মাজহার জীবন এর প্রবন্ধ: বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী

0

বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী
মাজহার জীবন


সাধারণভাবে এবং স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া হয় বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যের পঠন-পাঠন খুবই কম এবং তার ফলে আমরা বিশ্বসাহিত্যের রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত আমরা হচ্ছি। আবার উল্টোদিকে এও বলা হয়, আমাদের দেশের সাহিত্য অন্য ভাষায় অনূদিত হয়ে অন্য ভাষা-ভাষীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ফলে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাবে বাংলা সাহিত্যের জ্ঞানভাণ্ডারের রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্য ভাষার সাহিত্য অনুরাগীরা। তবে এই দুই ধারণার মধ্যে দ্বিতীয় ধারণাটি যথার্থতা অনেক বেশি। বিদেশী ভাষা (মূলত ইউরোপীয় বা গ্লোবাল নর্থের আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ভাষা থেকেই) থেকে যদিও বাংলা ভাষায় কিছু কিছু অনুবাদ এখন হচ্ছে কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ বিদেশী ভাষায় খুবই কম হচ্ছে, যা হচ্ছে তা একেবারে হাতেগোনা এবং ইংরেজিসহ মাত্র কয়েকটি ভাষায়। এই উপলব্ধি থেকে বলা যায় দেশের সাহিত্যাঙ্গনে অনুবাদ চর্চার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব রয়েছে।
আমরা এ প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের অবস্থান দেখার চেষ্টা করবো তবে তা গবেষকের দৃষ্টিতে নয় বরং তা হবে একজন সাধারণ পাঠকের দৃষ্টিতে। আলোচনাতে অনুবাদের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ও স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে।
বাংলাভাষী মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনেই অন্য ভাষার মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হয়েছে সেই আদিকাল থেকে। আর এই যোগাযোগের একটা বড় উপায় হলো অন্য ভাষা রপ্ত করা বা অন্য ভাষা বুঝতে পারা। এ অঞ্চলের মানুষের নানা কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশের নানা অঞ্চলসহ উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে সিল্করুট ধরে এগোতে হয়েছে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত। ফলে তারা নানা জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতির সাথে পরিচিত হয়েছে আর সাথে করে নিয়ে এসেছে সেসব দেশের সংস্কৃতি সাহিত্য ইত্যাদি। উল্টোদিকে বিদেশী শাসকরা এ অঞ্চল আক্রমণ করেছে বারবার। হিউয়েন সাঙ, ইবনে বতুতা প্রমুখ বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায়ও আমরা এ অঞ্চলের কথা জানতে পারি। আবার উল্টোদিকে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশ আর্য থেকে শুরু করে মুঘল এবং অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত হওয়ার কারণে অন্য ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মানুষকে জানতে হয়েছে, শিখতে হয়েছে, বুঝতে হয়েছে। ফলে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও তার সংস্কৃতি একরৈখিক না থেকে বরং তা নানা ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় ইতিহাসের বাঁক ধরে নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে – বিদেশী নানা কিছু গ্রহণ বর্জনের নিরন্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। নিজ ভাষায় বিদেশী সাহিত্যকে গ্রহণ করার অন্যতম সহজ উপায় দেশের সংস্কৃতির সাথে সাজ্জুয্য রেখে তা অনুবাদ করা।
এটা ধরে নেয়া হয়, বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃত ভাষাকে আর্য ভাষা আর বাংলা ভাষা যাকে দেশি ভাষা, গৌড়ীয় ভাষা বা লৌকিক ভাষা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয় তা মূলত এই এলাকার মানুষের মুখের ভাষা যা অবশ্যই অনেক আগেই আর্য ভাষার সাথে যোগসুত্র হারিয়ে ফেলেছে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘বাঙ্লা দেশে সংস্কৃত যে আদি সাহিত্যিক ভাষা ছিল না, তাহার পূর্বে – জনসাধারণের কথিত, সহজবোধ্য প্রাকৃতভাষা সাহিত্যমর্যাদাসম্পন্ন ছিল ও চিরস্থায়িত্বের উদ্দেশ্যে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে ব্যবহৃত হইত তাহার প্রাচীনতম নির্দশন মহাস্থানগড় লিপিতে বর্তমান। ইহার সম্ভাব্যকাল খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী। এই প্রাচীন যুগে সংস্কৃতের মহিমা বাঙালী সাহিত্যচেতনায় ও চর্চায় কোন রোখাপাত করে নাই। তাহার প্রায় সাত শতাব্দী পরেই সংস্কৃতের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত দেখিতে পায়। যদিও কোল বা মুণ্ডা গোষ্ঠী, দ্রাবিড়ীয় ও তিব্বত-ব্রহ্মণ-গোষ্ঠীর সহিত বিমিশ্র অবস্থায় খ্রীষ্টপূর্ব ১০ম-৯ম শতকে আর্য দিগি¦জয়কারী ও উপনিবেশস্থাপনকারীদের দ্বারা আর্য ভাষা প্রথম বাংলাদেশে আসে। ” পণ্ডিতদের মতে, আর্য ভাষার ইন্দো-ইরানীয় অংশের প্রাচীন ভারতীয় আর্য থেকে কথ্য রূপ যা প্রাচ্যের অংশ এবং প্রাচ্য থেকে মাগধী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশ এবং অপভ্রংশের পূর্বরূপ যেটাকে প্রাথমিক অবস্থায় বঙ্গ অসমীয়া বলা হয় এবং এর একটি অংশ হল বাংলা ভাষা। এখানে দেখা যাচ্ছে প্রাচীন আর্য ভাষা অনেক আগেই দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একটি কথ্য রূপ এবং আরেকটি সাহিত্যরূপ বা বৈদিক ভাষা যেটিকে আমরা বলতে পারি সংস্কৃত ভাষা (সংস্কৃত ভাষা কখনই কথ্যভাষা ছিল না)। তাহলে সংস্কৃত ভাষার সাথে এই কথ্যরূপ ভাষার বিচ্ছেদ ঘটেছে অনেক আগেই। হয়তো এক ধরনের উৎপত্তিগত কারণে একটা যোগসূত্র রয়েছে কিন্তু বাংলা সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি এটি বলাটা খুব একটা যুক্তিযুক্ত না বলেই মনে হয়।

চর্যাপদের (অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী) যে নিদর্শন আমরা পেয়েছি তাকে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। আমরা জানি চর্যাপদে তান্ত্রিকদের যোগ সাধনার কথা বলা হয়েছে যা নেপালের রাজধানীতে পাওয়া গিয়েছে। মহাকাব্য গিলগামেশ, ইংরেজি সাহিত্যে চসার কিংবা স্পেন্সারের কবিতা বর্তমান সময়ের সাধারণ পাঠকের বোঝার জন্য যেমন আধুনিক ইংরেজিতে রূপান্তরের প্রয়োজন পড়ে, তেমনি চর্যাপদ বাঙ্গালী সাধারণ পাঠকের বোঝার জন্য প্রয়োজন পড়ে আধুনিক বাংলায় তার রূপান্তর। কারণ এগুলো যে সময়ে রচিত হয়েছিল তারপর বাংলা ভাষার নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কারণে চর্যাপদের ভাষার সাথে এখনকার সময়ের ভাষার মিল খুব কম। আমরা এখন দেখব চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের ঢেণ্ঢনাপাদানাম লিখিত চর্যাপদের ৩৩ নম্বর পদটির চার লাইন বিভিন্ন অনুবাদক কিভাবে রূপান্তর করেছেন। মূল পদ এরকম:
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশি।।
বেঙ্গসঁ সাপ চড়িল জাই।
দুহিল দুধু কি বেন্টে সামাই।।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর রূপান্তর এভাবে:
নগরে মোর ঘর নাহি পড়শী
হাঁড়িতে ভাত নাই নিত্য পরিবেশন করা হয়
বেঙ্গের দ্বারা সাপ আক্রান্ত হয়
দোহা দুধ কি বাটে সামায়

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ রূপান্তর করেছেন এভাবে:
টোলায় আমার ঘর, প্রতিবেশি নাই;
অন্নহীন, নাই তবু ইস্টির কামাই!
ব্যাঙ কি কামড় মারে সাপের শরীরে?
অথবা দোয়ানো দুধ বাঁটে কি যায় ফিরে

ফলে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা ভাষার চর্যাপদ অনুবাদের ক্ষেত্রে শুধু শব্দগত পার্থক্যই নয় বরং অর্থের পার্থক্য আমরা দেখতে পাচ্ছি এক একটি অনুবাদে।
এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলির একটি কবিতার উদাহরণ দিয়ে দেখবো এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর মূল কবিতার থেকে কতখানি পার্থক্য তৈরি হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছেন Song Offering নামে। কেউ যদি Song Offering এর বাংলা করতে চায় তাহলে অনুবাদ হিসেবে গীতাঞ্জলি নাও আসতে পারে। অন্যদিকে গীতাঞ্জলি শব্দটার মধ্যে যে বাংলা তথা ভারতীয় ঐতিহ্য এবং মিথের মিথস্ক্রিয়া রয়েছে তা কিন্তু Song Offering এর মধ্যে পাওয়া যায় না। গীতাঞ্জলির ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ এই কবিতাটির এক ছত্র আমরা প্রথমে বাংলায় এবং পরে রবীন্দ্রনাথকৃত ইংরেজি অনুবাদ দেখব। আপনারা যদি রবীন্দ্রনাথকৃত ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করতে চান তাহলে দেখবেন মূল বাংলা থেকে ইংরেজির কতখানি দূরত্ব তৈরি হতে পারে এবং উল্টোদিকে ইংরেজি থেকে বাংলা করতে গেলে তাও কতখানি পরিবর্তন হতে পারে।
আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব-
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।।

Thou hast made me endless, such is thy pleasure,
this frail vessel thou emptiest again and again,
and fillest it ever with fresh life.

