শেখর হিমাদ্রী’র গল্প: অকৃপণ চাঁদের আলো ও ক’জন অকৃতজ্ঞ

0

খালামনি বরুণকে ডেকে বলল, দিয়াকে ফিরিয়ে আনতে যেতে হবে, সে আছে ছোট চাচার বাসায়। দিয়া খালামনির ছোটমেয়ে, বরুণের চেয়ে তিন বছরের বড় কিন্তু তুই তুকারির সম্পর্ক। কিন্তু একটা সমস্যা আছে। ও যে ২/৩ দিন বাসায় নাই সেটা বাসার অন্য কেউ জানেনা। দিয়া মাকে ম্যানেজ করে ছোট চাচার কথা বলে গেছে। তরুণ বলল – আসলে সে ছোট চাচার ওখানে নাই। মা তা জানত না, এখন জানে।
বরুণরা কয়েকজন তাস নিয়ে বসেছে – ব্রিজ খেলবে বলে। ছুটি ছাটার দিনগুলোতে ওরা তাই করে। সেটা তরুণের ভীষণ অপছন্দ। বরুণরা ব্রিজ খেলার পোকা – যে কোন ছুতায় বসতে পারলেই আর কিছু চাইনা। তরুণ তাসের কোনো খেলায় মন বসাতে পারে না। ৫২টা তাসের অঙ্ক তার মাথায় ঢোকে না। ও এসেই খবর দিয়েছে – ‘মা তোকে ডাকছে’। তরুণ, বরুণের সমবয়সী দিয়ার ভাই। ব্যাপারটা বোধহয় গুরুতর। কারণ, জানাজানি হলে খালামনির কাঁধে সব দোষ যাবে। তিনি খুবই সাদাসিদা মানুষ। সে কারণেই দিয়া সুযোগটা নিয়েছে। দুইদিন পার হওয়ায় তিনি অবস্থার ভয়াবহতা আঁচ করে বরুণের স্মরণাপণœ হয়েছেন। বরুণ সম্পূর্ণ তাঁর পক্ষে গেল। দিয়ার দেখা পেলে সে-ই একহাত নিবে স্থির করল। সুতরাং ব্রিজ খেলা চুলোই গেল। চাচার বাড়ি তো এখানেই, দশ টাকা ভাড়ার পথ। খালামনি তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে একান্তে বলল – ‘দিয়া গেছে তোর মেঝ মামার বাসায়। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়।’ সে তো অনেক দূর, রেলে চেপে যেতে হবে এক ঘন্টা তারপর এক জংশন ষ্টেশনে নেমে আলাদা ট্রেনে ৩০ মিনিট। রেল কোয়ার্টারস। সেখানে রেল কর্মকর্তা-কর্মচারিরা থাকেন। বরুণের দুই মামাও রেলের কর্মচারি, দীর্ঘদিন ওখানে থাকেন তারা, মামাতো ভাই-বোনদের জন্মও ওখানে। ওর খুব প্রিয় জায়গা। মন নেচে উঠল। দিয়ার সাথে ঝগড়া-ঝাটিও করা যাবে – বেড়ানো তো হবেই। খালামনি নিশ্চয় পকেট ভরে দিবেন – থোক্ বরাদ্ধ যাকে বলে – উদ্ধার পাওয়া বলে কথা। তিনি বললেন – ‘তোর মাকে বলে আজই রওনা দে।’ আর কেউ যেন না বোঝে। ‘আচ্ছা’ । তিনি সত্যিই পকেট আশাতিত ভরে দিলেন। আড্ডা ভুলে বন্ধুদের ‘বিশেষ কাজ আছে’ বলে বাড়ি গেল বরুণ, যথাপূর্বক প্রস্তুত হয়ে দুপুরের গাড়ি ছাড়ার আগেই ষ্টেশনে পৌঁছে গেল।

