হয় যদি শুধু একদিনের জন্য। সে তার স্থানীয় সমস্ত কর্মচারীদের জন্য পানীয় কিনে উদযাপন করেছিল এই আনন্দ, এবং তারপর সবাইকে রেখে সে আরঅ্যান্ডবি বেটিং শপটি বন্ধ হওয়ার আগেই পৌঁছতে হবে বলে দ্রুত রওনা হয়েছিল। সেদিনের জিতে যাওয়া অর্থের কিছুটা দিয়ে সে দ্যা ক্যাট এর উপর বাজি ধরতে চেয়েছিল এবং ভেবেছিল একবার জিতে গেলেই সবাইকে মিষ্টি কিনে খাওয়ানোর টাকা হয়ে যাবে।
বাড়ি ফেরার পথে সে মেরিলিনের কথা ভেবেছে। মেরিলিনের রান্না করা পুডিং রাইসের কথা ভেবেছে, তার করন্ড বীফ এবং বাঁধাকপির কথা ভেবেছে, যেখানে সবসময় মসলার অভাব থাকে। মেরিলিন কেমন গোড়ালি ছোঁয়া দৈর্ঘ্যের স্কার্ট পড়তে পছন্দ করে, মোটা ট্যান টাইটস এবং বাদামি রঙের হিল ছাড়া ব্রোগস(জুতো) পরতে পছন্দ করে। মেরিলিন কেমন টেলিভিশন দেখা বা নাচতে যাবার চেয়ে উপন্যাস পড়তে বেশি পছন্দ করে। কেমন করে সে চার্চে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে যখন তার পেট বেরিয়ে এসেছিলো এবং চার্চের সবাই ফিসফিস করে বলতে শুরু করেছিল যে, মাত্র কয়েক মাস হলো বিয়ে হয়েছে অথচ এত তাড়াতাড়ি তার পেট ফুলে উঠেছে কেমন করে? মেরিলিন তার বাবাকে কতটা মিস করে এবং স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল যে তার বাবা, ত্রিনিদাদী যাজকের সাথে তার এই স্বামীটির কোনই তুলনা হয় না। কেমন করে সে কখনই কিছুতেই খুব প্রয়োজন না হলে একটি পয়সাও খরচ করতো না, কারণ সে একটি বাড়ি কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছিলো। তাই যত অসুবিধাই হোক না কেন, লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিলের দেয়া ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে থাকতে সম্মত না হয়ে কীই বা করতে পারতো মেরিলিন। সেই চাঁদ-মুখটি মনে করে ছেলেটি ভাবছিলো, মেরিলিনকে সমস্ত জীবন ভালো লাগবে, শুধু মেরিলিনকেই ভালোবাসবে এবং বাকিটা জীবন সে তার সাথেই কাটাবে। সেকি সম্ভব?
দ্যা ক্যাট হচ্ছে ইনক্রেডেবল জিমি স্মিথ এর করা একটি এলপি, যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট থেকে আমদানি করা, যার দাম ছেলেটির সাপ্তাহিক মজুরির এক-পঞ্চমাংশের সমপরিমাণ। রেকর্ডের প্যাকেটটি ছিল সুস্পষ্ট দৃষ্টিনন্দন লাল রঙের, রেকর্ডের উপরে একটি কালো বিড়ালের ছবি, ছবিতে বিড়ালটি সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাড়িতে পৌঁছে তিনি রেকর্ডটিকে রেডিওগ্রামের ভেতর অরিজিন্যাল প্যাকেট সহ লুকিয়ে রাখলো।
মেরিলিন নার্সিং পরীক্ষার জন্য পড়া রিভাইজ করছিলো। ছেলেটি জানতো যে মধ্যবর্তী এই সময়টুকু মেরিলিনের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান, কারণ অল্প কিছুদিনের ভেতর তাদের বাচ্চাটা জন্ম নেবে। নার্সিং পরীক্ষার সার্টিফিকেট পাওয়ার আগে সন্তানের জন্ম দেওয়া মানে মেরিলিনের ক্যারিয়ারের শেষ লিখে ফেলা। তাই তিনি নিজের সদ্য কেনা সম্পদটিকে আপাতত গোপন রাখাই উত্তম হবে বলে মনে করেছে। কয়েক সপ্তাহ পর মেরিলিনের পরীক্ষা শেষ হলে দুইজন মিলে দ্যা ক্যাট রেকর্ডটি একসাথে শোনা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন। আপাতত স্মিথের সুরেলা হ্যামন্ড অর্গান সুরগুলো কেনার চিন্তায় বুদ্ হয়ে থাকলো সে। আর বাসটি সেই সময়ে ৭৩ নাম্বার রুটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছিলো এবং আসছিলো।