প্রিয় পাঠক এবার যদি আপনারা এই ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলাতে অনুবাদ করতে চান তাহলে দেখা যাবে কোনভাবেই এই দুই লাইনের সাথে বাংলায় মূল কবিতার সাথে মিলানো যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, বাংলা সাহিত্যের এমন কিছু কবিতা এবং রচনা রয়েছে যেগুলো এখনকার সময়ের পাঠকদের জন্য আধুনিক ভাষায় রূপান্তরের প্রয়োজন হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত ‘জাতিস্মর’কবিতার প্রথম চার লাইন এরকম:
নাথু-সংকটে হাঁকে তিব্বতী হাওয়া।
প্রাকৃত তিমিরে মগ্ন চুমলহরি।
ছঙ্গু-সায়রে কার বহিত্র বাওয়া
অপর্ণ বনে দিয়েছে রহস ভরি। ।

অনুবাদ নিয়ে সাহিত্যসমাজে নানা ধরনের তত্ত্ব রয়েছে। এখানে কোনটির ব্যাখ্যা না করে কয়েকটি শুধু উল্লেখ করা হলো। Translation শব্দটি এসেছে গ্রীক translatio থেকে যার অর্থ to carry across বা to bring across যা সোজা কথায় এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় প্রকাশ করা। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন মনে করেন, অনুবাদ হচ্ছে ‘প্রকাশভঙ্গি বা ‘প্রকাশশৈলী। তিনি বলেন, অনুবাদের মধ্য দিয়ে মূলের প্রতিধ্বনিকে যে ভাষায় ধরবার চেষ্টা সে ভাষার উপর প্রকাশিতব্য উদ্দেশ্যের প্রভাবকে শনাক্ত করাই অনুবাদকের দায়িত্ব। Étienne Dolet ১৫৪০ সালে তার La Manière de Bien Traduire d’une Langue en Aultre এ অনুবাদকের তিনটি অবশ্যম্ভাবী বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেন যা আজও প্রাসঙ্গিক – comprehend perfectly the source language বা উৎসভাষা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা, comprehend perfectly the target language বা অনূদিত ভাষা সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং knowledgeable in the subject matter বা বিষয় সম্পর্কে অনুবাদকের জ্ঞান থাকা। জন ড্রাইডেনের অনুবাদ তত্ত্বটি খুব বিখ্যাত – তিনি অনুবাদকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন metaphrase বা আক্ষরিক অনুবাদ, paraphrase বা ভাবানুবাদ, এবং imitation বা অনুকরণ। রোমান জ্যাকবসন তার অন লিঙ্গুয়িস্টিক আসপেক্টস অব ট্রানস্লেশন প্রবন্ধে অনুবাদকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন: intralingual অর্থাৎ একই ভাষার ভেতর নতুন শব্দ বা প্যারাফ্রেজ, interlingual বা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ এবং intersemiotic চিহ্ন বা সংকেত অন্য চিহ্ন বা সংকেতে প্রকাশ। আবার André Alphons Lefebvre অনুবাদকে ৭টি ধারায় বিভক্ত করেছেন Phonemic বা ধ্বনিসাম্যমূলক, Literal বা আক্ষরিক, Metrical বা ছান্দসিক, Prose বা গদ্য অনুবাদ, Rhymed বা মিত্রাক্ষর অনুবাদ, Blank Verse বা মুক্ত ছন্দ অনুবাদ এবং Interpretation বা ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ। ইউজিন এ নিডা সাহিত্যের অনুবাদে লক্ষ্য ভাষার প্রকৃতির অনুসন্ধান, অভীষ্ট লক্ষ্য ঠিক করা এবং অনূদিত ভাষার পাঠকদের অনুধাবন ক্ষমতার বিষয়টি অনুবাদের সময় একজন অনুবাদকের মাথায় রাখার কথা বলেছেন।


আমাদের দেশে ভাষার লিখিত রূপের প্রাচীনতম নিদর্শন প্রতিলিপি ও ভূমিদানপত্রে পাওয়া যায়। যেমন বগুড়ায় প্রাপ্য শিলাচক্রলিপি প্রাকৃত ভাষায় লেখা। আর গুপ্তযুগের আটদশখানা ভূমিদানপত্র (তাম্রশাসন) পাওয়া গেছে। বঙ্গ শব্দজাত বঙ্গাল শব্দটির উপস্থিতি টের পাওয়া যায় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী হতে। ভারতীয় পর্তুগিজরা বেঙ্গালা (Bengala) আর ইংরেজরা বলেছে বাঙালী ভাষা। অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে বাংলা নামে কোন ভাষা ছিল না। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, মূলত দুটো ভাষার নাম জানতো শিক্ষিত সমাজ – পান্ডিত্যের ভাষা সংস্কৃত আর অন্যটি হলো দেশি লৌকিক বা প্রাকৃত ভাষা। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একে বলা হতো গৌড়ীয় ভাষা। তাই আমরা রামমোহন রায়ের ব্যাকরণের নাম দেখি গৌড়ীয় বাংলা ব্যাকরণ।
প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগের আগ পর্যন্ত লিখিত বাংলা সাহিত্যে যেসব নিদর্শন পাওয়া যায় তার অধিকাংশ ধর্মীয় বিষয়বস্তু। আর এইসব ধর্মীয় বিষয়াবলী তুলে ধরতে গিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন কখনো কখনো। এ কথা বলা যেতে পারে যে, ধর্মীয় বিষয় আশ্রয় করে বেশিরভাগ রচনা হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়। এখানে উল্লেখ্য, সংস্কৃত ভাষার কাব্যনাটকের চর্চা ছিল মূলত রাজসভায় এবং রাজা ও সামন্ত শ্রেণির জন্য। সংস্কৃত ভাষার লিখিত কাব্য এবং নাটকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপযোগীতা এবং অভিগম্যতাও ছিল না। অনেক বাঙালি পণ্ডিতও সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেছেন ধর্মতত্ত্বের পুস্তক। বৌদ্ধ ধর্মের আগমনের পর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সংস্কৃতের চেয়ে প্রাকৃত বা সাধারণ মানুষের মৌখিক ভাষায় তাদের ধর্মতত্ত্ব লেখা ও প্রচারের চেষ্টা করেছেন। ফলে চর্যাপদের ভাষা হয়ে উঠেছে প্রাকৃত বা বাংলা। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য বাংলা ভাষাকেন্দ্রীক সাহিত্য রচিত হয় তা মূলত রাজন্যবর্গ বা এদেশে সংস্কৃতের প-িতদের হাতে নয় বরং তা সাধারণ মানুষের হাতেই রচিত হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মাঝেই তার চর্চা হয়েছে ব্যাপকভাবে।
ভারতবর্ষে মুসলমান শাসকদের আগমনের ফলে ধীরে ধীরে রাজভাষা হিসেবে ফার্সি ভাষা স্থান করে নেয় এবং তা অব্যাহত ছিল ইংরেজ শাসন পাকাপোক্ত করার আগ পর্যন্ত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ‘ইংরেজি শিক্ষা আইন ১৮৩৫ প্রবর্তন এর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৩৫ বছর উপমহাদেশের রাজভাষা ছিল ফারসি। ফলে ওই দীর্ঘ সময় ধরে দলিল-দস্তাবেজ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলীর একটা বড় অংশ লেখা হয়েছিল ফারসি ভাষায়। আর সেকারণেই রাজা রামমোহন রায়কেও পুস্তক লিখতে হয়েছিল ফার্সিতে। আর ইংরেজ আগমনে ফারসি জায়গা দখল করে নেয় ইংরেজি। রাজভাষা হয়ে পড়ে ইংরেজি। ভাষার রাজনীতিতে আবার ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় ভাষাগুলো মার খায় আধিপত্যবাদী ইংরেজি ভাষার কাছে। ব্রিটিশ আমলে বাংলায় শিক্ষার শুরুটা ছিল অনুবাদের হাত ধরে। উপনিবেশকালের অনুবাদ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই অর্থেই বাংলা ও উপনিবেশের প্রয়োজনে শাসিত জাতিগঠনে অলক্ষ্যে এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখলের পর ভাষা ও শিক্ষাকে ইউরোসেন্ট্রিক করার উদ্যোগ নেয়। যার অন্যতম একটি বিষয় হল, ইংরেজিকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ। উপনিবেশ স্থাপনের সাথে রাজনৈতিক অর্থনীতির পাশাপাশি ভাষা ও সাহিত্যের রাজনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলা ও অন্যান্য ভার্নাকুলার ভাষাকে পরাস্ত করে উপনিবেশিকের ভাষা ইংরেজিকে সেক্ষেত্রে তারা প্রতিস্থাপন করে, চাপিয়ে দেয় এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলা সাহিত্যে ১২০০ থেকে ১৪৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে কেউ কেউ অন্ধকার যুগ বলে থাকেন। কারণ এ কালপর্বে লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কম। বলা হয়ে থাকে এ সময় মুসলমান শাসকদের অত্যাচারে সাহিত্যচর্চা করা সম্ভব হয়নি। সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব চৌধুরী প্রমুখ মুসলমানদের আগমনে বাঙ্গলার সমাজব্যবস্থা ধ্বসে পড়ার কথা বলে এ সময়কালীন সাহিত্য রচনায় বাধা সৃষ্টি হয়েছিল বলে যে যুক্তি তারা দেখিয়েছেন তার বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ তারা দেখাতে পারেননি। ১২০০ সালের আগে যে সাহিত্য নিদর্শন মোটা দাগে আমরা দেখি তা হলো চর্যাপদ তাও তা কালের করালগ্রাস থেকে বিলুপ্তির হাত থেকে একে বাঁচিয়েছে নেপালের রাজদরবার। অথচ আমরা দেখি তথাকথিত এই অন্ধকার যুগেই রচিত হয়েছে গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের আমলে (১৩৮৯-১৪১০) শাহ মুহাম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলেখা, জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহের (১৪১৮-৩১) আমলে কৃত্তিবাসের রামায়ণ আর রুকনউদ্দীন বরবক শাহের আমলে মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য। আর রামাই পণ্ডিতের শুন্যপুরাণ, হলায়ুধ মিশ্রের সেক শুভোদয়া, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যও রচিত হয় এ কালপর্বেই। চট্টগ্রামের আলাউদ্দীন হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৮) আমলে মহাভারত প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর এবং তাকে এ কাজে উৎসাহ যোগান সুলতান হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল শাহ যা পরাগলী মহাভারত নামে পরিচিত। আবার ভাগবতের বারোটি খণ্ড ও ৬২ হাজার শ্লোকের বাংলা অনুবাদ করছেন মালাধর বসু বা গুণরাজ খান। এরও পৃষ্ঠপোষক বাদশাহ রুকনউদ্দিন বরবক শাহ। আবার এই সময়ই অনুবাদ হয়েছে ফেরদৌসির শাহনামার যা অনুবাদ করেন মোজাম্মেল হক। সে কারণেই হয়তো দীনেশ চন্দ্র সেন মনে করেন, “মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ই বঙ্গভাষার সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল”। ক্ষিতিমোহন সেন, যদুনাথ সরকার, স্টুয়ার্ট, মুহাম্মদ এনামুল হক প্রমুখ দীনেশ চন্দ্র সেন যেভাবে মনে করেছেন তেমনটিই তাদের আলোচনায় ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, চর্যাপদ এর মাত্র কিছু পদ ছাড়া প্রাচীন যুগ থেকে ১২০০ সাল অব্দি অন্য কোন লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্বই আপেক্ষিক অর্থে কম। ফলে কোন একটা কালপর্বে লিখিত রূপ কম পাওয়া গেলেই তাকে অন্ধকার যুগ বলে আখ্যা দিতে হবে এটা মারাত্মক দরবারী আধুনিক আগ্রাসী মনোভাবের প্রকাশ। যেকোন ভাষা ও জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের সাথে তার সংস্কৃতি, সাহিত্য ও আচার-আচরণ অবশ্যম্ভাবী হিসেবে চলমান থাকে ফলে সে তার জীবনযাপনের মাধ্যমেই তার সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটায় এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারণ করে ও বিকশিত হয়। অন্ধকার যুগের কথা বলে আমরা যদি মনে করি যে, এই সময়ে এই বঙ্গে কোন সাহিত্যচর্চা বা সংস্কৃতি চর্চা ছিল না – বিষয়টি একেবারেই ঠিক না। বরং সে সময় তখনকার মানুষের প্রয়োজনে এবং তাদের জীবনের অংশ হিসেবে অবশ্যই সাহিত্য ছিল, সংস্কৃতি চর্চা ছিল যার অন্যতম একটি বড় মাধ্যম হয়তোবা লোকায়ত সঙ্গীত কিংবা পালাগান। মূল বিষয় হলো আমরা এতটা সময়পর্বকে যদি অন্ধকার যুগ বলি তাহলে ওই যুগে বসবাসকারী মানুষদেরকে অপমান করা হয় যা আজকের তথাকথিত ‘আধুনিক সমাজের উন্ন্যাসিক মানুষের মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।
দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন, “আমাদের বাঙ্গালা ভাষাকে পূর্বে লেখাপড়া জানা লোকেরা গ্রাহ্য করিতেন না; তারা ছিলেন মস্ত বড় সংস্কৃতের পণ্ডিত, তারা রাজসভায় টীকি নাড়িয়া বড় বড় সংস্কৃত শ্লোক আওড়াইতেন।” এই তার এ বক্তব্যে বোঝা যায় যে, বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য এবং রাজরাজাদের ভূমিকা সব সময় কম ছিল বরং এই দুই গোষ্ঠীর প্রতিরোধই ছিল বেশি। কারণ বাংলা ভাষাকে অত্যন্ত নিচু মানের ভাষা এবং বাংলা ভাষা যে পণ্ডিতদের ভাষা না – সংস্কৃত ভাষাই হচ্ছে সাহিত্যচর্চার একমাত্র ভাষা – এই বিষয়টি রাজন্যবর্গ থেকে শুরু করে পণ্ডিতরা মনে করতেন। এখানে আবার বলি যেটা দীনেশচন্দ্র সেন বলছেন, “বাঙ্গালা ভাষায় তখন কেউ বই লিখিলে রাজসভায় তারা আদর হওয়া দূরের কথা – পণ্ডিতেরা তাহা ঘৃণা করিতেন। বাঙ্গালা ভাষা ছিল তখন ইতরের ভাষা – তাহার স্থান ছিল পাড়াগাঁয়ে ছোটলোকদের মধ্যে এবং মেয়েদের মহলে।” ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভূমিকা অর্থাৎ অন্ত্যজ মানুষের ভূমিকাই বেশি। এখানে পণ্ডিতবর্গের ভূমিকা নাই বললেই চলে বরং বলা যেতে পারে তাদের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক।
বাংলা ভাষার উদ্ভবের প্রথম দিক থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কৃত ছিল রাজদরবারের সাহিত্যের ভাষা অর্থাৎ রাজা-মহারাজারা সংস্কৃত জানতেন এবং তারা মনে করতেন যে, জ্ঞানচর্চা শুধু সংস্কৃতির দ্বারাই সম্ভব অন্য কোন ভাষায় নয়। এর ফলে যেটা হতো প-িতরা শুধু সংস্কৃত ভাষা চর্চা করতেন এবং তারা রাজদরবারে কদর পেতেন। আর এই সময়কালীন আমরা দেখি চর্যাপদ বাদে বাংলা সাহিত্যের উপস্থিতি অনেকদিন ধরে আমরা যাকে অন্ধকার যুগ বলছি সেই সময়টাতে লিখিত রূপের সাহিত্য কম পাওয়ার অন্যতম কারণ বাংলা ভাষা কখনোই রাজদরবারের আনুকূল্য পায়নি, ফলে তা সংরক্ষণও হয়নি। ফলে ওই রাজদরবারের সংরক্ষিত সাহিত্য এবং অন্যান্য পুঁথিতে বাংলা ভাষার উপস্থিতি পাওয়া যায় না বরং বাঙালি অর্থাৎ এই অঞ্চলের প-িত ব্যক্তিরাও প্রায় প্রত্যেকেই সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন যার মধ্যে অন্যতম জয়দেব।
আমরা দেখছি বাংলা ভাষায় যখন সাহিত্য চর্চা শুরু হয় প্রথম দিকে এর সংস্কৃতায়ন হয় যার অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন চন্ডীদাস নিজেই। এই সময়কালীন যত সাহিত্য রচিত হয় তার ভিতরে সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি আমরা বেশি লক্ষ্য করি। এখানে একটি বাংলা অনুবাদের উল্লেখ করছি যাতে বোঝা যাবে যে, দেবনাগরী হরফে লিখলে এটিকে হয়তো আমরা সংস্কৃত ভাষার কোন কবিতা হিসেবেই মনে করতাম। সেটি এরকম:
জয় শিবেশ শঙ্কর, বৃষধ্বজেশ্বর
মৃদঙ্গ শেখর দিগম্বর
জয় শ্মশান নাটক বিষাণ-বাদক
হুতাশ ভালক মহত্তর।