ওর বয়সটাই এমন যে যা কিছু চোখে পড়ে তাই-ই ভাল ঠেকে। ১৮’এর কাছাকাছি তরুণদের তো এমনই হওয়ার কথা। এখন ঘড়িতে ১২টা ১৫মিনিট, ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। অল্পক্ষণ পরই ছেড়ে যাবে। টিকেট কেটে গাড়িতে বসল সে, বিকেল-সন্ধ্যায় আবার দিয়াকে নিয়ে ফিরে আসবে বলে সাথে কোনো ব্যাগেজ নেই সাথে তার। নির্ঝঞ্জাট ভ্রমণ। গাড়িতে ভিড়াভিড়িও নাই। গাড়ি ছাড়ল। দিয়ার কথা ভাবল সে। এমন ফাঁকি কেন দিল সে খালামনিকে। এমনিতে সে খুব আমুদে, সবসময় হৈ চৈ করে, ভাইবোনদের নিয়ে জম-জমাট আসর জমিয়ে ফেলে। তবে তার হাসি পেলেই বিপদ – ওর হাসি দেখে অন্যরাও হাসতে শুরু করে। আর তার নিজের হাসির দমকে সে নিজের গায়ের বল-শক্তি হারিয়ে ফেলে, ফলে হাসি শুরু হলেই সে গড়িয়ে পড়ে, কোথায় আছে সেটা আর মনে থাকে না, বিছানা হতে পারে আবার মেঝেও হতে পারে। মানে হাসি শুরু হলে – স্থান বিবেচনার ক্ষমতা তার লোপ পায়। এই কারণে বড়দের ধমক খেতে হয় তাকে – যদিও হাসি দেখে তারাও হাসে। এই কারণে অনেকের কাছে আবার সে আদরিণীও। ক’জন মানুষই বা আছে জগতে যে এমন করে হাসতে পারে। কিন্তু কেবল হাসিই তো জীবন নয়। হাসির পাশাপাশি আছে কান্না। আছে সুখ-দুঃখ-বেদনা। অর্থ-নিরর্থ, মঙ্গল-অমঙ্গল, নিষ্ঠ-অনিষ্ঠ, শ্লীল-অশ্লীল, দলাদলি-লড়ায়। যুদ্ধ-শান্তি, জোয়ার-ভাটা, চাঁদ-সূর্য, আকাশ-বাতাস নক্ষত্রম-লী – কোনোটা বাদ দিলেই জীবন হয়ত থেমেই যেতো। কিন্তু বরুণের কাছে তা খুব একটা গুরুত্ব পায় না। ‘এতো হাসির কি আছে রে।’ এমন মানুষ হয়ত আরো আছে, কিন্তু বরুণ দেখেছে একজনই। আজ তার সাথে একচোট হয়ে যাবে – খালামনিকে বিপদে ফেললি কেন। আমার উপর আদেশ আছে ভালভালই ফিরতে না চাইলে ধরে নিয়ে যাওয়ার। মিনিট দশেক চলার পর গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল। কিন্তু এখানে দাঁড়ানোর কথা নয়। সামনে একটা নদী, জানা গেল, ব্রিজ মেরামতির কাজ চলছে। যত দ্রুতগামী ট্রেনই হোক না কেন এখানে এসে দাঁড়াতে হচ্ছে – ধীর গতিতে ব্রিজ পার হচ্ছে। তারপরই নদী লাগোয়া ষ্টেশন। তার মানে ২০/২৫মিনিট অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাচ্ছে। বরুণ ট্রেন থেকে নেমে পড়ল, ব্রিজের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে ষ্টেশনে যাবে। নামতেই নদীর ঢালু পাড়ে চোখ গেল। ওপর থেকে নিচে পানি ছুঁই ছুঁই পর্যন্ত শীতকালীন শাক-সবজি, ফল-মূলের বাগান করেছে কোনো বাগানী। পাতার ফাঁকে-ফাঁকে ফলগুলো হঠাৎ হঠাৎই টুকি মারছে যেন। যতদূর চোখ যায়, এই নদীর ঢালু পাড়ে সবুজে সবুজময়। অপ্রসস্ত নদী, এই সময় পানি কমে যাওয়ায় নদীর প্রস্থ আরো কমে গেছে। সে হেঁটে হেঁটে তাজা প্রাণময় সবজি বাগান দেখতে দেখতে নিচে নেমে পানির কাছে এলো। অপ্রসস্ত-অগভীর হলেও নদীতে জল প্রবাহমান, কোথাও কোথাও ছোট বড় পাথর থাকায় হেঁটেই নদী পার হওয়া যাবে।

