ভ্রমণগদ্য: সাগরদাঁড়িতে একদিন। ফয়সাল আহমেদ

0

ভ্রমণগদ্য

সাগরদাঁড়িতে একদিন
ফয়সাল আহমেদ

“দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!”

মাইকেল মধুসূধনের জন্ম ১৮২৪ সালে এবং মৃত্যু ১৮৭৩ সালে। সংক্ষিপ্ত অথচ বর্নাঢ্য, অসাধারণ সৃষ্টিশীল অথচ সকরুণ জীবন যাপন শেষে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে অকাল মৃত্যুবরণ করেন এই যুগস্রষ্টা কবি। কবির সমাধি কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের মল্লিক বাজার মোড়ের খ্রিস্টান কবরস্থানে তাঁরই রচিত এফিটাফে উপরের কথাগুলো লিখিত রয়েছে।
বাংলা কাব্য সাহিত্যে চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটের জনক হিসাবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। রামায়ণের একটি উপাখ্যান অবলম্বনে প্রথম সার্থক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের স্রষ্টা হিসেবেও মাইকেল মধুসুদন দত্ত চিরস্মরণীয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ও তাঁর সাহিত্যের মতোই বিস্ময়কর। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র মাইকেল মধুসূধন দত্ত কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু কলেজে(বর্তমান প্রেসিডেন্সি) পড়াশুনা করেন। এক সময়কার হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা ডিরোজিও’র চিন্তা ও কর্মের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তিনি। মধুসূধন দত্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন রাজনারায়ণ বসু, গৌরচন্দ্র বসাক, ভূদেব মূখোপাধ্যায়, প্যারীচরণ সরকার সহ আরো অনেকে। খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে মধুসূধনের পিতা তাকে ত্যাজপুত্র করেছিলেন। তাঁর বেহিসেবী খরচ এবং নিয়মিত অর্থ সংস্থান না হওয়ার ফলে বরাবরই তিনি আর্থিকভাবে অভাব অনটনে থাকতেন। কখনো কখনো চরম দূর্দশনার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রথম স্ত্রী রেবেকা’র সাথে ছাড়াছাড়ির পর দ্বিতীয় স্ত্রী হ্যানরিয়েটা বহু দুঃখ-কষ্ট ও আর্থিক দৈনতার পরও মাইকেলের সাথে আমৃত্যু ছিলেন। মাইকেল মধুসূধন দত্তের মতো প্রতিভা চিনতে পেরে অর্থ ও নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে সবসময় পাশে ছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তি। উনিশ শতকের নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলী এবং বাঙলার রেনেসাঁ প্রচেষ্টার নানা ঘটনাবলী নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারণ একটি উপন্যাস সেই সময়। এই উপন্যাসটি আমাদেরকে সত্যি সত্যি দুই শত বছরের আগে ও পরের সময়ের এক আশ্চর্য বাস্তব ও কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। এই উপন্যাসে মাইকেল মধুসূধন গুরুত্বের সাথে এসেছেন। কিংবা গোলাম মুরশিদের লেখা ‘আশার ছলনে ভুলি’ পড়তে পড়তে আশ্চর্য এক প্রতিভা মধুসূধনকে আবিষ্কার করি। এসব গ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয় ব্যক্তিগতভাবে বহুদিন থেকে এই অসাধারণ কবির জন্মভিটায় যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।
অপেক্ষার অবসান হয় কয়েক বছর পূর্বে। আমি ও সিলেটের বন্ধু সোহেল মাইকেল মধুসুধনের বাড়ি যশোর থেকে ৪৫ কি.মি. দূরে কেশবপুরে উপজেলার সাগরদাড়ি ভ্রমণ করি। বাঙলা সাহিত্যের এই মহান স্রষ্টার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ও তাঁর প্রিয় গ্রাম সাগরদাড়িতে কীভাবে যে পুরো একটি দিন কাটাই আমরা টেরও পাইনি। যশোরের বন্ধু ফারুক পূর্বেই একটি এনজিও’র গেস্ট হাউজে আমাদের থাকা ও খাওয়ার চমৎকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। বিকেলটা যশোর শহরের খানিকটা ঘুরেফিরে দেখি। ফারুকের সাথে দীর্ঘ আড্ডা হয়।