১৩০০ সালের দিকে মুসলমানদের কাছে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ হস্তগত হয়। তারা ইরান তুরান প্রভৃতি বহুদূর থেকে এসেছিল এবং বাংলাদেশে বসবাস করার কারণে এ দেশটি তাদের দেশ হয়ে যায়। তাদের কাছে রামায়ণ, মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় লেখা হওয়ার কারণে অপরিচিত হিসেবে থেকে যায়। এই মুসলিম শাসকরা বাংলা ভাষায় এই সমস্ত শাস্ত্র রচনা দিকে জোর দেয় এবং তারা বোঝার চেষ্টা করে যে, এইসব শাস্ত্রে কি লিখিত হয়েছে। আগে উল্লেখ করা হয়েছে,পণ্ডিতরা দেশি ভাষাকে অপছন্দ করতেন এবং ঘৃণা করতেন। ফলে তারা বাংলা ভাষায় কোনভাবেই প্রথমদিকে অনুবাদ করতে রাজি হননি। কিন্তু মুসলমান শাসকদের চাপে বা পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বাধ্য হয়ে বাংলা ভাষায় রামায়ণ, মহাভারত অনুবাদ করতে শুরু করেন। মুসলমানরা তখন বাংলার শাসনকর্তা ফলে দেখা যাচ্ছে যে, বিদ্যাপতি পর্যন্ত এই সমস্ত মুসলমান শাসকের প্রশংসা করেছেন। মুসলমান শাসকদের পাশাপাশি হিন্দু শাসকরাও বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করা শুরু করে। যেমন দেখা যাচ্ছে যে, মুকুন্দরামকে আশ্রয় দেয় মেদিনীপুরের রাজা বাঁকুড়া রায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেহেতু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বাধ্য হয়ে বাংলায় তাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলি অনুবাদ করেন, তাই অধিকাংশতেই দেখা যায় সংস্কৃত শব্দের অতি ব্যবহার। এও দেখা গেছে যে, যারা বাংলায় লিখেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা সরাসরি লিখেছেন। যেমন ব্রাহ্মণরা লিখেছেন, “যাহারা ১৮ পুরাণ ও রামায়ণের বাঙ্গালা অনুবাদ শ্রবণ করিবেন, তাহারা গোষ্টিশুদ্ধ রৌরব নামক নরকে যাইবেন।”
অপরদিকে যখন মুসলমান শাসক ভারতবর্ষ জয় করে এবং এখানকার শাসকরা হিন্দুদের বদলে মুসলমান শাসক প্রতিস্থাপন হয় তখন থেকে ধীরে ধীরে সংস্কৃতের বিপরীতে ফার্সি শব্দ এবং ফারসি সাহিত্যের চর্চা ও এই দেশে শুরু হয় এবং ওই সময়কালীন এবং তার পরবর্তী কালে যে বাংলা সাহিত্য চর্চা হয় সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ফারসি শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি।
জয়দেবের গীতগোবিন্দ সংস্কৃত ভাষায় রচিত। জয়দেবকে মনে করা হয় বাঙালি। তিনি দ্বাদশ শতাব্দীর কবি ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, জয়দেবের গীতগোবিন্দ সংস্কৃতে লিখিত হলেও এটি এমন সহজ ভাষায় লিখিত হয়েছিল যে সাধারণ বাঙ্গালীদের মধ্যেও জয়দেবের গীতগোবিন্দের অনেকগুলো কবিতা বাঙালীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতেন।
আগেই বলা হয়েছে, বৌদ্ধ-জৈনরা প্রাকৃত ভাষায় ধর্মতত্ত্ব চর্চা করতে পছন্দ করতেন। তাদের হাত ধরেই কথ্যভাষার (অপভ্রংশের) বিকাশ লাভ করে। অষ্টম শতাব্দীর আগ থেকেই অপভ্রংশ ও অবহঠট উত্তরাপথে সংস্কৃতের প্রতিপক্ষ ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশে বৌদ্ধরা কচড়া বই ও ছড়া গান লিখেছেন। চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে অপভ্রংশ- অবহঠটে প্রাকৃত পৈঙ্গল গ্রন্থটি লিখিত হয়। এর কতগুলো কবিতা বাংলাভাষী কবির। যেমন:
সো মোহ কান্তা
দূর দিগন্তা
পাউস আএ
চেলু দুলাএ
(সে মোর কান্ত (এখন) দূর দিগন্তে। বর্ষা আসিতেছে, আঁচল উড়াইব)
বাংলা লিপির উৎস ব্রাহ্মীলিপি। শ্রীরামপুর মিশন স্থাপন হওয়ার আগ পর্যন্ত নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্রাহ্মীলিপির আধুনিক রূপ একটি স্থায়ী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।

‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্যের চর্চা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ। এ রাজসভার কবিরা ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ রোমান্টিক প্রণয়কাব্য রচনা করেন। ফলে মুসলমান কবিদের হাতেই বাংলা সাহিত্যে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য ধারার উদ্ভব বলা যেতে পারে। অনেক মৌলিক কাব্যের পাশাপাশি এসব কবি নানা কাব্য বাংলায় অনুবাদ করেন। হিন্দি কবি সাধনের মৈনাসাত অবলম্বনে দৌলত কাজী (আনু ১৬০০-১৬৩৮) রচনা করেন সতি ময়না ও লোর চন্দ্রানী যার শেষাংশ সমাপ্ত করেন আলাওল। আলাওল (আনু ১৫৯৭-১৬৭৩) মৌলিক রচনার সাথে সাথে অনেকগুলো কাব্যের অনুবাদ করেন। তার মালিক মুহাম্মদ জায়সীর পদুমাবত এর অনুবাদ পদ্মাবতী, ফারসি কবি নিজামী গঞ্জভীর হপ্তপয়কর ও সেকান্দর নামার অনুবাদ যথাক্রমে সপ্তপয়কর ও সেকেন্দরনামা, শেখ ইউসুফ গদা দেহলবীর তোহফাতুন নেসায়েহ এর অনুবাদ তোহফা। আব্দুল করীম খোন্দকার ফারসি গ্রন্থের ভাবানুবাদ করেন দুল্লা মজলিস নামে।
দৌলত উজির বাহরাম খান ফারসি কবি জামীর কাব্য অবলম্বনে রচনা করেন লায়লী-মজনু (রচনাকাল আনু ১৫৪৩-৫৩ এর মধ্যে)। গরীবউল্লাহ ফারসি থেকে অনুবাদ করেন জঙ্গনামা। ফারসি হাতেম তাই অনুবাদ করেন সাদতুল্লাহ, সৈয়দ হামজা। হায়াৎ মামুদ সর্বভেদবাণী (১৭৩২) নামে হিতোপদেশের যে অনুবাদ করেছিলেন তা ফারসি গ্রন্থ অবলম্বনে সংস্কৃত থেকে নেয়া নয়। এছাড়া তিনি জঙ্গনামা (১৭৩২), হিতজ্ঞানবাণী ও আম্বিয়া বাণী (১৭৫৭) রচনা করেন। হিন্দুদের মহাভারতে যুদ্ধের কাহিনীতে যে শৌর্যবীর্যের দেখা পাওয়া যায় তেমনি মুসলমান কবিরা কারবালার ঘটনা নিয়ে লেখেন জঙ্গনামা যেখানে তাদের শক্তির প্রকাশ ঘটেছে যার লেখক হায়াৎ মামুদ, নসরুল্লাহ, গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা প্রভৃতি। ইউসুফ জুলেখার কাহিনী নিয়ে গরীবুল্লাহ লেখেন ইউসুফ জুলেখা। জৈনুদ্দীন, শেখ চান্দ, সাবিরিদ খান প্রমুখ মোহাম্মদের জীবনী কাব্য রসুলবিজয় লেখেন। শেখ চান্দের রসুলবিজয় কাসাস-উল-আম্বিয়ার ফারসি অনুবাদ। ঢাকার মুন্সি মুহাম্মদ মিরনের বাহার দানেশ মৌলবী এনায়েতুল্লাহর ফারসি রচনা অবলম্বনে লেখা। শাকের মামুদ, সেরাদোতুল্লাহ, ফকির মোহাম্মদ, আবদুল রহমান, মোহাম্মদ এবাদত খাঁ, বক্তিয়ার খাঁ, আব্দুল মজিদ, শাহ বদিউদ্দীন প্রমুখ কবিগণ ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেন যার অধিকাংশই আরবী-ফারসি গ্রন্থের অনুবাদ বা ভাবানুবাদ এবং তার পাঠক অবশ্যই ছিল মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাই।
পশ্চিমবঙ্গে লেখা প্রথম মহাভারত কাহিনী রামচন্দ্র খানের অশ্বমেধপর্ব ও জৈমিনীয় সংহিতার মর্মানুবাদ যা ১৫৩২-৩৩ সালের দিকে রচিত হয়। কামতা কামরূপের রাজা বিশ্বসিংয়ের (১৫২২-৫৪) আমলে পীতাম্বর নারায়ণ ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণ অবলম্বনে ঊষা-অনিরুদ্ধের কাহিনী এবং মহাভারত অবলম্বনে নল-দন্তময়ী উপাখ্যান রচনা করেন যার মূল উৎস সংস্কৃত। শংকরদেব (মৃত্যু ১৫৬৮) রামায়ণ উত্তরকা- এবং ৬-৭ স্কন্ধ ভাগবত-পুরাণ অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়া তিনি গরুড়-পুরাণের কৃষ্ণার্জুন অবলম্বনে ভক্তিপ্রদীপ রচনা করেন। শংকরদেবের সরাসরি শিষ্য মহাদেব পুরুষোত্তম দেবের নাম মালিকা (১৫৯৬-৯৭) অনুবাদ করেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের (মৃত্যু ১৫৮২) চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে নানা ধরনের সংস্কৃত উদ্ধৃতি রয়েছে যার অর্ধেকের মতো ভাগবত থেকে আর অন্যান্য মধ্যে রয়েছে গীতা, কৃষ্ণকর্ণামৃত, ব্রহ্মসংগীত, গীতগোবিন্দ, রামায়ণ, মহাভারত, পাণিনিসূত্র প্রভৃতি। এখানে উল্লেখ্য গ্রন্থটিতে কখনো কখনো হিন্দি ফার্সী শব্দের ব্যবহার রয়েছে। ১৫৬০ অব্দে প্রিয় দাসের লেখা ভক্তিমালের অনুবাদ ভক্তমাল এবং জগন্নাথ দাস ভক্তচরিতামৃত নামে অনুবাদ করেন। রামায়ণের প্রথম নারী অনুবাদক চন্দ্রাবতী (জন্ম ১৫৫০)।
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে মুসলমান শাসনের ফলে ব্রজভাষা শিক্ষিত বাঙালির কাছে পরিচিত ছিল। ফারসি শাসকদের ভাষা হওয়ায় অনেকে ফারসি শিখতে শুরু করে এবং আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় অবাধে প্রবেশ করতে থাকে। আর ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে। পর্তুগিজ পাদ্রীদের ধর্মগ্রন্থ অনুবাদের সূত্রে বেশকিছু পর্তুগিজ শব্দ ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় স্থান করে নেয়।