দুর্ভাগ্যক্রমে, তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে মেরিলিন ঘর পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে কেমন খুঁতখুঁতেস্বভাবের মেয়ে। ধুলাবালি এবং ময়লার দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর থাকতো সবসময়। ছোটবেলা থেকেই মেরিলিন ছিলো তার মায়ের সাহায্যকারী, তাই সে জানতো কীভাবে একটা বাড়িকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার রাখতে হয়। মেরিলিন যখন সিলিংয়ের কোণগুলি ধুতো, স্কার্টিং বোর্ডের প্রান্ত থেকে ধুলো ঝাড়তো, জানালার ময়লা মুছতো, তাদের কফি টেবিল, সাদাকালো টেলিভিশনটি মুছতো, ছেলেটি তখন আরাম চেয়ারের স্বাচ্ছন্দ্য বসে থেকে দেখতো শুধু। সেদিন মেরিলিন ব্রাউন টিক রেডিওগ্রামটিকে পালিশ করছিলো, রেডিওগ্রামটি ছিল তাদের জন্য একটা অমিতব্যয়ী ক্রয়, কিন্তু মেরিলিন এটি কিনতে অনুমোদন করেছিলো, কারণ এই ফার্নিচারটি নিজস্ব গুণে যেকোন ঘরের জন্য একটি সম্ভ্রান্ত ফার্নিচার। তাদের বাড়িতে এমন কোনও জায়গা ছিল না যার উপরে ধুলা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারতো। ছেলেটির সত্যিই বোঝা উচিত ছিল যে মেরিলিন খুব শীঘ্রই দ্যা কেট কে পেয়ে যাবে, তখনো সেটি মোড়ানো থাকবে তার স্বপ্ন-মাখা কাগজের ব্যাগে, দেরিতে নয়, আগেই।
তুমি! তুমি অপব্যয়ী! তুমি একটা অপদার্থ, যা-তা। কেমন করে তোমার কাছে আমাদের বাচ্চার চেয়েও গান আর ঘোড়াকে বেশি মূল্যবান মনে হয়? আমাদের নিজের জন্য একটা বাড়ির চেয়েও বেশি মূল্যবান? তুমি জোর করে আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছো নিজেকে আর এখন দেখো আমার কী দুর্দশা হয়েছে!
দুঃখজনক ঘটনাটি হলো গিয়ে, এই কথাগুলি বলার সময় মেরিলিন সিঁড়ির ঠিক মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল। এবং দুঃখজনক ঘটনাটি হলো যে, কথাগুলো বলার সময় তার চাঁদের মতো মুখটি বিকৃত হয়ে যাচ্ছিলো, তার মুখের রং টমেটোর মতো টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং এই সবগুলো, ছেলেটিকে প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য করেছিল। এবং দুঃখজনক ঘটনাটি হচ্ছে যে এতে ছেলেটির শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছিল এবং ভয়ংকর রাগের সাথে তার হার্ট দ্রুতগতিতে পাম্প করতে শুরু করে। দুঃখজনক ঘটনাটি হলো, ছেলেটি সত্যিকারভাবে একমাত্র যে মহিলাকে ভালোবাসতো, তিনি ছিলেন তার দাদি, সেটি এই মেয়েটি না বা অন্য কোনও মেয়ে নয়। দুঃখজনক কথা যে, তিনি যখন মেরিলিনকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরেছিলেন তখন তিনি শুধু মেরিলিনকে চুপ করাতে চেয়েছিলেন। তিনি চাননি মেরিলিন হাসপাতালে ভর্তি হোক এবং তার নার্সিং পরীক্ষা মিস করুক। তিনি চাননি ছোট্ট একটি সাদা কফিনকে সামনে রেখে শোক আর কান্নায় ভাসানো একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন হোক।
এবং যখন তিনি শুক্রবার রাতে কাজ থেকে বাড়ি এসে রান্নাঘরের টেবিলে একটি নোট পেয়েছিলেন, যেখানে লেখা ছিল যে মেরিলিন তার স্বাক্ষর জাল করেছে, তাদের এতোদিনের জমানো সব অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে এবং ত্রিনিদাদের একটি ফ্লাইটের টিকিট কিনে বাড়ি চলে যাচ্ছে, তখন ছেলেটি সমস্ত কিছুর জন্য অনুতপ্ত হয়েছে, কেবলমাত্র মেরিলিন তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টকু ছাড়া।
লেখক পরিচিতি:
জ্যামাইকা ও ত্রিনিদাদিয়ান ঐতিহ্যের মানুষ সোনিয়া হোপ বাস করেন উত্তর-পূর্ব লন্ডনে। তিনি ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গাল্যারি এবং ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন অনলাইন লাইব্রেরিতে গ্রন্থাগারিক হিসাবে কাজ করেন। সোনিয়ার লেখা বিভিন্ন সংক্ষিপ্ত কল্পকাহিনী প্রকাশিত হয়েছে দ্য নটিংহ্যাম রিভিউ, ফ্ল্যাশ ফ্লাড, ফ্লাইট জার্নাল, এলিপসিস জাইন, কিং লডস র্যাগ, অ্যাম্বিট, বেস্ট ব্রিটিশ শর্ট স্টোরিজ ২০২০ নাইন্থ জেরউড আরভন অনথলজি, দ্য আনট্যাংলিং এ।
২০১৯/২০-এর কথাসাহিত্য বিভাগে জেরউড/আর্বন শিক্ষার্থী ছিলেন সোনিয়া এবং ২০১৯ সালে তাঁর লেখা দ্যা ক্যাট বাই দ্যা ইনক্রেডিবল জিমি স্মিথ ছোটগল্পটি গার্ডিয়ান ফোর্থ এস্টেট বিএএমই শর্ট স্টোরি পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছিল।
বর্তমানে সোনিয়া একটি উপন্যাস এবং আরও স্বল্প-সংক্ষিপ্ত গল্প লিখছেন।