সঙ্গীতা ইয়াসমিন এর কবিতাগুচ্ছ
দায় মুক্তির সাধ
একটা স্বপ্নের বীজতলা সাজিয়ে
জাগ দিয়ে রেখেছি চার যুগ।
ওমের মায়ায় আগলে রেখে
পূর্বপুরুষের এই সোনার তালুক
অপেক্ষায় আছি-
দ্রোহের আগুনে গলে বাদামী বাকল ফুঁড়ে
একদিন সে বীজ অঙ্কুরিত হবে।
সুষুপ্তি ভেঙে স্বপ্নবৃক্ষের ডাল
ফোটাবে কৃষ্ণচূড়া শিমুল পলাশের লাল
নগরের খানাখন্দ শহরের অলিন্দ
ভেসে যাবে সুপুষ্ট বীজে-ঘুচবে আকাল,
মিনাক্ষীর সিঁথি বেয়ে যতদূর চোখ যায়
সোনার নোলকে রোশনাই ছড়ায়
সোহাগীর হাসির ফাঁকে সবুজের মায়াময় মাঠে।
অহল্যা এ মাটি একদিন ফলবতী হবে
দুধেল গাইয়ে নুইয়ে পড়বে সবুজ বাথান
অলৌকিক আশীর্বাদে মুছে যাবে অপুস্পক নাম।
ইটখোলা-হাটখোলা-কাঠগোলায়
কারখানা ছাপাখানা রেস্তোরায়
বুটপালিশ কি বা ফুল কুড়োনি
বেশ্যা পল্লী কি বা সুইপার কলোনি
আনন্দ মিছিলে নামে প্রজাপতি দিন
ভুখানাঙ্গা পাও ফাটা শুধে যায় জন্মের ঋণ।
কন্যা দায় থেকে আরোগ্য লাভ করেন পিতা
মোহমুক্ত হয় আমাদের প্রৌঢ় স্বাধীনতা!
অটিস্টিক যন্ত্রণায় ভোগে না আর
এই জনপদের আবালবৃদ্ধবণিতা।
কখনও বৃষ্টির কবিতা লেখা হয়নি
বৃষ্টির কবিতা লিখব বলে
একদিন বৃষ্টির কাছে আঁজলা পেতে
চেয়েছিলাম এক বিন্দু জল।
উদোম আকাশটা গ্রীবা বাড়িয়ে
ঢেলে দিল বিস্তীর্ণ ফোয়ারা।
বাতাসের মিহিন চাদরের স্রোতে
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি আদর মিশিয়ে দিল সারা গায়ে।
মেঘমল্লারের বিষাদে ঢাকা পড়ে গেল
সবুজ শরীরের ঘ্রাণ
হঠাৎ বাদামী মাটিতে জলের ছাঁটে
আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে কাষ্ঠল প্রাণ।
ছুঁয়ে দিতেই উছলে পড়ল আভূমি-কলকল
আষাঢ় শ্রাবণ নামল ভাদর-চোখের কোণে ঢল
বুকের ভাঁজে দুমড়ানো শ্বাস অনন্ত দীঘল
নীল সীমানার সামিয়ানায় নৈঃশব্দ অর্গল।
বৃষ্টিহীন অভিমানী আরশিতে
বৃষ্টি যাপন চলে কান্না ও শোকে
দুহাতের ফাঁকে কতটুকু গলে
এক শ্রাবণ ধরলে চোখে।
আরোপিত যাপন
আশৈশব একটা মাইলস্টোন
ঘাড়ের ওপরে ঝুলেছিল ।
অদৃশ্য ইটের সুতোয়
ঐশি বাণীর মত ওহি নিয়ে-
“ভালো মেয়ে হও” ।
জন্মাবধি আমার পদধ্বনির প্রতিটি শব্দ
গ্রন্থিত হয় সমাজের কঠিন বীক্ষণে
সময়ের পেন্ডুলাম বাঁক বদলায়
নতুন মাইলস্টোন আসে-নতুন বাহানায়।
প্রতিবারই গুরুত্ব পায় সমাজ-সংসার-পরিবার
আমিহীন ইচ্ছেরা নির্বিকার।
যতবার মাইলফলক ছুঁয়ে যাই,
আরোপিত লক্ষ্যমাত্রার দৌড়ে
একলা পাহাড় অথৈ অরণ্যে
কতবার ভাঙি-নিজেকে ডিঙাতে
কত আর যাপন আদিষ্ট জীবন?
অপাঙক্তেয় জন্মের জার্নালে
পাতায় পাতায় খুঁজি প্রজন্মের লড়াই,
দূরগামী ট্রেনের হুইসেল শুনি
ক্রমশ ম্রিয়মাণ অন্ধকারের স্রোতে
পরাভব মাইলফলক গুণি।
কৃষ্ণবিবর
চিরচেনা পৃথিবীর কপালে
হঠাতই লেগে গেল কলঙ্ক তিলক
রোদের অক্ষরে আঁকা গ্রীবায়
লেখা হল স্ববিরোধী বিরোধ
সময় গড়াতে গড়াতে সন্ধ্যের কার্নিশে
নিভে গেল গোধূলীর শেষ কণা,
লক্ষ লক্ষ তারা ঝরে গেল বিপ্লবের ডাকে
আমাজনের সবুজ পেলবতা থেকে তামু ম্যাসিফের দিকে।
পালক ফেলে হেঁটে গেল দূরগামী ট্রেন
ডাহুকের কালো ডানায় সময় অক্ষয়,
বাদুড় চোখও স্তিমিত হয়ে এল রাতের সামিয়ানায়,
শেয়াল, শকুন, হরিণ শাবকেরা বন ছেড়ে লোকালয়ে
শুশুক, সার্কের মহোৎসব সমুদ্র তীরে।
সেইসব অনড় ক্লান্ত দিনে,
থেমে থাকা ধুকপুকে- মানুষের ভয় শুধু মানুষে
মুখোশের আড়ালের মুখে।
হঠাৎই সুবাসিত সুভাষে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নিয়ে
একমুঠো আলো এলো ঘুলঘুলিতে,
ভয়হীন সুরক্ষিত বলয়ে- দেখা হল আনন্দ নগরে !
‘আদিত্য’ বলেই ডেকেছিলাম মনে পড়ে!
ভর দুপুরে নেমে এল রাঙা গোধূলী
সোনা রঙ আতসবাজির নৃত্য দশদিকে- তারা ঝলমল।
তারপর যেতে যেতে
আস্তিন খুলে বেরিয়ে এল ঘুটঘুটে আঁধার,
জোছনা গলে গলে এক নদী রক্ত
অবশিষ্ট অতলান্তিক কৃষ্ণবিবর।