দুটি অণুগল্প। রুখসানা কাজল

0

প্রথম নারীত্ব

আমাদের নোনা ধরা দেওয়ালের যেখানে সেখানে বটের চারা নয়নতারা গাছের জংগল। ঠিক দুপুরে ডেভিড এসে ঢিল মারে। ঝুল বারান্দা থেকে কৃষ্ণচূড়ার ডাল বেয়ে নেমে পড়ি দেওয়ালে। কাঁধে করে নামিয়ে নেয় ডেভিড। তারপরেই ছুট ছুট। নদী পেরিয়ে ওপার। চোখ ধাঁধানো কাঁশবন, প্রান্ত ছোঁয়া আকাশ, হা হা নীরব নির্জনতায়।
আজকাল ঘর থেকে বেরুলেই বকা শুনি। বড় হচ্ছি নাকি।
তা ঠিক। এখন আর যখন তখন জামা খুলে নদীতে ঝাঁপাতে পারি না। বহতা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে শুকিয়ে নিতে পারিনা ভেজা টপস। সেদিন ডেভিডও বল্ল জামাটা খুলিসনা ইয়ার। কেমন যেন ইল্লি ইল্লি লাগে।
তাই বলে ঘুরতে বেরুব না? দুপুরটা যখন বিকেলের সাথে গল্প শুরু করে আমি পাগল হয়ে যাই।
কাশফুলের মুকুট পরে ঘুরছি আমরা। মাথার উপর হলুদ আকাশ। গলে গলে পড়ছে বাতাস। ডেভিডের মুখে চিকন ঘামের মিল্কশেক বাবল্‌স। ঝমঝম করে ভেসে আসে এক নদী ভৈরবী। ডেভিডকে চমকে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার ঠোঁটে অন্য ভাষা, স্পর্শ আকুল বুক। এই প্রথম বুঝে যাই নারী হচ্ছি আমি।

আলোপুত্র

সাদা রোদ্দুরে ডুবে গেছে রাস্তা। ঝলসে যাচ্ছে আমাদের চোখ মুখ। হাঁসফাঁস করছি তীব্র গরমে। হাত পাখার বাতাসও তপ্ত হয়ে উঠেছে। মহাবৃক্ষ অশত্থের ছায়ায় বসে পড়েছি। এরমধ্যে দেখি রোদজ্বলা রাস্তা পেরিয়ে হেঁটে আসছে নারীপুরুষসহ অনেক মানুষ। ধূলি-ধূসরিত নগ্ন পা। চলছে ত চলছেই। ধুলোবালির সাথে রোদ্দুর মেখে চকচক করছে কাঁচা রাস্তা। প্রমিত আবেগে হেঁটে আসছে মানুষ। যেন অদৃশ্য হাতছানিতে কেউ ওদের ডেকেছে, বড় একা লাগছে রে। ওরে তোরা আয় আয়।
ছুটে গেলাম।
কপালে তিলক। কাঁধে বোঁচকা এক যুবককে থামিয়ে বলি, এই রোদ্দুরে কোথায় যাচ্ছ?
তিলক কপালে হাত ছুঁইয়ে আকাশ দেখায় সে, তিনি যে ডেকেছেন গো।
রক্তরাঙা আকাশ। কে তিনি! কোন থানে একা বসে আছেন আকুল প্রাণে! ডেকে নিচ্ছেন প্রিয়জনদের!
যুবকের কানের নিচে ঘামের ঝর্ণাধারা। দুই লহরীর তুলসিমালা ভিজে জবজবে।আগুন হয়ে ফুটছে বাতাস। পানির বোতল তুলে দিই। সরল হাসিতে হাত বাড়িয়ে দেয়। অমৃত জলরাশি ঝরার মূহূর্তমাত্র! চমকে কেড়ে নিই, আমি যে মুসলিম। পাপ হবে তোমার।
রোদপোড়া চরাচরে হেসে উঠে যুবক, কিসের পাপ গো! তুমি যে জলদাত্রী। মেঘমায়া। জলের আবার জাত কিগো দিদি!
আগুনলাল দুপুরে আর্দ্র হয়ে যাই। সহস্র নদীউপনদী বয়ে যায় শরীরে। যেন আমিই গঙ্গাগঙ্গোত্রী, ফল্গুসম যমুনা, সরস্বতী, পদ্মা দুহিতা গেরুয়াজল পুস্পিতা চঞ্চলা মধুমতি! আমিই ত সুজাতা! নিরঞ্জনা নদীতীরে বুদ্ধের অন্নদাত্রী পরাণবন্ধুয়া?
তালি আসি গো দিদি!
রোদ্দুরপুত্রের হাতে তুলে দিই পানির বোতল, এসো তবে আলোপুত্র!
থমকে যায় সে। দীঘল পায়ের আঙ্গুল। তাতে জমে আছে কালোমাটির অমিতশক্তি। ঘোরবর্ষায় এই আঙ্গুলে কাদামাটি কামড়ে পথ হাঁটে ওরা। গোলপাতার ছাউনি আর হোগলাকাছনির বেড়ার ঘরে গলা খুলে গায় বর্ষাগীত। ঈশ্বর তখন নেমে আসে। ওদের পাশে বসে গলা মেলায়। মন্দিরামঞ্জিরে নেচে ওঠে ইশ্বরের ধমনীরক্ত।
ঝরাপাতা সুরে ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে, আলোপুত্র! সে ভাগ্যি কি আমারে দেছে তোমার ঠাকুর? আমি যে ধূলিস্য ধূলো পথহারা।
স্পষ্ট শুনলাম যুবকের চরণস্পর্শ পেয়ে ঘাসেরা পদাবলী গাইছে,
“কি খেনে হইল দেখা নয়ানে নয়ানে, অগাধ সলিলে মীন মরে যে পিয়াসে—”

পাঠপ্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
Share.

Comments are closed.