পাথরের ওপর দিয়ে নদীর মাঝ বরাবর এসে পানিতে হাত ডুবালো সে। এই জলেই সিক্ত হয়ে চারপাশ সবুুজ-প্রাণময়, বিশেষ করে সবজি বাগানটা। আহ্ঃ অনুভব করল মন ভরে উঠেছে – মানুষ বা প্রাণীকে স্পর্শ করলে যেমন রক্তের প্রবাহ অনুভব করা যায় আর মনে হয় আমিও আছি – তেমন। স্পর্শের কী প্রচন্ড সক্ষমতা! ওপারে একটা প্রকা- বটগাছ। সন্ন্যাসীর মতো নীবর হয়ে বসে আছে, আর মনে হচ্ছে, যা দেখছে তাই-ই টুকে রাখছে নিজের খাতায়। কালের সাক্ষী হবে বলে।

হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল সে, ট্রেনটা মিস করা যাবে না। দিয়াকে খালামনির কাছে পৌঁছে দিতে হবে মনে পড়তেই দৌঁড় দিল সে ষ্টেশনের দিকে। কিছুটা দৌঁড়নোর পর স্পষ্ট বুঝল তার দরকার হবে না, উল্টোদিক থেকে আরেকটা ট্রেন ঢুকছে ষ্টেশনে – মানে এখানে ক্রসিং হবে – কিছুটা সময় পাওয়া গেল। জোর কদমে ষ্টেশনে পৌঁছে একটা কামরায় উঠে পড়ল সে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি ছাড়ল।

যথাসময়ে জংশন ষ্টেশনে এসে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে, এই ট্রেনের সঙ্গে তার সম্পর্কের এখানেই সমাপ্তি। এরপর সাটল ট্রেনে উঠতে হবে- তার জন্য আর টিকেট লাগবে না। এখান থেকে বিনে পয়সায় মামাবাড়ি পৌঁছানো যাবে। ঐ ট্রেন স্টাফ অথবা তাদের সন্তানরা ব্যবহার করে। এক কাপ চা প্রয়োজন – পেয়েও গেল – সেটা শেষ করতে না করতেই সাটল ট্রেন প্ল্যাটফরমে ভিরল। দিনে তিন দুগুনে ছয়বার যাতায়াত করে এই ট্রেন, কমপক্ষে । সাটল ট্রেনটা খুব ধীরে চলে আর প্রয়োজন হলেই দাঁড়িয়ে পড়ে। কে কোথায় নামবে তা বোধহয় ড্রাইভারের মুখস্ত। শেষ গন্তব্যে পৌঁছে গেল ট্রেন। চারিধারে কয়লার গন্ধ – এই সাটল ট্রেন এখন পর্যন্ত কয়লার ইঞ্জিনে চলাচল করে।

১০ মিনিটেই মামার বাড়ি পৌঁছে গেল বরুণ। তখন সবাই খেতে বসেছে। ওকে দেখে হৈ হৈ শুরু হল আর হাত-মুখ ধুয়ে তাকেও খেতে বসতে হলো। এরই মধ্যে সবার খবরাখবর জেনে নিল অন্যরা। দিয়ার চোখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠতে দেখল বরুণ – সে কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল। অন্যরা বোধহয় কিছুই বুঝল না। খাওয়া শেষে অনেকে লুডু নিয়ে বসল আর দিয়া বরুণকে একান্তে ডেকে নিয়ে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করলে, বরুণ বলল – এক্ষুণি তৈরি হয়ে তার সাথে ফিরে যেতে হবে। দিয়া বলার চেষ্টা করল – ‘সে তো বলেই এসেছে এখানে’। ‘সে তো জানে তোর মা – অন্যরা!’ ও বলল ‘আচ্ছা’ মানে ফিরবে। সবাই লুডু খেলছে – দিয়া আর বরুণ দর্শক। এমন সময় বরুণের অপরিচিতা দু’জন তরুণী এসে ঢুকল আর সবাই খুশিতে ফেটে পড়ল, তার মধ্যে একজন বরুণের সমবয়সী বা দু/এক বছরের ছোট। বরুণের বুক ধক্ ধক্ করতে লাগল, তার চোখ আটকে গেছে তরুণীর মুখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচয় হয়ে গেল, বড়জনের সঙ্গে আপা আপা বলে আলাপ জমিয়ে নিল বরুণ – তার মুখাবয়ব আর শাড়ী পরার ধরণের মধ্যে এক আশ্চর্য্য ক্ষমতা তার নারীকূলের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরী করার মতো। কিন্তু তরুণীর মতিগতি বোঝা গেল না তার নির্লিপ্ততার জন্য – সে কী সম্পূর্ণ নিশ্চিত তার সৌন্দর্যের ব্যাপারে। মনে হয় প্রশংসা পেয়ে পেয়ে আর আয়না দেখে সেটা সে ভালোই বোঝে। কিন্তু বরুণকে তো অনেক তরুণীই গ্রাহ্যে নেয় – তার অনেক উদাহরণ আছে। সুতরাং ব্যাপাটার শেষ দেখতে হবে – সহজে ছাড়া যাবে না। সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল সে। তাই বড়জন-রিনি আপা যখন নদীর ধারে বেড়াতে যাবার প্রস্তাব করল, বরুণ ভুলে গেল কিছুক্ষণ পরই তার সাটল ট্রেন ছেড়ে যাবে।