সকালে আমরা রওয়ানা হয়ে যাই কেশবপুর উপজেলার সাগরদাড়ির উদ্দেশ্যে। কেশবপুর পর্যন্ত বাসে ভ্রমণ। যাওয়ার পথে কলেজের বন্ধু মুকুলের কথা মনে পড়ে। তার বাড়ি কেশবপুরে এবং শুনেছি সাগরদাড়ি থেকে কাছেই কোনো এক গ্রামে। অনেকবার পরিকল্পনা করেও মুকুলসহ আসা সম্ভব হয়নি। কেশবপুর থেকে আমরা একটা অটোরিক্সা নিয়ে পৌঁছে যাই সাগড়দাড়িতে। বেশ বড়োসড়ো একটি জমিদার বাড়ি। মাইকেলের পিতা ছিলেন কলকতার স্বনামধন্য উকিল রাজনারায়ণ দত্ত। মাইকেল মধুসূদনের বাড়িটি তিনটি চত্বরে বিভক্ত। মাঝের ও পূবের চত্বরের দালানগুলো দ্বিতল বিশিষ্ট। পশ্চিম চত্বরের দালানগুলো একতলা। মাঝের চত্বরে রয়েছে একটি বড়ো পুজোমন্ডপ। পুজোমন্ডপের পেছনে একটি কক্ষে যা বর্তমানে অবলুপ্ত, জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী প্রতিভা। সাগরদাড়িতে মধুসূদনের বাড়িতে একটি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার রয়েছে। প্রতিবছর ২৫ জানুয়ারী মধুসুধনের জন্মদিনে সাগরদাড়িতে আয়োজন করা হয় মধুমেলা। দেশ-বিদেশ থেকে কবির ভক্তবৃন্দ এই মেলায় যোগদান করেন। এখানে এসে দেখতে পাই মধুসূদনের বাড়ির পাশেই রয়েছে রাত্রিযাপনের জন্য ডাকবাংলো, পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেল ও প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিশ্রামাগার।
মধুসূধন দত্তের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল হয়েছে। মধুসূধন দত্ত রামনারায়ণ রচিত ‘রত্মাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। এটি অনুবাদ করতে গিয়ে তাঁর মনে হয় বাংলা নাট্য সাহিত্যে মানসম্পন্ন নাটকের অভাব রয়েছে। এই অভাববোধ থেকেই তিনি নাটক লিখতে উৎসাহী হন এবং ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। এরপর তিনি ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে দুটি প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ রচনা করেন। লিখলেন সার্থক আরেকটি নাটক ‘পদ্মাবতী’। এই ‘পদ্মাবতী’ নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। এরপর একে একে অসাধারণ সব সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। তারপর তিনি যে মহাকাব্যের তিনি বাঙলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন সেই বিখ্যাত মেঘনাদ বধ কাব্য (১৮৬১) রচনা করেন। আরো লেখেন মহাকাব্য ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১), কৃষ্ণকুমারী নাটক (১৮৬১), বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)। মেঘনাধবধ কাব্যে মাইকেল মধুসূধন দেবতা রামকে নয়, মনুষ্যরূপী করে নায়ক করেন রাবণকে। এটি বাঙলা সাহিত্যের এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই দুঃসাহসী সৃষ্টিকর্মের জন্য বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূধনের সাহিত্যিক তাৎপর্য অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ।
ফেরার পথে মধুসুধনের বাড়ি সংলগ্ন বাজারটিতে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই। একটি ঔষধের দোকানের সামনের ডেস্কে দেখি সাজিয়ে রাখা আছে মাইকেলের ছোটো ছোটো কবিতা ও সংক্ষিপ্ত জীবনী গ্রন্থ। দোকানীর সাথে কথা বলে জানতে পারি তিনিও কবি। মাইকেলকে নিয়েই তাঁর কবিতা আছে, আছে গান। বাজারে আরেকটি স্থানে শুনতে পাই গান হচ্ছে। আয়োজকরা আমাদের বেশ খাতির যত্মের সাথে বসান। আপ্যায়ন করান। শিল্পী একে একে গান গেয়ে শোনান। বেশ লাগে সাগরদাড়ির এমন পরিবেশ দেখে! একজন বড়ো প্রতিভার সৃষ্টির সংস্পর্শে এসে, এই মাটির সাধারণ মানুষও যে অসাধারণ হয়ে উঠে এটি যেনো তারই নিদর্শন। আমরা আবার আসবো কথা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। ফিরে আসার সময় দীর্ঘক্ষণ কপোতাক্ষের তীরে দাঁড়িয়ে থাকি দু’জন। স্মরণ করি কবির বঙ্গভাষা কবিতার মর্মস্পর্শী চরণগুলো:

“হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে-
ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে ॥”

এই কবিতায় মাইকেলের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হাহাকার, তীব্র বেদনা এবং আবারো মাতৃ-ভাষা-রূপে ‘খনি’তে ফিরে আসার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। আমরা নিরবে কিছুক্ষণ বসে থাকি কপোতাক্ষের তীরে। নদীর দুই পাড়েই চোখে পড়ে গাছপালা ঘেরা সবুজ শ্যামলিমা আর শান্ত পরিবেশ। বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভার জন্ম ও বেড়ে উঠার স্মৃতিধন্য প্রকৃতি আমাদের সারাক্ষণ মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে রাখে। আমরা ফিরতি পথ ধরি কপোতাক্ষের পাড় ধরেই। “সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে” বলে কবি বিরলে আরো কতো কথাই ভেবেছিলেন তাঁর প্রিয় নদীকে ঘিরে। আমরাও কবির কথা এই বিরলে ভাবতে ভাবতে, সাগরদাড়িকে এবারকার মতো মতো বিদায় জানিয়ে যশোর শহরের পথ ধরি।

 

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.