ইংরেজদের শাসন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে মূলত সংস্কৃত এবং ফার্সি ভাষার সাংঘাতিক রকম নিপীড়নের শিকার হয়েই এগুতে হয়েছে। এর কারণ আগেই বলা হয়েছে, বাংলা ভাষা কখনোই রাজভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, দরবারের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। বাঙালী চিরকাল বিদেশী ও বিজাতি শাসিত। সাত শতকের শশাঙ্ক নরেন্দ্র-গুপ্ত এবং পনেরো শতকের যদু-জালালুদ্দিন ছাড়া বাংলার কোন শাসকই বাঙালী ছিলেন না। আহমেদ শরীফ মনে করেন, ‘জৈন-বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে বাঙালীরা উত্তর ভারতের আর্য ভাষা, লিপি সংস্কৃতি সমাজ ও নীতি বরণ করে সভ্য হয়ে উঠে।’যখন ইংরেজি সাহিত্য চর্চা শুরু হয় অর্থাৎ ইংরেজি যখন আমাদের দেশে শাসন এবং উপনিবেশিক শাসন নিয়ে গেড়ে বসে সে সময় থেকেই ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা শুরু হয় অর্থাৎ ইউরোপীয় ভাষার ব্যবহার বাংলাদেশের মানুষের সামনে চলে আসে। ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সত্যিকার অর্থে প্রথম এবং ব্যাপকভাবে ইউরোপীয় সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের সাথে মিশ্রণের সুযোগ পায়। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য শ্রীরামপুর প্রেস এর মাধ্যমে বা শ্রীরামপুর গোষ্ঠীর মাধ্যমে পর্তুগীজদের এখানে একটা বড় ভূমিকা ছিল। ফলে বাংলা ভাষার চর্চা অন্ত্যজ শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষের যে দৈনন্দিন জীবনে সংস্কৃতির ভাষার ব্যবহার এবং তাদের দৈনন্দিন সাহিত্য সেটাই আসলে বাংলা ভাষার প্রাণ। এখানে একটি গর্বের বিষয় হলো যে বাংলা ভাষা এমন একটি ভাষা বাংলা সাহিত্যে এমন একটি সাহিত্য আসলে বাংলাদেশের বা এলাকার মানুষের অন্ত্যজ মানুষ আমরা তাদেরকে বলি সেই মানুষের সাহিত্য এবং এই সাহিত্যের বিকাশ হয়েছে এই অন্ত্যজ মানুষদের হাত ধরে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে গীতগোবিন্দ বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়নি। রামানন্দ রায়ের জগন্নাথবল্লভ নাটক ষোড়শ শতাব্দীতে পদকর্তা লোচন দাস অনুবাদ করেন আর সপ্তদশ শতাব্দীতে আকিঞ্চন দাস। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতে বিল্বমঙ্গল রচিত কর্ণামৃত (কৃষ্ণকর্ণামৃত) কাব্যের অনেকগুলো শ্লোকের ভাবানুবাদ করেছিলেন। আর কাব্যটির মূল ও টীকায় কাব্য আকারে অনুবাদ করেছিলেন যদু নন্দন দাস। কাব্যটির নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণকর্ণামৃত। তার অন্যান্য গ্রন্থ হল রূপ গোস্বামীর বিদগ্ধমাধব নাটক অবলম্বনে দানলীলা-চন্দ্রামৃত এবং দানকেলিকৌমুদী ভাণিকা অবলম্বনে দানলীলাচন্দ্রামৃত এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের গোবিন্দলীলামৃত। ভগবতের দশটি শ্লোক অবলম্বনে ভ্রমরগীতার একাধিক অনুবাদক যেমন যদুনাথ দাস, রূপনাথ দাস এবং দেবনাথ দাস। রূপনাথ দাস এবং দেবনাথ দাস অষ্টাদশ শতাব্দীর। রূপের হংসদূতের অনুবাদক নরসিংহ দাস এবং নরোত্তম দাস।
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সিদ্ধান্ত সরস্বতী নারদীয় পুরাণ অনুবাদ করেন। বৈষ্ণব সাহিত্য মুকুন্দ দেবের ভৃঙ্গরতবলী প্রেম দাস আর অমৃতরসাবলী অনুবাদ করেছিলেন মথুরা দাস। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকের কবি কাশীরাম দাস মহাভারত কাহিনী অবলম্বনে ভারত পাঞ্জালী সংহিতা রচনা করেন। কাশীদাসী সংহিতার আরম্ভ সপ্তদশ শতাব্দীতে এবং পরিণতি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে। বেশ কয়েকজন লেখকের রচনা মিলে সংহিতার আদিপর্ব শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে ছাপা হয় ১৮০৩ সালে চার খণ্ডে। এছাড়া নিত্যানন্দ ঘোষও মহাভারতের অনুবাদ করেন যা আকারে ছোট। চাণক্য শ্লোকের অনুবাদও এ সময় পাওয়া গেছে। বিষ্ণুরাম সিদ্ধান্তের দুর্গাসপ্তসতীর অনুবাদ (১৭৭৩ অব্দ)। বিদ্যাপতি গোরক্ষবিজয় নাটকটি সংস্কৃত, প্রাকৃত মৈথিল ও বাংলা ভাষায় পাওয়া যায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুরাণের অনেক বাংলা অনুবাদ হয়। যেমন দ্বিজ বৈদ্যনাথ ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, শিবপুরাণ, রিপুঞ্জয় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, পদ্মপুরাণ, দ্বিজ রামানন্দ ধর্মপুরাণ, নৃসিংহপুরাণ, বলরাম কুন্ডু পদ্মপুরাণ, পরমানন্দ শর্মা স্কন্দপুরাণ, হরেন্দ্রনারায়ণ স্কন্দপুরাণ, পদ্মপুরাণ এবং মহিনাথ শর্মা মার্কেণ্ডেয় পুরাণ অনুবাদ করেন। এ ধরনের শতাধিক গ্রন্থ বিভিন্ন কবি পুরাণের অংশবিশেষ নিয়ে রচনা করেন। আবার এই শতাব্দীতে গীতগোবিন্দের অনুবাদ করেন গিরিধর দাস, রসময়য় দাস ও দ্বিজ প্রাণ কৃষ্ণ। রূপগোস্বামীর ললিতমাধবের অনুবাদ করেন স্বরূপচরণ গোস্বামী প্রেমকদম্ব নামে যার রচনাকাল ১৭৮৭-৮৮। তার পূর্বে যদুনন্দন রসকদম্ব নামে বিদগ্ধ মাধব নাটক অনুবাদ করেছিলেন। পরান দাস এবং গোপাল দাস রামানন্দ রায়ের জগন্নাথবল্লভ নাটক অনুবাদ করেন। কবিকর্ণপুরের চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকের অনুবাদ করেন প্রেমদাস সিদ্ধান্তবাগীশ (চৈতন্যচন্দ্রোদয় কৌমুদী নামে, ১৭১২ অব্দে)। রঘুনাথ গোস্বামীর বিলাপকুসুমাঞ্জলির অনুবাদ করেন রাধাবল্লভ দাস। বৈষ্ণব সাহিত্যের অনুবাদও দেখা যাচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আরো অনেক কবি করেছেন। কোনো কোনোটার কবির নাম পাওয়া যায়নি তবে কাব্য পাওয়া গেছে।
এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে, অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীর সন্ধিদশকগুলো বাংলা সাহিত্যের রচনাগুলো দু’ভাগ হয়ে যায়। একদিকে আগের পুঁথিতে লেখা ও প্রচারিত, অন্যদিকে ছাপার অক্ষরে প্রকাশের উদ্দেশ্যে সাহিত্যচর্চা। বলাবাহুল্য যত সময় গিয়েছে তত দ্বিতীয় ধারা শক্তিশালী হয়েছে এবং শেষে একসময় প্রথম ধারা বিলুপ্ত হয়েছে। দ্বিজ রামকুমার কর্তৃক ভাগবতের পদ্যানুবাদ শেষ হয় ১৮৩১ সালে। রাজা রামমোহন রায় ভগবদ্গীতার অনুবাদ করেন যা বৈকুণ্ঠনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ১৮১৯-২০ সালের দিকে ছাপা হয়েছিল। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে বাংলা অক্ষরে প্রথম সাহিত্য গ্রন্থ কৃত্তিবাসের রামায়ণ সম্পূর্ণ এবং কাশিরামের মহাভারতের প্রথম পর্ব যা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মদনমোহন তর্কালঙ্কার সুবন্ধু রচিত বাসকদত্তার অনুবাদ করেন ১৮৩৭-৩৮ সালে। কালীপ্রসাদ কবিরাজ বত্রিশ সিংহাসন এবং বেতাল পঞ্চবিংশতি অনুবাদ করেন।
সংস্কৃত সুকসপ্ততি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অনুবাদ করেন নন্দকুমার কবিরত্ন সুকবিলাস নামে। দ্বারকানাথ কুন্ডু ফার্সি থেকে গোলবে-সেনুয়ার এবং ইংরেজী থেকে তুর্কির ইতিহাস লেখেন। গোবর্ধন দাস হাতেম তাই, হরিমোহন কর্মকার ইউসুফ জুলেখা এবং আরব্য উপন্যাস মনোহর উপাখ্যান, মহেন্দ্র মিত্র লাইলী-মজনু রচনা করেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, মুসলিম সাহিত্যিকদের পাশাপাশি হিন্দু সাহিত্যিকরাও ফারসি আরবী সাহিত্য অনুবাদে উৎসাহী হন।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে গদ্য রচনা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় যদিও গদ্য রচনাকে দৃঢ় ভিত্তি পেতে পরবর্তী চার দশক লেগে যায়। এই সময়েও কালীকৃষ্ণ বাহাদুর Gay’s Fable এর অনুবাদ হিত-সংগ্রহ (১৮৩৬) এবং Persian Tales এর গিরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নীলমণি বসাকের অনুবাদ পারস্য ইতিহাস পদ্যে অনূদিত হয়। উল্লেখ্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সাহিত্যে গদ্যের অনুবাদের আরম্ভ হয় ১৮৪০ সালের দিকে। একদিকে মহাভারত-রামায়ণ অন্যদিকে হাতেম তাই, সংস্কৃত, উর্দু, ফার্সি থেকে গদ্যানুবাদ এবং রামায়ণ আদিকা- (১৮৫৪), মসনবি, সেকেন্দারনামা প্রভৃতির পদ্যানুবাদ করান বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ মহাতাপচাঁদ।
উনবিংশ শতাব্দীর আগে বাংলা গদ্যের ব্যবহার কেবল পত্রদলিল এবং শিক্ষার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো। এর আগে মূলত সাহিত্যে কোন গদ্যের ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। পর্তুগিজ পাদরী মানোএল-দা-আসসুম্পসাম সংকলিত ১৭৩৪ সালে লিসবন থেকে প্রকাশিত রোমান হরফে লেখা ক্রেপা অর্থ শাস্ত্রের অর্থভেদ প্রথম ছাপার অক্ষরে বাংলা বই। অষ্টাদশ শতাব্দীর অষ্টম দশকে চার্লস উইলকিন্স বাংলা মুদ্রণ উপযোগী বাংলা হরফ নির্মাণ করেন এবং নাথানিয়েল হ্যালহেড ১৭৭৮ সালে ইংরেজিতে লেখা বাংলা ব্যাকরণ মুদ্রণ করেন বোধপ্রকাশং শব্দশাস্ত্রং)। এই বইয়ে উদাহরণ ছাপতে প্রথম বাংলা হরফ ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর থেকে বাংলায় বাইবেল ছাপা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্লস উইলকিনস বাংলা ছাপার অক্ষর তৈরি করেন এবং তা এন বি হেলহেডের বাংলা ব্যাকরণ এর উদাহরণ ও উদ্ধৃতিতে প্রথম ব্যবহার হয় ১৭৭৮ সালে। আর বাংলা হরফের প্রথম সাহিত্যের বই স্যার উইলিয়াম জোন্স সম্পাদিত কালিদাসের ঋতুসংহার (১৭৯২)। উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪), উইলিয়াম ওয়ার্ড (১৭৬৯-১৮২৩) এবং জোশুয়া মার্শম্যানের সহায়তায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস ১৮০০ সালে স্থাপন করে ঐ বছরেই বাইবেলের মঙ্গলসমাচার মাতিউর প্রকাশ করেন। এদিকে গোলকনাথ শর্মার অনুবাদ বই হিতোপদেশ ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয় শ্রীরামপুর প্রেস থেকেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ব্যবহারের জন্য সংস্কৃত অনুবাদ বত্রিশসিংহাসন (১৮০২), রাজাবলি (১৮০৮) এবং হিতোপদেশ (১৮০৮) মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার সংকলন করেন। একই কলেজের অধ্যক্ষ গিলক্রিস্ট এর তত্ত্বাবধানে The Oriental Fabulist (১৮০৩) বাংলায় অনূদিত হয়। হিন্দি থেকে চণ্ডীচরণ মুনশী তোতা ইতিহাস (১৮০৫) এবং বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষা (১৮১৫) অনুবাদ করেন হরপ্রসাদ রায়। রাজা রামমোহন রায়ের বেদান্তগ্রন্থ এবং বেদান্তসার গ্রন্থ দুটো অনুবাদাত্মক।
অক্ষয় কুমার দত্তের বাহ্য প্রকৃতির সাথে মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে বিচার (১৮৫২-৫৩), চারুপাঠ (১৮৫৮-৫৯), এবং ধর্মনীতি (১৮৫৬), ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদ/ভাবানুবাদ। কালি প্রসাদ ঘোষ বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রথম ইংরেজিতে কবিতা লিখেছেন। ভারতচন্দ্রের কিছু কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। আবার কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজি ভাষায় প্রথম নাটক লেখেন The Persecuted ((১৮৩১)। এছাড়া শশীচন্দ্র দত্ত (১৮২৪-৮৫) Bangaliana এবং Shankar উপন্যাস ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। বিদ্যাসাগরের সহপাঠী মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ (মৃত্যু ১৮৬০) ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেন আরব্য উপন্যাস আরবীয়োপাখ্যান (১৮৫৯) এবং তারাশঙ্কর তর্করত্ন (মৃত্যু ১৮৫৮) বাণভট্টের কাব্যের অনুবাদ কাদম্বরী (১৮৫৪) এবং জনসনের রাগেলাস (১৮৫৭) অনুবাদ করেন।
ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি বেথুনের উদ্যোগে ১৮৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যার বাঙালি সদস্য ছিলেন বিদ্যাসাগর, রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক ইংরেজি পুস্তক বাংলায় অনূদিত হয় যার মধ্যে অন্যতম মধুসূদন বন্দ্যোপাধ্যায়কৃত ক্রীফলের নীতিকথা।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য হিসেবে স্বীকৃত রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যানে (১৮৫৮) শেক্সপিয়ার, মূর, স্কট প্রভৃতি ইংরেজি কবির কবিতার স্পষ্ট লক্ষণ পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি কালিদাসের কুমারসম্ভব এবং সংস্কৃত কবিতার অনুবাদ সংকলন নীতিকুসুমাঞ্জলি অনুবাদ করেন।
বিলেতি আদলে প্রথম বাংলা নাটকের মঞ্চায়ন হয় কলকাতায় ১৭৯৫ সালের ২৭শে নভেম্বর হেরাসিম লেবেদেভের মাধ্যমে। তিনি M Joddrell এর The Disguise বাংলায় অনুবাদ করেন যা মঞ্চে অভিনীত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজি নাটকের মাঝে দু এক অঙ্ক বাংলায় অভিনীত হত।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে গুরুদাস হাজরা ১২৫৫ বঙ্গাব্দে শেক্সপিয়ারের রোমিও এবং জুলিএটের মনোহর উপাখ্যান বের করেন। আর হরচন্দ্র ঘোষ ওই বছরই শেক্সপিয়ারের নাটকের নাট্যানুবাদ ভানুমতী-চিত্তবিলাস নাটক যা Merchant of Venice এর গদ্য ও পদ্যে বঙ্গানুবাদ। আর চারুমুখ-চিত্তহরা নাটক (১৮৬৪) রোমিও জুলিয়েটের দেশি সংস্করণ। ফলে দেখা যাচ্ছে ইংরেজ শাসন বাংলায় স্থায়ী আসন লাভ করার পর যাত্রাপালার জায়গায় ধীরে ধীরে কলকাতা নাগরিক সমাজে ইউরোপীয় ধারার নাট্যচর্চা বাড়তে থাকে। যেমন Rowe এর The Fair Penitent এর অনুবাদ নবকামিনী নাটক (১২৬৩ বঙ্গাব্দ) অনুবাদ করেন শ্যামাচরণ দাস দত্ত। শেক্সপিয়ারের Cymberline অবলম্বনে চন্দ্রকালী ঘোষ কুসুমকুমারী (১৮৬৮) অনুবাদ করেন এবং তা মঞ্চস্থ হয়। রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার সংস্কৃত থেকে বেণীসংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৮৬০) এবং মালতীমাধব (১৮৬৮) অনুবাদ করেন। এই সময়কালীন অসমীয়া নাটকেরও বাংলা অনুবাদ হয়। এই ধারায় সংস্কৃত নাটকেরও অনুবাদ হতে থাকে, যেমন নন্দকুমার রায় অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৮৫৫), কালীপ্রসন্ন সিংহ বিক্রমোর্বশী নাটক (১৮৫৭) অনুবাদ করেন। এছাড়া তিনি ভবভূতির মালতিমাধব ((১৮৫৯), শৌরীন্দ্রনাথ ঠাকুর মালবিকাগ্নিমিত্র (১২৬৩ বঙ্গাব্দ) এবং রামগতি ন্যায়রত্ন চন্দ্রকৌশিক (১৮৬৯) অনুবাদ করেন।