রিনি আপার একটা জিনিস বিস্ময়কর – সবাইকে তুই করে বলা। প্রথম দেখাতেই তুই তুই করার মধ্যে বাহাদুরি আছে বটে – ও যেন কত জনমের ছোটভাই, বরুণের খুব ভাল লাগল।
নানা ক্যারিক্যাচার করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বরুণ জেনে নিল তরুণীর নাম – রমা। সুরমা হলে আরো ভালো হত।

সবাই এলো নদীর ধারে। নদী, বড় নদী। গর্জন করছে। তার-ই উপরে আছে বিশাল এক রেলব্রিজ। সৌন্দর্য্যরে আরেক উদাহরণ।
ঢিল ছোঁড়া, বাদাম খাওয়া, গল্পে হৈ চৈ, কারণ-অকারণ হাসি আর আড়চোখে রমাকে দেখা; কিন্তু রমার ভিতরে পৌঁছনো গেল না এখনো। আজ আর ফেরা হচ্ছে না তাদের। খালামনির কাছে কী কৈফিয়ত দিবে তার জন্য মনে মনে বুদ্ধি করা লাগছে। মামী তো আরেকজন অতিথি বাড়ায় রান্না বান্নায় আরো মনযোগী হয়েছেন দেখে এসেছে বরুণ।
নদী তীরে অনেকক্ষণ অতিবাহিত করতে করতে বরুণের চেয়ে ৫/৬ বছরের বড় আরো একজন তরুণ ওদের সঙ্গে যুক্ত হল। বরুণের সাথেও আলাপ জমে উঠল, যখন দেখা গেল রমার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নাই। সেই তরুণের নিমন্ত্রণে রিনি আপা সবাইকে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। সেখানে আরেক প্রস্ত চা-নাস্তা খেয়ে ফিরে এলো মামার বাড়ি। শীতকালীন পিঠা তৈরি হচ্ছে মহাসমারোহে। রাতে ভুরিভোজের পর আবার হৈ চৈ আর লুডু খেলা, ‘ব্রিজ খোলোয়ার’ বরুণের তা ভাল লাগলো না। তবুও সময় পার হয়ে গেল, সেটা নির্ঘাত রমার উপস্থিতি। রিনি আপা ও রমা ছিল বহুক্ষণ। ওদের কোয়ার্টারস পাশেই। ওরা যাবার পরেও অনেকক্ষণ এমনকি ঘুমের ভেতরেও তো রমা থাকলো বরুণের চিন্তায়।
সকালে উঠে অপেক্ষা করতে থাকল কখন আবার দেখা হবে রমার সাথে। তবে তার রিনি আপাকেও দেখার লোভ হচ্ছে। কী যেন আছে রিনি আপার ভেতরে। আপা ডেকে ক্যামন যেন সুখ! এক ফাঁকে বরুণকে দিয়া ইঙ্গিত করেছে রমাকে নিয়ে। ওর ভিতরের ছটফটানি হয়ত চোখে পড়েছে দিয়ার। কিন্তু রমা ছাড়াও অন্য কী একটা চোখে পড়েও পড়ছে না, তা বুঝছে না সে, কি যেন ঘটছে তার চারপাশে। সেটা ধরতে পারছে না বলে একটা অসস্তি কাজ করছে তার ভেতরে। এসব করে করেই বিকাল হয়ে গেল, দিয়া মামীকে বলে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকল আর মন খারাপ হয়ে গেল বরুণের। এই খারাপ মন নিয়েই সাটল ট্রেন ধরার জন্য ষ্টেশনে রওনা দিল বরুণ দিয়াকে নিয়ে মামা-মামী ও ভাই-বোনদের বিদায় জানিয়ে।
কিন্তু ষ্টেশনে পৌঁছে মনটা দারুন নেচে উঠল তার – রিনি আপা আর রমা ছিল সেখানে – আরো ছিল সেই তরুণ বিশু ভাই। কী ব্যাপার রিনি আপা আর রমার কাছেও একটা করে ব্যাগ, ওরাও কী যাবে নাকি তাদের সাথে। হৃৎপি-টা ফেটে পড়ার উপক্রম হল বরুণের। কিন্তু ‘কিন্তু’ আছে। ওরা সাথে গেলে খালামনি বা অন্যরা কি ভাববে! অহেতুক ভাবনা, ওটা দিয়া ভাবুক। তবু এক ফাঁকে দিয়াকে জিজ্ঞেস করল। দিয়া জানালো যে – ‘মা ওদের চেনে আর দেখলে খুশিই হবে, রিনি আপা মা ও অন্যদের সামলাবে, বকুনি খেতে হবে না। এ জন্য তাকে সাথে নিয়েছি, আর রমাকে নিয়েছি তোর জন্য’ – বলেই অদ্ভুত হাসি হাসল। বরুণ চটলো – ‘চোপ্, যত সব বাজে কথা’। ওর সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না আর, শুধু মনে মনে বলল ‘তুই এতো ভাল’!
কিন্তু বিশু ভাই! সেও তো তাদের সাথে যাবে মনে হচ্ছে, ওনার কাছেও ট্র্যাভেলব্যাগ। তাকে সাথে নিলি কেন? আরে, এই বার মনের খচখচানি দূর হল, ও তাই চাচার বাড়ি বলে মামার বাড়ি আসা – সাথে এটাও ভাবল ‘তুমি বাপু এখনও শিশু’। ঘটনাপ্রবাহ বরুণকে বিজ্ঞজনে পরিণত করছে।