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১) ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তথাকথিত বাংলার রেঁনেশার অন্যতম প্রতীক। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার কারণে তিনি ইংরেজ সরকারের নীতিনির্ধারকদের সাথে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পান। ভার্নাকুলার ভাষাকে প্রমিত করতে যেয়ে তিনি সংস্কৃতায়নের দিকে মনোযোগ দেন। ফলে বাংলা ভাষায় এক ধরনের শৃঙ্খলা আসলেও তা সংস্কৃতমুখী হয়ে পড়ে। যাহোক বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনার চেয়ে অনুবাদই বেশি। ইংরেজদের উপনিবেশ প্রকল্পের বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সমন্বয়ক। যেমন “কালেজ অব ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্রত্য ছাত্রগণের পাঠার্থে, বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তকে নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদর্ষ্য। তৎপরিবর্ত্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্রীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নুতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসী নামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া, এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।” এটি হলো বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতির ভূমিকা ফলে তিনি যে ইংরেজদের আদেশেই পুস্তকটি লিখেছেন তা পরিস্কার। বাংলার ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো ইংরেজ সমাজের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল যা বিদ্যাসাগরের সুচারুরূপে পালন করতে পেরেছেন। তার অনুবাদ গ্রন্থ হিন্দি থেকে বাংলা: বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী), সংস্কৃত থেকে বাংলা : শকুন্তলা (১৮৫৪ ; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম), সীতার বনবাস (১৮৬০ ; ভবভূতির উত্তর রামচরিত ও বাল্মীকি রামায়ণ-এর উত্তরাকাণ্ড), মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ), বামনাখ্যানম (১৮৭৩ ; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)। ইংরেজি থেকে বাংলা : বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮; মার্শম্যানকৃত হিসট্রি অফ বেঙ্গল), জীবনচরিত (১৮৪৯; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ ), নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব-১৮৫১ ; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক), বোধোদয় (১৮৫১; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ), কথামালা (১৮৫৬; ঈশপস ফেবলস), চরিতাবলী (১৮৫৭; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা), ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস)। সম্পাদিত গ্রন্থ: কিরাতারজ্জুনীয়ম (১৮৫৩), সরবদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮), কুমারসম্ভবম (১৮৬২), কাদম্বরী (১৮৬২), বাল্মীকি রামায়ণ (১৮৬২), রঘুবংশম (১৮৫৩), মেঘদূতম (১৮৬৯), উত্তরচরিতম (১৮৭২), অভিজ্ঞানশকুন্তলম (১৮৭১), হর্ষচরিতম (১৮৮৩), পদ্যসংগ্রহ প্রথম ভাগ (১৮৮৮; কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে সংকলিত), পদ্যসংগ্রহ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯০ ; রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল)। বলে রাখি ভ্রান্তিবিলাস তিনি গদ্যে অনুবাদ করেন। তিনি স্থান, পাত্র-পাত্রীর নাম ইংরেজির পরিবর্তে ভারতীয় রাখেন। এখানে খেয়াল করার বিষয় এক্ষেত্রে যে নামগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন তা বাংলা ভাষার চেয়ে বরং সংস্কৃতঘেঁষা বেশি।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী সাহিত্যিক। তিনি একাধারে মহাকাব্য, নাটক, রম্য নাটক, চতুর্দশপদী কবিতা এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের সফল রূপকার। তার মহাকাব্য মেঘনাদবধের কাহিনী তিনি নিয়েছেন রামায়ণ থেকে যা সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এখানে সহজেই অনুমেয় মহাকবি তার এ মৌলিক বা স্বতন্ত্র মহাকাব্যটি রচনায় সংস্কৃত বা অনূদিত বাল্মিকীর রামায়ণের সাহায্য নিয়েছেন। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যের (১৮৬০) আখ্যান তিনি মহাভারতের আদিপর্বের সুন্দর-উপসুন্দর কাহিনী থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। বীরাঙ্গনা কাব্যে পুরাণে বর্ণিত ১১ জন নারীর কাহিনী বর্ণনা করেছেন। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব কাহিনী আরোহণ করতে তাকে সংস্কৃতি ভাষার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এদিকে তার পদ্মাবতী নাটকটি গ্রিক পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে আর কৃষ্ণকুমারী নাটকের উপাদান নিয়েছেন উইলিয়াম টডের রাজস্থান নামক গ্রন্থ থেকে। এছাড়া, তিনি সরাসরি অনুবাদ করেছেন হোমারের কাহিনী হেক্টরবধ। তিনি রত্নাবলী, শর্মিষ্ঠা এবং দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের অনুবাদ করেন ইংরেজ দর্শকদের বোঝানোর জন্য। ফলে দেখা যাচ্ছে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকর্মের সাথে অনুবাদের এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।

বাংলা গদ্যরীতি মোটামুটি একটা প্রতিষ্ঠা লাভ করলে উপন্যাস রচনার বিষয়টি সামনে চলে আসে। উপন্যাস রচনার প্রাথমিক একটি ধারা খ্রিস্টান মিশনারীদের লেখা অনুবাদ ও মৌলিক নীতিকথা। এর মধ্যে প্রথম হানা ক্যাথরিন মুলেনসের ফুলমণি ও করুণার বিবরণ (১৮৫২) এবং Missionary’s Badgerow এর অনুবাদ পাদরী সাহেবের বাজরা। এ ধারার অনূদিত আখ্যায়িকা Lady of the Lake এর অনুবাদ অপূর্ব কারাবাস (১৮৭১), কান্তি চন্দ্র বিদ্যারতেœর শেক্সপিয়ারের টুয়েলভ নাইট অবলম্বনে সুশীলা-চন্দ্রকেতু (১৮৭২), গালিভারস ট্রাভেলস এর উপেন্দ্রনাথ মিত্র কৃত অনুবাদ অপূর্ব দেশভ্রমণ (১৮৭৬), ডন কুইকসোটের বিপিনবিহারী চক্রবর্তী কৃত অদ্ভুত দ্বিগি¦জয় (১৮৮৭), নন্দ লাল দত্ত কৃত ফিল্ডিং এর এমিলিয়ার মন্মথ মনোরমা (১৮৭৭)। এছাড়া রেনল্ডেসের কয়েকটি পুস্তকের অনুবাদ হয় এই সময়ে। এখানে উল্লেখ্য বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে প্রথম ইংরেজি ধাঁচের উপন্যাস লেখেন। কপালকু-লা, দূর্গেশনন্দিনী, বিষবৃক্ষ এগুলি তার প্রমাণ।
১০
কাব্য অনুবাদে মধুসূদন দত্তের প্রভাবে গিরিশচন্দ্র বসু মিল্টনের মহাকাব্যের সাত সর্গ স্বর্গভ্রষ্টকাব্য (১৮৬৯) এবং ইলিয়ডের প্রথম সর্গ (১৮৩৭) অনুবাদ করেন। টেনিসনের ইনমেমোরিয়ামের অনুবাদ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় করেন মিত্র বিলাপ (১৮৬৯) নামে। এছাড়া তিনি মেঘদূত (১৮৮২) অনুবাদ করেন। এ সময় গোল্ড স্মিথ, গ্রে, পার্নেল, স্কট, কুপার, মিল্টনের কবিতা অনূদিত হয়। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শেক্সপিয়ারের টেম্পেস্ট অবলম্বনে নলিনী বসন্ত (১২৭৫ বঙ্গাব্দ) এবং রোমিও জুলিয়েট (১৮৯৫) অনুবাদ করেন।
অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫০-৯৮) পোপের এলোইস টু আবেলার্ড অবলম্বনে মাধবীলতা কাব্য রচনা করেন। রামকৃষ্ণ রায় রামায়ণ (১৮৭৭-৮৫) ও মহাভারত (১৮৬১-৭১) অনুবাদ করেন। এছাড়া তিনি জেমস এর পোয়েমস অব অসিয়ানের অংশত অনুবাদ করেন। হরলাল রায় ভট্ট নারায়ণের বেনিসংহার অবলম্বনে নাটক শত্রুসংহার (১৮৭৪) এবং শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ অবলম্বনে রুদ্র পাল (১৮৭৪) এবং অভিজ্ঞান শকুন্তলা অবলম্বনে কনকপদ্ম (১৮৭৪) রচনা করেন। বিজয় চন্দ্র মজুমদার (১৮৬১-১৯৪২) গীতগোবিন্দ (১৩২৬ বঙ্গাব্দ) অনুবাদ করেন। যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজি থেকে রজতগিরি (১২৮৫ বঙ্গাব্দ) অনুবাদ করেন। তিনি বাংলা ভাষায় ইংরেজি থেকে মার্কাস অরেলিয়াস-এর মেডিটেশনস ও শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার অনুবাদ করেন। মলিয়েরের ল বুর্জোয়া জাঁতিয়ম অবলম্বনে হঠৎ নবাব (১৮৮৪) এবং মারিয়াস ফোর্সে অবলম্বনে দায়ে পড়ে দারগ্রহ (১৩০৯ বঙ্গাব্দ) অনুবাদ করেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে তিনি সতেরটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত নাটক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এর মধ্যে অভিজ্ঞান শকুন্তল (১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ও মালিকাগ্নিমিত্র (১৩০৮ বঙ্গাব্দ ), বিক্রমোর্বশী (১৩০৮ বঙ্গাব্দ), ভবভূতির উত্তরচরিত (১৩০৭ বঙ্গাব্দ), মালতী মাধব (১৩০৭ বঙ্গাব্দ) ও সুদ্রকের মৃচ্চাদিকা প্রভৃতিসহ শ্রীহর্ষ, বিশাখা দত্ত, ভট্ট নারায়ণ কৃষ্ণ মিশ্র এবং কৃষ্ণ কানাইয়ার নাটক অনুবাদের পাশাপাশি তিনি মারাঠা থেকে ঝাঁসির রানী (১৩১০ বঙ্গাব্দ) ও বাল গঙ্গাধর তিলকের গীতারহস্য অনুবাদ করেন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ আধুনিক যুগে বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ। তিনি অনেক মৌলিক নাটক রচনা করেন। এই মৌলিক নাটকের পাশাপাশি তিনি ইংরেজি সাহিত্যের বিভিন্ন বিখ্যাত নাটক অনুবাদ করেন এবং তা মঞ্চস্থ হয়। যেমন ম্যাকবেথ (১৩০৮ বঙ্গাব্দ) এবং রেনল্ডসের ওয়াগনার দা ওয়ারউলফ অবলম্বনে মুকুল মঞ্জুরা এবং মলিয়েরের নাটক লা আমুর মেঁদিসা অবলম্বনে য্যায়সা কা আসসা (১৩১৩ বঙ্গাব্দ) লেখেন। শেক্সপিয়ারের নাটকের আরো কয়েকটি অনুবাদ প্রমথনাথ বসু অমর সিংহ (১৮৭৪, হ্যামলেট), যোগেন্দ্র নারায়ণ দাস ঘোষের অজয় সিংহ-বিলাসবতী (১৮৭৮, রোমিও-জুলিয়েট), তারকনাথ মুখোপাধ্যায় ম্যাকবেথ (১৮৭৫), অজ্ঞাতনামার মদনমঞ্জুরী (১৮৭৬, এ উইন্টার টেলস), প্যারীলাল মুখোপাধ্যায়ের সুর লতা (১৮৭৭, মার্চেন্ট অফ ভেনিস), চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রকৃতি নাটক (১৮৮০-৮৪, টেমপেস্ট) উল্লেখযোগ্য। ফলে দেখা যাচ্ছে, শেক্সপিয়ার কলকাতার রঙ্গমঞ্চে একটি শক্তিশালী আসন করে নিয়েছিলেন।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, এদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ তথা ইংরেজদের শাসন মজবুত হয়েছে, ইংরেজি সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ হয়েছে বা ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা বাংলা ভাষা-ভাষীদের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে এবং তারা পুরোপুরি তাদের উপনিবেশ আমাদের এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। সেই সময়ে ইংরেজি সাহিত্যচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। শ্রীরামপুর প্রেসের দ্বারা কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি এবং মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান অনেক ইংরেজি গদ্য ইতিহাস গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন বা করান যা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। এর সাথে যুক্ত হন এ দেশীয় ইংরেজি জানা রামকমল সেন, রামগোপাল সেন, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, গৌরদাস বসাক প্রমুখ। এরা সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা (১৮৩৮) প্রতিষ্ঠা করেন। এদের দ্বারাই নানাবিধ ইতিহাস, দর্শন এবং জীবনীগ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়। উপন্যাসের সাথে সাথে অ্যাডভেঞ্চার ও ক্রাইম কাহিনী বাংলা ভাষায় ব্যাপকহারে লেখা শুরু হয় এবং তা জনপ্রিয়তা পায়। মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনূদিত হতে থাকে এই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীগুলো। যেমন চণ্ডীচরণ সেন অনুবাদ করেন স্টো-এর টম কাকার কুটীর (প্রথম ভাগ, ১৩৯১ বঙ্গাব্দ) এবং তলস্তয়ের চল্লিশ বৎসর। ফরাসি গোয়েন্দা গল্পকার ভিদক, জ. জবরফ ও রেনল্ডেসের গোয়েন্দা কাহিনী অনূদিত হয় এ সময় কালে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের ধারা ক্ষীণ হতে থাকে এবং এ সময় কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ লেখার দিকে এদেশের সাহিত্যিকরা মনযোগী হয় বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে বাংলা ভাষার ভিত্তিও মজবুত হতে থাকে। অনেকগুলো সংবাদপত্র বাংলা ভাষায় বের হয়। সংবাদপত্র বাংলা লিখিত ভাষাকে প্রাঞ্জল ও গতিশীল হতে ভূমিকা রাখে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র হলো দিগদর্শন (১৮১৮), সমাচার দর্পন (১৮২০), বাহ্মণ সেবধি (১৮২১), সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১), রঙ্গপুর বাত্তাবহ (১৮৪৭), গ্রামবার্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩)।
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় গল্প ইংরেজিতে স্টোরিজ অফ বেঙ্গলি লাইফ প্রকাশিত হয় যার অনুবাদক ছিলেন গল্পকার নিজে এবং এমএস নাইট। বিজয় কৃষ্ণ ঘোষ (১৮৮৭-১৯৬১) ওমর খৈয়ামের রোবায়েৎ এবং আর্নল্ডের কবিতার অনুবাদ করেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তীর্থ সলিল (১৯০৮), তীর্থ রেণু (১৯১০) এবং মণিমঞ্জুষা (১৯১৫) নামে তিনটি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশ করেন যেখানে অন্তত সাড়ে পাঁচ শত কবিতার অনুবাদ রয়েছে। এখানে বিশ্বসাহিত্যের নানা ভাষার কবিতা অনুবাদ হয়েছে যদিও কবিতাগুলোর অনুবাদ তিনি বেশিরভাগ ইংরেজি থেকে করেছেন। এ ছাড়া তিনি স্টিফেন ফিলিপস, এস্কিলাস, মেটারলিঙ্ক এবং চীনা ও জাপানি নাটকের অনুবাদ করেন যার চারটি রঙ্গমল্লীতে (১৯১৩) স্থান পেয়েছে। তিনি নরওয়ের লেখক ঔড়হধং খরব এর লেখা লিভসস্লাভেন উপন্যাস ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেন জনমদুঃখী (১৯১২) নামে।
ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯২৯)। তিনি ওলান্দাজ হতে অনুবাদ করেন ভাগ্যচক্র। এছাড়া মনিলাল জাপানি গল্প জাপানি ফানুস (১৯০৯) ও কল্পকথা (১৯০৯) অনুবাদ করেন। অন্য সদস্য শচীন্দ্রনাথ বাগচী ফরাসি থেকে অনুবাদ করেন ফরাসি গল্প (১১৫)। আবার শৌরীন্দ্রমোহন মলিয়েরের নাটক যৎকিঞ্চিত (১৯০৮), তলস্তয়ের মৃত্যু-লোচন এবং মেটারলিঙ্কের রূপসীর নাট্যরূপ দেন। তার অনূদিত উপন্যাস বন্দী (১৯১১, হুগো), মাতৃঋণ (দোদে), অবন্ধনা ও নতুন আলো (গোর্কী), অসাধারণ (তুর্গেনেভ), জনৈকা (মপাশা)। অন্যদিকে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জার্মান লেখক হাউফের গল্প অবলম্বনে লেখেন আগুনের ফুলকি (১৩২১ বঙ্গাব্দ)। তিনি বিদেশী গল্প অবলম্বনে উপন্যাস লেখেন যার মধ্যে যমুনা পুলিনের ভিখারিনী (১৩৩০ বঙ্গাব্দ), চোরকাঁটা (১৩২৬ বঙ্গাব্দ), সর্বনাশের নেশা (১৯২৩), ব্যবধান (১৯৩৬) ইত্যাদি। এছাড়া তিনি হর্থনের স্কারলেট লেটার এর অনুবাদ পঞ্চতিলক (১৯১৯) নামে অনুবাদ করেন। হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩) ওমর খৈয়ামের কবিতা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আবার দেখা যাচ্ছে কয়েকটি ভারতীয় বই ইংরেজি ভাষায় রচিত হয়েছে যেমন রেভারেন্ড লালবিহারী দে এর Folk Tales of Bengal (১৮৮৩) লন্ডন থেকে প্রকাশিত এবং Govinda Samanta (১৮৭২) পরে Bengal Peasant Life (১৮৭৮) নামে প্রকাশিত হয়। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী শোভনা দেবীর গ্রন্থ The Orient Pearls (১৯০৫) ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। সুধীন্দ্রনাথ ঘোষ ইংরেজিতে উপন্যাস লেখেন যার মধ্যে অন্যতম হলো And Gazelles Leaping (১৯৪৯), Cradle of the Clouds (১৯৫১), The Vermilion Boat (১৯৫৩) এবং Flame of the Forest (১৯৫৫)।
শরৎচন্দ্র বলয়ের ভাগলপুর দলের অন্যতম হলেন ইন্দিরা দেবী (১৮৮৯-১৯২২)। তিনি কোনান ডয়েলের দ্য মিস্ট্রি অফ ক্লুম্বার অবলম্বনে তার প্রথম উপন্যাস সৌধ-রহস্য রচনা করেন। শান্তা দেবী ও সীতাদেবী দুই বোন মিলে শ্রীশচন্দ্র বসুর Tales of Hindoostan এর অনুবাদ হিন্দুস্তানি উপকথা (১৯১২) প্রকাশ করেন। সবুজপত্রের অন্যতম ব্যক্তিত্ব প্রমথ চৌধুরী বা বীরবল ফরাসি গল্পের অনুবাদ ফুলদানি, ইতালি থেকে অনুবাদ সিদ্ধ বোতলের কথোপকথন প্রবন্ধ সবুজপত্র প্রকাশ করেন। কল্লোল ও প্রগতি পত্রিকার যুগে মোহিতলাল মজুমদার একজন শক্তিশালী কবি তিনি মৌলিক কবিতার পাশাপাশি কিছু বিদেশী কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থ হেমন্ত গোধূলি (১৯৪০) কাব্যের একটি অংশ হলো অনুবাদ কবিতা।
গিরিশ চন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) প্রথম বাংলা ভাষায় পুর্ণাঙ্গ কুরআন (১৮৮০-৮৬) অনুবাদ করেন। এখানে দেখা যাচ্ছে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, বাইবেল বাংলা ভাষায় অনূদিত হলেও কোরানের অনুবাদ হয়েছে অনেক পরে। তিনি শেষ ফরীদুদ্দীন আত্তারের ফারসি ভাষায় রচিত তায্কেরাতুল আওলিয়ার ভাবাদর্শে তাপসমালা (১৮৮০-৯৫), হাদিস-পূর্ব বিভাগ (১৮৯২) শিরোনামে মিশ্কাত শরীফের প্রায় অর্ধাংশ অনুবাদ করেন। তার তত্ত্বরতœমালা (১৯০৭) শেখ ফরীদুদ্দীন আত্তারের মানতেকুত্তায়েব ও মওলানা জালালউদ্দীন রুমীর মসনবী শরীফ নামক ফারসি গ্রন্থদ্বয় থেকে সংকলিত। এ ছাড়া তিনি মূল ফারসি থেকে গুলিস্তাঁ ও বুস্তার হিতোপাখ্যানমালা, হাদিস বা মেসকাত্ মসাবিহ (১৮৯২-৯৮), দীউয়ান-ই-হাফিজ প্রভৃতি। তিনি রামমোহন রায়ের তুহ্ফাৎ-উল-মুয়াহ্হিদীনের (১৮৭৮) বঙ্গানুবাদ করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম দিওয়ান-ই-হাফিজ, রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম, কাব্যে আমপারা এর অনুবাদ করেন। এখানে উল্লেখ্য আধুনিক কালে অবাঙালি আবু সয়ীদ আইয়ুব মীরের গজল থেকে এবং গালিবের গজল থেকে নামক দুটি অনবদ্য কাব্য বাংলা অনুবাদ করেন। সুরেশ্বর শর্মা শেলী সংগ্রহ (১৯৩৯), ব্রাউনিং এর পঞ্চাশিকা (১৯৩৯) অনুবাদ করেন। কান্তি চন্দ্র ঘোষ (১৮৮৬-১৯৪৮) ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদ থেকে ওমর খৈয়াম কবিতা অনুবাদ করেন। আবার নরেন্দ্রনাথ দেব (১৮৮৯-১৯৭১) মেঘদূত এবং ওমর খৈয়ামের কবিতা অনুবাদ করেন যা সমাদৃত হয়েছিল।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) টি এস এলিয়ট, হানস্ এগন হোল্টহুজেন, জন ম্যাসফিল্ড, ডি এইচ লরেন্স, হেনরিক হাইনে, গ্যাটে, পল ভেলোরি, শেক্সপিয়ার এবং মালার্মের কবিতার বাংলায় অনুবাদ করেছেন যা তার প্রতিধ্বনি কাব্যে সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৮) কালিদাসের মেঘদূত, ফরাসি কবি বোদলেয়ার, রুশ কবি বরিস পাস্তরনাক, জর্মন কবি হোলডারলিন এবং রাইনে মারিয়া রিলকে, চীনা কবি লি পো, হান ইউ, পো চু-ই, এবং য়ুয়ান চন এবং মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড, ওয়ালেস স্টিফেন্স, ই ই কামিংস, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস্ প্রভৃতি কবিদের কবিতা অনুবাদ করে বিশ্বসাহিত্যের সাথে বিশেষ করে আধুনিক ইউরোপীয় ও আমেরিকান কবিদের সাথে বাঙালী পাঠকের পরিচয় ঘটান।
রুশ বিপ্লব এবং চিনা বিপ্লবের ফলে ওইসব দেশের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে বা বাংলা ভাষায় অনুবাদের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো হলো চিনা এবং রুশ ভাষা থেকে শুরু করে কোরিয়ান ভাষায়ও আমরা কিছু সাহিত্যের অনুবাদ পাই। রাশিয়ার ক্লাসিক সাহিত্য যেমন তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি, পুনরুজ্জীবন, আনা কারেনিনা, দস্তয়েভস্কির ইডিয়ট, বঞ্চিত লাঞ্ছিত, ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট, কাজারভ ভাইয়েরা, চেখভের গল্প, মায়াকাভস্কির কবিতা, নিকলাই গোগল, তুর্গেনেভ প্রভৃতির সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ হয়। ওদিকে চীনের প্রাচীন সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, লু সুনের সাহিত্য, চিনা লোককাহিনী বাংলায় অনূদিত হয়। অপরদিকে কিছু স্প্যানিশ সাহিত্যের অনুবাদ আমরা পরবর্তী কালে পাই। যেমন মার্কেজের গল্প সংগ্রহ ও হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউট এর শতবর্ষের নীরবতা নামে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।
অনুবাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সেবা প্রকাশনী। উঠতি বয়সী যুব পাঠকদের কথা মাথায় রেখে ফরাসি, ইংরেজি এবং স্প্যানিশ সাহিত্যের বিখ্যাত বই অতি সহজ বাংলায় সাধারণীকরণের মাধ্যমে অনুবাদের কাজটি করে এই প্রকাশনী। ফলে বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকের কাছে সাধারণ অর্থে পরিচিতি পায়। সেবা প্রকাশনীর কিশোর ক্লাসিক বাংলাদেশে অনুবাদের একটি নতুন ক্ষেত্র। এই প্রকাশনীর মাধ্যমে শেক্সপিয়ার, আলেকজান্দার দ্যুমা, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, চার্লস ডিকেন্স, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, এরিক মারিয়া রেমার্ক, হোমার, হার্ডিং, ব্রুন্টি, মার্ক টোয়েন প্রভৃতি সাহিত্যিকের বই বাংলায় সহজ ভাষায় রূপান্তরিত হয় ফলে আমরা দেখি ওয়েদারিং হাইটস, ইলিয়াড, ওডিসি, ডন কুইক্সোট, ডি আর্বারভিল, গ্রেট এক্সপেকটেশন, ডেভিড কপারফিল্ড প্রভৃতি নাটক, উপন্যাস, মহাকাব্য বাংলায় পড়ার সুযোগ তৈরি হয়। এই সমস্ত ক্লাসিকের অনুবাদকদের মধ্যে অন্যতম কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী শাহ নূর হোসেন, শেখ আবদুল হাকিম, সায়েম সোলায়মান চৌধুরী, নিয়াজ মোর্শেদ প্রমূখ।