এই বয়সটাই যত ঝামেলার। যেটাকে ‘পাখি’ বলেই স্বীকার করতে চায় না মানুষ, সেই কাককেও ভাল লাগছে বরুণের। বড় প্রাচীন কড়ই গাছে কিছু কাক কা কা করছিল। মাটিতেও লাফিয়ে, উড়ে যাচ্ছিল কয়েকটি কাক। মনের ভেতরে কতো সুর যে ভেসে বেড়াচ্ছে তার তলা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে, সেই ধীর গতি। ‘এই ট্রেন – এভাবেই চল্, কোনোদিন থামবি না।’ কিন্তু বরুণের প্রার্থনা বিধাতার কান অবধি পৌঁছল না। জংশন ষ্টেশন এসে গেল। সবাই যে এতো কথা, হাসাহাসি করছে – কিছুই তার কানে ঢুকছে না। বাড়ি পৌঁছে গেলেই তো সব শেষ। কয়েকবার শুধু ভাবল, দিয়া রমাকে ওর সম্পর্কে কিছু বলেছে কিনা! বিশু ভাইকে নিয়েও ভাবল। উপসংহার ঃ যাক সে নিজে মজা করছে, দিয়া করলে ক্ষতি কী?
এইবার আসল ট্রেন – যেটা ওদের বাড়ি পৌঁছে দিবে আর তার খালামনির দেয়া কর্তব্য শেষ হবে। জংশন ষ্টেশন, অনেক প্ল্যাটফরম, অনেক ট্রেন। কোনোটা এসে দাঁড়াচ্ছে, কোনোটা ছেড়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তাদের ট্রেন এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়ালো। ওরা উঠে বসল, হয়ত এক্ষুণি ছেড়ে যাবে। বরুণ একবারও রমার পাশে বসার কথা ভাবেনি, পাশে বসলে তো দেখতেই পাবে না। ওর ভয় ‘সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে’। সবাই কাছাকাছি বসেছে তবু মনে হয় কত দূর।
ট্রেন ছাড়ল, কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকালয় শেষ হয়ে গেল, এই গাড়ি বেশ দ্রুতগামী। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়েছে বেশ আগে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল বরুণ। আকাশে চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎ¯œার আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত। ফসলের মাঠ, জলাশয় আর গাছগাছালির মাথা চাঁদের আলোয় আলোকিত। অদ্ভুত-অপরূপ জ্যোৎ¯œার আলো ধুয়ে দিচ্ছে পৃথিবীকে।
একটা ষ্টেশন এসে গেল আর এরা সবাই উঠে দাঁড়ালো ব্যাগসমেত। কী ব্যাপার? না, ওরা এখানে নামবে। চমকে উঠল বরুণ – এখানে নামব কেন? বাড়ি যাব না? উত্তর দিলেন রিনি আপা – চল না, এখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে কাল সবাই যাব তোদের বাড়িতে। বরুণ বলল, ‘না না, খালামনি ভীষণ রাগ করবে -এমনিতেই একদিন দেরী করে ফেলেছি।’ ট্রেন এখানে বেশীক্ষণ দাঁড়াবে না, রিনি আপা ধমকে তাড়া দিল, দিয়া মুচকি হেসে অসহায়ভাবে মাথা নাড়ালো – ওর কিছু করার নাই এমন ভাব। এরা সব আগে থেকেই কি প্ল্যান করে রেখেছে তা বরুণ বুঝছেও না, জানানোও হচ্ছে না ওকে। রমাও কী হাসছে,আমাকে ভীতু ভাবছে, ভাবল সে। চিন্তা করার সময় ফুরিয়েছে। চাবি দেয়া পুতুলের মতো ওদের পেছন পেছন নেমে এল সে।
নামার পর পরই ট্রেন ছেড়ে দিল আর বরুণ অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল, কারণ দিয়ার দায়িত্ব এখন ত্ার কাঁধে। ষ্টেশন শূন্য হয়ে গেল, এখানে ওরা ছাড়াও জনা দশেক মানুষ নেমেছিল, কিন্তু ষ্টেশনের বাইরে এসে দেখল ওরা দুইটা ছেলে আর তিনটা মেয়ে, অন্যরা নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেছে। বরুণ মেনে নিল ‘কাল বাড়ি ফিরবে’; ভয় দূর হয়ে গেছে তার। ভয়টা আসলে দূর করে দিয়েছে চাঁদের আলো। চারিধার গ্রাম এবং বিদ্যুৎবিহীন কিন্তু সেটা বুঝতে দিচ্ছে না আকাশের ঐ অপরূপ চাঁদের আলো। এমন জ্যোৎ¯œারাত কী কখনও সে দেখেছে; নাহ্ কখনোই দেখেনি। মন ভরে উঠল একটা কথা মনে হতেই – বিধাতা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছে। আরো একটা সম্পূর্ণ রাত পাওয়া গেল, সাথে রমা। এটা ভাবলে বরুণের উপর খুবই অবিচার করা হবে যে, সঙ্গে রমা আছে বলেই তার এতো ভালো লাগছে আকাশের ঐ চাঁদের আলো।
কাঁচা রাস্তা ছেড়ে মেঠোপথ ধরলেন বিশু ভাই নিয়ে চললেন মনে হয় তারই কোনো আত্মীয়ের বাড়ি। কিন্তু জানা না থাকলে এমন রাতে ৪/৫জন মানুষ আচমকা উদয় হলে তাদের অবস্থা কিরূপ বিব্রতকর হবে! চাঁদের আলোয় এমন ভাবনা খুব একটা ঠাঁয় পাচ্ছে না মনে। অজানার প্রতি ক্যামন এক রকম টান তৈরি হচ্ছে।