১১
আধুনিক যুগে এসে বাংলাদেশে আরব্য রজনী, রুমির শাহনামা প্রভৃতি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। শাহনামা বিশাল গ্রন্থটি অনুবাদ করেন মনিরউদ্দীন ইউসুফ (১৯১৯-৮৭)। তার অন্যান্য অনুবাদ হলো ইকবালের কাব্য সঞ্চয়ন, দীওয়ান-ই-গালিব, কালামে রাগিব, রুমীর মসনবী। প্রথমদিককার গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ হলো ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯৭০) অনুবাদ করেন রণেশ দাশগুপ্ত। অতিসম্প্রতি মির্জা গালিব, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আহমেদ ফারাজ, সারমাদ শাহীদ, মনসুর হাল্লাজ, আহমেদ ইলিয়াস, রুমির কবিতা উর্দু- ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ (১৮৬৯-১৯৬৮) উম্মুল কেতাব, আমপারার তাফসীর এবং কুরআনের বঙ্গানুবাদ তাফসিরুল কোরআন প্রভৃতি অনুবাদ করেন। এস ওয়াজেদ আলী (১৮৬৯-১৯৬৮) গুলদাস্তা লেখেন। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বেশকিছু অনুবাদ করেন যার মধ্যে অন্যতম দিওয়ান-ই-হাফিজ, রুবাইয়াৎ-ই-উমর খয়্যাম, শিকওয়াহ ও জবাব-ই-শিকওয়াহ, মহাবাণী, বাইঅতনামা এবং অমিয়বাণী শতক। মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) সভ্যতা (ক্লাইভ বেলের সিভিলাইজেশন) এবং সুখ (রাসেলের কনকোয়েস্ট অফ হ্যাপিনেস) গ্রন্থের অনুবাদ করেন। ড. মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-১৯৮২) অস-সবউল-মু অল্লকাত সম্পাদনা করেন। ড. আহমদ শরীফ সম্পাদনা করেন লায়লী মজনু, তোহফা, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সিকান্দর নামা, আর সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) সফোক্লিসের ইডিপাস নাটক এবং মেরিডিথ ও ওয়াল্ট হুইটম্যানের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ আর সম্পাদনা করেন পদ্মাবতী ও মধুমালতী। মোবাশ্বের আলীর (১৯৩১-২০০৫) অনুবাদ এন্টিগোনি। আবুল কালাম শামসুদ্দীন অনাবাদি জমি নামে ইভান তুর্গেনেভ এর ভার্জিন সয়েল উপন্যাসের অনুবাদ করেন এবং তার ঝর্ণাধারা উপন্যাসটি তুর্গেনিভ এর গল্প অবলম্বনে রচিত। ইউজিন ও নীলের লং জার্নি ইনটু নাইট নাটক অমা রজনীর পথে নামে অনুবাদ করেছেন কবির চৌধুরী। আর্থার মিলারের ডেথ অব আ সেলসম্যান অনুবাদ করেছেন ফতেহ লোহানী। ওয়াইল্ডারের দি স্কিন অফ আওয়ার টিথ নাটকটি যন্ত্রণা চাপ নামে অনুবাদ করেন আসকার ইবনে শাইখ। ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা অনুবাদ করেন শামসুর রাহমান। শওকত ওসমান (১৯১৭-৯৮) অনেকগুলো গ্রন্থ অনুবাদ করেন যার মধ্যে রয়েছে নিশো, লুকনিতশি , বাগদাদের কবি, টাইম মেশিন, পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়), স্পেনের ছোটগল্প , পাঁচটি নাটক (মলিয়ের), ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা, পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ, সন্তানের স্বীকারোক্তি।

গিরিশ কার্নাড ও বিজয় টেন্ডুলকারের নাটক অনূদিত হয়ে ঢাকায় মঞ্চস্থ হয়েছে। আসাদুজ্জামান নূর ব্রেখ্টের দেওয়ান গাজীর কিস্সা ও তারিক আনাম খান মলিয়ঁয়ের-এর কঞ্জুস অনুবাদ করেন। সফোক্লিস, মলিয়ঁরের, হেনরিক ইবসেন, আলবেয়ার কামু, জাঁ পল সার্ত্রে, বানার্ড শ, এরিয়েল ডর্ফম্যান, আন্তন চেখভ, তৌফিল আল হাকিম প্রমুখের নাটক বাংলাদেশের মঞ্চে হয় অনুবাদে, না হয় রূপান্তর করে মঞ্চস্থ হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের শেকস্পিয়র অনুবাদ দেশের মঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছে। এই নাটকগুলোর মধ্যে ক্রয়লাস ও ক্রেসিদা, ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, এবং হ্যামলেট উল্লেখযোগ্য। শেকস্পিয়রের নাটকের মুক্ত অনুবাদ করেন মুনীর চৌধুরী। তার অনূদিত মুখরা রমণী বশীকরণ টেলিভিশনে অভিনীত হয়েছে। শেকস্পিয়রের ওথেলো, করিওলেনাস, মার্চেন্ট অব ভেনিস, এ মিড সামার নাইটস ড্রিম, রোমিও জুলিয়েট, জুলিয়াস সিজার-এর রূপান্তর গণনায়ক বাংলাদেশের মঞ্চে অভিনীত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। খলিকুজ্জামান ইলিয়াস অনুবাদ করেছেন মার্কেজের পেয়ারার সুবাস, সুইফটের গালিভারের ভ্রমণকাহিনী, আকুতাগাওয়া রিউনোসুকের রাসোমন। আব্দুস সেলিম অনুবাদ করেছেন ব্রেক্খটের গ্যালিলিও, হিম্মতি মা, গোলমাথা চোখামাথা, ইবসেনের নাটক লেডি ফ্রম দি সি, হ্যারল্ড পিন্টারের দি বার্থ ডে পার্টি, লুইস ক্যারলের আজব দেশে এলিস। আহমেদ ছফা গ্যাটের ফাউস্ট, হাইকেল হাশমী বাংলাদেশের উর্দু ছোটগল্প, গৌরাঙ্গ হালদার ইরাকি কবি আনোয়ার ঘানির কবিতা, সাগুফতা শারমীন তানিয়া আন্তনিও স্কারমেতোর দ্য পোস্টম্যান, আলম খোরশেদ ভিস্লাভা শিম্বোর্স্কার ত্রিশ কবিতা ও উলফের একটি নিজের কামরা, ফারহানা আজিম নাওয়াল আস-সাদাবির শূন্য বিন্দুতে নারী অনুবাদ করেন। রাজু আলাউদ্দিন ও রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী হোর্সে লুইস বোর্হেসের আত্মজীবনী অনুবাদ করেছেন।
এখানে বলে রাখা ভালো বাংলা সাহিত্যে আমরা যেভাবে বাংলাভাষী হিসাবে দরদ দিয়ে প্রয়োজনের তাগিদে শুধুু বাংলাই আমাদের কাছে প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলা ভাষা ছাড়াও বাংলাদেশে অনেকগুলো ভাষায় অনেক মানুষ কথা বলে যার অন্যতম হলো পাহাড় ও সমতলের বসবাসরত আদিবাসী, দলিত সস্প্রদায় ও চাজনগোষ্ঠীর অনেকগুলো মাতৃভাষা এবং বাংলাদেশের একটি অংশের মাতৃভাষা উর্দু। আমি এই সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, এই ভাষাগুলো সম্পর্কে আমার এই ছোট আলোচনায় কোন আলোচনা করা হয়নি। তবে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি এটুকু বলতে পারি বাংলাদেশের এই সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের সাহিত্য আমাদের সামনে আসা উচিত। সেগুলো যেমন বাংলায় অনুবাদ পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও তাদের ভাষায় অনুবাদ প্রয়োজন।
১২
ইদানীং অনুবাদ নিয়ে সাহিত্যিকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে নানা ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে। এখানে অনুবাদের মান নিয়ে আমি কোন কথা বলবো না। তবে অনুবাদ হচ্ছে এটা একটা বড় কথা এবং এই অনুবাদগুলো প্রকাশের একটি নতুন জানালা হলো প্রচুর অনলাইন লিটল ম্যাগাজিন। পাশাপাশি প্রিন্টেড ভার্সনেও অনেক অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। ফরাসি, আরবি, পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশ ভাষা থেকে অনূদিত হচ্ছে ইংরেজির পাশাপাশি। সম্ভবত এই অনুবাদ হওয়ার অন্যতম কারণ লেখকরা অতি সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানা ধরনের নানা দেশের লেখার সাথে নিজেরা পরিচিত হচ্ছে এবং তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সেগুলিকে অনুবাদ করার চেষ্টা করছে। লক্ষণীয় বিষয় হল অতি সম্প্রতি প্রকাশিত কোন বিখ্যাত বই বাংলা ভাষায় মাসখানেকের ভিতরে অনূদিত হয়ে যাচ্ছে যদিও খুব কম ক্ষেত্রেই লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি নিয়ে তা হচ্ছে। এটি একটি ভাল লক্ষণ। আবার ছোটগল্প, কবিতা, আর্টিকেল যেগুলো ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো নানাজন নানাভাবে অনুবাদ করছেন ফলে অনুবাদের পরিমাণ বাংলা সাহিত্যে অনেক বেড়ে গেছে। সামনে এর গুণগত মানের দিকে নজর দিতে হবে।
এখন সময় এসেছে অনুবাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা। লেখক সত্বের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমিয়া, ডায়াসপোরা কমিউনিটি, মিডিয়া হাউজ, বিভিন্ন অ্যাম্বাসীর পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ যার মাধ্যমে দেশে একটা অনুবাদ সহায়ক পরিবেশ গড়ে উঠবে।

সহায়ক:
▪ Buddhist Mystic Songs : Dr. Muhammad Shahidullah
▪ সরল বাঙ্গালা সাহিত্য : দীনেশচন্দ্র সেন
▪ বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস : সুকুমার সেন
▪ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : মাহবুবুল আলম
▪ বাঙলা, বাঙালী বাঙলাদেশ : আহমেদ শরীফ
▪ বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা (প্রথম খ-) : শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
▪ আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য: মুহম্মদ এনামুল হক ও আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ
▪ বিদ্যাসাগর রচনাবলী
▪ মধুসূদন রচনাবলী
▪ বিদ্যাসাগর : নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণ – দেবোত্তম চক্রবর্তী
▪ মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস : মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ
▪ বাংলা ভাষায মুসলমানদের অবদান : সম্পাদনা শেখ তোফাজ্জল হোসেন
▪ সাহিত্যে অনুবাদ ও রূপান্তরের ভূমিকা : আতাউর রহমান
▪ অনুবাদ সাহিত্য: বৈচিত্র্য ও বৈভব, আদর্শ ও বিতর্ক : আবদুস সেলিম
▪ বাংলা একাডেমি অনুবাদ পত্রিকা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ২০২১)
▪ প্রবাহ ম্যাগাজিন (লালা, আসাম, বর্ষ ৩৩, সংখ্যা ২, অক্টোবর ২০২০)

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.