চাঁদের আলো কিন্তু সত্যিই অসাধারণ। কোনো কিছুই দৃষ্টির অগোচর নয়। হাঁটা পথের রাস্তাটা যেখানে এসে শেষ হয়েছে, দেখা গেল সামনে একটা চতুষ্কোন বিঘা খানেক জমি, পানিতে টলমল করছে। অন্য পথ নাই। বিশু ভাই বলল – পানি হাঁটু সমানও হবে না – জুতা খুলে কাপড় একটু ঘুটিয়ে নিলেই হবে। তারপর শুকনো রাস্তা। কিন্তু এই ঠা-ার মধ্যে! ঘুর পথে গেলে ঘন্টা খানেক দেরি হয়ে যাবে। সুতরাং কষ্টটা করতেই হবে। উপায় নাই। কী আর করা, বরুণ অন্যদের দেখাদেখি জুতা খুলে প্যান্ট গুটাতে লাগলো। প্রথমে পানিতে নামলেন বিশু ভাই – সত্যিই পানি হাঁটুর চার আঙ্গুল নিচ পর্যন্ত। নামল বরুণও, তারপর সবাই। সময় আটটা সাড়ে আটটা হবে। কিন্তু আশেপাশে বাড়িঘর নাই বলে কেমন শুনসান লাগছে। জমি যদি অসমতল না হয় তবে আর সমস্যা কি? রিনি আপা একহাতে চটি আর শাড়ি ধরে অন্যহাতে বরুণকে ধরলো। পেছনে তাকিয়ে বরুণ দেখল দিয়া আর রমাও সালওয়ার গুটিয়ে চটি হাতে পানিতে নেমেছে, কাঁধে ব্যাগ; তবে ঠা-ায় কাতর হলো। রিনি আপা বলল – ‘পানিটা খুব ঠা-া রে, সর্দি-জ¦রে না পড়ি!’ পার হতে দুই মিনিটের বেশীও লাগতে পারে, ব্যালান্স ঠিক রাখার জন্য তাড়াহুড়ো করা যাচ্ছে না। বরুণের একহাত খালি ছিল, সে রিনি আপার সুবিধার জন্য হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাঁর হাতের কনুই এর উপর বাহুটা ধরে রাখল। রিনি আপা এবার দুই হাতই ব্যবহার করতে পারছেন। তিনি বরুণের বুদ্ধির তারিফ করলেন। রমা দশ হাত পিছনে। আমরা কতো কাছাকাছি, এই ভাবনায় সে পুলকিত হলো কিন্তু তখনও সে জানতো না এই দূরত্বটাই অনেক। ওর উচিৎ ছিল দিয়ার কাছে থাকা। চাঁদের আলো জমিনের উপর ঢেলে দিয়েছে অবারিত ¯েœহ, পানি শুধু শরীর ধুয়ে দিতে পারে, জ্যোৎ¯œা মনটাও ধুয়ে মুছে পরিছন্ন করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, এখানে কোনো দলাদলি নাই, লাঠিয়াল বাহিনী নাই, কোনো ধর্ষক নাই, ছিনতাকারী নাই, নাই কোনো নিপীড়িতজন, সবাই পবিত্র। একে অপরের পরম আত্মীয়। পিছনে দিয়ার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে বরুণ, রমা অনুচ্চ স্বরে বললেও শোনা যায়। দিয়া আমার ভাল ভাল গুণের কথা বল্ না ওকে, বিশ^াস কর কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে আর ফিরেও তাকাবো না – আমার মনের কথা কী শুনতে পাচ্ছিস না – তুই না আমার বোন।

রিনি আপার বাহু ধরে হাঁটছে সে – অন্য পাশে বিশু ভাই – কথা বলছে তারা কিন্তু কোনো কিছু কানে যাচ্ছে না তার, সমস্ত মনযোগ পিছনে। হঠাৎই উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠলো দিয়া।

দিয়া হাসছে, এই হাঁটু পানিতে! মহা সর্বোনাশ! আতঙ্কিত হলো বরুণ। ও তো এক্ষুণই পানির ভেতর হাবুডুবু খাবে! ও তো এখন জ্ঞানহীন। অন্যরাও নিশ্চয় জানে দিয়ার হাসির ব্যাপারটা। কিন্তু সর্বাধিক দায়িত্ব তারই, পিছনে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করলো সে, কিন্তু পানিতে কী দৌঁড়নো যায়! প্রতিবার পা সম্পূর্ণ বের করে করে স্টেপ দিতে হচ্ছে, ফলে সময় লাগছে ৪গুণ, পৌঁছানো গেল না, রমাও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে দিয়াকে ধরতে। কারণ সেও হাসছে। দিয়ার এখন শুধু মু-টা দেখা যাচ্ছে, বাকিটা পানির তলায়। দিয়ার কাছে পৌঁছে হাত ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো বরুণ। তখনও হেসে চলেছে সে। তার উলেন কার্ডিগ্যানটার ওজন বেড়ে হয়েছে ৫গুণ। এই অবস্থা দেখে হাসতে লাগল রিনি আপাও। বিশু আর বরুণ গম্ভীর। কার কথায় হেসেছিল দিয়া, নিজের না রমার?
শুকনো জায়গায় উঠে এলো ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে দিয়ার হাসি থেমে শুরু হলো কাঁপুনি। গা থেকে কার্ডিগ্যান খুলে পানি নিগড়ে নেয়া হলেও সেটা গায়ে দেয়ার অযোগ্য। সাথে থাকা ব্যাগটাও পানি খেয়ে ঢোল। সুতরাং হাতাতে হলো রমা আর রিনি আপার ব্যাগ। কিন্তু লাভ হলো না কারণ এখানে তো চেঞ্জ সম্ভব না, তাই অপেক্ষা করতে হলো সেই বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত। দ্রুত কদমেও চল্লিশ মিনিট মতো লাগলো সেখানে পৌঁছাতে, ততক্ষণ কাঁপতে থাকলো দিয়া, কারো সহানুভূতি কাজে এলো না তার। বরুণ ধমকে বলেছিল – এটা একটা কাজ করলি, হাসির আর সময় পেলি না! অন্যরা তাকে থামিয়ে দিল।

হাঁক ডাকে এ বাড়ির নারী-পুরুষ সবাই ঘুম থেকে উঠলো। অবস্থা দেখে কোনটা আগে আর কোনটা পরে করবে ভেবে হিমসিম খেলো তারা। আগুন জে¦লে দিয়াকে রক্ত জমাট বাঁধার হাত থেকে রক্ষা করার আগে তাকে আরেকবার পুকুরে সাবান-শ্যাম্পুসহ চুবানো হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য। পুকুর পাড়ে খড়ের আগুন জ¦ালানো হলো, তার উপর শুকনো ডালপালা দিতেই আগুন দাউ দাউ জ¦লে উঠল। বাড়ির ভেতরেও আগুন জ¦লল কিন্তু সেটা রান্নার জন্য, বাড়ির মহিলারা মাটির হাড়িতে টুক বুক করে ভাত ফুটাচ্ছে। একজন প্রৌঢ়কে দেখা গেল বড় সড় একটা মোরগ জবাই দিতে। অসাধারণ আয়োজন শুরু হয়েছে। দিয়া কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে, ঘন্টা খানেক পর আবার তার মুখে হাসি দেখা গেল তবে সেটা বোকা বোকা, এখন সে আগুনে কাপড় শুকাচ্ছে। বরুণ মনে মনে বলল – বোকা! এই চাঁদের আলোয় মনটাকেও ধুয়ে নে।

অনেক সময় পেরিয়েছে, রাত প্রায় ১১টা। মাংসের যে ঘ্রাণ ছুটেছে, পাশের বাড়ির মানুষের ঘুম না ভাঙ্গে। রিনি আপা বসেছিল মাটির বারান্দায়, পাশে বসা সাদা চুলে ঝুটি বাঁধা-লম্বা দাড়ির সেই প্রৌঢ় মানুষটা বলছে – ‘আমি মস্তান মানুষ, আমার সময় আর অসময় কি, তোরা আসলি আমার ভালো লাগছে।’ হাতের হুক্কা থেকে লম্বা এক দম দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন তিনি। বরুণ রিনি আপার পাশে গা ঘেষে বসল। বিশু ভাই একবার বাইরে আগুনের কাছে আবার ভিতরে প্রৌঢ়ের কাছে করে অস্থির সময় কাটাতে লাগলেন। একটু পর গরম গরম ভাত আর ঝাল ঝাল মাংস খেতে কেমন লাগবে ভাবলো বরুণ। ধোঁয়া ছেড়ে প্রৌঢ় আবার বললেন – ‘সবই মায়া রে মা, সবাই আমি আমি করে।’ মনে হলো মানুষটার হাতে একটা একতারা ধরিয়ে দিলেই গেয়ে উঠবেন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়।’

রিনি আপা বরুণকে বললেন – ‘তুই আমার কাছে বসে কেন। যা না, রমার সাথে একটু গল্প টল্প কর।’ এতো ভাল লাগলো যে তার রিনি আপার বুকে মাথা রাখতে ইচ্ছা করলো, সেটা পারলো না বলে তাঁর পিঠে মুখ ঘষতে লাগলো, তার মায়ের গায়েও এমন গন্ধ। তিনি হাত ঘুরিয়ে বরুণকে স্পর্শ করে বললেন – ‘আচ্ছা, থাক – তুই আমার কাছেই থাক।’

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.